“আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”
এটা একটা দুজন অসম বয়সী নারীর সত্য গল্প। দুজনের ভেতরে প্রবল পার্থক্য। একজনের বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। অন্য জনের বয়স মাত্র ১৫। দুজনেই অসম্পুর্না। একজনের স্বামী মারা গেছে ২০ বছর আগে। ৫০ বছর আগে তিনি এসেছিলেন তার জন্মস্থান উজানের ‘চিলমারী’ থেকে এই ভাঁটির দেশে। অন্য জনের জন্ম ভাঁটির দেশেই । জন্মলগ্ন থেকেই তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তার ছোট ভাই বোনগুলো তার চোখের সামনে তর তর করে বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার বয়সটা থেমে আছে দশ এর কোঠায়। কথাও বলতে পারেন না তিনি। অথচ এই দুজনে যখন সকালের মৃদু আলোয় উঠোনে পিড়ি নিয়ে বসে শীত পোহান বা নিঃশব্দ আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন তা এক অপরুপ দৃশ্যের অবতারনা সৃষ্টি করে। আমি এই দুই অসম্পুর্না নারীর যূথবদ্ধতা দেখতে দেখতেই বড় হয়ে উঠছিলাম। আমার চোখের সামনেই তারা হয়ে উঠেছিলেন পরস্পরের পরিপূরক নিবিড় একক সত্ত্বা!
বর্ষীয়সী নারীটি আমার দাদার সৎ মা। আমার দাদার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা উত্তরাঞ্চলের ‘চিলমারী’ বন্দরের সন্নিকটবর্তি অন্য এক নদী ভাঙ্গনের এলাকা থেকে তাকে বিয়ে করে এনেছিলেন। বাড়ির সকলেই তাকে ডাকতো ‘উজান গাঙের মাইয়া’! বিয়ের পর থেকে তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি আর কখনই তার জন্মের স্থানে ফিরে যাননি বলে আমার ধারনা । কারন আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে আমি কখনই ঐ দূরবর্তী অঞ্চলের লোকজনের সাথে আমাদের এলাকার মানুষের সামান্যতম যোগাযোগ হতে দেখিনি। এটাই এই এলাকা গুলোর মানুষের নিয়তি। একবার নদী ভাঙনের পর যখন তারা নতুন জেগে ওঠা চরে বসতি স্থাপন করে, তখন তাদের পূর্বের এমন কি পূর্ব জন্মের স্মৃতিও অবশিষ্ট থাকে না। আমার দাদার এই মাকে আমরা ডাকি জেঠী বলে। তিনি আমাদের বাড়ী থেকেও কোথাও কোনদিন যাননি। সত্তুরের দশকে শুকনো মওসুমে আমাদের এলাকার একমাত্র বাহন গরুর গাড়ি আর বর্ষাকালে নৌকা। আমরা যখন গরুর গাড়িতে করে সপরিবারে নানা বাড়িতে বেড়াতে যেতাম অথবা রেডিওতে বাজত “হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে”, আমি খেয়াল করতাম তার চোখ দুটো ক্রমশই অশ্রু সজল হয়ে উঠত। তবে তাকে আমরা কখনই আমাদের কাছে বা কারো কাছে তার মায়ের বাড়ির গল্প করতে শুনিনি।
আমাদের জেঠীর ছিল এক সন্তান। নাম আলতাফুর রহমান। আমার আব্বার বয়সী। আলতাফুর রহমানকে জন্ম দেবার পরেই তার স্বামী পরলোক গমন করেন। বিয়ের পর থেকেই তার নিঃসঙ্গ জীবন। কাজেই তার ছেলের বিয়ের পর ছেলের ঘরে যখন নতুন শিশুর জন্ম হল, তখন আলতাফুর রহমান বা তার স্ত্রীর চেয়ে আমাদের জেঠীরই আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সবারই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল যখন তারা সবাই খেয়াল করল যে, নবাগত মেয়ে শিশুটির একটা পা সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরে আছে। কোন ধরনের তাবিজ কবজেই সেই মেয়ের পা আর সোজা করা গেলনা। মেয়েটার নাম নাম রাখা হল বেদেনা, যা ডালিম ফলের আরেক নাম। ডালিম ফলের ভেতরের রক্ত লাল কোয়াগুলো তার ভবিষ্যৎ জীবনের বেদনাকেই প্রতিবিম্বিত করবে! কিছুদিন পর সবাই সবিস্ময়ে আবার খেয়াল করলো যে মেয়েটার মুখে সারাক্ষন মৃদু হাসি লেগে থাকলেও সে কোন কথা বলছেনা। একে তো মেয়ে তার ওপর খোঁড়া আর বোবা । ফলে অনাদর আর অবহেলার মধ্যে শুরু হল বেদেনার জীবন। নিজের মা’ পর্যন্ত তাকে কোলে নেয়না বা বুকের দুধ দেয় না ঠিকমতো। মেয়েটার ভার নিলেন তার দাদী অর্থাৎ আমাদের সেই জেঠী। হয়তোবা সবার অলক্ষ্যেই দুটো জীবন এক সুত্রে গ্রথিত হয়ে গেলো!
