মৃত্যুঞ্জয়ী
১৯৭১ সালে আমাদের মাদারগঞ্জ থানায় পাকবাহিনী ঢুকতে পারেনি।কারন এর পশ্চিম দিকে যমুনা আর অবশিষ্ট তিন দিক যমুনার শাখা প্রশাখা দ্বারা বেষ্টিত থাকার ফলে নদী অতিক্রম করা ছাড়া এখানে প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ করা সহজসাধ্য ছিলনা। ফলে যুদ্ধের পুরো সময়েই এই এলাকা ছিল অনেকটা মুক্ত স্বাধীন ক্ষুদ্র একটা রাষ্ট্রের মতন, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অভয়ারণ্যের মৃগয়াদের মতন চলাফেরা করত। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে নাকি একবার বলা হয়েছিল মাদারগঞ্জ থানার গাছের পাতায় পাতায় নাকি মুক্তিযোদ্ধারা বিচরন করে! তথ্যটা সত্য কি মিথ্যা তা যাচাই করার বয়স তখনো আমার হয়নি। তবে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সত্যি সত্যিই আমাদের থানায় ছিল থানার দুই প্রান্তে। একটা ক্যাম্প ছিল আমাদের বাড়ীর সন্নিকটের ঝাড়কাটা স্কুলে এবং অন্য ক্যাম্পটি ছিল যমুনা নদী এবং খরকা বিলের মধ্যবর্তী স্থানে আমার নানাবাড়ি সুখনগরি গ্রামের একটা স্কুল ঘরে। তাই বলে যুদ্ধের ট্রমা যে আমাদেরকে স্পর্শ করেনি সেটা কখনই নয়। আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাদারগঞ্জ থানার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত যমুনার শাখা নদী ঝাড়কাটা নদীর ওপারেই মেলান্দহ থানার শেষ অংশ মাহমুদপুর। জামালপুর শহর থেকে ট্রেনে করে অথবা সড়কপথে মেলান্দহ আসা যায়। মেলান্দহ থেকে মাহমুদপুর বাজার পেরিয়ে ঝাড়কাটা নদীর সিকস্তি পর্যন্ত পাকবাহিনীর অকস্মাৎ আগমন কোন কঠিন ব্যাপারই নয়। ঝাড়কাটা নদী বর্ষার সময়ে কূল ছাপিয়ে পুরো জনপদ ভাসিয়ে দিতে সমর্থ হলেও অন্য ঋতুতে মূলত এটা ছিল একটা ঘুমন্ত নদী যা হাঁটুজল পেরিয়ে যে কারো পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব।
ঘটনাটা ঘটেছিলো বর্ষা চলে যাবার পরে শরৎ অথবা হেমন্তকালে। একদিন বলা নেই, কওয়া নেই – এক শুভ্র সকালে পাকবাহিনী জামালপুর থেকে ট্রাকে ট্রাকে এসে মেলান্দহ থেকে মাহমুদপুর পর্যন্ত রাস্তার পাশের সকল ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে গেল। আমরা নিজ নিজ বাড়ী থেকেই দেখতে পেলাম এই দিগন্ত বিস্তারি খাণ্ডব-দাহন। এই এলাকা থেকে হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ বনিতা নদী সাঁতরে আমাদের দিকে চলে এসেছে। শিশু এবং মেয়েদের আর্ত চিৎকারে আমাদের বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পাকবাহিনীর প্রস্থানের পরেও এলাকা জুড়ে সবার ভেতরে ভীত সন্ত্রস্থ ভাব। এরা যে কোন সময়েই আবার ফেরত আসতে পারে এবং ফেরৎ আসলে হাঁটুজল পেরিয়ে তারা আমাদের থানায় ঢুকে পরবে। ঝাড়কাটা স্কুল ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা নদীর এই পাড় জুড়ে শত শত রাইফেল ট্রেঞ্চ খনন করেছে। দূর থেকে এগুলোকে দেখতে মনে হচ্ছে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কবরের সারি। পরবর্তী যুদ্ধে যারা হারবে, এগুলো তাদেরই সমাধিক্ষেত্র হবে!
আমাদের এলাকার সব মানুষেরাও শঙ্কিত। শুধুমাত্র হোসেন মাস্টারের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির একটা প্রচ্ছন্ন ছাপ খুব খেয়াল করলে বোঝা যায়! এই গণ্ডগোলের বছরটা তার জন্যে ভাল যায়নি। গত কয়েক মাসে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে কম জালায়নি। অন্তত ৫ বার তাদেরকে তার গোয়ালের সবচেয়ে তরতাজা গরু জবাই করে দাওয়াত খাওয়াতে হয়েছে। আমার মা চাচীদেরকে দেখলাম তাদের অলঙ্কার কাঁসার কলসের ভেতরে রেখে দিয়ে সেই কলস এবং দামী অন্যান্য বাসনকোসন মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে। এই দুর্যোগময় সময়ের এক সকালে আমাদের চাচা চান মাস্টার বাড়ীর সকল কিশোর এবং যুবা বয়সের সবাইকে তার উঠোনে ডাকলেন এবং আমাদেরকে বললেন, “মাহমুদপুরের লোকেরা পালিয়ে আমাদের এখানে এসেছিল; কিন্তু আমাদের পালিয়ে যাবার কোন জায়গা নেই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করছে মেলান্দহ এবং মাহমুদপুরের মধ্যবর্তী ‘পয়লা’ ব্রিজ উড়িয়ে দিতে। তাহলে তাদের এই শীতেও এই এলাকায় আসা কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু এর আগেই যদি ওরা আমাদেরকে আক্রমন করে বসে তবে আমাদেরকে যুদ্ধ করেই মরতে হবে”। এরপর তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন তার উঠোনের ভেতরে একটা বড় আকারের ট্রেঞ্চ বা গর্ত খুঁড়তে। ঠিক অন্দর বাড়ীর উঠোনে এই গর্ত আমাদের কি কাজে লাগবে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “যদি মরতে হয় তবে পুরো বাড়ীর সবাই আমরা একসাথে এই ট্রেঞ্চের ভেতরে ঢুকে একসাথে মরবো, পাকিস্তানিদের সামর্থ্য হবেনা আমাদের কাউকে এখান থেকে পৃথক করে নিয়ে যেতে!” তার কথার ভেতরে কতটুকু যুক্তি ছিল তা সেই বয়সে আমাদের কারুরই বিচার করার ক্ষমতা ছিলনা। তবে ‘মরলে সবাই একসাথে মরব’ কথাটা আমাদের সবার ভেতরে প্রবল আনন্দের সৃষ্টি করেছিল। আমার খেয়াল আছে পর পর তিন দিন দিবারাত পরিশ্রম করে আমরা সেই ট্রেঞ্চটি খোঁড়া সম্পন্ন করেছিলাম। আমাদের কারুরই এতোটুকু কষ্ট হয়নি। এমনকি এর পর আমরা শিশু কিশোরেরা আমাদের বাড়ীর চারপাশের শুকিয়ে যাওয়া পুকুর আর পগারের পাড়গুলো ভরিয়ে দিয়েছিলাম মাছরাঙা পাখির মতন শত শত গর্ত আর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে!
ওপরের গল্পটা বিস্মৃতির ভেতর থেকে বের করে আনা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতোনা যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’ডাকঘর’ নাটকটা না পড়া থাকতো এবং যানুস কোরচাক নামের বিখ্যাত ব্যক্তিটির সম্পর্কে আমি নীচের কথাগুলো না শুনতাম!
যানুস কোরচাক (২২ জুলাই ১৮৭৮ – ০৭ আগস্ট ১৯৪২) এই ছদ্মনামেই তিনি পরিচিত ছিলেন।ইহুদী পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল।ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন পোল্যান্ডের ‘ওয়ারশ’ শহরের একটি এতিমখানার মালিক, শিশুদের ডাক্তার এবং শিশুতোষ বইপুস্তকের লেখক। তার এতিমখানায় আনুমানিক ২০০ শিশু এতিম ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে এই এতিমখানাটিকে ইহুদী নিধনযজ্ঞের অন্যতম মৃত্যুকুপ নামে পরিচিত ত্রেবলিঙ্কার অদূরে উঁচু পাচিলঘেরা একটা ঘেঁটোতে স্থানান্তর করা হয়। যানুস কোরচাক জানতেন যে যথাসময়ে তাকে এবং তার এতিমখানার সকল শিশু এতিমদেরকে ত্রেবলিঙ্কার মৃত্যুকুপের অভ্যন্তরের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে অন্য অনেক ইহুদিদের সাথে হত্যা করা হবে! শিশুদের প্রচণ্ড রকমের ভালবাসতেন যানুস কোরচাক। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদেরকে তিনি কিভাবে মৃত্যুর বারতা শোনাবেন? কিভাবে তিনি তাদেরকে মৃত্যুর জন্যে যারা জীবন শুরু হয়নি বললেই চলে?এই কাজটা করতে তিনি সাহায্য নিলেন ১৯১২ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নাটক ‘ডাকঘর’ এর পোলিশ অনুবাদের। এই নাটক লেখা হয়েছিল মৃত্যুপথযাত্রী এক বালকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, যে বালক তার আসন্ন মৃত্যুকে কৌতূহল, আবিস্কারের উচ্ছ্বাসে এবং বিমল আনন্দ নিয়ে বরন করতে যাচ্ছিলো। কাহিনীটা অনেকটা এরকম! এতিম অমল মাধব দত্তের আশ্রিত একজন অসুস্থ বালক। মাধবদত্তের মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ আর পরিচর্যার কারনে তার স্বাস্থ্য ক্রমঅবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। চার দেয়ালের বন্ধন ছেড়ে সে বাইরে যেতে চায়; চায় বাইরের ক্রীড়ারত বালকদের সাথে খেলতে; চায় তার ঘরের জানালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মালিনীকন্যা সুধার সাথে ফুল কুড়াতে। কিন্তু বাইরের বাতাসে অমল আরও অসুস্থ হয়ে পরছে এই কারনে কবিরাজের নির্দেশে একসময়ে জানালাটাও বন্ধ করে দেয়া হয়। অমল তখন তার ঠাকুরদার কাছ থেকে জানতে পারে যে আশেপাশেই একটা ডাকঘর বসেছে কোথাও, যে ডাকঘর থেকে রাজার পক্ষ হতে তার কাছে চিঠি আসবে। এই চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে অমল। একদিন রাজদুত তার রাজকবিরাজ নিয়ে সত্যি সত্যিই অমলের ঘরে হাজির হয় এবং নির্দেশ দেয় ঘরের সমস্ত দরজা জানালা খুলে ফেলতে। মুক্তবাতাসে জ্বলজ্বলে তারার তারার নীচে অমল ঘুমিয়ে পরে। সুধা আসে ফুলের ডালা নিয়ে। অমল ঘুমিয়ে পড়েছে জানতে পেরে মাধবকে বলে যায় যেন সে অমলকে বলে যে তাকে ভোলেনি!
যানুস কোরচাক তার এতিমখানার শিশুদেরকে দিয়েই এই নাটকটার অভিনয় করিয়েছিলেন শুধুমাত্র তাদেরকে বোঝানর জন্যে যে আসন্ন মৃত্যুকেও হাসিমুখে প্রবল আত্নমর্যাদা সহকারে গ্রহন করা সম্ভব। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। মৃত্যুর মুখোমুখি এসেও এই শিশুরা ছিল ধিরস্থির, পরিনত এবং আনন্দিত। কোরচাক নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৮ জুলাই ১৯৪২ সালে। এর মাত্র কদিন পর ৬ আগস্ট ১৯৪২ সালে কোরচাক, তার সহকর্মীদের এবং ২০০ শিশুকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ত্রেবলিঙ্কায়। তাদের মধ্যে না ছিল উদ্বেগ, না ছিল ক্রন্দন! তাদেরকে দেখা শেষ প্রত্যক্ষদর্শী জশুয়া পার্লে এর বর্ণনায় এসেছে এভাবে, “Janusz Korczak was marching, his head bent forward, holding the hand of a child, without a hat, a leather belt around his waist, and wearing high boots. A few nurses were followed by two hundred children, dressed in clean and meticulously cared for clothes, as they were being carried to the altar.” — Joshua Perle, Holocaust Chronicles । এরপর আর কেউ কোনোদিন কোরচাক বা শিশুদের পুনর্বার দেখেনি!
অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকেও হাসিমুখে ও আত্ন মর্যাদা সহকারে প্রস্তুত হয়ে বরন করা সম্ভব এমনকি শিশুদের পক্ষেও যাদের যদি সেই মৃত্যু সত্যিই গর্বের, আনন্দের বা মুক্তির হতে পারে তা তাদেরকে বোঝানো সম্ভব হয়।আমার মাঝে মধ্যেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ এবং কোরচাকের মতন আমার সেই অর্ধ শিক্ষিত চাচাও একই দর্শনকে ধারন ও লালন করেছেন, যদিও এদের দুজনের মধ্যে কোরচাকের নাম তিনি কখনোই শুনেন নি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটক পড়ার বা বিশ্লেষণ করতে পারার সৌভাগ্য তার কখনই হবার কথা নয়!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
৩০ নভেম্বর ২০১৫
:boss: :boss: :boss:
বিবেক হলো অ্যানালগ ঘড়ি, খালি টিক টিক করে। জীবন হলো পেন্ডুলাম, খালি দুলতেই থাকে, সময় হলে থেমে যায়।
হৃদয়কে স্তব্ধ করে দ্যায়
সবিনয়ে বলি ভাইয়া, আমি আপনার লেখার সবিশেষ ভক্ত পাঠক। আরো অনেক অনেক লেখা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।
কিছু কিছু দর্শন আছে যা এতই সাবলিল, যে সততা থাকলে, তা মৌলিকভাবে পুনর্নিমান করা যায় বারবার।
পূর্বজ্ঞানের দরকার পড়ে না।
বুঝলাম, আপনার চাচা, তেমনই জ্ঞানি একজন দার্শনিক।
তাই তাঁকে রবিন্দ্রনাথ বা কোরচাক পড়তে হয়নি এই দর্শন বিনির্মানে।
আর কি অবাক কান্ড, তিনি তা তৈরী করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তা সংক্রামিত করতে পেরেছেন আপনাদের মধ্যেও!!!
নির্দ্বিধায় শত সহস্র :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