(এই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট আর সময় বোঝাতে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা এবং চরিত্র উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাদবাকী ঘটনা আর চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে অবাস্তব নয়। অনেক ঘটনাই বাস্তব আমজনতার অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হয়েছে।)
এক দুই তিন চার এবং পাঁচ
ছয়
সাত
নয়-আট
দশ
চৌদ্দ
নীলিমাদির কাছ থেকে দুটো গান তুলে নিতে হবে। তিনটের দিকে ঘর থেকে বেড়িয়ে প্রথমে শিপ্রাদের বাসায় আসলাম। আজকাল রিক্সা-ভাড়া খুব বেড়ে গেছে। শিপ্রাদের বাসা আমাদের বাসা থেকে খুব কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যায়। রিকশাওয়ালা সে পথটুকুর ভাড়া দাম চাইল পুরো একটাকা। নিরদাসুন্দরী স্কুলের কাছে ওদের বাসা। এ বাড়িতে কেমন জানি একটা বিষাদের গন্ধ পাই। অনেকটা জায়গার উপর পুরনো ধাঁচের একতলা দালান বাড়ি। বাড়ির চারদিকে চারফুট উঁচু বাউন্ডারি দেয়াল আছে। সে দেয়াল রংচটা, পলেস্তারা খসা, নোনা ধরা। সামনের দিকে একেবারে মাঝ বরাবর প্রবেশদ্বার। উন্মুক্ত। বোঝা যায় এখানে আগে একটা খানদানী লোহালক্কড়ের গেট ছিল। এখন তার একটা অংশ উধাও। আরেকটা অংশের ভগ্নাংশ কোন রকম লেগে আছে। বাউন্ডারি দেয়ালের পুরোটা জুরে মুঠো মুঠো করে লেপে লেপে গোবরের গুটি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সামনের উঠোনটায় অযত্নের ছাপ। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই বাড়ির মানুষেরা খুব অর্থকষ্টে আছে। সেইসাথে আছে এক ধরনের নিরাপত্তা-হীনতার বোধ। মূল বাড়ির দেয়ালের এখানে সেখানে পলেস্তারা খসে পরেছে। কোন এককালে চুনকাম হয়েছিল, এখন তার বিবর্ণ দশা। সেখানে নোনা ধরা ছোপ ছোপ ছাই রঙ। কোথাও কোথাও তা কালচে হয়ে গেছে। প্রথমেই কয়েকটা সিঁড়ি পেড়িয়ে বিশাল এক বারান্দায় উঠতে হয়। সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে দুটো লম্বা থাম উঠে গিয়ে উঁচু সিলিং ছুঁয়েছে। যখনই আসি , তখনই দেখি শিপ্রার বাবা বারান্দার এক কোনে চেয়ারে বসে আছেন। চুপচাপ। কখনও কোন কথা জিজ্ঞেস করেননি। আমার দিকে কোনদিন সরাসরি তাকিয়েও দেখেননি। উনি এ দুনিয়ায় অবস্থান করেন কিনা এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়। জানি যে ভদ্রলোক এখন কোন কাজও করেন না। বুঝে পাইনা শিপ্রাদের এতজনের সংসার কিভাবে চলে। ভালোর মধ্যে এই যে বাড়িটা ওদের নিজের। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ওদেরই কোন শরীক আত্মীয় ভারতে চলে যাবার সময় শিপ্রার বাবার পরিবারকে এখানে থাকতে দিয়েছিল। এরপর তো পঁয়ষট্টি আসলো, একাত্তর আসলো, পঁচাত্তর আসলো – ওর বাবার পরিবারের বাদবাকি সদস্যরা একে একে কোলকাতা পাড়ি জমাল। শুনেছিলাম মাসিমা নিজের হাতের আঁচার আর সন্দেশ বানিয়ে দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেন। শিপ্রাদের তিনটা গরু আছে। মাসিমা নিজ হাতে সব দেখাশোনা করেন। কোলকাতা থেকে ওদের মামারা শুনেছি শিপ্রাদের সাহায্যে করেন। এখনও এই পরিবারে তিনটা মেয়ে আছে। হিন্দু মেয়েদের তো আবার বিয়ে দেওয়ার সময় প্রচুর যৌতুক দিতে হয়। কে জানে মাসিমা এসব যোগার করবে কিভাবে?
