মেকং এর নাকফুল
প্রস্তাবনা
“চেয়ে দেখ মেকং আর বেনহাই এর জলে নতুন জীবনের মুখ
কান পেতে শোন নতুন দিনের ঘোষণা মন্দ্রিত হচ্ছে হো-চি-মিন এর কণ্ঠে।”
কেবল মেকং নদী দিয়েই দেশগুলোকে এক বিনিসুতোর মালায় গেঁথে ফেলা যায়! কেননা, এই নদীকে কেন্দ্র করেই এর তীরবর্তী বা অববাহিকার দেশগুলোয় গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ, বহু সংগ্রাম ও বিপ্লব এবং নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার উত্থান ও বিকাশের ঐতিহ্য। তিব্বতের মালভুমিতে থেকে এশিয়ার যে কয়টা মহানদী নেমে এসেছে তার মধ্যে মেকং অন্যতম। সাগরের সাথে মহামিলনের তীর্থযাত্রায় তার ৪২০০ কিলোমিটার যাত্রাপথে ইন্দো চীনের সবকটি দেশ অর্থাৎ চিন, বার্মা, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া, শ্যামদেশ (এখন যার নাম থাইল্যান্ড) আর ভিয়েতনাম পাড়ি দিয়ে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মধ্যাঞ্চলকে প্লাবিত করে চীন সাগরে পরেছে। মজার ব্যাপার হল লাওস সীমান্ত অতিক্রম করে মেকং কম্বোডিয়াতে প্রবেশ করার পর কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন শহরের কাছে টোনলে (Tonle sap) সরোবর-নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই সরোবর নদীর সাথে মেকং-এর ঋতুভিত্তিক জল-বিনিময় ঘটে। যখন টোনলে-এর জলপ্রবাহ বেশি থাকে, তখন টোনলে থেকে মেকং-এ জলধারা এসে মিলিত হয়। আবার যখন মেকং-এর জলপ্রবাহ বেশি থাকে, তখন মেকং থেকে টোনলে-তে জলপ্রবাহ হয়। মেকং এবং টোনলের মিলিত স্রোতধারার দক্ষিণ দিক থেকে ব্যাস্যাক (Bassac) নামক একটি শাখা নদী বের হয়ে ভিয়েৎনামে প্রবেশ করেছে। উত্তর দিক দিয়ে মূল মেকং নদী কিছুটা ঘুরে ভিয়েৎনামে প্রবেশ করেছে। আর এই দুই নদীর স্রোত ধারা মিলিত হয়ে তৈরি করেছে মেকং বদ্বীপ। উভয় নদী সাইগন এর (এখন হো চি মিন সিটির) সামান্য দক্ষিনে মিলেছে দক্ষিণ চীন সাগরে। যাত্রাপথের একেক জায়গায় নদীটির নাম একেক রকম। তিব্বতে এর নাম ‘যুং চান’, চীনে ‘লানকাং, ক্যাম্বোডিয়াতে ‘তনলে থোম’ (বড় নদী) এবং থাইল্যান্ডে এর নাম হয়েছে ‘মায়ে নাম খোং’! আর এই শেষ নাম থেকেই পাশ্চাত্যের লোকেরা এই নদীর নাম দিয়েছে ‘মেকং’!
হিমালয়ের চূড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে মেকং নদী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে পরতে যখন গভীর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে প্রবল গতিতে বয়ে চলে, তখন মনে হয় সে যৌবনের উচ্ছাসে ফেটে পড়ছে। আসলে চীন অতিক্রম করতে করতেই নদী তার মোট দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকটা যাত্রা করে ফেলেছে এবং উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ৪,৫০০ মিটার নীচে নেমে এসেছে। তবে বাকী যাত্রা পথে মেকং নদী আরও ৫০০ মিটার নীচে নামবে এবং প্রবাহিত হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বা মেঘনার মতন কিছুটা শান্ত অথচ প্রলয়ঙ্করী সাজে। এখনো বর্ষা মৌসুমে লাউসের মেকং নদী স্বাভাবিক তুলনায় ২০ গুন পানিতে ভরে যায়, তৈরী হয় খরস্রোত , খরস্রোতা সেই নদীর গতি এতটাই তীব্র যে , তা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের চাইতেও দ্বিগুন। জানা যায়, ১৮৬০ এর দশকের শেষের দিকে ফরাসিরা মেকং নদী দিয়ে চীনে যাওয়ার পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের আশা ভঙ্গ হয়েছিল, যখন তারা কাম্বোডিয়া এবং দক্ষিণ লাওসে বেশ কয়েকটা বিরাট আকারের কয়েকটা নদী প্রপাতের সম্মুখীন হওয়ার কারনে। এগুলোতে যে ঘন জল পরে তা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের চেয়েও দিগুন!
১৯৯৩ সনের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৯৪ সনের মার্চ মাস। আমার যৌবন এবং বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের খেলা আমাকে টেনে এনেছে মেকং নদীর পারে সামরিক পর্যবেক্ষক হিশেবে। আগামী এক বছর আমার কাটবে এই এলাকার নদী, বনভুমি আর মানুষের সাথে নিবিড় সখ্যতায়!
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার খাতা
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৮ এপ্রিল ২০১৫
মেকং এর নাকফুল (দ্বিতীয় পর্ব)
“রুপ নারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়”
আমার জীবনটা কেটেছে সীমিত পরিসরে, কঠোর অনুশাসন আর সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে প্রথমে ক্যাডেট কলেজে, পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে। পরিচিত সীমারেখার বাইরে আমার কোনই পরিচিতি নেই! কাজেই ১৯৯৩ সনের এপ্রিল মাসে যখন আমি নিমেষের মধ্যেই বাংলাদেশ তথা সেনাবাহিনী থেকে উড়ে চলে এলাম কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে তখন আমার দুচোখ জুড়ে শুধুই বিস্ময়! যুদ্ধ বিধ্বস্ত নমপেনের সৌন্দর্য আর ফরাসি মাস্টার প্ল্যানে তৈরি করা নমপেনের রাস্তাঘাট আমার চোখে রীতিমতো মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দিচ্ছে। আমরা কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে এসেছি একসাথে – লেঃ কর্নেল রব, লেঃ কর্নেল মহসিন, লেঃ কর্নেল আনোয়ার, লেঃ কর্নেল আশফাক, মেজর ফিরোজ, মেজর গুলজার, ক্যাপ্টেন বশির, ক্যাপ্টেন রবি এবং আমি। আমাদের কয়েকদিন আগে এসেছে আমার কোর্সমেট ক্যাপ্টেন বায়েজিদ, ক্যাপ্টেন মুজাফফর আর ক্যাপ্টেন লুতফুল কবির। আমার আরও অনেক কোর্সমেট এসেছে এই মিশনে, তবে তারা থাকে ‘সিয়েমরিয়েপে’ এঙ্কর ওয়াটের পার্শ্ববর্তী স্থানে ডেপ্লয়েড ৩ ইস্ট বেঙ্গলের সদস্য হিশেবে। আমি খেয়াল করলাম মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধান সত্ত্বেও আমাদের পূর্বে আসা নমপেনের বন্ধুরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত! আমাদেরকে গাড়ী হাঁকিয়ে তারা নিয়ে যাচ্ছে নমপেনের যত্রতত্র – রাজ প্রাসাদে, সিলভার প্যাগোডায়, সেন্ট্রাল মার্কেটে অথবা ওয়াট নম নামের বৌদ্ধ মন্দিরে!
নান্দনিক রাজপ্রাসাদ আর সিলভার প্যাগোডার সামনেই টনলে স্যাপ সরোবর। আমরা বাঙ্গালী অফিসাররা সবাই থাকি হোটেল প্যারাডাইস নামের একটা বহুতল হোটেলে। বায়েজিদের সাথে আমার সখ্যতা অনেকদিনের। মাঝে মধ্যেই সন্ধ্যের পর অন্যেরা যখন ‘পাব’-এ যায় আনন্দ ফুর্তি করতে অথবা ইউ এন এর চকচকে গাড়ীতে করে লং ড্রাইভে আমরা দুই বন্ধু মিলে ৩ চাকার সিক্লুতে করে চলে যাই রাজ প্রাসাদ আর সিলভার প্যাগোডায় অথবা সামনের মাঠ পেরিয়ে ‘টোনলে স্যাপ’ সরোবরের ওপর ভাড়া করা বোটে বসে থাকি গভীর রাত পর্যন্ত। কয়েকদিন আগে ইউ এন থেকে বিভিন্ন দেশের মিলিটারি অফিসারদের নিয়ে একটা দল গঠন করে দেয়া হয়েছে। এই দলের কাজ হবে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন স্থানে ডেপ্লয়েড সামরিক পর্যবেক্ষকদল এবং বিভিন্ন দেশের সেনা ইউনিটগুলোকে কম্বোডিয়ায় সংঘর্ষের ইতিহাস, সামাজিক কালচার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা প্রদানের। আমাদের বায়েজিদকে এই আন্তর্জাতিক দলে সদস্য হিশেবে নেয়া হয়েছে ‘কম্বোডিয়ায় সংঘর্ষের ইতিহাস’ অংশটুকু সম্পর্কে অবহিত করানোর জন্যে। ফলে আমার জন্যে একটা চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মেকং অববাহিকা তথা ইন্দোচীনের সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার!
মেকং নদী এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়ে ইন্দোচীনের ১০০টা স্থানীয় ও উপজাতিগত জাতিসত্তার প্রায় ১০ কোটি লোককে উপকৃত করছে। প্রতি বছর, এই নদী থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ টন মাছ ধরা হয় যা উত্তর সাগর থেকে ধরা মাছের চারগুণ। মেকং নদীর অববাহিকার মানুষেরা মূলত মংগোলয়েড নৃগোষ্ঠির, বিশ্বাসে বৌদ্ধ ও প্রকৃতি উপাসক। একেবারে শুরুতে আমরা যাকে কম্বোডিয়া বলি সেখানে ছিল ফুনানদের রাজত্ব। ষষ্ঠ শতকের দিকে এখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ‘এঙ্কর’রা যারা তৈরি করেছিল বিখ্যাত মন্দির ‘এঙ্কর ওয়াট’। এদের সাতশো বছর পরে এখানে রাজত্ব কায়েম করে চাইনিজ খেমাররা। আজকের দক্ষিন ভিয়েতনামের একটা বড় অংশই এই খেমারদের দখলে ছিল। অবশেষে ঊনিশ শতকে ফরাসী ঔপনেবেশিকরা ভিয়েতনাম, লাওস আর কম্বোডিয়ায় তাদের উপনিবেশ তৈরি করতে সমর্থ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৩ বছর কালের জন্য জাপানীরা হস্তগত করে এই ইন্দোচীন উপদ্বীপ। ১৯৪৫ সালে তারা পরাস্ত হলেও প্রাক্তন উপনিবেশগুলো তাদের পুরাতন ইউরোপিয়ান মনিবদের কাছে ফিরে যেতে বিশেষ আপত্তি তোলে। এর একটা কারণ তারা দেখেছে উদীয়মান এশিয়ান জাপানী শক্তির কাছে ইউরোপিয়ানরা কি করুণভাবে পরাস্ত হয়েছিলো। দ্বিতীয় কারণ ছিল এই দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান আর তৃতীয় কারণ ছিল চীন দেশে কমিউনিস্টদের উত্থান। এই প্রেক্ষিতেই বছর তিনেকের মতো লড়াই করে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দাবী মেনে নেয় ওলন্দাজরা। বার্মা ছেড়ে যায় ব্রিটিশরা। আর ঘাঁটি গেড়ে বসে ফিলিপাইনকে স্বাধীনতা দেয় আমেরিকানরা। তবে এর মধ্যে ফরাসীরা সবরকম দাবীদাওয়া অগ্রাহ্য করে ইন্দোচীনের আধিপত্য ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ শুরু করে দেয়। আমেরিকা মুখে স্বাধীনতার কথা বললেও ফরাসীদের পুরো সমর্থন জুগিয়ে গেছে ১৯৫৪ সালে দিয়েনবিয়েনফু লড়াইতে পরাজয়ের আগ পর্যম্ত। তার পরে তারা নিজেরাই তাদের তাঁবেদার দিয়েম সরকারের পিছনে কলকাঠি নেড়েছে এবং ১৯৬১ সালে টনকিন উপসাগরে এক ভুয়া ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে করে নিজেরাই যুদ্ধে জড়িয়ে পরে যা চলবে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। আমেরিকানদের আচরণের একটা কারণ ছিল মুল চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নিরংকুশ বিজয়। আমেরিকানদের ধারণা ছিল ভিয়েতনামে কমিউনিস্টদের ঠেকানো না গেলে একসময় তারা মালয় উপদ্বীপের দক্ষিনে মালাক্কা/ সিংগাপুর পর্যন্ত চলে আসবে। ফলে, ফরাসীরা চলে যাবার পরে দিয়েমের ডানপন্থী আর হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধ তুঙ্গে ওঠে।
১৯৫৫ সালে জেনেভার এক শান্তিচুক্তিতে ভিয়েতনামকে দু’ভাগ করার কথা উল্লেখ করা হয়। উত্তরের রাজধানী হবে হ্যানয়, সেখানে কমিউনিস্টদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া হয় আর দক্ষিনে সাইগন (এখন হো চি মিন সিটি)। কথা ছিল ৫৬ সালের মধ্যে নির্বাচন হবে এবং দু্ই ভিয়েতনাম এক হয়ে যাবে। কিন্তু আমেরিকানদের পরামর্শমতো রিপাবলিক অভ ভিয়েতনামের (দক্ষিন ভিয়েতনাম) প্রেসিডেন্ট নগো দিন দিয়েম ওই নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে অস্বীকার করেন। আর তার পরই উত্তর ভিয়েতনাম থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দক্ষিনের অঞ্চলে কমিউনিস্ট ভিয়েতকং (সংক্ষেপে ভি সি) গেরিলারা তাদের অ্যাকশন শুরু করে যাদেরকে চীন/সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব উদারভাবে সাহায্য করে গেছে। মজার কথা হলো যখন ৫৯-৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চিনের সম্পর্কের চিড় ধরে তারপরেও কিন্তু চীন তাদের এলাকা দিয়ে সোভিয়েত অস্ত্র উত্তর ভিয়েতনামকে পৌঁছে দিত।
১৯৬৮ সালেই ঘটে গিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাসমুহের একটা। বিখ্যাত ‘টেট অফেন্সিভ’। চৈনিক নিয়মে চান্দ্র বৎসরের শুরুতে একসপ্তাহ উৎসব পালন করে থাকে এই অঞ্চলের মানুষজন। সেই টেট উৎসবকেই ভিয়েতকং গেরিলারা বেছে নেয় দক্ষিন ভিয়েতনামে সরকারী দফতর আর আমেরিকান ঘাঁটিগুলোতে অতর্কিতে যুগপৎ হামলা চালানোর জন্য। ১৯৬৮ সালের ৩১ জানুয়ারি, ভোরবেলা হাজার হাজার গেরিলা একই সাথে দক্ষিন ভিয়েতনামের বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টগুলোতে হামলা চালাতে শুরু করে দেয়। এমন কি সাইগনের আমেরিকান অ্যাম্বেসিও কয়েকঘন্টার জন্য তাদের দখলে ছিল। আর হুয়ের কাছে ব্যাটল অফ খেসান তো ছিল প্রায় একটা এপিক লড়াই!
যদিও এই ট্যাকটিক্যাল দৃষ্টিতে দেখলে পুরো অপারেশনটাই একেবারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং প্রচুর লুকিয়ে থাকা গেরিলা ইউনিট তাদের গোপনীয়তা হারিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসতে বাধ্য হয় যাদেরকে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয় আমেরিকানরা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিতে দেখলে এটা ভিয়েতনাম যুদ্ধে এটা একটা অন্যতম ওয়াটারশেড, গতিপথ পরিবর্তন। টেট অফেন্সিভের পরে ‘দক্ষিন ভিয়েতনাম খুবই শান্ত ও স্থিতিশীল আছে’ বলে আমেরিকান প্রপাগান্ডার কাছা খুলে যেতে থাকে তখন থেকেই। যদিও এই প্রাণঘাতী লড়াই চলতে থাকবে আরো সাত বছর, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই ‘টেট অফেন্সিভ’ এর সময়েই কমিউনিস্টরা উত্তর থেকে শতশত কিলোমিটার দীর্ঘ জঙ্গলাকীর্ণ, পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে দক্ষিনে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ পাঠিয়েছিল, যেগুলোর নাম একসাথে ছিল ‘হো চি মিন ট্রেইল’। আমেরিকানরা নির্বিচারে বম্বিং করেছে এইসব ট্রেইল আর উত্তর ভিয়েতনামের ঘাঁটিগুলোর উপরে। লাওস, কম্বোডিয়াতে তখনও রাজতন্ত্র ছিল। তবে লাওসে ‘পাথেট লাও’ গেরিলারা সরকারী সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখছিল আর কম্বোডিয়াতে প্রিন্স সিহানুক সার্কাসের দড়াবাজের মতো একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে হেলে তাঁর দেশকে নিরপেক্ষ ও যুদ্ধের বাইরে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা নমপেন সরকারের অনুমতি না নিয়েই কম্বোডিয়াকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল এবং তাদেরকে ঠেকাতে আমেরিকানরা বম্বিং করছিল ক্যাম্বোডিয়ার উত্তর অংশে। এরই পরিনতিতে পরবর্তী দু’বছরের মধ্যেই ক্ষমতা হারিয়ে গৃহবন্দী হয়ে পড়বেন নরোদম সিহানুক আর খেমারুজ বাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম রক্তপাতগুলো একটার সূচনা করবে কম্বোডিয়ার মাটিতে!
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার খাতা
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৯ এপ্রিল ২০১৫
মেকং এর নাকফুল (৩য় পর্ব)
মেকং এর ঘোলা জল
“তারা আমাদের বলে গেলো হারানো দিনের সেই অনুপম স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি
আমরা অনুভব করলাম আবার সেই সব হারানো গল্প
যা আমরা এতাবৎকাল হারিয়ে এসেছি
হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি ফিরে পাবনা
জেনে কখনো আর…..
ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর
সেইসব জ্যোস্নার ঝরাপাতার কথকতার দিন ফিরে পাবো না আর।” – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আমি এখনো স্বপ্নময়তার মধ্যেই বসবাস করছি। যদিও ‘টোনলে স্যাপ’ এর রহস্য নীল পানিতে বোটের ওপরে মায়াবী চাঁদের রাতে ভাসতে ভাসতে আমি আর বায়েজিদ এই পুরো এলাকার ইতিহাস আর ঐতিয্যের অনেক টুকুই ইতিমধ্যেই খনন করে ফেলেছি, তবুও কম্বোডিয়ার নৃশংস ইতিহাস বা বর্তমান পর্যন্ত এর বিন্যাশ কিছুই আমার জানা হয়নি। আমার চোখে শুধুই এদেশের নয়নাভিরাম দৃশ্যপট! নমপেনে আমরা দুজনে মিলে কম্বোডিয়ার ইতিহাস সম্পর্কিত ইংরেজিতে লেখা কোন বই পুস্তক পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজতে বের হয়েছিলাম অনেকবার, কিন্তু কোন বই পুস্তকই খুঁজে পাইনি শুধুমাত্র কম্বোডিয়ান খেমার ভাষায় অনুদিত সম্ভবত থাইল্যান্ড থেকে আসা কিছু চিত্রিত ‘কমিক’ বই ছাড়া। দোকানীদের জিজ্ঞেস করতেই তারা জানিয়েছে ‘পলপট’ এর সময়ে দেশের সকল বই পুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে! আমি ভীষণ অবাক। এরকম একটা অপূর্ণ অবস্থাতেই আমার বদলী হয়েছে নমপেন থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে লাওস সীমান্তবর্তী STUNG TRENG প্রভিন্সে। আগামী এক বছর সময়কালে আমিই হবো একমাত্র বাঙালী মেকং তীরবর্তী এই নির্জন নদীতীরে।
১৯৯৩ সনের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। আমার টিম লিডার মালয়েশিয়ার লেঃ কর্নেল পাক ওয়ান চেক, আমি এবং আমাদের দোভাষী কম্বোডিয়ান নারা জাতিসঙ্ঘের হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছি STUNG TRENG-এ। চীনা-মালয় শঙ্কর বংশোদ্ভূত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার যিনি বাংলাদেশের মিরপুর স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স করেছেন! প্লেনে ওঠার পরেই আমাকে বিদ্রুপ করে বললেন, “ আসাদ, আমি তোমাদের দেশে স্টাফ কোর্স করার সময়ে খেয়াল করেছি যে, তোমরা বাঙালিরা ‘ধন্যবাদ’ বলতে কার্পণ্য করো !” আমিও ছাড়ি না তাকে ! বলি, “ আপনাদের ফেস গুলো তো বাঙালিদের মতন এক্সপ্রেসিভ না তাই আপনাদের শব্দ ব্যবহার করে ভাব প্রকাশ করতে হয়!!” নারা মধ্যবয়সী একজন কম্বোডিয়ান, যে থাইল্যান্ডের রিফিউজি সেন্টারে থাকার সময়ে ‘পাব’ গুলোতে ব্যান্ডের ইংরেজি বা থাই গান করতো। কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধে সে বউ, ছেলে, মেয়ে সবাইকে হারিয়েছে। বর্তমানে এই যুদ্ধ বিরতির সময়ে সে নমপেনের কোন এক পরিবারহারা মহিলার সঙ্গে আবার ঘর বেঁধেছে। প্রথম থেকেই সে আমার সঙ্গে ফ্রেন্ডলি হবার চেষ্টা করছে। আমারও ভাল লাগছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন একজনকে পেয়ে যার সাথে মন খুলে কথা বলা যাবে। আমাদের টিমে পরবর্তীতে আরও কয়েকজন জয়েন করবে – একজন আইরিশ মেজর, একজন ফ্রেঞ্চ মেজর, একজন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন এবং একজন চাইনিজ ক্যাপ্টেন! তবে সবাইকে ছাড়িয়ে নারাই হয়ে উঠবে আমার একমাত্র আন্তরিক জন!
নীচে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত সবুজের ওপর দিয়ে লো ফ্লাই করে আমাদের হেলিকপ্টার উড়ছে! মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে চারপাশে এলোমেলো গড়ে ওঠা পাতার ছানি দেয়া কিছু মাচাংমতো চৌচালা ঘর। দুতিনটি ঘরের গুচ্ছ পরস্পর হতে বিপরীতমুখী হয়ে মাঝখানে বেশ কিছু জায়গা খালি রেখে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। গ্রামের চারপাশে বনাঞ্চল এতই গভীর যে মনে হয়, ছন, বাঁশ ও গোলপাতার পল্লিখানি সবুজের কুলহারা সায়রে ধূসর দ্বীপ হয়ে ভাসছে। প্রায় ৩ ঘণ্টা সবুজের ওপর দিয়ে চলার পর রাশিয়ান হেলিকপ্টার চালক আমাদেরকে বলল যে আমরা STUNG TRENG এর পাশের মেকং এবং সেকং নদীর ওপর দিয়ে উড়ছি। আমি নীচে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুটো নদী একসাথে এসে মিলেছে। তবে নদী দুটো একসাথে মিলে গেলেও তাদের স্রোতের রঙ মেলেনি! সেকং এর রঙ ঘন নীল আর মেকং এর রঙ ঘোলাটে- আমাদের যমুনা নদীর পানির মতন। আমাদের ক্যাম্প হবে মেকং এর পাড়ে ‘থালা বারিওয়াত’ নামের ডিসট্রিক্ট সদরে! আমি মনে মনে খুশিই হলাম কারন নীল জল আমার কাছে অচেনা লাগে! তারচেয়ে আমার ছোটবেলার ঘোলা পানিই ভাল! নদীটির দুই তীরে নিবিড় সবুজ বনানী। পাড়ে বালুকাময় চর। কোথাও নদীর তীরে বাঁধা জনহীন দুতিনখানা নৌকা। কোথাও নাওয়ে বসে খেলছে বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েরা। আমাদের নীচ দিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে নদীজল ছলকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তিনটি হাতি।ম্যাপে দেখেছি STUNG TRENG এর পাশের প্রভিন্স ‘রত্নাকিরি’ আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের মতন পাহাড়ি জায়গা, সেখানে অভয়ারণ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় হাতিরা!
STUNG TRENGএ লাঞ্চ করেই আমরা দুপুরের পর ফেরি যোগে রউনা দেই ‘থালা বারিওয়াত’ এর উদ্দেশ্যে। দুটো ইঞ্জিনের বোটকে পাশাপাশি বেঁধে ওপরে কাঠের প্লাটফর্ম দিয়ে এই ফেরি তৈরি করা হয়েছে। আগামী এক বছর আমরা এই ফেরিতে করেই নিবিড় গ্রাম থেকে বার বার ফিরে আসব STUNG TRENGএ অথবা যাব অন্য কোথাও! ফেরি থেকে নামতেই একটা বিশাল ধূলিধূসরিত প্রকাণ্ড রাস্তা চলে গেছে অরন্যের গভীরে। এই রাস্তা জুড়েই চলবে আমাদের সকল অপারেশন কার্যক্রম। দুপাশে এলিফ্যানট গ্রাসে ছাওয়া রাস্তাটা দেখেই আমার ‘হচিমিন ট্রেইল’ এর কথা মনে পরে গেল। আর একটা চিকন রাস্তা নদীর পাড় দিয়ে ‘থালা বারিওয়াত’ ডিসট্রিক্ট অফিস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। উরুগুয়ের একটা ব্যাটালিয়ন আস্তানা গেড়েছে এখানে জাতিসঙ্ঘের হয়ে। পথের ওপরের একটা ভাঙ্গা ব্রিজকে মেরামত করছে একটা সেনাদল। পাশেই ভরা মেকং এর পানি বাদ দিয়ে এরা গাছের ওপরে একটা ড্রাম ফিট করে সবাই দিগম্বর হয়ে স্নান করছে। দেখে মনে হচ্ছে আমাজনের বনে জলকেলিতে মেতেছে বন্য বানরেরা! কর্নেল পাক ওয়ান বললেন, “ মিশন করতে এসেছে এশিয়াতে, আর ভাব করছে এমন যে এরা তাদের নিজের দেশেই আছে! আমি কালই যাব ইউনিট অধিনায়কের কাছে এবং তাকে বলব এসব বেলেল্লামি বন্ধ করতে!” মেকং নদীর পারে ডিসট্রিক্ট অফিসে আমাদের অফিস এবং বাসস্থান দুটোরই ব্যবস্থা করা হয়েছে! এখানে আসার পর আমার প্রথম শিক্ষণীয় হল, যে কোন ধরনের খাবারের সঙ্গে নিজেকে এডজাস্ট করে নেয়া! কারন আমি জানি আমি রান্না করতে পারবনা। দ্বিতীয় যে কাজটা আমি শিখলাম সেটা হল ইন্টারপ্রেটার নারার কাছ থেকে কয়েকটা অতিপ্রয়োজনীয় কম্বোডিয়ান খেমার শব্দ শিখে নেয়া। আসলে আমি আনুসঙ্গিক বিষয়ে এতোটাই বুদ হয়ে রয়েছিলাম যে, আমার মনেই হচ্ছিলনা আমাকে বিশ্ব ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে কোন পরাশক্তির হয়ে একটা রোল প্লে করার জন্যে এখানে পাঠানো হয়েছে। আমি আমার এই অবস্থাটা আরও বুঝতে পারি আমার কয়েকটা ডায়েরি এন্ট্রি হতে, যদিও ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিলনা!
০৭ মে ১৯৯৩। আজই ক্যাম্পে আমার প্রথম দিন। টিমের অপারেশন রুম সেট করার জন্যে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমি ঘুম থেকে উঠেই কয়েকটা ম্যাপ নিয়ে বসে আছি। মেজর বারত্রান্দ পাশের বারান্দায় টেপ রেকর্ডারে তার ব্রিটিশ প্রেমিকার কাছে চিঠিতে যা লিখবেন তা রেকর্ড করছেন। তিনি ইংরেজি বলতে বা লিখতে জানেন না, তার পরেও তার প্রেম হয়েছে প্যারিসে বসবাসকারী এক ইংরেজ মেয়ের সাথে! আমি রুমের ভেতর থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরের মেকং এর দিকে তাকিয়ে আছি। নদীটা দেখতে অনেকটা আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে যমুনার শাখা নদীর মতন। একই রকম ঘোলাটে আর স্মৃতিময় এর জল!
২৮ মে ১৯৯৩। বাইরে চমৎকার রোদ ওঠেছে ! সকালের উজ্জ্বল নরম আলোয় চারদিকটা হলদে-সবুজ! আমার বাসার একশো গজ দূরের ক্ষেত থেকে এক খেমার ভুট্টা তুলছে ! দুই তিন দিন আগে আমাদের দোভাষী নারার সাথে মেকং পারের মাচার তৈরি ছোট এক কুড়ে ঘরে বেড়াতে গিয়েছিলাম! এক থাই মেয়ে যে থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে থাকার সময়ে খেমার এক যুবকের সাথে প্রেমে জড়িয়ে গিয়ে বিয়ে করে পালিয়ে এসে এখানে বাসা বেঁধেছে -তার বাসায় ! সেই মেয়ে আমাদেরকে যত্ন করে সিদ্ধ ভুট্টা আর বাঁশের ঠোঙ্গায় তৈরি sticky rice খাইয়েছে! নারাকে খাইয়েছে রাইস ওয়াইন আর আমাকে ক্যান কোক! গতকাল বিকেলে সে আমাদের ভাড়া করা বাসায় এসে আবার আমাকে অনেকগুলো সিদ্ধ ভুট্টা দিয়ে গেছে ! এটা নিয়ে রাতে টিম ক্যাপ্টেন মালয়েশিয়ান কর্নেল পাক ওয়ান এবং আইরিশ মেজর ডিয়ারম্যুইড আমার সাথে ফান করেছে! কিন্তু আমি জানি নিজের সমস্ত সম্পর্কের বাঁধন চিরতরে ছিন্ন করে শুধুমাত্র ভালবাসার কারনে এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে চলে আসা এই মেয়েটি তার বর্তমান ভীষণ একাকী জীবনের নির্জনতা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে নারার সাথে কিছুক্ষন গল্প করার জন্যেই এসেছিল, কারন নারাও একসময়ে থাইল্যান্ড এর শরণার্থী শিবিরে ছিল এবং থাই ভাষায় সে খুব পারদর্শী ! আমার জন্যে সিদ্ধ ভুট্টা নিয়ে আসাটা একটা উপলক্ষ মাত্র !
০৪ জুন ১৯৯৩। সকালের মৃদু আলোতে মেকং নদীর পারে হ্যামক ঝুলিয়ে তার ওপর শুয়ে শুয়ে রুড ইয়ার্ড কিপ্লিং এর ‘কিম’ নামক উপন্যাস পড়ছি ! এমন সময়ে দুই মাতাল কম্বোডিয়ান যুবক/ কিশোর আমাকে মাঝখানে রেখে গোলাগুলি শুরু করে দিল! একজন আমার এত কাছে থেকে যে তার এ কে ৪৭ এর কার্তুজ গুলো আমার শরীরের ওপর এসে পরছিল! আমি হ্যামক থেকে লাফ দিয়ে নীচের ভুমিতে শুয়ে পরে নিজেকে রক্ষা করলাম! এদের প্রায় সবার কাছেই অস্ত্র আছে এবং কোন কারনে মন বেশি খারাপ হলে গোলাগুলি করে আনন্দ অর্জনের চেষ্টা করে! অবশ্য ঘটনার পর তদন্তে যে সত্যটা বেরিয়ে এলো সেটা হল অতি প্রাচীন সত্য! এক মেয়েকে দুইজনে ভালবাসার কারনে উপরোক্ত সংঘর্ষ ! একজন স্পট ডেড ! আমার টিম লিডার আমাকে বললেন, “ তুমি আর ঐ কম্বোডিয়ান কিশোরীদের সাথে কথা বলবেনা ! আমার কথা না শুনলে তোমারও একই পরিনতি বরন করতে হবে!” আমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম !
৩০ জুন ১৯৯৩। আজ ঘুম থেকে জেগেই দেখি বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি – একেবারে মুষলধারে! গত কয়েকদিনও প্রবল বৃষ্টি হয়েছে ! মেকং এর পানি ফুলে ফেঁপে একাকার এবং ভীষণ ঘোলা! আমার কার যেন একটা কবিতার লাইন মনে পরে গেল – “ নদীর জল এতো ঘোলা যে হারানো নাকফুলের হদিস করতে আর কেউ জলে নামবে না !” কর্ণফুলী নদীর কথা! বিদেশে থাকলে সবারই মনে হয় এই তুলনা গুলো বেশি করে মনে পরে ! দারুন স্রোতের মুখে ঘোলা পানিতে কাঠের গুড়ি আর আবর্জনা ভেসে যাচ্ছে ! গোসল করতে আমি প্রায়ই মেকং এ নামি ! আমি আর নারা সাঁতার কাটতে কাটতে মধ্য নদীতে চলে যাই! আজ নদীতে সাঁতার কাটতে চেয়েও মত পালটালাম! আমাদের বাসার পাশে তৈরি মেইক-শিফট শাওয়ারের বিরাট ট্যাঙ্ক উপচে পরছে! এখানেই গোসল সেরে নিলাম আজকের মতন! CPAF শিবিরে আজ কোন নতুন খবর নেই! ক্যান্টনমেন্টের অধিকাংশ সৈনিকই নাকি চাষাবাদের জন্য গ্রামে চলে গেছে! কিছু অস্ত্র জমা নিয়েছি আমরা, কিন্তু তা পরিমানে খুবই কম এবং বেশীর ভাগই জং ধরা পুরনো অস্ত্র ! দুপুরে ফ্রেঞ্চ মেজর বার্ত্রান্দ জানালেন জাতিসংঘ শান্তি চুক্তি ঠিক মতন না মানার কারনে NADK (খেমারুজ বাহিনি) এর ওপর অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করবে বলে জানিয়েছে !
৫ জুলাই ১৯৯৩। খুব চমৎকার চাঁদ উঠেছে আজ রাতে! রাত সাড়ে নয়টার দিকে আমার বাসার সামনে মেকং এর পারের একটা তেতুল গাছ আর একটা নাম না জানা গাছের সাথে হ্যামক টাংগিয়ে শুয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ আমি আর নারা! আমাদের বাসার মালিক মেয়েটির নাম মম! সে এক ছেলের সাথে প্রেম করে লিভ টুগেদার করে! মম আর তার প্রেমিক এসে আমাদের সাথে গল্প করে গেছে অনেক্ষন! চারদিকে মাতাল করা পরিবেশ ! চাঁদ গলে পরে মেকং এর জলের ওপর একটা রূপালি আবরন সৃষ্টি করেছে যেন! কালপুরুষটা ঠিক আমার মাথার ওপরে! গাছের পাতার জন্য তার ধনুকটা দেখা যাচ্ছেনা ! মনে হচ্ছিল অতীতের কোন এঙ্কর (ANKHOR) রাজপুত্র যুদ্ধ শেষে চির নিদ্রায় শুয়েছে এই কিছুক্ষন আগে মাত্র! চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের সম্মিলিত শব্দ কিছুক্ষনের জন্য উচ্চকিত হয়ে থেমে যাচ্ছে বার বার! আমার কান ঠিক ওই সময়েই শব্দ নির্ভরতা থেকে সরে যেয়ে ঢুকে পরে স্মৃতির ভেতরে! আমার মনে পরে যায় ছোট বেলায় বাড়ির উঠোনে বাঁশের অথবা বেতের চাটাইয়ের ওপর শুয়ে শুয়ে দিদিমার পাখার বাতাসে রুপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা !
২২ জুলাই ১৯৯৩। সকালে ফেরিতে করে STUNG TRENG গিয়েছিলাম সেক্টর চিফ মিলিটারি অবসারভার এর অফিসে টিমের সবাই। ফিরেছি বিকেল তিনটের দিকে! বিকেলে কিছুই করার নেই ! ছবি আঁকার কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসলাম ! বিষয় নিয়ে ভাবছি! এমন সময়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল ছবি! এই কিশোরী মেয়েটা আমাদের রান্না করে দেয়! সবই কম্বোডিয়ান ডিশ! আমার খারাপ লাগেনা! তবে সবচেয়ে বেশি এনজয় করে ফ্রেঞ্চ মেজর বার্ত্রান্দ ! আমরা সবাই মিলে যা খাই সে একাই তার চেয়ে বেশি খায়! ছবি আমি কোন বাংলা বা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করলে তার প্রতিধ্বনি করে! ভিনদেশী নতুন শব্দ শেখার চেয়ে এটা করেই বেশি আনন্দ পায় বেশি! ছবি আঁকার বিষয় বস্তু হিশেবে ওকেই বেছে নিলাম – যদিও আমি জানি যে ওর ছবি হবেনা ! ছবির ছবি হয়নি, তবে ওর ছেয়ে সুন্দরী এক খেমার মেয়ের ছবি হয়েছে! ছবি ভীষণ খুশি – সম্ভবত আঁকার সাবজেক্ট হবার আনন্দে!
৩১ জুলাই ১৯৯৩। বাইরে চমৎকার রোদ ওঠেছে ! আমার রুমের সামনে দিয়ে একপাল গরু চড়ে বেড়াচ্ছে! চমৎকার বাতাস! প্রজাপতির উড়া উড়ি! নদীর রঙ রূপালী ! অথচ আমার মন ভাল নেই! কর্নেল পাক ওয়ান, মেজর বার্ত্রান্দ এবং নারা সকালে হেলিকপ্টারে করে নমপেনে গিয়েছে! এই মাত্র CPAF ক্যান্টনমেন্ট থেকে পর পর ১৫/২০ টা গুলির শব্দ ভেসে আসলো ! আমি জানি ওরা এমনিতেই গুলি খরচ করছে! মন খারাপ হলেই করে! এই দেশে পাখি নেই বললেই চলে ! চারদিকে এত সবুজ অথচ পাখি নেই, কেমন অবাক করা ব্যাপার! গতকাল পেট্রলিং এ যাবার সময়ে একটা ঘুঘু পাখি ডাকছিল যা আমার ভীষণ ভাল লেগেছে! আমাদের দেশে এত পাখি একসাথে ডাকে যে, কিচির মিচির শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যায় না ! এখানে পাখি ডাকেই না ! একটা ডাকলে মনে হয় কেউ উঁচু গলায় গান ধরেছে! এই মুহূর্তে আমার সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্য গ্রন্থের কয়েকটা লাইন মনে পরছে – পাখির প্রসঙ্গটা আসাতেই বোধ হয়!
“ আধান শীতল পাটি ভরা এক অমাবশ্যা নিয়া
দেখি রোজ উত্তরের একদল ধলা হাঁস নামে,
বুকের ভেতরে চুপ , তারপর আঁত খা উড়াল –
এদেশে মানুষ নাই, অন্য খানে তাই যায় গিয়া।“
এখানকার পাখিরা বোধহয় অনেক আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে! পাখিরা যুদ্ধ বা গুলির শব্দ ভালবাসেনা ! আমার জানা মতে পাখি প্রজতির ভেতরে শকুন আর বাজপাখিরাই যুদ্ধ ভালবাসে !!!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২১ এপ্রিল ২০১৫
মেকং এর নাকফুল (৪র্থ পর্ব)
“এই মৃত্যু উপতাক্যা আমার দেশ না !”
ইলেকশন রেজিস্ট্রেশন টিম নিয়ে আমি এবং ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন মাইক এক জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামের পাশের মাঠে হেলিকপ্টার নামিয়েছি। হেলিকপ্টার থেকে নামতেই দেখি খেমারুজদের এক বিশাল দল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমাদের হেলিকপ্টার ঘিরে আছে! আমি ইন্টারপ্রেটার নারাকে ওদের সাথে কথা বলতে হবে জানাতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বলল, খেমারুজরা তার স্ত্রী এবং মেয়েকে মেরে ফেলেছে। শুধুমাত্র সে পালিয়ে বেঁচে থাইল্যান্ড চলে গিয়েছিল। ওদের সাথে কথা বলতে যাওয়ার সাহস তার নাই। আমি দেখলাম আমরা যদি এখন হেলিকপ্টার উড়িয়ে চলে যাবার চেষ্টা করি, তাহলে নির্ঘাত ওরা হেলিকপটারে রকেট লাঞ্ছার মেরে দেবে এবং আমাদের নিশ্চিত মৃত্যু! এই পরিস্থিতিতে একমাত্র আমিই সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি, কারন আমি কিছুটা হলেও কম্বোডিয়ান কথা বলতে শিখেছি। আমি ভয়ে ভয়ে হেলিকপ্টার থেকে নেমে ওদের একজনকে খেমার ভাষায় ‘সকসো বাই’ (কেমন আছো ?) সম্বোধন করে ডাকলাম ! আমাকে ওদের ভাষায় কথা বলতে দেখে ওরা সবাই অবাক এবং ভীষণ খুশী।! নারা যখন দেখল ওরা আমার সাথে ফ্রেন্ডলি বিহেভ করছে, তখন সেও সাহস পেয়ে নীচে নেমে এলো। আমি নারাকে বললাম, “ কোন ধরনের কনফ্লিকট-এ যাওয়া যাবে না। ওরা যা চাইবে আমরা তাই করবো। এমনকি আমাদেরকে এবডাকট করতে চাইলেও কোন ধরনের রেজিসটেন্স দেয়া যাবে না!” খেমারুজ দলের লিডার আমাকে বলল, “ পিস প্রসেস ইমপ্লিমেন্টেশনের বিষয়ে তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে।” আমি নারাকে বললাম লিখতে। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত আমরা ওদের পর্যবেক্ষণগুলো লিখলাম। এবং পরিশেষে তাদেরকে বললাম, “ এই প্রতিবেদনটি আমি ফিরে যেয়েই নমপেনে UNTAC সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেব।” তারা আমাকে জানালো ইলেকশনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে দেবে না। আমি জেনারেল নিয়াজির মতন সুবোধ বালকের মতন তাদের সমস্ত ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ বা আত্মসমর্পণ করলাম ! ফলে, সে যাত্রায় আমার ভাষা জ্ঞানের কারনে আমরা সবাই বেঁচে গেলাম !
তবে আমি আর একটু হলেই ভুল করে ফেলেছিলাম যা পুনরায় আমার এবং আমার সাথের সবার জীবনকে বিপন্ন করে ফেলতে পারতো।
খেমারুজদের সাথে আলাপচারিতার শেষ অংশে আমি নারাকে ইংরেজিতে বললাম, “ ওদেরকে বল যে, আমাদের পক্ষ থেকে ‘লাল খেমার’দেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ!” নারা আমাকে ফিসফিস করে বলল, “ওদের সামনে ‘লাল খেমার’ শব্দটা ভুলেও উচ্চারন করা যাবেনা, ভীষণ ক্ষেপে যাবে!” ফেরার পথে আমি নারার কাছে বিষয়টার শানেনজুল জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, “ ‘রুজ’ শব্দটা একটা ফরাসি শব্দ যার অর্থ ‘লাল’! কাজেই খেমারুজ শব্দের অর্থ ‘লাল খেমার’। কিন্তু এই নামটা তারা পছন্দ করেনা, কারন নামটা দিয়েছিলেন স্বাধীনতাউত্তর কম্বোডিয়ার প্রথম শাসক প্রিন্স নরোদম সিহানুক, যিনি এদের ওপরে একসময়ে অনেক অত্যাচার করেছিলেন! তারা নিজেদেরকে কমিউনিস্ট গেরিলা হিশেবে পরিচয় দিতেই গর্ব বোধ করে”। খেমারুজ গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ‘পলপট’। তবে এটা তার আসল নাম না, ছদ্মনাম। তার আসল নাম ছিল সালথ সার যে ১৯২৫ সালে কম্বোডিয়ার এক অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছিল এবং বুদ্ধের অহিংশবাদই ছিল তার ছেলেবেলার শিক্ষার অন্যতম ভিত! অথচ পরবর্তীতে এই পলপটের নির্দেশেই লক্ষাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল!
১৯৪৮ সাল। সালথ সার রেডিও ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তে ফ্রান্সে গেছে। সেই সময়টায় গোটা ইউরোপ ছিল মাকর্সবাদ নিয়ে উত্তেজিত। সেই সময়ককার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি মনে করতেন মাকর্সবাদ সর্ব প্রকার সামাজিক রোগের একমাত্র প্রতিষেধক। এমন কী সার্ত্রর মতন নিরাসক্ত মানুষও মাকর্সবাদের আকর্ষন এড়াতে পারেননি। প্যারিসেই মাকর্সবাদে দীক্ষা সালথসারের। সম্ভবত সার্ত্রর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। কম্বোডিয়ায় তখন ফরাসী শাসন। সার্ত্র উপনিবেশগুলোয় ফরাসী শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। পলপট কম্বোডিয়ায় ফেরেন ১৯৫৩ সালে। ফিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভিয়েতনামও লড়ছিল ঔপনেবেশিক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। ভিয়েত কংদের সঙ্গে যোগাযোগ হল পলপটের।
১৯৫৩ সালেই ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিল কম্বোডিয়ার স্বাধীনতাকামী জনগন। নরোদম সিহানুক হলেন রাজা। স্বাধীনতার পরপরই পলপটসহ অন্যদের তৎপরতায় কমিউনিষ্ট আন্দোলন দানা বাঁধছিল কম্বোডিয়ায় যে আন্দোলনের পিছনে ভিয়েতনামের শ্রমজীবি শ্রেনির অগ্রনায়ক হো চি মিন-এর প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল। প্রিন্স নরোদম সিহানুক ছিলেন প্রাচীনপন্থি। তিনি মাকর্সবাদ বুঝতেন না। তিনি নির্মম উপায়ে কমিউনিষ্ট দমন করতে লাগলেন। তবুও পলপটের নেতৃত্বে ষাটের দশকে কমিউনিষ্ট আন্দোলন আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে কম্বোডিয়ায়। ভিয়েতনামের ভিয়েতকংরা তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিল। দুটি প্রতিবেশি দেশের অবস্থা তখন ভয়ানক জটিল। থেকে থেকে মার্কিন বিমান হামলা চলছিল ভিয়েতনামে; সীমান্ত পেরিয়ে এমন কী কম্বোডিয়াতেও বোমা বর্ষন করছিল মার্কিন বোমারু বিমানগুলি । কেননা, মার্কিন প্রশাসন ইন্দোচিনে কমিউনিষ্ট তৎপরাতার মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়!
১৯৬৭ সাল। পলপটের নেতৃত্বাধীন কম্বোডিও কমিউনিস্টরা একের পর এক সিহানুক নিয়ন্ত্রিত সরকারী বাহিনীকে আক্রমন করে করে পযুদর্স্ত করতে থাকে । প্রিন্স নরোদম সিহানুক পালিয়ে চলে যান চীন দেশে।
১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল। ৮ বছর গেরিলা যুদ্ধের পর ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন শহরে প্রবেশ করে। এপ্রিল মাস। সরকারী বাহিনীকে বিধস্ত করে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে প্রবেশ করে। সেই ষাটের দশক থেকেই কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলারা কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। ১৯৭৫ সালে তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন দখল করার পলপট সরকার কম্বোডিয়ার নামকরণ করে ‘ডেমোক্রেটিক কাম্পূচিয়া’। তারপর নানাবিধ সংস্কারে নামে পলপট সরকার ভয়ঙ্কর এক হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯। এই সময়টায় পলপট সরকার কম্বোডিয়ায় শুদ্ধি অভিযানের নামে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারপর ১৯৭৯ সাল অবধি প্রায় ৩০ লক্ষ কম্বোডিয় জনগনের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। এই গনহত্যার অন্যতম কারন ছিল নমপেনবাসীর ওপর খেমার রুজ গেরিলাদের ছিল ভয়ঙ্কর ক্রোধ। খেমার রুজ গেরিলাদের চোখে নমপেনবাসী ছিল পাতি বুর্জোয়া, যারা সব সময় শস্তা ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে, মদ খায়, নাইট ক্লাবে নাচে, আমেরিকান কালচারে আসক্ত, খেতে পছন্দ করে বার্গার ও কোক, দেশের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র টান নাই, যারা বিপ্লবে যোগ দেয়নি, যারা সব সময় কেবল আমেরিকার যাওয়ার ধান্দায় থাকে, গ্রামে যেতে চায় না, গ্রামের মানুষের দারিদ্র নিয়ে ভাবে না, কোন মতে পাশ করে একটা চাকরি পেলেই যারা খুশি। খেমার রুজ গেরিলারা নমপেনবাসীর নাম দিয়েছিল ‘মেকং নদীর বেশ্যা!’
পলপট তার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ করলেন ঠিক এভাবে, “THE SPADE IS YOUR PEN, THE RICE FIELD YOUR PAPER!” কাজেই অস্ত্রের মুখে আমেরিকা-আসক্ত পাতি বুর্জোয়া নমপেনবাসীকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের দিকে । রাস্তার ওপর হাজার হাজার নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা হাঁটছে। এপ্রিল-মে মাসের কড়া রোদ! তৃষ্ণা! ক্ষুধা! বিলাসী জীবন যাপনের কারনে মুটিয়ে গিয়েছিল অনেকেই। হাঁপাতে-হাঁপাতে পথেই মরল অনেকেই। দু’পাশে কারবাইন উঁচিয়ে খেমার রুজ গেরিলারা। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই গুলি! মাঝে মাঝে একটা কালো ট্রাক এসে থামত রাস্তার পাশে। বেছে বেছে খেমারুজ গেরিলারা লোকজনকে তুলে দিত সেই ট্রাকে। তারপর ট্রাকটা চলে যেত ‘টুঅল স্লেঙ্গ’ নামক নির্যাতন কেন্দ্র। টুঅল স্লেঙ্গ-এ বন্দিদের প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত । তারপর মৃতপ্রায় বন্দিদের আবার ট্রাকে তোলা হত। ট্রাক ছুটত ‘চোয়েয়ুঙ্গ এক’ এর দিকে। ‘চোয়েয়ুঙ্গ এক’ ছিল খেমার রুজ গেরিলাদের অন্যতম বধ্যভূমি। প্রায় ২০, ০০০ মানুষকে ওখানে মেরে ফেলা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের পর ওখানকার একটি গনকবরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। মৃত্যুর আগে প্রায় সবাই টুঅল স্লেঙ্গ এ ছিল। বন্দিরা প্রথমে মাঠের ওপর একটা গর্ত খুঁড়ত। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে বন্দিদের গর্তের পাশে দাঁড়াতে বলত খেমার রুজরা। হত্যাযজ্ঞের সময় পলপট সরকার বুলেট খরচ করত না; লোহার রড, এমনকি কখনো কখন কোদাল বা নিড়ানির মতো ভোঁতাও ব্যবহার করে বন্দিদের পিটিয়ে পিটিয়ে মারত, ঠিক যেমন হিটলার ইহুদীদের মারতে গুলি বাঁচানোর জন্যে তাদেরকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকাতেন! খেমার রুজরা এভাবেই তারা গনহত্যার মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে কম্বোডিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। পলপট বিশ্বাস করতো যে তার বিপ্লবকে সার্থক করতে দেশে এত মানুষের দরকার নেই!
ইতিমধ্যেই এককালের সুহৃদ ভিয়েতনামের সঙ্গে ইতিমধ্যেই পলপটের সর্ম্পকে ফাটল ধরেছিল। কারন উগ্র জাতীয়তাবাদে ভোগার কারনে খেমারুজরা ভিয়েতনাম সীমান্তও আক্রমন করছিল এই অজুহাতে যে, ভিয়েনাম নাকি কম্বোডিয়ার পূর্বাঞ্চলের সীমানা গ্রাস করে নিয়েছিল। অতঃপর ১৯৭৮ সাল। ভিয়েতনামী সৈন্যরা কম্বোডিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশের অবশ্য অন্য কারণও ছিল। পলপট সরকার কর্তৃক পরিচালিত অমানবিক গনহত্যা । অপ্রতিরোধ্য ভিয়েতনামী সৈন্যরা দ্রুত নমপেনের দিকে এগিয়ে আসছিল তখন ১৯৭৯ সালে পলপটসহ খেমার রুজরা গেরিলারা থাই সীমান্তের পালিয়ে যায়।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হল পলপটরা সমাজতন্ত্রের নামে কৃষি ভিত্তিক সাম্যবাদ বানানোর যে উদ্ভট তত্ত্ব দিয়েছিল, সেসময়ের কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই একে সমর্থন করেনি। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামে পরাজিত হয়ে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্দোচীন এলাকায় সমাজতন্ত্র কায়েমের ঢল দেখে আমেরিকা ঐ নীতিটি গ্রহন করে এবং একদিকে চীনের বিপরীতে তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়ার বিপরীতে দ. কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের বিপরীতে কম্বোডিয়ার খেমারদের তারা সাহায্য করে। অবশ্য পরবর্তীতে এরাই খেমারুজদের গনহত্যার বিচার করবে!
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট এবং আমার অভিজ্ঞতার খাতা
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৩ এপ্রিল ২০১৫
মেকং এর নাকফুল ( ৫ম এবং শেষ পর্ব )
নস্টালজিয়া
“আমরা সবাই
বলেছিলাম ফিরে আসবো!
এই যেমন রবি তার
নব বিবাহিতা স্ত্রীকে বলেছিল এক দঙ্গল সন্তান নিয়ে আবার তারা ফিরে আসবে মেকং নদীর পারে!
সাহেলকে নিয়ে
হেলিকপ্তারে মেঘের ভিতর আনন্দময় বিহারের সময়ে দুর্ঘটনার আভাস পেয়ে সে মহা আনন্দিত ভাবে বলেছিল, ” এভাবেই, এখানেই মরে যেতে চাই !!”
গুলজার স্যার
ওখান থেকে আদৌ ফিরবেন কিনা সেটা নিয়েই সবার সন্দেহ হয়েছিলো!
বায়েযিদ বলেছিল
কোন এক মায়াবী রাতে আবার ফিরে আসবে এংকর ওয়াটে একাকী!
নমপেনের এর মায়াবতী কিশোরীদের সে বলতেই পারেনি যে সে
চলে যাচ্ছে!
আমি দোভাষী
নারাকে বলেছিলাম, “পরের বার মেকং
নদীর উপর নৌকা ভাসিয়ে গভীর রাতে আমরা শুনব ভাটিয়ালী গান!”
চায়নার ক্যাপ্টেন
শি বলেছিল, ” কম্বোডিয়াতো তার বাড়ি ঘরের মতোই!”
ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন মাইকতো উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছিল,”আই লাইক দিস
কানট্রি!”
আমরা কয়েকজন প্রবল যুবক কি আত্ম বিশ্বাসেই না উচ্চারণ করেছিলাম একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকার !
রবির প্রথমা টেকেনি, দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে সে বেড়িয়ে এসেছে ইনডিয়ার
মানালি থেকে!
মাইক নাকি আমাকে নিতে ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলো, ভাগ্যিস আমার
খোঁজ পায়নি; শুনেছি, ১৯৯৬ পর্যন্ত সে
হংকং-এ ছিল,ব্রিটিশদের শেষ
উপনিবেশ থেকে বিতারিত হবার আগ পর্যন্ত!
সাহেল আর গুলজার
স্যার ইতিহাস হয়ে গেছে প্রত্যাবর্তনের অনেক আগেই!
আমি যুদ্ধ থেকে
পালিয়ে এসে বনানী আট নম্বরে আছি একা;
এসি রুমে বসে
কৃষিকাজে করেছি মনোনিবেশ!
শুধু বায়েযিদ
কম্বোডিয়া নিয়ে অনবরত দেড় যুগ ধরে বই লিখছে!
এখনো নস্টালজিয়া
কাটিয়ে উঠতে পারেনি!”
মানুষের স্মৃতিগুলো খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির! মস্তিষ্কের কোন এক গভীর নির্জনে হিম হয়ে বসে থাকে, মনেই হয়না কোনোদিন কখনোই তারা সেখান থেকে বের হবে! কিন্তু ঠিকই একদিন অনির্দেশ্য কোন এক অভিজ্ঞানের অভিঘাতে নির্ঝরের কলতান নিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কম্বোডিয়ায় আমি ছিলাম ১৯৯৩-৯৪ সালে, দুই দশকেরও বেশি সময় আগে। আমি কখনই ডায়রি লিখিনা, যদিও কম্বোডিয়াতে আমার একটা পারসোনাল নোটবুক ছিল, যেখানে আমি কয়েকদিন টুকিটাকি কিছু লিখেছিলাম; কিন্তু সেগুলো ছিল নিতান্তই আমার মনের কথা! যেখান থেকে আমার ঐ সময়কার কিছু মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কখনই তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কাজেই আমি যখন একটা মুহুর্তিক আবেগের বশে ‘মেকং এর নাকফুল’ নামে একটা লেখা শুরু করে দিলাম, তারপর থেকে আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে প্রবলভাবে বিব্রত!
ক্যাম্প লোকেশনে আমার প্রথম দিন। আমি মেকং পারের ‘থালা বারিওয়াত’ ডিসট্রিক্ট সদর দপ্তরের একটা রুমে বসে আছি। সামনেই ৫০ গজ দূর দিয়ে মেকং প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে তার ঘোলা পানি নিয়ে। এখন বর্ষাকাল। মেকং এর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে কাঠের গুড়ি, গাছের ভাঙ্গা ডাল এবং নাম না জানা কয়েকটা রঙিন ফুল। এই ফুলগুলো হয়তবা উজানের কোন বৌদ্ধ মঙ্ক তার উপাসনার অংশ হিশেবে আজ সকালেই ভাসিয়েছে। নদীর ধার ঘেঁষে একটা পাকা রাস্তা ফেরিঘাট পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার পাশেই ক্লান্ত সমুদ্র সফেন সম একটা অশ্বত্থ গাছ আর নানা রকমের গাছের সারি! নিবিড় বট, তেতুল, দেবদারু আর আমলকী গাছ তারা। আমার পাশের রুমটি ডিসট্রিক্ট চীফের অফিস। অফিসের ভেতরে টেবিলের ওপরে ‘হচিমিনের’ পাতলা শ্মশ্রু মণ্ডিত একটা পাথরের মূর্তি। আমাদের অফিস রুমটা টিনশেড বিল্ডিং এর শেষ কক্ষ। মেকং এর দিকে এর দরজা। বাকি দুইদিকে জানালা। আমি নমপেনের জাতিসঙ্ঘ অফিস থেকে দেয়া কয়েকটা ম্যাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। আমার দৃষ্টি এই মুহূর্তে ম্যাপের ওপরে নিবদ্ধ। এমন সময়ে খেয়াল করলাম আমার জানালার পাশে খিলখিল হাসির শব্দ। আমি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই! একটু পর আবার হাসির শব্দ। এবারে শব্দের সাথে ৪ কিশোরীর উজ্জ্বল আলোকিত মুখ। আমার সাথে সাথেই মনে পরে গেল সুনীলের কবিতার লাইন, “ ঘূর্ণি জলের পাশে একদিন দেখে নিও মুখের ছায়ায় রৌদ্র ভ্রমরীর খেলা!” সবগুলো কিশোরীই একসাথে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “বং স্রলাইন অউন”! ওরা ভেবেছে আমি এই বাক্যের অর্থ বুঝিনা। অথচ গত কয়েকদিনে আমার দোভাষী নারার কাছ থেকে আমি বেশ কয়েকটা খেমার বাক্যই শিখে নিয়েছি! এই বাক্যের অর্থ হল ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’! আমি এর প্রতিউত্তরে কি বলতে হবে তাও জানি! আমিও সাথে সাথেই বলে উঠলাম, “ বং!” মানে হল “আমিও!” মেয়েগুলো ভীষণ অবাক এবং হেসে কুটিকুটি! এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার নাম ‘কিম লিয়াং’ এখানকার ডিসট্রিক্ট চীফের মেয়ে। একটা তার ছোটবোন এবং বাকি দুইজন তার বান্ধবী। সে এসেছে গ্রামের আরেক প্রান্ত থেকে মোটর সাইকেল চালিয়ে। আগামী একবছর এরাই হবে আমার আর নারার গল্পের সাথী। এক সময়ে এরা ইংরেজি শেখার জন্যে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন মাইককে বাদ দিয়ে আমাকেই তাদের টিউটর হিশেবে বেছে নেবে এবং আমিও এদের সাথে আলাপচারিতা থেকেই শিখে যাবো খেমার ভাষায় অতি প্রয়োজনীয় কথাবার্তা, যা আমাদেরকে অন্তত একবার সেইভ করবে মারন্মুখি একদল খেমারুজদের হাত থেকে! এরা কয়েকজন ছাড়াও খেমার ভাষায় মোটামুটি নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারার কারনে এখানকার কিশোর যুবাদের মধ্যেও আমি ভীষণ প্রিয়। যতক্ষণ আমরা ক্যাম্পে থাকি কাজ কর্ম ছাড়া এরা সবাই এসে আমার আর নারার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। আমার টীম লিডার কর্নেল পাক ওয়ান আমাকে নিয়ে শঙ্কিত।
একদিন সকালের মৃদু আলোতে মেকং নদীর পারে হ্যামক ঝুলিয়ে তার ওপর শুয়ে শুয়ে রুড ইয়ার্ড কিপ্লিং এর ‘কিম’ নামক উপন্যাস পড়ছি ! এমন সময়ে দুই মাতাল কম্বোডিয়ান যুবক/ কিশোর আমাকে মাঝখানে রেখে গোলাগুলি শুরু করে দিল! একজন আমার এত কাছে থেকে যে তার এ কে ৪৭ এর কার্তুজ গুলো আমার শরীরের ওপর এসে পরছিল! আমি হ্যামক থেকে লাফ দিয়ে নীচের ভুমিতে শুয়ে পরে নিজেকে রক্ষা করলাম! এদের প্রায় সবার কাছেই অস্ত্র আছে এবং কোন কারনে মন বেশি খারাপ হলে গোলাগুলি করে আনন্দ অর্জনের চেষ্টা করে! অবশ্য ঘটনার পর তদন্তে যে সত্যটা বেরিয়ে এলো সেটা হল অতি প্রাচীন সত্য! এক মেয়েকে দুইজনে ভালবাসার কারনে উপরোক্ত সংঘর্ষ ! একজন স্পট ডেড ! আমার টিম লিডার আমাকে বললেন, “ তুমি আর ঐ কম্বোডিয়ান কিশোরীদের সাথে কথা বলবেনা ! আমার কথা না শুনলে তোমারও একই পরিনতি বরন করতে হবে!” আমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম !
অফিসের কাজে কর্নেল পাক ওয়ান গেছেন নমপেনে। বাকিরা STUNG TRENGএ। আমি নারাকে বললাম, “নারা, আমি কোন একটা কম্বোডিয়ান নাগরিকের বাসায় নিমন্ত্রন খেতে চাচ্ছি। মেন্যু হবে খেমার মেন্যু। টাকা আমি দেব।” নারা ভীষণ খুশী। কিছুক্ষনের ভেতরেই সে একটা ছোট ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে ফেলল। আমরা দুজনে মিলে মেকং এর ভেতরে নৌকা চালিয়ে চলে গেলাম নদীর অপর পাড়ে গভীর বনের ভেতরের এক গ্রামে। কাঠের মাচাং এর ওপরে তৈরি বাড়ি, অনেকটা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাড়িঘরগুলোর মতন। বাড়ীর মালিক আমাদের পরিচিত। অনেকবারই আমাদের অফিসে এসেছে। পৌঁছতেই চিনি ছাড়া পানি পানি চা দিয়ে আমাদেরকে আমন্ত্রন জানানো হল। নারা আর আমি বাড়ীর মালিকের সাথে গভীর গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর গৃহিণী খাবার সার্ভ করল। সবই খেমার ডিশ। পানিতে জবজবে ভেজানো নুডুলস। চায়নিজদের মতন সটীক দিয়ে খেতে হয়। STICKI RICE আর পাকা কলা চ্যাপ্টা করে নিয়ে ভেঁজে দেয়া হয়েছে। আমার কাছে কোন খাবারই ভাল লাগেনি। ফেরার পথে বাড়ীর মালিকের হাতে ৫০ ডলারের একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে আমি নারাকে বললাম আমাদের এই ভেঞ্চারটা যেন কর্নেল পাক ওয়ানকে জানানো না হয়!
বিশ্ব ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে যখন স্নায়ু যুদ্ধের পৃথিবী রুপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্তে ইউনিপোলার পৃথিবীতে, তখন শুরু হয়েছিল এই জাতিসঙ্ঘ মিশন। এই মিশনেই প্রথম বারের মতন জাতিসঙ্ঘের বৃহত্তম ডেপ্লয়মেনট হয়। ৪৫ টি দেশ হতে আনুমানিক ১৬৯৯০ সেনাসদস্য এবং সামরিক পর্যবেক্ষক, ৩৪০০ সিভিলিয়ান পুলিশ, ২০০০ সিভিলিয়ান, ৪৫০ ইউএন ভলান্টিয়ার এবং ৫০,০০০ কম্বোডিয়ান ইলেকশন স্টাফ কাজ করেছিল এই মিশনের জন্যে। অবশ্য এতদ সত্ত্বেও জাতিসঙ্ঘ খেমারুজদেরকে নিরস্ত্র করতে পারেনি, যদিও অন্যান্য গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করন পূর্বক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পেরেছিল। উল্লেখ্য, জাতিসঙ্ঘের অধীনে যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হবার সময়ে পলপট মারা যাবে ১৯৯৮ সনের এপ্রিল মাসে থাই সীমান্তের গভীর জঙ্গলে এক কাঠের বাড়ীতে হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। কিন্তু এই মিশনের ফলে আমাদের ‘নারা’ কি ফেরত পাবে তার তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী এবং দুই মেয়ের নাকফুল ?
আমার মনে আছে ছোটবেলায় বর্ষার সময়ে আমার চাচাতো বোনের একটা নাকফুল হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের বাড়ি আর মুজিবর ভাইদের বাড়ির মধ্যিখানের নিচু জায়গাটায়। ঘোলা বানের পানিতে আমরা কয়েক কিশোর গোধূলি পর্যন্ত এক বিকেল শুধু ডুব সাঁতার দিয়েছিলাম ঐ নাকফুলটাকে ঘোলা পানির নীচ থেকে তুলে আনার জন্যে। আমাদের প্রানান্তকর চেষ্টাতেও আমরা সেই নাকফুল উদ্ধার করতে পারিনি। তারপর বানের পানি সরে যাবার পর একদিন ঠিকই আমি দেখলাম শুকনো বালিতে ঝিকমিক করছে হারিয়ে যাওয়া নাকফুল। ততদিনে আমাদের বোন চলে গেছে তার শুশুর বাড়ীতে ! কম্বোডিয়াও মেকং এর তেমনি এক নাকফুল। এই নাকফুলকে উদ্ধার করতে ইন্দো চীনে ঝরেছে অযুত রক্তধারা ! অবশেষে যখন নাকফুলটাকে পাওয়া গেল তখন নারা’র চোখে শিশির ভিড় করে বসে আছে। একশত জোছনার মতো ছড়িয়ে যাওয়া আলোয় কুড়িয়ে পাওয়া নাকফুল নিয়ে সে এখন খুঁজছে তার অস্তিত্বকে – তার দুই মেয়ে এবং তাদের মাকে!
– মোহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
২৫ এপ্রিল ২০১৫