ভূমিকম্প এবং ‘থিয়োরি অফ এবসারডিটি’!

ভূমিকম্প এবং ‘থিয়োরি অফ এবসারডিটি’!

অতি সম্প্রতি আমি আমার অফিসে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকার সুযোগ নিয়ে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা আলোয় আলবেয়ার কাম্যুর ‘আগন্তুক’ (The Stranger) নামের একটা বিখ্যাত উপন্যাস পড়েছি, সম্ভবত যে উপন্যাসের জন্যে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। উপন্যাসটির মূল থিম ‘থিয়োরি অফ এবসারডিটি’ (Theory of Absurdity) কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে যার মোদ্দা কথা আমি যতটুকু বুঝেছি তা হল যে, মানুষ মাত্রেই যৌক্তিক (Rational) চিন্তা বা আচরন করতে অক্ষম; সমাজ বা ধর্ম সার্বক্ষনিকভাবে আমাদের ওপরে এই যৌক্তিক (Rational) চিন্তা বা আচরন আরোপ করার চেষ্টা করলেও এগুলোও এক সময়ে নিজেরাই অযৌক্তিক আচরনকারীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকে!

আজ সকাল পাঁচটা পাঁচ মিনিটে বুদ্ধিলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমার স্মরনকালের সবচেয়ে ঝাঁকুনি সৃষ্টিকারী ভুমিকম্প প্রবল একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলে আমাকে পুনরায় আমাকে একটা জাগ্রত ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ভেতরে নিক্ষেপ করল! একটা ছয়তলা বাড়ীর চতুর্থ তলায় আমাদের বসবাস।এখান থেকে নীচে নামার অনেক আগেই ভুমিকম্প শেষ হয়ে যাবে। তারপরেও স্ত্রীকে পাশ থেকে জাগিয়ে তুললাম।ঘুম থেকে জাগার কারনে প্রথমে কিছুটা হতবুদ্ধি হলেও পরবর্তী মুহূর্তেই চারপাশের পৃথিবীকে নড়েচড়ে বসতে দেখে ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে সে বিছানার বাইরে নেমে এলো। একটু দূরের কক্ষে আমার দুই মেয়ে ঘুমোচ্ছে। আমরা দুজনেই দ্রুত সেই কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখলাম তারা কম্বল মুড়ি দিয়ে মশারীর নীচে শুয়ে আছে!আমাদের দুজনের পায়ের শব্দ শুনে ওরা দুজনেই তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে নেমে এলো। পৃথিবীর কম্পন ইতিমধ্যেই থেমে গেছে!

তারপরেও দ্রুত জামাকাপড় বদলে নিয়ে আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে এলাম। এই বাসায় রাত আঁটটার পরেই বিদ্যুৎ খরচ কমানোর জন্যে লিফট বন্ধ করে দেয়া হয়। লিফট চালু থাকলেও এই বিপর্যয়ের সময়ে সেটা ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত হতোনা। নীচের গ্রাউনড ফ্লোরে মেয়েদের এবং বাসার সামনের রাস্তায় অফিস বা বাসার ছেলেদের ভিড়। ভয়ে সবাই নীচে নেমে এসেছে। প্রাথমিক ভুমিকম্পের হাত থেকে স্বয়ং স্রস্টা ছাড়া কেউই আমাদেরকে রক্ষা করতে পারতোনা। তবুও আমরা সবাই নীচে নেমে এসেছি যদি ভূমিকম্পের পরের কোন ঢেউ থেকে নিজেদেরকে আমরা রক্ষা করতে পারি। গত দীর্ঘ কয়েকমাস এই বাসায় অবস্থানকালে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে এতগুলো মানুষ আমরা এই বাড়ীতে বসবাস করি এবং আজ সকালের অভিনব পোষাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের আমরা কেউ কখনই পরস্পরকে দেখিনি!আমি নিজেই লুঙ্গির ওপরে খালি গায়ে একটা উইন্টার জ্যাকেট পরে আছি! নামার সময়েই বুদ্ধি করে আমি শার্টের বদলে জ্যাকেটটা পরে নিয়েছিলাম। কারন ভুমিকম্পের তীব্রতা তাৎক্ষণিকভাবে কমে গেলেও শীতের তীব্রতা যে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হবার আগে শেষ হবেনা তা আমার যৌক্তিক (Rational) স্বত্বা নিজ থেকেই বুঝতে পেরেছিল। সুবহে সাদেকের মৃদু আলোতে আমাদের সকলের পরিচ্ছদ পরস্পরের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর অধিক সময় ভুমিকম্পের পরবর্তী ঢেউয়ের জন্য বাসার নীচে অপেক্ষা করা যৌক্তিক এবং শোভনীয় হবেনা ভেবে আমরা সবাই নিজেদের ঘরে প্রত্যাবর্তন করি।

