সমান্তরালের জীবনগুলো
১৯৮৫ সাল।আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। অপারেশনাল ডিভিশন হবার কারনে ২৪ পদাতিক ডিভিশনে বাৎসরিক শীতকালীন যৌথ অনুশীলন অনুষ্ঠিত হয়না। তারপরেও আমাদের ইউনিটের উপ অধিনায়ক মেজর মুহিব! প্রচণ্ড রকমের প্রফেশনাল অফিসার । সেনাবাহিনীর ‘স্টাফ ডিউটিস ইন দ্য ফিল্ড’ বইটা শুনেছি তিনি নিজ হাতে লিখেছেন। তার ভয়ে শুধু আমরা জুনিয়ররা নই, আমার ইউনিটের অধিনায়ক, এমনকি ডিভিশন সদর দপ্তরের এবং অন্যান্য ইউনিটের তারচেয়ে সিনিয়র অফিসারগন পর্যন্ত তটস্থ থাকেন। তিনি আমাদেরকে সেনানিবাসের উত্তরদিকে অবস্থিত ‘টেম্পল হিল’ জায়গাটিতে নিয়ে এসেছেন ১৫ দিনের জন্য এসেছেন যাতে আমরা অপারেশনের ধান্দা করে সেনাবাহিনির প্রশিক্ষনের কালচারটি যাতে ভুলে না যাই। আমার জন্য এটা প্রকারান্তরে আনন্দের পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে, কারন ইউনিটে কোয়ার্টার মাষ্টার হিশেবে চাল, আটা, ডাল আর চিনির হিশাব রাখতে রাখতে গত কয়েকমাসেই আমি সেনাবাহিনীতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। চমৎকার একটা অফিসার্স ফিল্ড মেস স্থাপন করা হয়েছে মাটি খুঁড়ে। ভেতরে হেসিয়ান ক্লথ দিয়ে মেঝে এবং দেয়াল ঢেকে দেয়া হয়েছে। এই হেসিয়ান ক্লথের পিছনেই হান্নান স্যারের নেতৃত্বে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার লুকিয়ে রাখা হয়েছে, যেটা সম্পর্কে মেজর মুহিব জানেননা। এই ক্যাসেট প্লেয়ারটিও বেজে ওঠে গভীর রাতে শুধুমাত্র জুনিয়র অফিসাররা ফিল্ডমেসে ঢুকলেই, যখন মেজর মুহিব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সকাল চারটার দিকে তিনি আবার উঠবেন ইউনিটের পেরিমিটার ডিফেন্স ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা এবং সকালের ‘স্ট্যান্ড-টু’ তে আমরা সকল অফিসাররা সবাই উপস্থিত হয়েছি কিনা তা পরখ করার জন্যে!
পদবী অনুযায়ী আমাকে একটা ৪০ পাউনড এর তাবু দেয়া হয়েছে। আকৃতিতে অনেকটা সিঙ্গল মশারী অথবা কবরের মতন। ভেতরে ঢুকলেই আমার হাঁসফাঁশ শুরু হয়ে যায়। হিচককের সেই কঠিন সিনেমার মতন মনে হয় যেখানে এক জেল খাঁটা আসামী এক বৃদ্ধ মানবিক জেলরক্ষীর সহায়তায় জেলখানা থেকে এক মৃত জেল বন্দীর কফিনে করে বেরিয়ে আসে শুধুমাত্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাসপেন্স আবিস্কার করার জন্যে। নির্ধারিত ছিল মৃতের কফিনের ভেতর থেকে বের হয়ে সে কবরের ভেতরে বসে থাকবে এবং সেই জেলরক্ষী কবর খুড়ে তাকে বের করে আনবে। কিন্ত কফিনটা ভেঙে বের হয়ে অপরিসর কবরের ভেতরে টর্চের আলো জ্বালাতেই অবাক বিস্ময়ে সে দেখতে পেলো তাকে রক্ষাকারী বৃদ্ধ জেল রক্ষীর মৃত ম্লান মুখ, যার ঠোঁটের কোনে তখনো জেগে আছে পরোপকারীর মৃদু হাসি! যাইহোক বেশি প্রসঙ্গান্তরে যাবার আগেই মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
তাবুর ভেতরের বদ্ধ অন্ধকার থেকে আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম। আকাশে প্রবল জ্যোৎস্না। নীচে পৃথিবী জুড়ে ঘন কুয়াশা। দুইশত গজ দূরেই টেম্পল হিলের মাথায় মন্দিরের ভেতরে আলো জ্বলছে মিটমিট করে। খুব নাম করা মন্দির, তা না হলে এক কিলোমিটার দূরের হাঁটহাজারী এলাকা থেকে কে একটা ১১ কে.ভি লাইন এই পাহাড়ের ওপরে সংযোগ দিয়ে যাবে? মন্দিরের চারপাশটায় হাজার হাজার ফুলের গাছ। সবই দারুন পরিচর্যায় বেড়ে উঠছে। গন্ধরাজ এবং শিউলি ফুলের গন্ধ আমার তাবু পর্যন্ত চলে এসেছে। এই ফুলের গন্ধেই হয়তো সবাই নিঃসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। শুধু জেগে আছি আমি আর একটু দূরে অনুশীলনের অফিসার্স বাসস্থান এলাকার রাত্রিকালীন প্রহরী। একে আমি খুব ভালভাবেই চিনি। আমার রেজিমেন্টেশনের সময়ে আমার পাশের রুমেই ছিল এবং কয়েকদিন আমার রানার হিশেবেও কাজ করেছে। নাম সৈনিক রফিক। চাকুরি বড় জোর দেড় বছর। তবুও ইউনিটে সে আমার সিনিয়র। আমার চাকুরি মাত্র ৫ মাস! আমি রফিককে কাছে ডাকলাম। সেও খুব খুশি হয়ে উইন্টার কোটের খসখসে আওয়াজ তুলে আমার দিকে দৌড়ে এল এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ স্যার, আপনার জন্যে কিছু আনতে হবে?” এদের কাছে অফিসার ডাকা মানেই কোন ফায়ফরমাশের অগ্রিম সংকেত! আমি ক্যাম্প সটুল (camp stool) এর ওপরে বসে আছি। বললাম, “না, তোমার সংগে গল্প করবো, তাঁবুর ভেতরে ঘুম আসছে না! আমি তাকে এক এক করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকি; সে একান্ত বাধ্যগতের মতন আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি তার নাড়ীনক্ষত্রের খোঁজ নিয়ে ফেলেছি। অনেকটা আমারই মতন ব্যাকগ্রাউনড! পার্থক্য আমার বাড়ী যমুনার পাড়ে আর তার বাড়ী পদ্মানদীর পাড়ে। আমি ক্যাডেট কলেজে পড়েছি, সে নদীর পারের একটা গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করেছে। তারপরেও রসিকতা করে আমি তাকে বললাম, “রফিক, তুমি যদি ছোটবেলা থেকেই আমার মতন পড়াশুনায় সিনসিয়ার হতে তাহলে তাহলে তুমিও অফিসার হতে পারতে এবং আজ রাতে এই পাহাড়-জঙ্গলের ভেতরেও আমার মতন নাক ডেকে ঘুমাতে পারতে!” রফিক আমাকে বলল, “ স্যার, আপনিও যদি অফিসার না হয়ে আমার মতন সৈনিক হতেন, তাহলে রাতের বিভিন্ন প্রহরে যে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, ঝিঁঝিঁ পোকাদের শব্দ বদলে যায় সেটা শুনতে পারতেন! এমনকি রাতের বেলায় শেয়ালেরাও যে কেমন বাঘের মতন বীরবিক্রমে চলাফেরা করে তা দেখতে পারতেন! জীবনের এই অংশটা আপনার কাছে অজানাই থেকে যাবে!” আমি নিশ্চুপ!
আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর আমার চাকুরির স্থায়িত্তের বিষয়ে অনেকটা অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন বছরে এটা আমার দ্বিতীয় চাকুরী। মাত্র ৪ মাস আগের কথা। একদিন ব্যক্তিগত কাজে আমি আমেরিকান এম্বেসির সামনে থেকে বনানী যাবো। আমার সাথে কোন বাহন নেই! কোন ট্যাক্সি বা ক্যাব না পেয়ে আমি একটা রিক্সায় চড়ে বসলাম। আমার গন্তব্যের কথা জানাতেই রিকশাওয়ালা বলল, “ তালতলায় যাবেন তো? অনেক ঘুরে যেতে হবে। মেইন রাস্তায় আমাদেরকে চলতে দেয়া হয়না!” তালতলা নাম শুনে আমি অবাক। এত বছর ধরে আমি এই এলাকায় চলাফেরা করেছি। তালতলা বলে কোন জায়গার নাম তো শুনিনি। আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম সময় বা ভাড়া যাই লাগুক না কেন, আমি আজ তালতলা দেখবই। অনেক ঘোরার পর আমরা এক সময়ে তালতলাতে এসে পৌঁছালাম। আমাকে রিকশাওয়ালা নামিয়ে দিয়েছে বনানী সুপার মার্কেটের সামনে। আমি এখানেই আসতে চেয়েছিলাম। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, “তোমার তালতলা কোথায়?” সে মৃদু হেসে ২০ গজ দূরের একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জীর্ণশীর্ণ তালগাছ দেখিয়ে দিল। রিকশাওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝলাম ওরা আমাদের সমান্তরালে আর একটা প্রাচীন জীবন যাপন করে যা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ ওই জীবনটাই একসময়ে আসল জীবন ছিল।
আমি বনানী মার্কেটের পাশে গড়ে ওঠা বা নির্মীয়মাণ বহুতল ভবন গুলোর মাথার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে ওরা কালমেঘ ফুরে উড়ে যাবার ধান্দা করছে! এরই মধ্যে তালগাছটাকে লাগছে ভিজে কাকের মতন ! এর মাথার পাতার সংখ্যাও কমে এসেছে পুরনো চিরুনির মতন। এই গাছে একটাও বাবুই পাখির বাসা নেই! রাতের বেলাতেও হয়তো কোন পাখি এসে এর শাখায় রাত পার করেনা! নির্মীয়মাণ বহুতল ভবনের ওপর থেকে ঝরে পরা লাল ইটের গুঁড়া পরে গাছের মাথাটা অনেকটা হালকা মেঘের আড়ালে অস্তগামী সূর্যের মতন লাগছে। অনাগত কোন ভবিষ্যতে হয়ত এই তালগাছের খণ্ডিত দেহ পরে থাকবে কয়েকদিন রাস্তার পাশে। তারপর একদিন সবাই ভুলে যাবে তাকে। যেমন পথচারীরা ভুলে যায় রাস্তার ওপরে শুয়ে থাকা কোন জীর্ণ শীর্ণ ম্লান ভিক্ষুককে! এমনকি রিকশাওয়ালারাও!
“শিমুল গাছের নিচে গম ক্ষেত দেখলাম আজ।
পুরো গম ক্ষেতটিই বাদামি রঙের, তাতে অন্য রঙ নেই
দেখে দেখে মনে হয় ক্ষেতে গম পেকে গেছে প্রায়।
আমিও পথের মাঝে থেমে প’ড়ে গম গাছগুলি দেখলাম।
বুঝলাম ইউরোপে এবং আমেরিকায় শস্যক্ষেতগুলি এ প্রকার।
আমাদের বাঙলায় ধান ক্ষেত সমূহের ধরন যেমন
গমক্ষেত সমূহের ধরন তেমন নয়, স্পষ্টতই বিদেশি ধরন।
এ যেন ইউরোপের কিয়দংশ দেখছি এখানে
শিমুল গাছের নিচে; এইসব ধান গম মানুষের মেধার ফসল
ধান গম খেয়ে খেয়ে মানুষের হৃৎপিন্ড সচল থাকে এ কথা সকলেই জানি”। –বিনয় মজুমদার
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
০১ নভেম্বর ২০১৫
খুব ভাল লাগলো ডিয়ার আসাদ।
:thumbup:
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
স্যার ৫ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ানের ৪০ পাউন্ড তাবুগুলোতে আমাদের মত জুনিয়র অফিসারদের রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা এখনও ঠিক তেমনি রয়ে গেছে। ফিল্ড মেসে ক্যাসেট প্লেয়ারের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে এলইডি টিভি। আর কালের পরিক্রমায় ৩৯ বছরে ইউনিট চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা, আবার চট্টগ্রাম হয়ে এখন রংপুরে থিতু হয়েছে গত ৮ বছর হল।
ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্যে
আরেকটি ক্ল্যাসিক।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
অনেক ধন্যবাদ