সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়!
লুমলে বীচ (LUMLEY BEACH)
‘সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নক্ষত্রের তলে বসে আছি’!ঠিক তাই। এই মুহূর্তে আমার মন পড়ে আছে আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী পশ্চিম আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ সিয়েরালিওনের রাজধানী ‘ফ্রি টাউন’ সন্নিকটবর্তী ‘লুমলে’ , ‘গডরিচ’, ‘লাক্কা’ এবং ‘রিভার২’ নামক বিস্মৃত বেলাভূমিগুলোতে । আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তৃত সৈকতরেখা জুড়ে এই বেলাভূমিগুলো সমুজ্জ্বল কণ্ঠহারের মতন জ্বলজ্বল করছে আদিকাল থেকে। পৃথিবীর কোন দুঃখ, দুর্দশা, মারামারি –হানাহানি কখনোই এদেরকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি, বরং যুদ্ধের সময়ে এরা তাদের আদি অকৃত্তিম রুপ ফিরে পেয়েছে! সেনাবাহিনীর চাকুরীর একটা অসাধারন বৈশিষ্ট্য হল এই চাকুরী আপনাকে এমন সব জায়গায় এমন সময়ে নিয়ে যাবে যা আপনি অন্য কোন চাকুরিতে কস্মিনকালেও চিন্তা করতে পারবেন না। স্বপ্নেও না! শুধু পর্যটকদের দৃষ্টি দিয়ে আপনি এই জায়গাগুলো দেখে ও অনুভব করে নিজভূমে প্রত্যাবর্তনের পর এগুলোর ওপরে পরবর্তীতে মনোজ্ঞ ভ্রমন কাহিনী লিখবেন, এটাও সম্ভব নয়। কারন আপনাকে এখানে থাকতে হবে ন্যুনতম এক বছর বা তারও অধিকাল, যা প্রকারান্তরে আপনাকে এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাতেই পরিনত করে দিয়ে নন্দন তত্ত্বের পৃথিবী থেকে আপনাকে নামিয়ে আনবে ঘোর এক বাস্তব পৃথিবীতে যেখানে রয়েছে প্রতিনিয়ত রোগব্যাধি, জরা, প্রতিকুল আবহাওয়া এবং অজ্ঞাত শত্রুদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার প্রানান্তকর প্রয়াস। এক সময়ে আপনার এটাও মনে হতে পারে যে আপনি এই বৈরি/প্রতিকূল প্রতিবেশেরই একজন হয়ে গেছেন বা আগে থেকেই ছিলেন এবং আপনার কাছে আপনার কর্তৃক ইতিপূর্বে যাপিত নিস্তরঙ্গ আনন্দিত জীবন আর ভালো লাগছেনা!
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ব্যানসিগ-২ (বাংলাদেশ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন-২) দুই এর অগ্রগামী দলের সদস্য হিশেবে আমরা কয়েকজন আটলান্টিকের ওপারের ‘লুঙ্গি বিমান বন্দর’ হতে রাশিয়ান হেলিকপ্টারে করে ১৫ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত ফ্রি টাউনের ‘এবারডিন’ হেলিপ্যাডে অবতরন করেছি। আকাশ থেকে অবতরনের অব্যবহিত পরেই বুঝতে পারলাম দুর্ভোগ আমার আর সাইদুল স্যারের পিছু নিয়েছে। কারন লুঙ্গি বিমান বন্দরে আমাদের চার্টার প্লেন হতে আমাদের লাগেজ নামানোই হয়নি। নিজস্ব ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া ব্যাটালিয়নের অপারেশনাল এবং নন-অপারেশনাল লাগেজগুলোর মধ্য হতে এগুলোকে পৃথক করে আমাদের নিকটে পৌছাতে আগামীকাল বিকেল নাগাদ লেগে যেতে পারে। আমার দেখা মানুষদের ভেতরে সৈয়দ কামরুজ্জামান স্যার ‘বাই ডিফল্ট’ একজন ভাগ্যবান মানুষ। কোন এক অজানা সৈনিক তাকে ভালবেসে তার লাগেজ প্লেন থেকে নামিয়ে হেলিকপ্টারে তুলে দিয়েছে। আজ বিকেলে আমাকে আর সাইদুল স্যারকে জামান স্যারের জামাকাপড় পরেই রাত্রিযাপন করতে হবে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে জামান স্যারের শার্ট এবং পায়জামা দুটোই যথাক্রমে আমার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের দেড় থেকে দুইগুণ।
অধিনায়ক ব্যানসিগ-১, কর্নেল সিদ্দিক হেলিপ্যাডে আমাদেরকে রিসিভ করতে এসেছেন। লুঙ্গি’তে এসেই শুনেছি তিনি ‘ফ্রি টাউন’ থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরে ‘গডরিচ’ নামক মরুক্রান্ত পাথুরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা মরূদ্যান গড়ে তুলেছেন। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব তা আমি শোনামাত্র সাথে সাথেই বিশ্বাস করে নিয়েছি, কারন তিনি ঢাকা সেনানিবাসে ১১ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নে অধিনায়ক থাকাকালে প্রকৃতির প্রতি তাঁর নিখাদ ভালবাসার নির্যাস দিয়ে ইউনিট এলাকাকে নান্দনিক বোটানিক্যাল বা বলদা গার্ডেনে পরিনত করেছিলেন। নির্জন দুপুরে এখানে ঘু ঘু পাখির ডাক শোনা যেতো এবং সন্ধ্যের পর এখানে আসলে গা ছমছম করতো।প্রচণ্ড রকমের বাৎসল্যপরায়ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি তাকে ভয় পাই, কারন আমার জানামতে তার এই বাৎসল্য প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র তার ইউনিটের কনিষ্ঠ অফিসারদের জন্যই প্রযোজ্য হয়ে থাকে। সাইদুল স্যার তিনি ইউনিটে উপ অধিনায়ক থাকাবস্থায় কনিষ্ঠতম অফিসার ছিলেন। জীপে করে গডরিচে গমনের সময়ে তিনি মূলতঃ সাইদুল স্যারের সাথেই কথা বলছেন এবং কৌতুক করছেন। অজানা কোন কারনে কর্নেল আসিফ যিনি ব্যানসিগ-২ এর অধিনায়ক তিনিও আমার মতই তাকে সমীহ করে চুপচাপ আছেন!
হেলিপ্যাড থেকে বের হবার পরই লুমলে বীচ রোডের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লুমলে বীচ। সাদা অথবা সোনালী বালুকনা দিয়ে তৈরি এই সৈকত বিকেলের আলোতে মনোহারী এক রুপ ধারন করেছে। আমি আর একাকীবোধ করছিনা। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আগামী এক বছর প্রতিদিন এই সৈকতে আসব, মনের আনন্দে এর নরম বালিতে হেঁটে বেড়াবো, সাঁতার কাটবো এবং ছোটবেলায় পুকুরের পানির ওপরে হালকাভাবে স্পর্শ করে ঢিল বা পাথরকে ব্যাঙের মতন লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটানোর কৌশলকে এই সৈকতের জলে পুনরায় নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবো!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
অনেক ক’টা দিন আসা হয়নি। আর একটু হলে হয়তো মিসই হয়ে যেতো। গোগ্রাসে পড়া হলো।
অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের।
অনেক ধন্যবাদ
সিয়েরা লিওন যে এতো সুন্দর জানা ছিল না। মনে হচ্ছে একবার যেতেই হবে।
আসাদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ ঝরঝরে বর্ণনায় সিয়েরা লিওনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অনেক ধন্যবাদ
আসাদ ভাই, শুরুটা দারুণ হল।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
দেরীতে হলেও শুরু তো করলাম...
এখন এগুই দেখি পরের পর্বের দিকে... (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ভালো লাগলো। কয়েকটা ছবি পেলে আরো বেশী ভালো লাগতো।
কর্নেল সিদ্দিক প্রকৃতই একজন বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ। আমাদের এলাকা বারিধারা ডিওএইচএস তার হাতের ছোঁয়ায় ছায়াশীতল বৃক্ষরাজি দ্বারা পরিপূর্ণ।