বিপ্লব, যুদ্ধ এবং শৈশব (তৃতীয় পর্ব)
“বালক হিসেবে আপনি যখন যুদ্ধে যাবেন তখন আপনার মধ্যে অমরত্বের মোহ কাজ করবে। অন্যরা নিহত হবে; কিন্তু আপনি নন…” – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
স্বাধিকার বা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিই যুদ্ধ। এটা পৃথিবীর আদিমতম চরম সত্যগুলোর একটি। যুদ্ধের রকমফের যাই হোক না কেন, কোন দেশ বা জাতিই এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। ন্যুনতম নিজেদের অধিকার অর্জনের জন্য অথবা আপনার ওপরে চেপে বসা অন্য কাউকে প্রতিহত করবার জন্য যুদ্ধে আপনাকে নামতেই হবে। এর ব্যতিক্রম কখনোই হয়না/হয়নি!
১৯৭১ সনে আমার বয়স ৭ বছর। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ ঐ বয়সের স্মৃতি সঠিকভাবে অবিকৃতভাবে ধারন করতে পারে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও আমি নিশ্চিত যে আমার স্মৃতিশক্তি আমাকে সেই অদ্ভুত সময়ের ভেতরে নিয়ে যেতে সক্ষম! কারন ঐ সময়ের অনভিজ্ঞ বয়সের অভিজ্ঞতাগুলো যখন আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে আমি তখন সেগুলোকে পূর্ণ অবয়ব দিতে না পারলেও সেগুলো যে আমার অবাস্তব কল্পনা ছিলনা তা আমি পরিস্কার বুঝতে পারি। ৭১’র ৫ মার্চ তারিখেই চট্রগ্রামে পাকনাদার বাহিনির গুলিতে শহীদ হন দুই শতাধিক মুক্তিকামি জনতা; টঙ্গিতে এবং যশোরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কয়েকজন। এগুলো তো তখন সবার মুখে মুখে ভাসছে! ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক ভেঙ্গে তিন শতাধিক কয়েদি বের হয়ে চলে যায় শহীদ মিনারে এবং মুক্তিকামি জনতার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ফটক ভাঙ্গার সময় কারারক্ষীদের গুলিতে নিহত হয় কয়েকজন। আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ পরের দিন সকালে আমি রেডিওতে শুনেছি এবং দৈনিক পত্রিকাতে রেসকোর্সের ময়দানের সেই বিশাল জনারন্যের ছবি দেখেছি। এত বড় বিশাল জনস্রোত পূর্ব বা পরের কোন স্মৃতিতে আমার নাই!
১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের কাল রাত্রির কথা আমি শুনেছি। সবার মুখ থেকে আমি শুনেছি কিভাবে নির্বিচারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং ঢাকার নিরস্ত্র জনগনের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে অযুত প্রানহানি করেছিল!আমি জেনেছি সে কাল রাতের আঁধারেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করে নিয়ে অজ্ঞাত কোন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিন পর্যন্ত তিনি জীবিত আছেন, নাকি তাকে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে গুজবের অন্ত ছিলনা। মার্চের শেষের দিকে মেজর জিয়া নামের একজন বাঙালি সেনা অফিসার চট্টগ্রামের কোন রেডিও ষ্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন! জীবনে এই প্রথম আমি একজন বাঙালী সামরিক অফিসারের নাম শুনেছিলাম। আমাদের পরম চাওয়া মুক্তির পথের বৈকুণ্ঠ যাত্রায় এ সবই ছিল আমাদের প্রাথমিক নির্মাল্য এবং অহঙ্কার!
আমাদের বাড়ি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায়! আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল পশ্চিম দিয়ে যমুনা নদী বয়ে গেছে। যমুনার একটা শাখা পশ্চিম থেকে পুবে প্রবাহিত হয়ে আমাদের বাড়ি থেকে এক মাইল দূর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে । মে অথবা জুন অথবা তারও পরে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এলাকায় এলো। আমার আব্বার স্কুলের (আমার আব্বা ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন) টিনের ঘরে ওরা ক্যাম্প করল! স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের ছোট ভাই যে ঐ স্কুলেরই সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সেও এসেছে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে। হাতে স্টেনগান! স্টেনগানের গায়ে অসংখ্য ছিদ্র। আমি ভাবতাম এই সবগুলো ছিদ্র দিয়েই গুলি বের হবে ( অবশ্য অনেক পরে সেনাবাহিনিতে এসে বুঝতে পেরেছি যে ছিদ্রগুলো মুলত অস্ত্রের এয়ার কুলিং এর জন্য ব্যবহৃত হয়!) এবং একসাথে অনেক গুলি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির সদস্যদের বুক ঝাঁঝরা করে দেবে।আমি বিরক্ত হয়েছিলাম আমাদের নিকটাত্মীয় কেউ মুক্তিযুদ্ধে যায়নি বলে!
আমাদের থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো ক্যাম্প ছিল! দুই কোম্পানি। একটা ছিল আমাদের বাড়ির কাছে। অন্যটা মাদারগঞ্জ থানার পাশে আমার নানাবাড়ির সন্নিকটে। হয়ত থানার দুই পাশের পশ্চিম এবং উত্তরের দুটো ফ্ল্যাঙ্ক এর ওপর যমুনা নদীর ওপার থেকে আসা শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আমাদের বাড়ির কাছের যমুনার শাখা নদীর তীর ঘেঁষে এপারে অসংখ্য রাইফেল এবং এলএমজি ট্রেঞ্চ খনন করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা! লম্বা সারিতে দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত এই ট্রেঞ্চগুলোকে পাকিস্তানী হানাদারদের ভবিষ্যৎ কবর বলে মনে হত আমার। আমার আরেক চাচা যিনি আব্বার স্কুলের ফিজিক্যাল টিচার – তিনি একদিন আমাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের বাড়ির ভেতরের উঠোনের মাঝখানে বিরাট একটা এল এম জি ট্রেঞ্চ খুঁড়লেন। আমরা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, “ পাকিস্তানিরা যদি আক্রমন করে তবে আমরা সবাই এই ট্রেঞ্চে ঢুকব এবং মারা গেলে সবাই একসাথে মারা যাবো”। আমি তখন ভীষণ উত্তেজিত এক বালক! মৃত্যু চিন্তা আমাকে ভীত করেনা! আমি গাছের ডাল কেটে টিক্কা খানের একটা মডেল বানিয়েছি আর বানিয়েছি একটা খেলনা রাইফেল। টিক্কা খানের মডেলটাকে সামনে রেখে আমি সারাক্ষন মুখ দিয়ে গুলির শব্দ করে দিনে সহস্র বার আমি টিক্কা খানকে কল্পনায় হত্যা করি। এই সময়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমাদের এক আত্মীয় পরিবার এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিল। ঐ পরিবারের এক ছেলে আমার চেয়ে বড় এবং ভীষণ স্মার্ট। আমাকে টিক্কা খানকে খেলনা রাইফেল দিয়ে গুলি করতে দেখে দাবি করে বসলো ঢাকা থেকে আসার আগে সে টিক্কা খানকে আসল বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে এসেছে। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল! আমি এতদিন ধরে ভেবে আসছিলাম অদূর কোনো ভবিষ্যতে টিক্কা খানকে আমিই মারবো !
