অতীত নেই, ভবিষ্যতও নেই কোনখানে!

অতীত নেই, ভবিষ্যতও নেই কোনখানে!

 

“মাহফুজা আমরা যাতে যুদ্ধ থেকে না পালাই, সেজন্য আমাদের পশ্চাতে নিয়োজিত/ প্রশিক্ষিত কুকুর বাহিনী। সামনে শক্রর তরবারি; পিছনে ততোধিক নিষ্ঠুর/ সম্রাটবাহিনী। মাহফুজা, কথা হলো, কে আমাকে যুদ্ধে নামিয়েছে?” – কবি মজিদ মাহমুদ

 

পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের কোন অতীতই নেই!আমি স্বচক্ষে দেখেছি অন্তত তিনবার!তাই যাদের অন্তত একটা অতীত আছে বা ছিল তাদেরকে আমি সৌভাগ্যবানই মনে করি।

 

প্রথমবার আমি মানুষের এই অতীতহীনতা অবলোকন করি ১৯৯২ সনে কম্বোডিয়াতে জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক হিশেবে কাজ করার সময়ে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে কমিউনিস্টপন্থী খেমার রুজ গেরিলাদের প্রধান পলপট সরকার কম্বোডিয়ায় শুদ্ধি অভিযানের নামে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায়। পলপট বিশ্বাস করতো যে তার বিপ্লবকে সার্থক করতে দেশে এত মানুষের দরকার নেই!‘টুঅল স্লেঙ্গ’ নামক নির্যাতন কেন্দ্রে জিজ্ঞাসাবাদ তথা অত্যাচার করার পর মৃতপ্রায় মানুষদেরকে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো ‘চোয়েয়ুঙ্গ এক’ বধ্যভূমিতে। এভাবে সে ১৯৭৯ সাল অবধি প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা অর্ধেকের নীচে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। আমার কর্মস্থল ছিল কম্বোডিয়ার সর্ব উত্তরের প্রদেশ STUNG TRENG- এ। প্রায় এক বছর সময়কাল আমি এখানে ছিলাম।এই সময়ে আমি দেখেছি অসংখ্য মানুষ যাদের অতীত বলে কিছুই ছিলনা। আমাদের দোভাষী ছিল ‘নারা’ নামের কম্বোডীয় এক যুবক। সে এই গৃহযুদ্ধে হারিয়েছিল তার বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানদের! আমরা মেকং পারের যে ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম সেটার মালিক ছিল ‘মম’ নামের এক যুবতী মেয়ে এবং তার প্রেমিক (নাম মনে নেই!)। মমের ছোট একটা বোন ছাড়া আর কেউই অবশিষ্ট ছিলনা। তার প্রেমিকেরও! আমাদের বাড়ী থেকেই একটু দূরে CPAF (CAMBODIAN PEOLE’S ARMED FORCES), যাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করানো ছিল আমাদের পর্যবেক্ষক দলের অন্যতম প্রধান কাজ।মমের ছোটবোন এই বাহিনিরই মিলিশিয়া হিশেবে কাজ করতো। আমি মাঝে মধ্যেই তাকে দেখেছি দুপুরের বা রাতের নির্জনতা ভাঙ্গানোর জন্যে সে একে-৪৭ রাইফেল থেকে অবিরত অনির্দেশ্য গুলি ছুঁড়তে। আমি কারন জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলতোনা, শুধু পাখপাখালি হীন অরন্যের দিকে অথবা নির্বিকার ভাবে বয়ে যাওয়া মেকং এর দিকে অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকতো। CPAF ক্যাম্পের অধিকাংশ কিশোর সৈনিকদেরই বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বলে কেউ ছিলনা। এমনকি আমাদের রান্না করে দিত ছবি (SOVI) নামের যে মেয়েটা তারও কেউ ছিল বলে আমার মনে পড়েনা! একবার খেমারুজ গেরিলাদের একটা দলের সাথে আমার সখ্যতা হয়েছিল। আমি জেনেছি এদেরও বেশিরভাগেরই কোন পূর্বপরিচয় অবশিষ্ট ছিলনা। এক ছেলে আমাকে জানিয়েছিল সে নিজ হাতে তার বাবা মাকে হত্যা করেছে কারন তারা বুর্জোয়া ছিল!
১৯৯৩ সনে আমার নিজ দেশেই আমি অতীত বা অস্তিত্বহীনতার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়েছিলাম।সীমা নামের একটা মেয়ে সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছিল তার দত্তক বাবামায়ের সাথে তার মায়ের খোঁজ করতে। ১৯৭২ সনে এই পরিবার তাকে দত্তক হিশবে নিয়ে গিয়েছিলো আমাদেরকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে। সীমা তার মাকে খুঁজে না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। আমার এই কাহিনীটা আমি অন্যত্র লিখেছি।

 

২০০২ সালে আমি জাতিসংঘ মিশনে পুনর্বার যাই সিয়েরালিয়নে। ফ্রি টাউন থেকে অদূরে একটা যুদ্ধাহতদের পুনর্বাসন কেন্দ্র ছিল। রাস্তার পাশেই। আমি এই এলাকা অতিক্রম করার সময়ে নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেলতাম। এই পুনর্বাসনকেন্দ্রের অধিকাংশই কিশোর বা যুবক যাদের অধিকাংশেরই হাত, পা, স্কন্ধ, হাঁটু নাই, কোন আত্ন পরিচয় তো দুরের কথা! আমি সিয়েরালিওনের ‘লুনসার’ নামক স্থানে কয়েক পক্ষকাল ছিলাম। ইব্রাহিম অথবা ইসমাইল নামের একটা কৈশোর অতিক্রমকারী এক অনূর্ধ্ব যুবক আসতো আমাদের ক্যাম্পে। বাবা মা ভাই বোন কেউই নাই তার। আমাকে সে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল তাকে আমি যেন দত্তক সন্তান হিশেবে গ্রহন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসি! আমার পূর্বতন অফিসারকেও সে একই অনুরোধ করেছিল বলে আমি সেই অফিসারের কাছ থেকে পরবর্তীতে জানতে পেরেছিলাম।

 

ইতিহাস আমাকে খুব বেশি আকর্ষণ করেনা। কারন ইতিহাস আদিকাল থেকেই সব সময়ে বিজয়ীদের দ্বারা লিপিবদ্ধ হয়ে আসছে। পরাজিতদের মধ্য থেকে আমার জানামতে শুধুমাত্র ফিল্ড মার্শাল রোমেলের কিছু লেখা আমাদের কাছে এসেছে লোকচক্ষুর আড়ালে এবং টিকে আছে এর মধ্যকার অন্তর্গত সাহিত্যিক এবং মানবিক উপাদানসমূহের কারনে।আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয় ‘ALLIED FORCES’ না জিতে যদি জাপানীরা বা জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জিতে যেতো, তাহলে আমরা পৃথিবীর তাবৎ সামরিক বাহিনীরা তাদের শেখানো যুদ্ধবিদ্যাই এখন মুখস্ত বা আত্মস্থ করতাম!

 

আমি ক্যাডেট কলেজে ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময়ে সায়েদ আমীর আলির ‘A SHORT HISTORY OF SARACENS’ বইটা আমার সাইন্সের পড়াশুনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আমাদের জন্য নির্ধারিত প্রেপ আউয়ারে (PREPARATION HOUR) লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম এবং ভেতরে ভেতরে অনেকদূর এগিয়েছিলাম। তবে কখনই শেষ করা হয়নি। এই বইটাতে সারাসিনদের উথান পতন, তাদের অর্থনীতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং অবক্ষয়ের ইতিহাস মোটামুটি নৈর্ব্যক্তিকভাবে তুলে আনা হয়েছে (এটা আমার ব্যক্তিগত ধারনা মাত্র, কারন তুলনা করার মতন আর কোন বইই আমি পড়িনি!)। এখানে উমাইয়া এবং আব্বাসি বংশের উত্থান পতন এবং শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়দ্বয়ের বিকাশের যে রক্তাক্ত ইতিহাস দেয়া আছে তা আমাকে সত্যিই ব্যথিত করেছিল। এমনকি আমাদের প্রিয় নবীর মৃত্যুর পরের অব্যবহিত পরের শতাব্দীগুলোতে মুসলমানদের শৌর্য বীর্যের ইতিহাসের সমান্তরালে কলঙ্কের ইতিহাসও কম উঠে আসেনি এখানে! এই শৌর্য বীর্যের ইতিহাসও আমাদের নবী বেঁচে থাকলে কতোটা অনুমোদন করতেন সে সম্পর্কে আমার পূর্ণ সন্দেহ আছে! আজকের দিনের আইসিসের ইতিহাস একই সুত্রে গাঁথা বলেও আমার ধারনা।

 

আশির দশকের শেষের দিকে (১৭৭৯) আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করার ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন মুসলমানদের বিশ্বকে করতলগত করার বাসনা পুনর্জীবিত হয় একই সাথে ইরানে শিয়া শক্তির পুনরুত্থান ১৪০০ বছর আগের বিভাজনের পুনঃ সুত্রপাত করে। এর পরের দৃশ্যাবলী বায়স্কোপের দৃশ্যাবলীর মতনঃ ইরানের আনবিক শক্তি অর্জনের প্রয়াস, সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে শিয়াদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠান, সিরিয়ার সাথে ইরাকের মিত্রতা, লেবাননে হিজবুল্লাহদের শক্তি বৃদ্ধি এবং ইসরাইলের সাথে সংঘর্ষ, অতি পুরাতন প্যালেস্টাইন ইস্যু, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর্তৃক সুচিত আরব বসন্তের ঢেউয়ে হুসনে মোবারক এর পতন, ন্যাটো জোট ও সৌদি আরবের মিলিত আক্রমনে লিবিয়ার গাদ্দাফির পতন (যেখানে পশ্চিমা নিও লিবারেলিসম এবং অস্ত্র সাহায্য নিয়ে আইসিস তার বর্তমান অন্তর্নিহিত শক্তির অধিকারী ও ধীরে ধীরে Frankenstein এ রুপান্তরিত হচ্ছে)এবং সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ পূর্ববর্তী শত্রুতার নবজাগরণ!

 

আমি ওপরের অনুচ্ছেদের কোন ব্যাখ্যাতেই যাবো যাবনা! আমি শুধু আমার একজন খুব শ্রদ্ধেয় বন্ধুর (নামোল্লেখ করছিনা!) লেখায়, “দুই পরাশক্তির বৈষম্য শুধু আইসিসকেই শক্তিশালী করবে, আর বৈরুত, প্যারিসের মত বিশ্বের আর ও অনেক বড় বড় শহরে এমনকি ছোট জনপদও নিরীহ মানুষের রক্তে ভেসে যাবে”- এই সত্যির প্রতিধ্বনি করছি! কারন পৃথিবীতে যাদের এখন পর্যন্ত অতীত আছে তাদেরকে নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। অতীত হীনতা শুধুমাত্র ভবিষ্যৎহীনতাই নয়, বরং এক সময়ে বিস্মরণের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া!

 

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৩ নভেম্বর ২০১৫

৩,২২৯ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “অতীত নেই, ভবিষ্যতও নেই কোনখানে!”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ভাল লেগেছে।
    কে বলেছে কঠিন কথা বলতে গেলে কঠিন করেই তা বলতে হবে?

    চাইলে কত সহজ করেই না কঠিন কথা গুলো বলে ফেলা যায়!!!
    :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।