আমি বড় হতে হতে দেখেছি যে, বেদেনার আমাদের প্রতি খুব টান। আমরা ভাই বোনরা তার চেয়ে এক জেনারেশন নীচের। বেদেনার বয়স আমার চেয়ে দুই তিন বছর কম হবে। সম্পর্কে সে আমার ফুপু হলেও আমি তাকে নাম ধরেই ডাকি। কারন সে বড় হচ্ছেনা। এর মধ্যে তার আরও দুই বোন এবং এক ভাই জন্ম নিয়েছে এবং স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠছে। সবাই স্কুলে যায়। বেদেনা এতেই ভীষণ খুশি। যদিও সে কথা বলতে পারেনা , তবুও তার সারাক্ষন হাসি আর মুখ ভঙ্গী থেকে বোঝা যায় যে সে ভীষণ খুশি। ১৯৭৭ সন। আমি ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যাচ্ছি। এলাকার সব লোকজনই জানে। জানেনা শুধু বেদেনা আর তার দাদী। পুরো সংসারে এই দুইজন এতোটাই অপ্রয়োজনীয় যে তাদেরকে কেউ জানানোর প্রয়োজনই বোধ করেনি। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করার আগে আমি ভাবলাম জেঠীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। এসময়েই হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেঠী আর বেদেনা আমাদের ঘরে ঢুকল। বেদেনার হাতে একটা বাংগি ফল। কেটে চিনি দিয়ে নিয়ে এসেছে। জেঠি একটা পিরিচে করে বাংগিটা আমাকে খেতে দিতেই দেখি বেদেনা মৃদু হাসছে! অন্য সবার মতন সেও ভীষণ খুশি। আমাদের বাড়ির উঠোনেই বেদেনা আর তার দাদী মিলে একটা ফলের বাগান করেছে। তাতে কামরাঙ্গা, ডালিম, বাংগি সবই ধরেছে। বাড়ির শিশুরা কেউ ফল বাগানে ঢুকতে গেলেই বেদেনা গোঙানির মতন চিৎকার করে ওঠে। ফলে শিশুরা কেউই সেই বাগানের কাছে ভিড়তে সাহস পায়না।
আমি ক্লাস টেনে পড়ি। টার্ম এন্ডের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। আলতাফুর দাদাদের ঘরের পেছনে প্রকাণ্ড আম কাঁঠালের গাছের নীচে আমাদের বংশের গোরস্থানে দুইটা নতুন কবর। শুনলাম আমাদের জেঠী মারা গেছেন। জেঠী মারা যাবার মাত্র সাত দিন পর মরে গেছে বেদেনাও!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
জানি, তাদের এই একসাথে চলে যাওয়াটা হয়তো কাকতালই তবুও ভাবতে ইচ্ছা হয়, এর পিছনে হয়তোবা কোন যোগসুত্রই আছে......
বিচিত্র মানব মন।
বিচিত্র তার আকাঙ্ক্ষা......
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। 🙁
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
লেখাটা ভালো লাগলো। কিন্তু মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো, না দেখা দু'জন মানুষের জন্য।
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বার বার
🙁
জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
কিছুলেখা পড়লে মনটা একেবারে কাদা হয়ে যায়.....এটিতার ব্যতিরেক নয়!!!!!
যথারীতি সুন্দর,ভাই!!!
তানভীর আহমেদ
সবার সহমর্মী মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ
এমন লেখা যা পড়লে মন ভারী হয়ে যায়, চোখ ভিজে আসে। সংসার থেকে কিছুই না পাওয়া এই মানুষ গুলো কেমন নীরবে অলক্ষ্যে চলে যায়, তাদের কথা হয়তো কেই মনেও করে না।
🙁
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
যথারীতি সুন্দর লেখা।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
ধন্যবাদ
সবাই চলে যায়......
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
পছন্দের অংকুর
বুকে মেঘ গুড় গুড়
ক্রমশ পত্রপল্লবে
বাঁধে গ্রন্থি সুর
সম্পর্কগুলো এভাবেই চেতনার আড়ালে বানায় সম্পর্ক-সেতু গ্রন্থি লতিয়ে বাড়বার মাচা।
শুধু মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য প্রেমে তাতে সাময়িক নামে ভাটা। জীবন কখনো তেমন কারো জন্যে নেহায়েত দিনযাপনের খাঁচা।
অসংখ্য ধনয়বাদ অসাধারন মন্তব্যের জন্যে !