সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়!
দ্বিতীয় পর্বঃ লাক্কা বীচ (Lakka Beach)
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। মজার অথচ বিষাদময় একটা ঘটনা ঘটেছে। ঠিক সমুদ্র থেকে মাত্র কয়েক শ’ গজ দুরেই আমাদের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর। আমাদের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর থেকে একটা প্রকাণ্ড পাথরের মাঠ পেরিয়ে ‘মিলটন মারগাই কলেজ অফ এডুকেশন এন্ড টেকনোলজি’ অতিক্রম করার পর ঘন নলখাগড়ার বনের ভেতরের ৫০/১০০ গজ পথ পেরুলেই গডরিচ বীচ।অথচ দলবদ্ধভাবে ইউনিটের তত্ত্বাবধানে ছাড়া আমাদের কারুরই এখানে আসার অধিকার নেই। কারন অনেকদূরে রিভার-২ বীচ অথবা লুমলে বীচে নিকট অতীতে কোন বাংলাদেশী সেনাসদস্য কর্তৃক অসমানুপাতিক আচরন!
জাতিসংঘ মিশনে সেনাসদস্যদের খুব কাজের ভেতরে ডুবে থাকতে হয়, এমন দাবী স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি (Special Representative of the Secretary-General) অথবা ফোর্স কমান্ডারও করতে পারবেন বলে আমি মনে করিনা। তবে তাদেরকে যুধ্যমান/বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মত পার্থক্য/সংঘর্ষ দূরীভূত করতে সারাক্ষন হিমশিম খেতে হয় এবং সর্বক্ষণ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয় এটা খুবই ঠিক।
সাইদুল স্যার, আমি আর শাহরিয়ারের অবস্থান ইউনিটের কমান্ড চ্যানেলে অনেক নীচের দিকে। তিন জনেই তিন কোম্পানির ‘কোম্পানি অফিসার’।আমাদেরকে দিয়ে কাজ করালে কোম্পানি কমান্ডারগণ নিজেরাই কাজের অভাবে আত্ম-অসন্তুষ্টিতে ভুগবেন! কাজেই আমাদের কোন কাজ নেই। সমুদ্রযাত্রা যেহেতু আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ সেহেতু আমরা সারাদিনমান ইউনিটের পাশ দিয়ে রিভার-২ বীচের দিকে প্রবাহিত লাল মাটির রাস্তার ওপরে কুয়াশার মতন জমে থাকা ধূলার মধ্য দিয়ে সরল পথে গমনাগমন করে থাকি। রাস্তার দুপাশে কিছুদূর পর পর মড়কে মরে যাওয়া গরুর মতন পুড়িয়ে দেয়া অসংখ্য গাড়ি পরে আছে। এরাই সদ্য থিতিয়ে যাওয়া যুদ্ধ চিহ্নের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই পথ ধরেই বিদ্রোহীরা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র লাইবেরিয়া থেকে জনপদ, যানবাহন এবং প্রকৃতি ধ্বংস করতে করতে ফ্রি-টাউনের দিকে এগিয়ে এসেছিলো। প্রায়শই আমরা তিনজন রাস্তা ছেড়ে পুব দিকের পাহাড় আর বনের ভেতরে ঢুকে পরি। গাছপালা, লতাগুল্ম তথা উদ্ভিদ জগতের প্রতি সাইদুল স্যারের প্রবল আকর্ষণ। তিনি বনের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে চার্লস ডারউইনের মতন নতুন নতুন উদ্ভিদের প্রজাতির বিবর্তন অনুসন্ধান করেন। শাহরিয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাদের দু’জন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমাদেরকে অনুসরন করা এবং বন্য পশুপাখি এমনকি শত্রু বা মিত্র দ্বারাও আমরা আক্রান্ত হলে দূর থেকেই পালিয়ে যেয়ে আমাদের ইউনিট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা, যাতে তারা আমাদেরকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পারেন অথবা বিসর্জন দেবার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেন! আর আমি অকারনেই ঘুরাফেরা করি অনেকটা বিরস মনে! কারন আমার মন পরে আছে আটলান্টিকের বেলাভূমিতে।
কয়েকদিন বনের ভেতরে ঘোরাফেরায় ক্লান্ত হয়ে ‘পাকিস্তানের মিলিটারি পুলিশ কোম্পানি’র পাশদিয়ে চলে যাওয়া মুল রাস্তার পশ্চিম দিকে একটা উঁচুনিচু মাটির রাস্তা আবিস্কার করলাম আমরা। এই রাস্তাটা সমুদ্রের বেলাভূমি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাহাড়, গ্রাম এবং অরন্যের মধ্য দিয়ে দক্ষিন দিকে চলে গেছে। এই পথ দিয়ে যাবার সময়ে সমুদ্র খুব কাছ থেকেই আপনার সাথে লুকোচুরি খেলবে, কিন্তু কেউই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারবেনা যে আপনি সমুদ্রের বেলাভূমির ওপর দিয়ে হাঁটছেন! সাইদুল স্যারকে নিয়ে আমি আর শাহরিয়ার এখন এই পথেই ভ্রমন করি এবং দইয়ের স্বাদ ঘোল দিয়ে মিটাই।
এক দিন দুপুরের আগে আগে আমি আর সাইদুল স্যার এই পথের শেষে একটা কর্দমাক্ত জলাভূমির মতন জায়গা অতিক্রম করে একটু হাঁটতেই আমাদের চোখের সামনে সমুদ্র তার অপার সৌন্দর্য আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরল। এটা অন্য একটা বেলাভূমি যার বালির রঙ সোনালী! দূর থেকে ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের বালিতে ভরে যাওয়া তিতাসের পাড়ের মতন চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোতে চিকচিক করছে।আমদের থেকে আর একটু সামনেই বেলাভুমি থেকে সরু আঙুলের মতন একটা বালি-পাথরের রাস্তা সরীসৃপের জিভের মতন প্রসারিত হয়ে সমুদ্রের ভেতরে প্রবেশ করে পাথরের ভূমিখণ্ডে যেয়ে শেষ হয়েছে। এর ওপরেই কয়েকটা ঘর নিয়ে অনেকটা জাহাজের মতন করে বানানো হয়েছে বাড়ীটা। গৃহযুদ্ধ বা আছড়ে পরা বানিজ্যবায়ুর ঢেউ কিছুই এর স্থায়িত্ব বা সৌন্দর্যকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। বাড়ীটার নাম ‘লাক্কা বীচ রিসোর্ট’ এবং এর থেকে দক্ষিন দিকে সাপের মতন প্রসারিত ও সরু হয়ে দিগন্তের আড়ালে চলে যাওয়া বেলাভূমির নাম ‘লাক্কা বীচ’ ! বাংলাদেশ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন-২ এর কোন সদস্যই এখন পর্যন্ত দূর থেকেও এই বেলাভূমি দেখেনি। রিসোর্টের পশ্চিম ও দক্ষিন দিকটা পাথরের ওপর দিয়ে সমুদ্রের ভেতরে অনেকখানিই চলে গেছে। এই পাথরের ঝুল ধরে বা লাফ দিয়ে আপনি এক পাথর থেকে অন্য পাথরে চলাচল করতে পারেন। এখন ভাটির সময়। দুই পাথর খণ্ডের মধ্যবর্তী খোলা জায়গার ভেতর দিয়ে নীচে তাকালেই দেখা যায় কালচে নীল জমাট জলরাশি। জলের নীচ দিয়ে চলাফেরা করছে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতন কোন বড় মাছের ছায়া শরীর। মাঝে মধ্যেই সাদা জলের ঢেউ পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমাদের দুজনকেই আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে। একটু দুরেই পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে সামুদ্রিক মাছ ধরার বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে রিসোর্টের কেউ একজন। সাইদুল স্যার সাগর থেকে ধরা মাছ দিয়ে আমাদের দুজনের জন্যেই লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন।
বিকেলের দিকে জোয়ারের পানিতে বেলাভূমি আর রিসোর্টের সংযোগস্থলের অংশটা ক্রমশ জলের নীচে তলিয়ে গেলো। আমরা পার হবার সময়েই দেখি জল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। বেলাভূমিতে কিছুক্ষন হাঁটার পর আমি সাইদুল স্যারকে প্রস্তাব দিলাম সমুদ্রের জলে স্নান করার। সাইদুল স্যার বললেন, “আজ আমি নামবো না, তুমি নামো। আমি দেখছি”। আমি শুনেছি হাঙরেরা দিনের বেলায় বেলাভূমির কাছে আসেনা। যদি কোন কারনে আসেও অনেকদূর থেকেই জলের নীচে ওদের ছায়া শরীর দেখা যায়। আর ওপরে তো সাইদুল স্যার আছেনই। যারা আমাদেরকে বেলাভূমিতে আসতে নিষেধ করেছেন, তাদের কেউ এসে পড়লেও সাইদুল স্যার আমাকে যথাসময়ে সতর্ক করতে পারবেন! চমৎকার জল। আমি মহানন্দে পানিতে নেমে গেলাম।
কয়েকদিন পর সিয়েরালিওনে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট সমুহকে নিয়ে সংগঠিত সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে এই বেলাভূমি পরিভ্রমনে ব্যান সিগ-২ এর অধিনায়ক কর্নেল আসিফ এবং এই ইউনিটের সকল অফিসারবৃন্দ লাক্কা বীচে এসেছিলাম আমাদের আবিষ্কৃত পথ অনুসরন করে। গাইড যথারীতি সাইদুল স্যার আর আমি!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
রোমাঞ্চকর গল্পের আড়ালে বুঝি হারিয়েই যেতে বসেছে বিপদ সংকুল মিশন সংকটের সম্ভাব্য আবশ্যক চেহারা।
সুখপাঠ্য লেখায় ঘুরে এলাম সেই জায়গা আর সময়গুলোও যেনো।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে। যুদ্ধের বা সংকটের চেহারা কখনই উৎরে যাবার নয়। মনে হয় এভাবেই আস্তে আস্তে সেখানেও ঢুকে যেতে পারি আমরা যে কোন সময়ে !
এটা দেখি আবিষ্কারের গল্পে পরিনত হয়েছে।
😀 😀 😀 😀 😀 😀
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
সাইদুল স্যার সাগর থেকে ধরা মাছ দিয়ে আমাদের দুজনের জন্যেই লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন। -- এই না হলে সিনিয়র!
গাইড যথারীতি সাইদুল স্যার আর আমি -- 🙂
বীচের কিছু ছবি দেখতে পেলে আরো ভালো লাগতো।