পোস্ট মাস্টার বাবর আলী
“আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো : ‘এই জীবন নিয়ে
তুমি কি করেছো এতদিন ?’— তাহলে আমি বলবো
একদিন বমি করেছিলাম, একদিন ঢোঁক
গিলেছিলাম, একদিন আমি ছোঁয়া মাত্র জল
রুপান্তরিত হয়েছিল দুধে, একদিন আমাকে দেখেই
এক অপ্সরার মাথা ঘুরে গিয়েছিল একদিন
আমাকে না বলেই আমার দুটো হাত
কদিনের জন্য উড়ে গেছিল হাওয়ায়….…” – (জয় গোস্বামী)
আমার মাঝে মধ্যেই মনে হয় আমি কোন কিছুই কল্পনা করতে পারিনা! আমি যখনই লেখার জন্য কোন প্লট বা সাবজেক্ট নিয়ে কল্পনা করতে যাই একরাশ অতীত স্মৃতি এসে আমার কল্পনাগুলোকে ওলট পালট করে দেয়। ফলে আমার লেখাগুলো হয়ে ওঠে মূলত বাস্তব জীবনের ভাষিক বা চিন্তক রূপ মাত্র। জীবনের জটিল অভিজ্ঞতা গুলোকে প্রকাশের জন্যই এমনতর ভাষিক রূপ বা রূপকের প্রয়োজন হয়ে থাকে আমার, যা আসলে কখনই কল্পনা নয়,বাস্তব।
১৯৭২ সাল। আমাদের বাড়ি মাদারগঞ্জ থানার অন্তর্গত করইচরা ইউনিয়নের কুমার পাড়া গ্রামে। তখন উপজেলা বলে কিছু ছিলনা। ছিল থানা, মহকুমা, জেলা এবং বিভাগ। আমি কুমার পাড়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী ঝাড় কাটা সরকারী প্রাইমারী স্কুলে সদ্য অটো প্রমোশন পেয়ে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু’তে উঠেছি। স্কুলে যাবার অভ্যাস আমার ভেতরে তখনো গ্রো করেনি। যাই কারন স্কুলটা আমাদের বাড়ির পাশে এবং স্কুলে তখন বিলিতি দুধ বিলি শুরু হয়েছে। প্রায় দিনই আমি কাগজের ঠোঙায় করে, যে ঠোংগাগুলো অংক খাতার পাতা ছিঁড়ে তৈরি করা হয়েছিল, সেই ঠোঙায় বিলিতি দুধ নিয়ে আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরি। আমার নিরিবিলি স্পর্শকাতর আঙুল ঢুকিয়ে বিলেতি দুধ তুলে নিয়ে জিহ্বা ঠোঁট সাদা করে নিই; দাঁতের সাথে দুধের মিহিগুড়া লেগে থাকে। আঠাল মিষ্টি তার অনুভব!
ঠিক এই সময়টাতেই আমার দেখা হয়েছিল আমাদের মোমেনাবাদ পোস্টঅফিসের পোস্টমাস্টার বাবর আলীর সঙ্গে! এক চোখ ট্যারা, একটু কুঁজো। তবে প্রচণ্ড প্রানবন্ত এক যুবক। যুদ্ধের পর আমাদের কুমার পাড়া গ্রামের নামটা বদলিয়ে রাখা হয়েছে মোমেনাবাদ। এই গ্রামের নামেই এই নতুন পোস্ট অফিসটির নাম। আমার আত্মীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মধ্যে একমাত্র বাবর আলী ভাইই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। অথচ যাবার কথা ছিল অন্যদের। আমাদের গ্রামের তালুকদার বাড়ীর যুবকেরা ২৬ মার্চের পরের রাতেই মেলান্দহ বাজারের এক বিহারী পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল এরা কেউই যুদ্ধে যায়নি! এমনকি আমার ছোট চাচা যিনি ’৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করেছিলেন, তিনিও যাননি। কেন তা আমি জানিনা বা সেই সময়ে আমার বোঝার বয়স হয়নি। তবে তাদের এই না যাওয়াটাকে আমি কখনই পছন্দ করতে পারিনি, বরং এ নিয়ে নিজকে সবসময়ে লজ্জিতই মনে করতাম আমি। বিশেষ করে আমার আব্বার স্কুলের এসিসটেনট হেড মাস্টারের ছোট ভাই ক্লাস এইটের একজন কিশোর যখন মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে স্টেন গান নিয়ে অযুত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমাদের স্কুলে এসে আস্তানা গেড়েছিল, আমি তখন আমার অষ্টম শ্রেণীতে পড়া বড় ভাইকে নিয়ে খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম সে কেন যুদ্ধে যায়নি ভেবে।
বাবর আলী আমার আব্বার স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আব্বার অন্যান্য ছাত্রদের মতন তিনিও আমাকে প্রবল স্নেহ করতেন। তিনি আমার কাছে গল্প করেছেন কিভাবে ভরা বর্ষার রাতে নৌকোয় করে, কাদা মাটিতে গভীর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা অচেনা যুবকের সাথে কুমিল্লা সীমান্ত পার হয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানে তার সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী থানা ইসলামপুরের বীর সেনানী মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে। আমাকে তিনি অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন যুদ্ধের এবং সেই অভূতপূর্ব সময়ের যা আমাদের জাতীয় জীবনে একবারই মাত্র এসেছিল! আমার কিছুই খেয়াল নেই। শুধু মনে আছে একটা টগবগে যুবক রাতের অন্ধকারে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে ছুটে চলেছে এক অনন্ত সূর্যোদয়ের সন্ধানে!
যুদ্ধের কিছুদিন পরেই তিনি আমাদের পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার হয়েছিলেন। আমি তাকে কোনদিনই ‘মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট’ নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। মোট কথা তিনি তার পোস্ট মাস্টারের চাকুরীটা নিয়ে খুবই খুশি ছিলেন। ক্লাস সেভেনে আমি যখন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরিক্ষায় চান্স পেলাম, তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আমি পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে গেলেই আমাকে ডেকে নিয়ে অন্যান্য পরিচিত অপরিচিতদের বলতেন, “ এটা আমাদের হেড স্যার এর ছেলে; খুবই ভাল ছেলে, পড়াশুনায় খুবই ভাল, আমাদের এলাকার ভেতরে সেই প্রথম ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়েছে। আপনারা সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন যাতে একদিন সে অনেক বড় হতে পারে, আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে”। আমি জীবনে কখনই তেমন বড় কেউ হতে পারিনি। কিন্তু এই ভালবাসার গল্পগুলো আমার মনকে এত বড় করে রাখে যে আমার কখনই নিজেকে ছোট মনে হয়না!
১৯৯৫ সন। আমি সেনাবাহিনি সদর দপ্তরে চাকরি করি। একবার আমার এলাকার একটা ছেলে আমার বাসায় এলো। বলল, “ আমি পোস্টমাস্টার বাবর আলীর ছেলে। বাবা এই চিঠিটা দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন”। আমি চিঠিটা খুলে পড়তে বসি। লিখেছেন,
“ প্রিয় আসাদ, অনেক বছর যাবত তোমার সাথে দেখা হয় নাই। আশা করি ভাল আছ। আমি ভেবেছিলাম দেশের কাছ থেকে আমি কখনই কিছু চাইব না। সে কারনেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটা পর্যন্ত সংগ্রহ করার কোন চেষ্টাই আমি কখনই করি নাই। দেশকে ভালবেসেইতো যুদ্ধে গিয়েছিলাম, দেশ ভাল থাকলেই আমাদেরও ভাল থাকার কথা। কিন্তু আমাদের আত্নত্যাগ এখনও পারস্পারিক অন্তর্দন্দকে পাশ কাটিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে বলে আমি মনে করিনা। যাই হোক, আমার ছেলে এবার এইচ এস সি পাশ করেছে। ওর সেনাবাহিনিতে যাবার খুব শখ। আমিও চাই সে সেনাবাহিনিতেই যাক। কারন আমার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটা ছাড়া তাকে কেউই কোথাও নিচ্ছে না। আশা করি তুমি আমাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারবে। আমরা তোমাকে নিয়ে খুবই গর্ব করি। ……………… ইতি বাবর আলী ”
আমি পোস্ট মাস্টার বাবর আলীর হয়ে চেষ্টা করি। অধিনায়ক বি আর ইউ আমার পরিচিত। আমি তাকে রিং করে সাহায্য চাই। সেও আমাকে আশ্বাস দেয়। আমি মনে মনে খুশি হই এ কারনে যে, আমার একজন প্রিয় মানুষের জন্য আমি অবশেষে কিছু করতে পারছি। সন্ধ্যার পর ছেলেটা ম্লান মুখে ফিরে আসে! বলে, “ভেরিকস ভেইনে সমস্যা থাকার কারনে তাকে মেডিক্যাল পরীক্ষায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে”। আমার মনে পরে যায় ২৫ বছর আগের কথা – অনেকগুলো টগবগে যুবক যখন অকারনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখেছিল, সেই সময়ে এই এক চোখ ট্যারা, একটু কুঁজো বাবর আলীই একা চলে গিয়েছিল যুদ্ধে!
– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
:boss:
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
প্রাণস্পর্শী। সত্যের ছায়ারা ছেয়ে আছে লেখা জুড়ে।
ভালো লাগলো অনেক লেখাটা পড়ে।
কিছু বলতে পারি না শেষে এসে।
চোখে জল, নির্বাক।
আসাদ ভাই,
বাস্তবতা / মানসিকতা / ভালোবাসার মিশ্রণে আমার চোখেও জল এলো।
তানভীর আহমেদ
গল্পের শেষে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এই "ভেরিকোজ ভেইন" এর সমস্যা দেখিয়ে সেনাবাহিনীর ভর্তি পরীক্ষায় বহু যুবককে ফিরিয়ে দেয়া হতো একসময়। এখনো হয় কিনা জানিনা। আমি কুমিল্লার কর্ণেল এডমিন থাকাকালে এরকম বহু প্রত্যাখ্যাত যুবকের কাছ থেকে অভিযোগ পাই। এ নিয়ে মেডিকেল অফিসারের সাথে কথা বলে জানতে চেয়েছিলাম, কেন এরকম একটি রোগের এত ব্যাপক প্রকোপ হলো। ডাক্তারদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেউ সাধারণতঃ মাথা ঘামাতে চায় না। আমি এডিএমএস এর সাথে এ নিয়ে কথা বলি। পরেরবার থেকে এই কারণে প্রত্যাখাতদের সংখ্যা অনেক কমে যায়। পরে অবশ্য শুনেছি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মেডিকেল অফিসারসহ ঐ বিআরইউ এর অনেকের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো।