একজন অসার্থক বিউগলারের স্মৃতি কথন!

একজন অসার্থক বিউগলারের স্মৃতি কথন!

পৃথিবীর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভেতরে যেমন স্পষ্ট সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান, তেমনিভাবে আমার বিশ্বাস সমগোত্রীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র দল সমুহের ভেতরেও স্পষ্ট সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান থাকতে পারে। অন্ততঃ আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে! ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার পর আমাদের ক্লাসের ৫৫ জন ক্যাডেটকে লটারি অথবা র‍্যানডম স্যামপ্লিং এর ভিত্তিতে বিভিন্ন হাউজে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। কাজেই মাত্র ৩০০ জন ক্যাডেট নিয়ে সংগঠিত ফজলুল হক হাউজ, সোহরাউয়ার্দি হাউজ এবং নজরুল হাউজের ক্যাডেটদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক শক্তির বিকাশ সম্পর্কিত পার্থক্য ব্যতীত অবশিষ্ট বিষয়ে তাদের মধ্যে তেমন কোন ভেদ থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি! আমি যে স্থান ও সময়কালের কথা বলছি তা মোমেনশাহী/ মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ এবং সময়কালঃ ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩। এটা উল্লেখ করলাম এ কারনে যে, স্থান এবং সময়কাল ভেদে জলবায়ু পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

ফজলুল হক হাউজ একাডেমিক ব্লকের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত হবার কারনে এই হাউজের ক্যাডেটরা শিক্ষক অথবা হাউজ টিউটরদের নিষ্পেষণেই হোক অথবা হাউজ মাস্টার শামসুজ্জহা স্যার, রেজাউল ইসলাম স্যার অথবা গফুর স্যারের ব্যক্তিত্বের কারনেই হোক মূলত একটা নিয়মানুবর্তিক গোষ্ঠী হিশেবে গড়ে উঠেছিলো। এদের বেশির ভাগই ছিল প্রবলভাবে বিদ্যানুরাগী, খেলাধলায় যথেষ্টই দুর্বল, তবে কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে যুগোপযোগী। কলেজে আমরা কখনই বুঝতে পারিনি যে এরা কলেজ পরবর্তী বাস্তব জীবনে তেমন ভালো করবে!

অন্যদিকে সোহরাউয়ার্দি হাউজের ছেলেরা পড়াশুনায় ভাল হলেও তাদের শৃঙ্খলার সাধারন মান ছিল যথেষ্টই নিম্ন। অধিকাংশই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত স্মার্ট। হৈ হুল্লোড় করতে বেশি পছন্দ করে। কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে যথেষ্ট ভাল। প্রবলভাবে খাদ্য অনুরাগী; আমাদের আগের ব্যাচের কাদের ভাই কলেজের প্রায় পুরোটা সময়েই ডাইনিং হলের মধ্যবর্তী স্থানে খাবার সরবরাহ করার সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থানে বসতেন এবং মুরগীর সবচেয়ে বড় রান ও ইলিশ মাছের সবচেয়ে বড় মাথাটা তার জন্যেই নির্ধারিত ছিল অথবা নিজেই নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। মধ্যরাতের পর এই হাউজের অনেককেই দেখা যেতো বিশেষ ধুঁয়া সৃষ্টি করে ছাঁদের শীতের কুয়াশাকে আরও ঘনীভূত করতে! কলেজের শিক্ষকদের বেশীরভাগ নিকনেইমই এই হাউজের ক্যাডেটদের সৃষ্টিশীলতার অভিনবত্ব থেকে সৃষ্ট। ভবিষ্যৎ জীবন এদের ঝরঝরে হবে বলেই প্রায় সবাই আশা করেছিলো, কিন্তু সবাইকে হতাশ করে দিয়ে এদের প্রায় সবাই জীবৎকালেই আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন ‘স্টার’ হয়ে গেছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে!

সর্ব দক্ষিনে পেয়ারা বাগানের সবুজ বনানীর পাশে নজরুল হাউজ। প্রকৃতিই এই হাউজের সন্তানদের নিবিড় মায়া দিয়ে তাদের মধ্যে নির্জনতার প্রতি আকর্ষণ এবং প্রেমিকভাবের সৃষ্টি করেছিল।আমার এক ক্লাসমেটকেই আমি দেখেছি ক্লাস নাইনে থাকতেই প্রেমে পরে যেতে যা তাকে পরবর্তীতে কলেজের সর্ব কনিষ্ঠ বিবাহিত মানুষের মর্যাদা দিয়েছিল। বর্তমানে তার নাতিপুতিরাও বিবাহযোগ্য হয়ে উঠছে।অথচ আমার ছোট মেয়ে পড়ে ক্লাস ফোরে!এরকম উদাহরন একটা নয় একাধিক! এই হাউজের ছেলেপুলেরা স্বভাবগতভাবে কিছুটা নির্বাক প্রকৃতির। কথাবার্তা কম বলে, তবে খেলাধুলায় খুব ভাল। আন্ত হাউজ প্রতিযোগিতায় এরা ফুটবল, ভলিবল, এথলেটিক্সে এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় তারা কবিতা আবৃতিতে স্বর্ণপদক পায়। এদের শৃঙ্খলার মানও যথেষ্ট উন্নত। নেতিবাচক কোন ইতিহাস নাই বললেই চলে; শুধুমাত্র কলেজের প্রিন্সিপ্যালের বাসার মুর্গীগুলোকে রাতের অন্ধকারে চিকেন রোস্ট বানিয়ে খেয়ে ফেলা ছাড়া। আমার নিবাস এই হাউজেই ছিল। নিবিড় গ্রাম থেকে আসা একটা কিশোরের জন্য এর চেয়ে ভাল কোন আধুনিক পরিবেশ হতে পারেনা।

আমরা নজরুল হাউজের ছেলেদের ‘হেমায়েত কবির’ ভাইয়ের বিউগলের শব্দে ঘুম ভাঙত! তার বিউগলের শব্দেই আমরা খেলাধুলা ছেড়ে স্নান এবং ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম।বিউগল বাজানো খুব কষ্টের ব্যাপার। সাধারন ফুঁ দিয়ে বিউগল বাজানো সম্ভব নয়। অদ্ভুত ভঙ্গীতে বুকের ভেতর থেকে বাতাস টেনে এনে গলার শিরা উপশিরাগুলোকে বৃদ্ধদের হাতের উল্টোদিকের শিরাগুলোর মতন ফুলিয়ে বিউগল বাজাতে হয়। এই অতিরিক্ত পরিশ্রম করার জন্যে হেমায়েত স্যারকে ডাইনিং হল থেকে সকাল-বিকাল এক গ্লাস করে পাউডার মিল্ক পান করানো হত যা ছিল অনেকেরই ঈর্ষার কারন।আমি চিন্তিত থাকতাম হেমায়েত কবির ভাইয়ের মধ্য যৌবনে ফুলে ওঠা গলার শিরা উপশিরার কথা ভেবে। এমনিতেই তার গায়ের রঙ আমার মতন কালবোশেখির মেঘ বর্ণের! তার ওপরে গলার শিরা উপশিরা ফুলে গেলে কস্মিনকালেও কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করবে কিনা সেটা নিয়ে আমার গুরুতর সন্দেহ ছিল!

আমি কখনই বিউগলার হতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম কলেজ বাদকদলের ড্রামবাদক হতে এবং প্রতি সপ্তাহের প্রথমদিনে ‘প্রিন্সিপালের প্যারেডে’ ড্রামটা ফাটিয়ে দিতে!কিন্তু এই দলের জন্য কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী ক্যাডেটদের নির্বাচন করা হয়।কাজেই আমার জন্যে এখানে কোন অবকাশই ছিলনা। আমি, বাহাদুর আর আব্দুল্লাহ এথলেটিক্স-এ ভাল ছিলাম বলে একদিন শফিক ওস্তাদ আমাদের তিনজনকে বললেন বিউগল শেখার পার্টিতে জয়েন করতে; সেই সাথে দুই বেলা দুই গ্লাস পাউডার মিল্কেরও লোভ দেখালেন। আমি তাকে বললাম, “ওস্তাদ আমি ব্যান্ড পার্টিতে জয়েন করতে চাই”। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে পৃথিবীতে তিনি এর চেয়ে অদ্ভুত কথা কোনদিনই শুনেননি!

আমার পারিবারিক ইতিহাসে বাদ্যযন্ত্র তো দূরের কথা, বাঁশের বাঁশিরও কোন ইতিহাস নেই। একবার মামার কাছ থেকে একটা আধুলি নিয়ে ইদের মেলা থেকে নল খাগড়ার কাণ্ড দিয়ে তৈরি একটা বাঁশি কিনেছিলাম। ফেরার পথেই মসজিদের হুজুরের সাথে দেখা। তিনি আমাকে বললেন, “ফুঁ দিয়েছিস? দিয়ে থাকলে আগামী ৪০ দিন আর কোন ফেরেশতা তোর ধারেপাশে আসবেনা” অতঃপর তিনি আমাকে আরও হতাশ করে দিয়ে মসজিদের পাশের ইন্দিরাতে (ইঁদারা) আমার বাঁশিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।এই ইন্দিরাতেই তিনি বিভিন্ন সময়ে গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের অন্তত এক মন ওজনের মার্বেল ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন!