আমাদের ছোট মেয়ে রাইয়া এতক্ষন চুপচাপ ছিল। বাসায় ফিরতেই তার উত্তেজনা বেড়ে গেল। সে চিৎকার করে ভূমিকম্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে লাগলো- কিভাবে টেবিলের ওপর থেকে চাবির রিং সশব্দে মেঝেতে পরে যাওয়ায় তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, কীরকম থরথর করে খাট, টেবিল এমনকি মশারিও নড়ছিল, কিভাবে তার শেখা তিনটে দোয়া’র ভেতরে সে দুটোই ভুলে গিয়েছিল, সেগুলোর বর্ণনা! ক্রিকেটের কমেন্টরির মতন অনবরত কথা বলে যাচ্ছে সে।

তার মা তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “তুমি জেগে গিয়ে থাকলে হৃদিকে নিয়ে আমাদের রুমে না এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলে কেন?”
– “আমি তো ভেবেছিলাম এই মুহূর্তেই আমাদের ঘরের ছাদ বা দেয়াল ভেঙ্গে পরবে। আমি ছোট মানুষ; আমি কি সবাইকে সেইভ করতে পারবো নাকি? তাই আমি শুধু হৃদি আপুকে নিয়ে কম্বলের নীচে চলে গিয়েছিলাম”। তার ভাবখানা এই যে, কম্বলের নীচে কোন বিপদই তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবেনা!

ইতিমধ্যেই বাসায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। রাইয়াকে নিয়ে একটু পরেই আমাকে তার স্কুলে যেতে হবে। বাসার নীচে অবস্থানকালেই আমার স্ত্রী মোবাইলে সকল আত্মীয়স্বজনের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। আমি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে ভারতের মণিপুর রাজ্যের ‘ইম্ফাল’ এলাকায় এই ভূমিকম্পের ভূকেন্দ্র ছিল এবং রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৭। আমার ভেতরেও ভূমিকম্পের ভয় কমে গিয়েছে। আমি মনে মনে স্টাফ কলেজ ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিন –এশিয়া থিয়েটারে ‘ইম্ফাল-কহিমা’ যুদ্ধের জাবর কাটতে থাকলাম। মানুষের অতীত তাকে কখনই ছেড়ে যায়না বা যেতে চায়না!

স্কুলে যেতে যেতে রাইয়া আমাকে বলল,
– “আজ সারাদিন আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার চিল্লাচিল্লি করবেন”
-“কেন?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতেই তার স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর,
-“জানিনা, তবে এ ধরনের বড় কোন ঘটনা ঘটলেই, তিনি সারাদিন চিল্লাচিল্লি করে আমাদেরকে সাবধান করে দেন!”

অফিসে আসার পথে ড্রাইভারের নিকট থেকে শুনলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না কোথায় যেন কোন এক ছাত্র আতংকে দোতলা থেকে লাফ দেবার কারনে মৃত্যুবরণ করেছে। আমার পাশের সীটে বসা আমার কোম্পানির ধার্মিক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব জানালেন,
-“ স্যার, আজ সকালে আমাদের মসজিদে ফজরের নামাজে অনেক মানুষ হয়েছিল। অনেকদিন এই মসজিদে ফজরের নামাজে আমি এতো বড় জামাত হতে দেখিনি!”

আমার মনের ভেতরে ভাবান্তর এসেছে। আমাদের পৃথিবীটা কতো সুন্দর অথচ কত ভঙ্গুর!স্ত্রী, সন্তান, শত্রু, মিত্র, সমাজ – সবাইকে নিয়ে কি প্রবল অনুভুতিময় আনন্দ বেদনার এই জগত-সংসার আমাদের। অথচ মুহূর্তের ভেতরেই স্রষ্টার অঙ্গুলি নির্দেশে সব কিছুই চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। অথচ কত দ্রুত এবং সহজেই আমরা অতীত স্মৃতিকে ভুলে যেতে পারি আমরা, এমনকি স্রষ্টাকেও!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
৪ জানুয়ারি ২০১৬

৩,১৭৬ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ভূমিকম্প এবং ‘থিয়োরি অফ এবসারডিটি’!”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    দিনলিপি হিসাবে নিঃসন্দেহে চমৎকার একটা পরিবেশনা।
    তবে এবসার্টিজমের ব্যাপারটা মনেহয় একটু অতি সরলিকৃত হয়ে গেছে।
    কিয়ের্কগ্রাদ প্রস্তাবিত ও আলবেয়ার কাম্যু (কলেজে থাকাকালে আমরা বলতাম আলবার্টো ক্যামাস) সমর্থিত এবসার্টিজমের মূল কথা হলো, বৃহত্তর পরিসরে বা বিগার ফ্রেমে কোন কিছু ঘটার পিছনে কোন কার্যকারন থাকে না।
    কারন তা থাকলে সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য এত বেশি তথ্য সন্নিবেশ ও বিশ্লেষণ করার দরকার পড়ে, যা মানুষের সাধ্যের ভিতরে পড়ে না।
    এটা বর্তমানে মেনে নেয়া র‍্যানডমনেস-এর আদি ব্যাখ্যা।
    একটা উদাহনরন দেই।
    ক্ষুদ্র পরিসরে যখন বলবো, পারভেজ কিভাবে পৃথিবীতে এলো, উত্তর হবে, ওর বাবা-মা এর মাধ্যমে।
    তারমানে হলো এইরমক ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা একটি ইভেন্টের কার্যকারন ব্যাখ্যা করতে পারি।
    কিন্তু যখনই আমরা, পরিসর বা ফ্রেমটা বড় করবো, দেখা যাবে এরকম কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা আর দাড় করানো যাচ্ছে না।
    নেক্সট বিগার লেভেলের প্রশ্ন হতে পারে-
    "পারভেজের বাবা-মা কিভাবে একত্রিত হলেন?"
    এখানেই কিন্তু আমরা র‍্যানডমনেস আবিষ্কার করা শুরু করে দেবো।
    এইভাবে যত বেশি বড় ফ্রেমে আমরা ঢুকবো, দেখা যাবে, ঘটনা যেটা ঘটেছে, তার পিছনে কারো কোনো হাত ছিল না।
    এই যে কার্যকারন বা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই ঘটনার সংঘটনা অর্থাৎ এবসার্ট বিহাইন্ড ভেরিয়াস এক্টিভিটি, এটাই হল এবসার্টিজম।

    কোথায় কখন ভুমিকম্প হবে, কে তাতে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হবে, সে সবই হলো র‍্যানডম ইভেন্ট।
    কে জিন্স পরেছে নাকি? পাপাচার বেশি করছে? - সেসবের সাথে ভুমিকম্প ঘটার কোনো সম্পর্ক নাই.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।