নব্বই চর
আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে কেউ শব্দ করে কথা বললেও আমি শুনতে পাইনা, অথচ আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করলেও আমি বুঝতে পারি কি বলা হচ্ছে! ফলে ছোটবেলা থেকেই আমি ক্লাসের টিচারদের সব কথা ফলো করতে পারিনা, কারন তাদের দৃষ্টি সারাক্ষন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ক্লাসের ভেতরে। আমি শুধু বুঝতে পারি যমুনার ভাঙ্গনে দুভাগ হয়ে যাওয়া সারিয়াকান্দি থানার দ্বিখণ্ডিত পূর্ব অংশে (মাদারগঞ্জ থানার দিকে) নদীর সিকস্তিতে অবস্থিত ‘নব্বই চর’ গ্রাম থেকে আমাদের ঝাড়কাটা স্কুলে পড়তে আসা আমার ক্লাসমেট সাদুল্লাহর সকল কথা।কারন সে সবকথা আমাকে বলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে। জন্মলগ্ন থেকেই তার ফ্যারিংস (PHARYNX) ঠিকভাবে ডেভেলপ না করার কারনে সে স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেনা, শুধুমাত্র হাঁসের মতন মৃদুভাবে হাঁসফাঁশ অথবা ফিসফিস করতে পারে ।ফলে তার কথা তিন গজ দূরে বসে থাকা ক্লাস টিচারের কান পর্যন্ত কখনোই পৌঁছায়না, এমনকি হজরত আলী যে তার সাথে নব্বই চর থেকে হাঁটতে হাঁটতে, গাইতে গাইতে স্কুলে আসে সেও তার কথা ঠিকভাবে শুনতে সমর্থ হয়না। আমাদের ক্লাসে স্যার যখন হাজিরা খাতা নিয়ে মাথানিচু করে এক এক করে আমাদের নাম ডাকেন, তখন সাদুল্লার নাম আসলেই আমি প্রক্সি দেই ‘হাজির স্যার’ বলে। স্যার কোনদিনই খেয়াল করেননা! সাদুল্লাহর সাথে আমার এই নিবিড় সম্পর্কে আমাদের ক্লাসমেটরা পর্যন্ত যুগপৎভাবে বিস্মিত এবং আনন্দিত। তারা কোনদিনই স্যারকে বলেনি যে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার পর গত নয়মাস থেকে আমি সাদুল্লার হাজিরা দিয়ে আসছি!নয়মাস পর শুধু একদিন স্যার আমাদের হাজিরা নেবার সময়ে মাথা তুলে তাকিয়েছিলেন হঠাৎ করে এবং আমাকে সাদুল্লার স্থলে ‘হাজির স্যার’ উচ্চারন করতে দেখে তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। আমি স্যারকে বলেছিলাম, “স্যার, আমার নাম আসাদুল্লাহ হবার কারনে আমি সাদুল্লাহ’র বিপরীতে ভুল করে হাজিরা দিয়ে দিয়েছি!” স্যার ও আমাকে অবিশ্বাস করেননি, শুধু বলেছিলেন আমাকে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে, যেহেতু আমি হেড স্যারের ছেলে!
সাদুল্লাহ’র সাথে আমার সখ্যতার কারন ভিন্ন। ‘নব্বই চর’ আমার কাছে রহস্যে ঘেরা এক সিন্দাবাদের দ্বীপের নাম। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি যমুনার এই চরের মানুষেরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এখানে পুলিশেরাও যেতে ভয় পায়। পাকিস্তান আমলে একবার নাকি ২ জন পুলিশ এই চরে একটা জমি নিয়ে সংঘর্ষ জনিত একটা তদন্ত করতে যেয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো চিরতরে। তাদেরকে আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি।তখন থেকেই নব্বই চর একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক আগেই। ১৯৬৯ এর গন অভ্য্যুথানের সময়ে আমার এক চাচা তার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে নব্বই চরে পালিয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে।রাতের বেলায় চাঁদের আলোর ভেতরে তারা কয়েক বন্ধু নাকি সাদা জামা পরে চরের বালিতে গর্ত করে শুয়েছিলেন; পুলিশ তাদেরকে খুঁজে পায়নি। ১৯৭১ সনেও নব্বই চর ছিল একটা অঘোষিত ‘মুক্ত এলাকা’! নব্বই চর থেকে অদূরে এই নদীতেই ১৯৭১ সনের আগস্ট মাসে ভুয়াপুরের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি অস্ত্র এবং গোলাবারুদবাহী জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি গোলাবারুদের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দে আর আলোর ঝলকানিতে। কাজেই যমুনা পারের কারো সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমিও নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করেছিলাম। সাদুল্লাহ আমার চেয়ে বয়সে ৩/৪ বছরের বড় ছিল। আমিই ছিলাম আমাদের ক্লাসের ভেতরে সবচেয়ে ছোট সাইজের। কাজেই অভিভাবক ধরনের একটা বন্ধুর প্রয়োজন ছিল যে আমাকে বিভিন্ন বিপদে আপদে নিরাপত্তা দেবে, বিশেষ করে স্কুলের পাশে সরকার বাড়ীর এক দঙ্গল ছেলেদের থেকে যারা আমার একাকিত্তকে মনে করত তাদের শক্তির বৃদ্ধি। দ্বিতীয় কারন ছিল রহস্যে ঘেরা নব্বই চরে আমার ভ্রমনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। আমি আমার এক চাচাতো ভাইকে প্রস্তাব করেছিলাম ইতিপূর্বে।সে রাজী হয়নি যেতে, কারন নব্বই চর সম্পর্কে প্রচলিত অতি-প্রাকৃত কাহিনীগুলো নিয়ে তার ভীতি!
একদিন আমি আর সাদুল্লাহ সারাদিন নব্বই চরে কাটিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে দুই একটা বাড়িঘর যেন বালির সমুদ্রের ভেতরে ভাসছে। প্রবল বাতাস বইছে নদীর দিক থেকে।এই বাতাসের ভাঁটিতে আপনার কাউকে চিৎকার করে ডাকার দরকার নেই। নদীর প্রবাহ আর বাতাসের গতিবেগই আপনার ফিস ফিস করে আওড়ানো শব্দমালাকে নিয়ে যাবে আপনার প্রিয়জনদের কাছে।কাজেই স্কুলে সাদুল্লাহ’র বাকহীনতার কারনে সমস্যা হলেও এখানে সে অন্য যে কারুর মতনই স্বচ্ছন্দ!সময়টা শরৎকাল অথবা হেমন্ত। চরের একপাশটা দিগন্ত পর্যন্ত সবুজে আচ্ছাদিত।এগুলো মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, অড়হর, মাষকলাই, খেসারির ক্ষেত। আমি আর সাদুল্লাহ ফলন্ত মটরশুঁটির লতানো শাখা প্রশাখা ছিঁড়ে এনে শুকনো খড়ের ন্যাড়ার সাথে মিশ্রিত করে আগুন লাগিয়ে দেই। প্রবাহমান বাতাসে কয়েক মুহূর্তেই সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে চলে যায়, নীচে পরে থাকে অজস্র মটরশুঁটির অর্ধসিদ্ধ দানা।মরিচের সাথে শুকনো মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে এনেছে সাদুল্লাহ। এগুলোই আমাদের আজকের দুপুরের লাঞ্চ!খাওয়া শেষে আবার প্রবল বাতাস, প্রখর সূর্যকিরণ আর ধূলিধূসরিত সবুজ প্রান্তরের ভেতরে আমি আর সাদুল্লাহ দৌড়াতে থাকি দুই দুরন্ত খরগোশের মতন। পশ্চিম থেকে বিকেলের সূর্যের আলো যমুনার ওপরে ঠিকরে পরেছে!অনেকগুলো ঘাসফড়িঙ, এক ঝাঁক সবুজ টিয়ে আর কয়েকটা ছাগল ছাড়া এই আদিগন্ত প্রান্তরে আমাদের দুই কিশোরকে দেখার মতন আর কোন প্রাণীই নাই!
বার্ষিক পরীক্ষার পর আমাদের স্কুল ছুটি দেয়া হয়েছে একমাসের। সাদুল্লাহ আর আমি দুজনেই ক্লাস সেভেনে উঠবো। একদিন হজরত আলী দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের স্কুলে এসে হাজির। গতরাতে সাদুল্লাহকে কারা যেন মেরে কলাইয়ের ক্ষেতের ভেতরে ফেলে গেছে!লাঠি অথবা বৈঠার আঘাতে সাদুল্লাহ্’র মাথা ফেটে দুভাগ হয়ে গেছে।সকাল পর্যন্ত তার দেহে প্রান ছিল।শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে সে বিড়বিড় করে অনেক কথাই বলেছে, কিন্তু কেউই বুঝতে পারেনি!
“একটা মৃত খরগোশ-কান্নার মতো সপ্রতিভ কোন ভাষায়
আমাকে ব্যাতিব্যাস্ত রাখে অহেতুক-আধপাওয়া ঘুমে”
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৪ নভেম্বর ২০১৫
একই রকমের ঘোরে পাওয়া নিরেট বুনন...
ভাল লেগেছে।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়ার মত "গল্প"......
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ধন্যবাদ
অসম্ভব মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। "প্রবল বাতাস, প্রখর সূর্যকিরণ আর ধূলিধূসরিত সবুজ প্রান্তরের ভেতরে আমি আর সাদুল্লাহ দৌড়াতে থাকি দুই দুরন্ত খরগোশের মতন" - বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে এরকম একটি লাইন লেখা সম্ভব নয়।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi