আমাদের গ্রাম

আমাদের গ্রাম

‘নকশিকাঁথার মাঠ’ এর কবি এবং আমাদের প্রিয় পল্লী কবি জসীম উদ্ দীন নাকি জীবনের শেষ দুই দশক কিছুই লিখেননি, আমার প্রিয় কথাশিল্পী মাহমুদুল হক (‘জীবন আমার বোন’, ‘খেলাঘর’, ‘কালো বরফ’ এর লেখক) প্রবল কোন আত্মাভিমান থেকে লেখাই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন! আর ইন্দ্রনাথ আর নতুন দা’র সৃষ্টিকর্তা কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাকি জীবনের শেষ দিকে একটা সোনার কলম বানিয়ে নিয়েছিলেন; আশ্চর্যজনকভাবে এর পর থেকে আর তেমন কিছুই লিখতে পারেননি তিনি!আমরা সাধারন মানুষ। বিখ্যাত ব্যক্তিদের উল্লেখ আমাদের জন্যে কোন গুরুত্বই বহন করেনা। আমি একজন ছাপোষা মানুষ। সকাল থেকে রাত সাড়ে সাতটা আটটা পর্যন্ত জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত থাকি।অফিস সময়ের মধ্যে মাঝে মধ্যে ফুরসৎ পেলে অতীতের স্মৃতিচারণ করি ফেসবুকে।শুধুমাত্র বর্তমানের আমিকে খুশি করার জন্যে। আর কোন কারনে নয়। ভবিষ্যৎ আমাকে দোলা দিলেও এর রুপ আমাকে খুব একটা তাড়িত করেনা। কারন দিব্য চোখ ছাড়াই শুধুমাত্র পাওয়ার গ্লাস দিয়েই আমি ‘ডিসট্যান্ট ভিসনে’ দেখতে পাই এর ঝরঝরে রুপ! কাজেই ওটা নিয়ে আনন্দিত বা আতঙ্কিত থাকার কোন প্রয়োজনই আছে বলে আমি মনে করিনা! তারপরেও গত কয়েকদিন ধরে নিদারুন নিষ্ফলা সময় যাচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে ‘সব শব্দ কবিতা হয়ে উঠতে পারে না কবিতার মত দেখতে লাগে শুধু!’ অথবা এমন হতে পারে আমিই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি খুব দ্রুত, শুরু করার আগেই!

 

অবশেষে তাই নতুন কোন বিষয় মস্তিষ্কের ভেতরে আমাকে বিচলিত না করাতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আজ সোমবারে আমি ‘আমাদের গ্রাম’ রচনাটা পুনর্বার লিখব। জীবনে প্রথম আমি এই রচনাটা লিখেছিলাম প্রাইমারী স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষায়। প্রশ্নপত্রে নির্দেশ ছিল ‘আদর্শ গ্রাম’ এর ওপরে রচনা লেখার। কিন্তু আমাদের গ্রামটা আসলেই আদর্শ গ্রাম ছিল কিনা, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ থাকার কারনে আমি ‘আমাদের গ্রাম’ টাইটেল দিয়েই রচনাটা লিখেছিলাম এবং দ্বিতীয় গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুন স্যার আমার ওপরে খুব মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন আমি রচনার টাইটেলটা সঠিকভাবে লিখিনি বলে। কারন আমার প্রথম গ্রেডে বৃত্তি না পাওয়াটা তার স্কুলের জন্যে ছিল একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। ইতিপূর্বে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ার হ্যাট্রিক করেছে তার স্কুল!
আমাদের গ্রামের নামটা খুবই অকাব্যিক, ছন্নছাড়া এবং লজ্জাস্কর। একেবারে বাইপোলার লিকার্ট স্কেলের নেতিবাচক অংশের শেষপ্রান্তে অবস্থিত। ‘কুমার পাড়া’! অথচ আমাদের পাশের গ্রাম গুলোর নাম লিকার্ট স্কেলের ইতিবাচক অংশ অনুযায়ী ক্রমানুসারে ‘খুব সুন্দর’, ‘সুন্দর’ অথবা ‘চলনসই’।

আমাদের গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামের নাম নিশ্চিন্তপুর। শুনলেই নান্দনিক এক শৈশব ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়! মনে হয় অপু আর দুর্গার সাথে সত্যজিত রায়ের হাত ধরে আমরাও যাচ্ছি ট্রেনে চড়ে অস্কার পুরস্কার গ্রহন করতে! পূর্বদিকে ‘বিনোদ টঙ্গি’। মুহূর্তের ভেতরেই আপনাকে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠকে, এমনকি আরাফাতের ময়দানকেও স্মরন করিয়ে দিতে পারে যেখানে প্রকাণ্ড এক পাথরের ওপরে স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হবার পর ‘ইভ’ বিরহকাতর হয়ে ‘সিংহল’ থেকে আদমের আগমনের অপেক্ষা করছে! দক্ষিনের গ্রামটার নাম শিমুলিয়া। বসন্তে যখন শিমুল পলাশের রঙে চারদিক রঙিন হয়ে ওঠে, তখন আপনার মনে হবে এ জীবন নেহায়েত অর্থহীন নয়! সবশেষে উত্তর পাশে ঝাড়কাঁটা নদীর নামে গ্রামের নাম ঝাড়কাঁটা। চলনসই নাম। অন্তত ঢাকা শহরের নিউমার্কেটের পার্শ্ববর্তী ‘কাঁটাবন’ এর রঙধনু রঙের মাছেদের বাসস্থান একুইরিয়াম গুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে আপনাকে।

বিশুদ্ধ অর্থে পাড়া-গাঁ বলতে যা বোঝায় আমাদের গ্রামটা ছিল তেমন একটা গ্রাম। জামালপুর শহর থেকে পঁচিশ মাইল দূরে এবং ঝাড় কাটা নদী থেকে আধামাইল দূরে একটা কুয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তরের ভেতরে কচ্ছপের মতন শুয়ে থাকতো আমার গ্রাম। ট্রেন, মোটরগাড়ি, বিদ্যুৎ অথবা শিল্প বিপ্লবের ছিটেফোঁটা কোনটাই আমার শৈশবে এখানে পদার্পণ করেনি। আমাদের গ্রামের মাটির তৈরি প্রবেশপথটা ঝাড় কাটা নদীর যেখানটা ধনুকের মতন বেঁকে মহিষবাথান গ্রামের দিকে চলে গেছে সেখান থেকে খাদ্যনালীর মতন একে-বেঁকে আমাদের গ্রামের বাঁশ বনের নীচে হারিয়ে গিয়েছিল। কোন পোস্ট অফিস ছিলনা। শুধুমাত্র ঝাড়কাটা প্রাইমারী এবং হাইস্কুল নামের দুইটা বিদ্যাপীঠ ছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে। গ্রামের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ ছিল নব্বইচর, চর পাকেরদহ, গোবিন্দি চর এবং আরও দূরদূরান্ত থেকে লজিং থেকে স্কুলে পড়তে আসা কিশোর অথবা যুবক ছাত্র। এরা পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলাই বেশি পছন্দ করত। কাদের ডাক্তার নামের গ্রামের একমাত্র হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার দুই পাশ দিয়েই খুলে ফেলা যায় এমন একটা কাল ব্রিফকেস থেকে ছোট্ট শিশি বের করে তা থেকে সরিষার আকৃতির দুই তিনটা সুগার বল ইঞ্চি কাটা এক বোতল পানির ভেতরে ফেলে দিয়ে ঝাঁকানি দিতেন। সকালের মৃদু আলোতে এবং গোধূলির অন্ধকারে এই বোতলের একদাগ পানি খেয়েই রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠত অথবা নির্বাণ লাভ করত !
গ্রামের উত্তর দিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সবুজ আর সোনালি রঙ ছিল।গ্রামের দক্ষিন দিকে ছিল নিম্নভুমি। বর্ষার পরেও শরৎকালে এই প্রান্তরে ফুটে থাকতো শাপলা ফুলের মেলা। এই নিম্নভূমির ঠিক মাঝ বরাবর ছিল একটা হিজল গাছ। প্রবল বন্যার সময়ে যখন চারদিকটা প্লাবিত হয়ে যেতো, তখনও গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা এই হিজল গাছই নির্দেশ করতো দূরদূরান্ত থেকে আমাদের গ্রামের নিশানা নাইওরে ফিরে আসা গ্রামের মেয়েদের। গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই অনাদরে বেড়ে ওঠা কয়েকটা করে মেয়ে ছিল। এরা আমাদেরই বোন বা আত্মীয়া। সুন্দরের ধারনা এদের মাধ্যমেই আমাদের মনের ভেতরে সৃষ্টি হয় ! তবে এই গ্রামে সৌন্দর্যের স্থায়িত্বকাল কখনই দীর্ঘতর হতোনা। কৈশোরেই তারা বিয়ের কারনে এরা অন্যত্র চলে যেতো। বর্ষাকালে বা শীতের সময়ে এরা ফিরে আসতো কয়েকদিনের জন্যে নাইওরি হিশেবে, আবার কেউ কেউ কখনই ফিরতনা!

আমি যদি আমার এই গ্রামের রচনাকে্ দির্ঘায়িত করতে চাই, তাহলে আমি এপিসোডহীন অনন্ত দীর্ঘ পরিক্রমার ভেতরে কেটে যাবে আমার অনিকেত সময়!

“সব শব্দ শেষ হয়ে যাওয়ার পর
ছড়িয়ে থাকে যে মুখর নৈঃশব্দ্য
তাকে ছুঁয়েই জেগে উঠি প্রতিবার
নবনির্মাণে”।

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

৫,৬৬৩ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “আমাদের গ্রাম”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাইয়া নাম আর কলেজে অবস্থান কাল টা বাঙলায় করে দিয়েন কিছু মনে না করলে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    ভাই,আমি মুগ্ধতাতা নিয়ে আপনার লেখা সবসময় পড়ি।আমার কলেজবন্ধু বা পরবর্তী কালের সহপাঠীদের মধ্যে আমারমত একেবারের গ্রামের ছেলে পেয়েছি খুব হাতেগোনা, দু'একজন।
    সুন্দরবনের অদূরের লোনাজমি-জলের মাঝের ছোট্ট গ্রাম আমার। শৈশবে সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া খুঁজে না পেলেও এখন বেশ পাই।কিন্তু এই নির্মম আধুনিকতা কেন জানি আমার সেই স্বপ্নিল শৈশবকে গ্রাস করে চলেছে দিনেদিনে।চেনা পরিবেশকে লাগে দিনে দিনে অচেনা।মানুষ গুলোও কেমন জানি হারিয়ে যাচ্ছে এক অচেনা অন্ধকারে।
    মন ভরেগেলো......হাহাকারও সৃষ্টি হলো।
    অনেক লিখেছি আবেগতাড়িত হয়ে।খুব ভালো লাগলো।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।