কিছুদিন পর বর্গী দস্যুদের সাজে পাকিস্তানীরা সত্যি সত্যিই এলো এবং মেলান্দহ বাজার থেকে মাহমুদ পুর পর্যন্ত সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা যমুনা নদীর শাখার (ঝাড়কাটা নদী নামে পরিচিত) এপার থেকে দেখলাম দাউ দাউ করে পুড়ছে বাড়িঘর। যমুনার কারনে ওরা আমাদের এলাকায় আসতে পারেনি। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধারাও এপারের নদীর পারের ট্রেঞ্চগুলোতে প্রবল প্রতিরোধ অবস্থান গ্রহন করেছিল এবং গুলি ছুড়েছিল! এর কিছুদিন পর একদিন রাতের অন্ধকারে মাহমুদ পুর এবং মেলান্দহ বাজারের মধ্যবর্তী পাকা ‘পয়লা ব্রিজ’টাকে মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লসিভ মেরে গুড়িয়ে দিল, যাতে ওরা মাহমুদ পুরেও আর আসতে না পারে। এই অপারেশনের সময়ে আমার দাদীর এক ভাতিজা যে যুদ্ধে গিয়েছিল সে মারা পরল! সবাই বলাবলি করতে লাগল যে সে বোকামির কারনে রাতের অন্ধকারে নিজের দলের সামনে দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে! কাজেই তাকে নিয়ে কাউকে আর বেশি দুঃখ করতে দেখলাম না। শুধুমাত্র আমার দাদীকে দেখেছি সন্ধ্যের আগে আগে বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড়ের পাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে সুর করে তার জন্য কাঁদতে।
পাকিস্তানীরা আমাদের থানায় ঢুকতে পারেনি ! তবে মাহমুদ পুর পর্যন্ত আসার কারনে আমাদের ভেতরে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো । আমার আম্মা তার সকল কাঁসার বাসন-কসন প্যাক করে পানির কলসির নীচে যে মাটির প্লাটফর্ম থাকে সেটাকে উপড়িয়ে নীচে গর্ত করে আবার আগের মতন করে রেখে দিলেন! যাতে যুদ্ধ শেষে আমরা যদি কোনদিন নিজ বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করি, তখন যেন আমাদের এই মূল্যবান জিনিসগুলো আমরা যাতে ফেরত পাই!
সেপ্টেম্বর অক্টোবরের দিকে আমাদের বাড়ির কাচারি ঘরে এসে আশ্রয় নিলেন এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। কোন যুদ্ধে তার পায়ের উরুতে গুলি লেগেছে। হাঁটতে পারেন না । আমার দায়িত্ব হল সকাল, দুপুর, রাতে তার জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া।এভাবেই তার সাথে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠলো। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর চলে গিয়েছিলেন! যুদ্ধ শেষ হবার পর আজ অবধি তার সাথে আমার বা আমাদের পরিচিত কারোর কোনোদিন দেখা হয়নি। দায়িত্ব শেষ করার পর মুক্তিযোদ্ধারা সবার অলক্ষ্যে এভাবেই একদিন হারিয়ে যান !
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
আমার বয়স তখন ছয়।
তবুও যা যা দেখেছি, মনে করতে পারি।
এর প্রধান কারন হলো এই যে আমি এত ছোট ছিলাম না যে কারো কোলে বা কাধে উঠতে পারি, আবাত এত বড় ছিলাম না, যে নিজেই নিজের দেখ ভাল করতে পারি।
তারপরেও প্রতিটা মুহুর্ত নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা, আমাকে অন্যদের মতই বড় বানিয়ে দিয়েছিল.....
তাছাড়া, খাওয়ার কষ্ট, ঘুমানোর কষ্ট, জীবনযাপনের কষ্ট - এসব তো ছিলই..... (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আসাদ ভাই,
অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। ঘটনার পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা আরেকটু বিস্তারিত হলে আরও ভালো লাগত। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সমাজ ইতিহাস নিয়ে অতি সাধারণ বিষয়গুলো জানা সেসময়কার ইতিহাস জানার জন্য সবথেকে বেশি জরুরী, যার খানিকটা আপনার ধারায় লেখার মধ্যে খানিকটা পাওয়া যায়।
আপনার বর্ণনায় পরিচিত কিছু এলাকার কথা এই সিরিজ পড়ার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার চাচা ছিলেন সুখচর স্কুলের শিক্ষক, এখন আমার চাচাতো ভাই সেখানকার শিক্ষক। ছোটবেলায় ভাইয়ের সাথে ঝাড়কাটা নদীতে গিয়েছি কয়েকবার।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx