হযবরল
‘গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?’
‘আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিন-চারদিনের আলাপ, প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।’
‘তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কেন?’
‘কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়—আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়?’
উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বটি ‘ফিরে এসো চাকা’ র কবি বিনয় মজুমদারের একটা সাক্ষাতকার থেকে নেয়া। আমি ফেসবুকে পোস্ট করতে পছন্দ করি। তবে গত দুইদিন হল আমি বিষয়ের সল্পতায় ভুগছি। লিখতেই হবে এমন কোন বাধ্যকতা আমার ভেতরে কখনোই জন্মায়নি। তারপরেও সমস্যা হয়ে পরে যখন হাতে অফিসের আপাত কাজগুলো শেষ হয়ে যাবার পর আমার আর তেমন কিছুই করার থাকেনা। অথচ আমাকে এখানে থাকতে হবে অন্তত সন্ধ্যা অবধি। মাগরিব নামাজের পরে আমার অব্যাহতি। এই সময় পর্যন্ত আমি আমার কর্পোরেট অফিসের (!) পাশের ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলতে পারি। কিন্তু কতক্ষন? আমি ছাড়া অফিসের সবাই মোটামুটিভাবে একই ফ্রিকোয়েন্সির। কয়েকদিন আগে একজন প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা, পরবর্তীতে বি এস সি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছে এমন একজন আমাদের অফিসে যোগদান করেছেন। আমি ভাবলাম, “ এবারে একজন কথা বলার সঙ্গী পাওয়া গেল”। কিন্তু দুইদিন পরেই বুঝলাম আমাকে কথোপকথনের সঙ্গী হিশেবে খুব একটা পছন্দ করছেন না। আমিও না! ফলে আমার বদলে তিনি আমাদের অফিসের আরও দুইজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের সাথে ইলেকট্রিক সার্কিট, ডি জি ডি পি’র টেণ্ডারিং পদ্ধতি, ডাটার ‘বিট’ এবং ‘বাইট’এর মধ্যে আকৃতিগত/গুনগত পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মহানন্দে আলোচনা করেন। তাদের হতাশাটা শুধুমাত্র বোঝা যায় ফেরার সময়ে। অফিস শেষে আমার সাথে একই লিফট দিয়ে নামতে নামতে তারা পরস্পরের সাথে ‘ক্রিব’ করতে থাকেন কার কতদিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাদের পড়াতে বসা হয়নি অথবা তাদেরকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি।আমি মুখে কিছুই বলিনা, তবে ঈষৎ মৃদু হাসি। এতেই তারা বুঝে যান যে, আমি তাদের প্রতি দারুনভাবে সহমর্মি!
সকাল দশটার দিকে আমার কোর্সমেট এবং বন্ধু আলমের কাছে রিং করলাম। অন্য প্রান্ত থেকে তার আনন্দিত দরাজ গলা, “কিরে একেবারেই হারিয়ে গেলি নাকি? আর কি কোনদিনই আমাদের দেখা হবেনা?” আমি তাকে বললাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে একটা ‘লস্ট জেনারেশন’ বলে একটা জেনারেশনের সৃষ্টি হয়েছিল। বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ত হেমিংওয়ে নিজেই সেই জেনারেশনের প্রতিনিধি ছিলেন এবং তিনিই তাঁর উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’-এ ‘লস্ট জেনারেশন’ শব্দবন্ধনীটি জনপ্রিয় করে তোলেন। তার লেখার অনেক চরিত্রই এই জেনারেশনের প্রতিনিধিত্ব করত। যেমন ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লেইস’ এ তারা পানশালায় সারারাত্রি ধরে মাছের মতো পান করত, ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ মত্ত হয়ে ষাড়ের লড়াই উপভোগ করত, এমনকি কেউ মাছ ধরার নাম করে জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়ে দিত সমুদ্রে বসে থেকে (আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্টিম )!কারন এরা বিশ্ব যুদ্ধকে দেখেছিল অনেক কাছে থেকে। ফলে খুব কাছ থেকে দেখার বেদনা এরা কখনই ভুলতে না পারার কারনে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে জীবনটা এদের কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়েছে। এবং একারনেই এদের অনেকেই পরবর্তীতে আত্নহত্যা করে, এমনকি হেমিংওয়েও (১৯৬১)! আমার ওপরেও হয়তোবা এই জেনারেশন এসে ভড় করছে। কথাটা বলে শেষ করার পরেই আমার মনে হল প্যালেস্টাইন, সিরিয়া বা গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই তো আবার বীজ বপনের কাজ চলছে নতুন কোন ‘লস্ট জেনারেশন’ নামক বিষবৃক্ষের!
আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয় এই যে সারা বিশ্ব জুড়ে আমরা উত্তরোত্তর সহিংসতার সৃষ্টি করে চলেছি, এর শেষ কোথায়? কোনদিন যদি পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ হয়েও যায়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরা কি পারবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে? নাকি ক্রমশ আমরা পৌঁছে যাবো এইচ জি ওয়েলস এর হতাশাগ্রস্ত বিবর্ণ, বিকীর্ণ কোন পৃথিবীতে?
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৪ অক্টোবর ২০১৫
যুদ্ধের সহিংসতা তো বটেই, সামাজিক সহিংসতাও জন্ম দিয়ে চলে আপাত "লস্ট জেনারেশন"
এককালে এরিক মারিয়া রেমার্কের "দ্যা রোড ব্যাক" পড়ে খুব ধাক্কা খেয়েছিলাম, মনে পড়ে গেল 🙁
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
বিনয় মজুমদার আর গায়ত্রী প্রসঙ্গ আমাকে বরাবর খুব টানে।
কবির একটা বই আছে 'গায়ত্রীকে' নামে -- স্বহস্তে লেখা এই বইটি আমার বেশ প্রিয়। দুরূহ সব কবিতা --- তবু কেন যে এত টানে।
আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেছি আসাদ ভাই।
হেমিংওয়ের লস্ট জেনারেশন একটা টার্ম থেকে কমন নাউনে পরিণত হয়েছে। এটা বোধ হয় এক ধরনের সিনড্রোম যা সংবেদনশীলতার একটা স্তরের অবিশ্যম্ভাবী পরিণতি।
আর কোনো গায়ত্রী ছাড়া তো কতো অনুভূতিই জীবনের থেকে যাবে অনুন্মোচিত অনুচ্চারিত।
ভালো লাগলো খুব আসাদ ভাই।
হেমিংয়ের লাস্ট জেনারেশনে তো যুদ্ধের প্রভাব ছিলো ভাই, কিন্ত আমদের জেনারেশনে সামাজিক সহিংসতা যে ভাবে গ্রাসকরে আছে তাথেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাইনা.....
আপনার হযবরল ভাবিয়ে তুলে জানান দিল লেখাটা মোটেও লাইট কোন লেখা নয়।
তানভীর আহমেদ
শিরোনামটা প্রতারকের ভূমিকায় আবির্ভূত। এটা মোটেই হযবরল কোন লেখা নয়। এভাবেই পৃথিবীতে কোন না কোন জায়গায় কোন না কোন সময়ে লস্ট জেনারেশন তৈরী হয়ে চলেছে প্রতিকারবিহীন।।