কাজেই বাধ্য হয়েই বিউগলের মতন অধার্মিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে হল। ইচ্ছার অভাব এবং প্রতিভার অপ্রতুলতার কারনে আমি শুধু সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের বিউগল বাজানো শিখতে পারলাম কয়েক মাসের প্রানান্তকর পরিশ্রমের পর। হেমায়েত কবির ভাইকে নিয়ে ভিন্নধর্মী সমস্যা হচ্ছে। নির্বাক সংস্কৃতির নজরুল হাউজের ক্যাডেটদের প্রতিবাদের ভাষা অনেকটা মহাত্মা গান্ধীর শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ভাষার ন্যায়। আন্তঃ হাউজ এসলট কোর্স (ASSAULT COURSE) প্রতিযোগিতায় আমাদের হাউজের ক্যাডেটরা অনুভব করতে পারছে যে বিচারকদের ভুল সিদ্ধান্তের কারনে আমাদের হাউজ হেরে যাচ্ছে, কিন্তু বলার কিছুই নাই। এই সময়ে আমাদের হাউজের একটা দল (কবির ভাই এবং আরও দুজন দুর্ধর্ষ এথলেট আছেন) তাদের প্রতিযোগিতা শুরু করল। অনেকটা বিদ্যুতসম গতিতে এই দলের সবাই সকল বাঁধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পুরো নজরুল হাউজ আনন্দে উদ্বেলিত। হাউজ টিউটর বজলুর রশিদ স্যার তাদেরকে অনুপ্রেরনা দিতে দিতে তাদের সমান্তরালে দৌড়াচ্ছেন। আর মাত্র দুইটা বাধা অতিক্রম বাকী। ক্রল ট্রেঞ্চের(CRAWL TRENCH) কাঁটা তাঁরের নিচে তারা ঢুকে গেছেন। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি তারা বেরিয়ে এসে জিগজ্যাগ (JIG-JAG) নামের সহজ বাঁধাটা অতিক্রম করলেই শেষ। কিন্তু তারা সকলেই তিনটা ট্রেঞ্চের ভেতরে ঘুমিয়ে পরেছেন, তাদেরকে জাগানোর সামর্থ্য প্রিন্সিপাল কেন স্বয়ং ইস্রাফিল (আঃ) ফেরেশতার আছে কিনা সন্দেহ আছে!

আমাকে আর বাহাদুরকে নিয়োজিত করা হল কবির ভাইয়ের বদলে নজরুল হাউজের বিউগলার হিশেবে। প্রতিদিন সকালে সুবহে সাদেকের অনেক আগে আমাদের দুইজনকে ঘুম থেকে জাগতে হয় এবং পরবর্তীতে সবাইকে জাগাতে হয়। মাত্র দুই সপ্তাহেই বাহাদুর আর আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষে পরিনত হলাম। দুই সপ্তাহ পর বাহাদুরকে বললাম খুঁজে বের করতে কিভাবে আমরা এই কঠিন অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে পারি। আমরা দুজনেই নিশ্চিত যে ‘আরব্য রজনী’র সিন্দাবাদও কখনই এধরনের বিপদে পরেনি! বাহাদুর আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। তার ক্যাডেট নম্বর ক্লাসের প্রথম দুইতিন জনের ভেতরে।

সপ্তাহের প্রথম কি দ্বিতীয় সকাল। সকালে পিটি আছে। সুবহে সাদেকের অনেক আগেই আমি আর বাহাদুর উঠেছি। সাধারনত ছাঁদের ওপরে দাঁড়িয়ে সামনের বাগানের দিকে মুখ করে আমরা বিউগল দেই। আজ বাহাদুরের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে ছাঁদের পাশের কমন টয়লেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে পেয়ারা বাগানের দিকে মুখ করে আমরা বিউগল দিয়েছি। ফলাফলটা যা হোল হাউজের পশ্চিমদিকের রুমগুলোর সবাই বিউগলের শব্দে জেগে গেছে। জাগেনি শুধু পুব দিকের রুমের জনগন। অথচ সূর্য ওঠে পুব দিক থেকেই!

দুপুরের পর হাউজ লিডার কিবরিয়া ভাই আমাদের দুজনকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন আমাদের। আমরা দুজনেই সবিনয়ে তাকে জানালাম, “আমরা বিউগল দিয়েছি!” তিনিও ইতিমধ্যেই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারাও তাকে জানিয়েছে যে বিউগলের শব্দেই তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে। কিবরিয়া ভাই আমাদের দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন! হয়তোবা অন্য কোন কারনে। অথবা এমনিতেই। কিছুক্ষন পর তিনি আমাদের দুজনকে বললেন, “ আগামীকাল থেকে তোমাদের দুইজনের বিউগল দেয়ার দরকার নেই! আব্দুল্লাহ কাল থেকে বিউগল দেবে”। আব্দুল্লাহ শুধু আমাদের ক্লাসেই নয়, কলেজের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্যাডেটদের অন্যতম।

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
০৬ ডিসেম্বর ২০১৫

৩,৩০৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “একজন অসার্থক বিউগলারের স্মৃতি কথন!”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।