দুটো নতুন নজরুলগীতি তোলার জন্য শিপ্রাকে নিয়ে নীলিমাদির বাসায় যেতে হবে। দুই মাস পরে ঢাকায় টেলিভিশনে কুমিল্লা থেকে একটা সাংস্কৃতিক দল যাচ্ছে। যথারীতি এই দলের মধ্যমণি আমি। শহরের যে কোন বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখন আমাকে ছাড়া ভাবা যায় না। দিন দিন আমার মাথার মুকুটে পুরষ্কারের পালকের সংখ্যা বাড়ছে। টেলিভিশনে গান গাইছি, খেলাঘরের সাথে বিদেশে গান গাইতে যাচ্ছি। আমাকে আর পায় কে? যেসব বান্ধবীরা একসময় আমার ইমেজ ফুটো করার চেষ্টা করতো তারাও এখন তোষামোদিতে ব্যস্ত। অন্তত সামনাসামনি। তবে পেছনে কে কি বলছে তা জানতে আমার বয়েই গেছে। যথারীতি শিপ্রা এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় বান্ধবী। আমার প্রতি শিপ্রার বশ্যতা সন্দেহাতীত। তাই এই স্থানটা আর কাউকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। সাংস্কৃতিক দলের কোরাসে শিপ্রাকে রাখি। একটা সময় শিপ্রা অনেক ভালো গান গাইত। তখন আমি ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম যে কোনদিন আমিও এইরকম গান করতে পারবো কিনা। শিপ্রা এখনও অনেক ভালো করে। ওর হারমোনিয়াম নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও খালি গলায় রীতিমতো রেওয়াজে বসে। অথচ আমার নামডাকের তুলনায় সে কিছুই নয়। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় গান শুধু শোনার নয়, দেখারও জিনিষ। নইলে মানিকদা সব সময় আমাকে এমন ভাবে তুলে ধরবেন কেন?
নীলিমাদির বাসা রাণীর দিঘির পাড়ে। শিপ্রাদের বাসার সামনের রাস্তাটা বড় রাস্তার সাথে ইংরেজি টি অক্ষরের মতো করে মিলেছে। অর্থাৎ ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় হয় ডানে নয় বামে যেতে হবে। সোজা বরাবর বড় রাস্তার ঐ প্রান্তে একটা মাজার রয়েছে। শিপ্রা আর আমি রাস্তা পার হই। মাজারের প্রধান ফটকের পাশে দানবাক্সটার সামনে দাঁড়াই। মনে মনে ছোট একটা মানত ছিল। দুই টাকা আর পাঁচটা পাঁচ পয়সা মিলিয়ে মোট দুটাকা চারআনা দান বাক্সে ঢুকিয়ে দেই। আজকে অনেক খরচ হয়ে গেল। গান-টান গেয়ে কিছু পয়সা পাওয়ার পর থেকে খরচের হাতটা বেড়ে গেছে। ব্যাপারটা ঠিক না।
পেছন ফিরে শিপ্রাকে বলি,’বাতাসটা কি ভাল লাগছে! চল আজকে হেটে হেটে যাই।’
শিপ্রা আমার কোন কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করে না। অজ্ঞতা আমরা হাটতে থাকি। মাঝে মধ্যে খুব ইচ্ছে করে শিপ্রাকে ওর মেজো বোনের কথা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু করতে পারি না। বুঝে গেছি শিপ্রা এই প্রসঙ্গে কোন কথা বলতে চায় না। সবারই কিছু না কিছু গোপন স্পর্শকাতর জায়গা থাকে। ওসব জায়গায় হাত না দেওয়াই ভাল। আমার যেমন হিরণ ভাই। এ বিষয়টা নিয়ে আমি কোনদিন কারো সাথে আলাপ করিনি। তাই শিপ্রা জানে না কি গভীর দুঃখ আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। ওর মতে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী।
হটাৎ করেই ঘ্যাঁচ করে একটা লাল গাড়ি আমাদের পাশে খুব জোরে ব্রেক কষে থামল। গাড়িতে পাঁচ-ছয়জন উঠতি বয়সী যুবক। এই কুমিল্লা শহরের ছোট ছোট সরু সরু রাস্তাঘাটে ব্যক্তিগত গাড়ি এখনও এক দৃষ্টব্য বস্তু। তাই রাস্তায় গাড়ি দেখলে তাদের মালিকের নাম বলে দিতে পারি। এই লাল গাড়িটা খালেক মজুমদারের। চালকের আসনে তার ছেলে শাহেনশাহ। বাদবাকিরা তার সাঙ্গপাঙ্গ। এক ঝলক সেদিকে তাকিয়ে শফিককে চিনতে পারলাম। শফিকের এক চাচা নাকি খালেক মজুমদারের হয়ে অনেক মানুষ খুন করেছে। এর মধ্যে কাজলের বাবাও আছে। এইসব অবশ্য ভেতরের খবর। শফিক এক সময় দাদামনুর সাথে পড়তো। দাদামনু বলেছে সে পকেটে নাকি সত্যিকারের পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয়না। বেশ বুঝতে পারি এখন পোলা-চোরের ভয়ে কাজ হবে না দেখে আমাকে শফিক গুণ্ডার ভয় দেখাচ্ছে।
এক ঝলক দেখেই বুঝলাম শাহেনশাহ ছাড়া গাড়ির ভেতর সব ছেলেগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির ভেতর থেকে গান বেজে চলল – ‘সত্যম শিভম সুন্দরম’। গত বছর এই নামের একটা হিন্দি ছবি খুব হিট হয়েছে। এতে ছবির নায়িকা জিনাত আমান নাকি খুব সংক্ষিপ্ত কাপড় পড়ে খুব তোলপাড় করে দিয়েছিলো। গাড়িটা আমাদের পথ আটকে আছে। উদ্দেশ্য কি? শাহেনশাহ কি আমার সাথে ফিল্ডিং মারছে? আবারও চালকের আসনে চোখ তাকালাম। যেন কিছুই হয়নি, পৃথিবীর কোনদিকে তার খেয়াল নেই এমন নির্বিকার-ভাবে শাহেনশাহ একটা সিগারেট ধরাল। যেরকম হটাৎ থামিয়েছিল ঠিক সেরকমই হটাৎ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো। তারপর এক হাতে সিগারেট আর আরেক হাতে কায়দা করে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে হুস করে গাড়িটা নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
’তোকে দেখে যুবরাজ গাড়ি থামাল।’
’যুবরাজটা কে?’
’জানিস না যেন!শাহেনশাহকে সবাই যুবরাজ বলে ডাকে।’
’গাড়িটা পারলে একদম গায়ের উপর উঠিয়ে দেয়। এরকম একটা ফালতু ছেলেকে যুবরাজ উপাধি দেওয়া দেয় কেউ।’
’আমরা তো আর তোর মতো বিদেশে গিয়ে কূটনীতিবিদ আর দেশে প্রেসিডেন্টের হাত থেকে স্বর্ণপদক নিই না, আমাদের অল্পস্বল্প দেখা চোখে শাহেনশাহই যুবরাজ। আর খারাপ কি দেখলি? একদম হিন্দি ছবির নায়কদের মতো।’
শাহেনশাহ আমার কাছে শুধুই খালেক মজুমদারের ছেলে। আমার আশেপাশে ওই লোক সমন্ধে এতো খারাপ কথা শুনেছি যে তার ছেলে কতোটা সুদর্শন সেটা আমার পক্ষে ভাবার কোন অবকাশ নেই।
‘খালেকর পোলা আর কত ভাল হবে!’
‘ছেলের নামে তো কোন বদনাম নাই। মেয়েদের দিকে তাকায় না পর্যন্ত। অথচ এই শহরে কত মেয়ে যে এই ছেলের জন্য পাগল!’
’শিপ্রা এই লোকই না তোদের বিপদে ফেলতে চাইছিল? একসময় কি কড়া আওয়ামীলিগারই না ছিল অথচ দেখ পঁচাত্তরের পর আওয়ামীলীগ গ্যাঁড়াকলে পড়লো আর এই লোকও সাথে সাথে ভোল পালটে ফেললো। ’
’আমার তো মনে হয় এই দেশে থাকতে হলে ভোল পালটানো ছাড়া গতি নাই। মাঝে মধ্যে ভাবি কি ভোল ধরলে আমাদের আর দেশ ত্যাগ করতে হবে না।’ শিপ্রার কথার সুরে বিষাদের ছায়া। ওদের আত্মীয়-স্বজন বলতে গেলে প্রায় সবাই একে একে ভারতে চলে গেছে। তিনবছর আগে ওর দুই মাসির পরিবার চলে যায়। ওদেরই এক আত্মীয় থেকে আম্মা নজরুল এভিনিউয়ের উপর সরস্বতী স্টোর দোকানটা কিনে রাখেন। নাম মাত্র মূল্যে। তাও আবার বেশ খানিকটা বাকী রেখে। তখন মনে আছে সারারাত কেঁদেছিলাম। কেন ওরা দেশটাকে এতো পর মনে করে চলে যাচ্ছে। এখনও তো প্রতিদিন সন্ধেবেলা মাগরিবের আজান আর উরু ধ্বনি একটার পর আরেকটা শুরু হচ্ছে। কেউ তো মানা করছে না। তবে কেন এই চলে যাওয়া? শিপ্রা কখনও এই বিষয়ে কথা তোলে না। তবে বুঝি ওর ভেতরে অনেক অভিমান জমে আছে।
’শিপ্রা তোর মাসিরা কেন চলে গেলরে?’
’দেখ যেই কাদের মোল্লার এতদিন কোন খবর ছিল না,সেই লোক দেখ গত বছর কেমন করে ইলেকশন করলো? তাও আবার জামাতি ইসলামীর প্রার্থী হয়ে? আচ্ছা তোদের বাসায় কাদের মোল্লার বৌ আসে কেন?’
প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়ে। শিপ্রা কথা ঘোরাচ্ছে। ওর হাত থেকে স্টিয়ারিং হুইলটা কেড়ে নিলাম না। আমিও ঘুরলাম। কিন্তু এমন একটা বাঁকে নিয়ে গেল যে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কাদের মোল্লার বৌ আসে কৃতজ্ঞতা দেখাতে। সাথে নিয়ে আসে ছেলেদের পাঠানো সৌদি আরব থেকে পাঠানো খেজুরের বিস্কুট। মহিলা নাকি এখনও ভুলতে পারে না যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আম্মার উপকারের কথা। আর আম্মাও সব ভুলে মহিলাকে বেশ ভালভাবেই আপ্যায়ন করে। মাঝে মধ্যে আমি খুব রাগ করে আম্মাকে বলি, ’যেই লোকটার জন্য আমরা প্রায় মরতে বসেছিলাম তার বৌকে তুমি কিভাবে এতো খাতির করো?’
আম্মা খালি উদারতার কথা শোনায়। ’বঙ্গবন্ধুও তো এদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।’
আম্মাকে কে বোঝাবে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই করতে পারেন কিন্তু আম্মা পারেন না। এই যেমন শিপ্রার কাছে এখন আমাকে এক অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। কি উত্তর দিব ওকে?
’কাদের মোল্লার বাসায় তো আমরা ভাড়া থাকতাম। সে পরিচয়েই আসে। আর একবার আসলে তো আর ঘর থেকে চলে যেতে বলা যায় না।’
আমার উত্তরে বোধহয় একটু ঝাঁজ মিশে গিয়েছিল। শিপ্রা একটু নরম স্বরে বলল, ’এই লোকটা না খান দাদাদের পাক সেনাদের হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল?’
আমার এখনও সেইদিনের কথা ভাবলে ভয়ে হাতের লোম খাড়া হয়ে যায়। চোখের সামনে দ্রুত ভেসে যায় সেই ভয়ংকর স্মৃতি। হিরণ ভাই ড্রামের মধ্যে লুকিয়ে আছে। আমি শব্দ করে পানি ঢালছি। দরজায় ধাক্কা। বাইরে কাদের মোল্লার কণ্ঠস্বর। স্মৃতিটাকে মাথা থেকে মুছে ফেলার জন্য চোখ বন্ধ করলাম। কাজ হল না। চোখের মতো ব্রেনেরও যদি পলক থাকতো! তাহলে চাইলেই সে পলক বন্ধ করে ভয়ংকর স্মৃতিগুলোকে অদৃশ্য করে রাখতে পারতাম। আমার সেই ঘটনার কথাও আমি কোনদিন শিপ্রাকে বলিনি।
’এখন হটাৎ করেই এইসব লোকদের খবরদারী বাড়ছে বলেই তো মাসিরা চলে যাচ্ছে। আমাদের এখন রবীন্দ্রসংগীত বাদ দিয়ে খালি নজরুলগীতি গাইতে হচ্ছে।’ কিছুটা যেন আপন মনেই কথাগুলো সে বলে উঠলো।
এই বিষয়ে শিপ্রার অভিমানটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকে অপস্রিয়মাণ করা হচ্ছে। কাজি নজরুল ইসলামকে দাড় করানো হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে। প্রেসিডেন্ট জিয়া মহাসমারোহে সরকারি উদ্যোগে নজরুলকে জাতীয় মর্যাদা দিয়ে কোলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাঁকে উপলক্ষ করে গড়ে উঠে নানা প্রতিষ্ঠান, নানা সংঘ-সমিতি, নানা সৌধ-ইমারত। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানের সাথে তাঁকে সমাহিত করা হল একটি মসজিদের পাশে, ঠিক যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন বিখ্যাত এক গানে। যে মানুষটাকে জীবিতাবস্থায় কাফের আর শয়তান বলে গালাগাল করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল বাংলার মুসলমান সমাজ, সেই সমাজই আজকে তাঁর মাজারে গিয়ে দোয়াদরুদ পড়ছে। এই বিলম্বিত সম্মানের মূল কারণ তাঁর নাম ’কাজী নজরুল ইসলাম’। তাই বাংলাদেশের মানুষের সৃষ্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে নজরুল ইসলামের দ্বন্দটার মূল লক্ষ্য কাব্যপ্রতিভা নয়, ধর্ম। হিন্দু মুসলিমের ভেদাভেদ। কে শ্রেষ্ঠ এই সংস্কার আজ গ্রাস করছে সংস্কৃতিতে। অথচ এই বিদ্রোহী কবি নিজেই সারাজীবন সাম্যবাদের গান গেয়েছেন।
বেশ কিছুদিন ধরে আমি নজরুলের উপর লেখাপড়া করছি। ছোটবেলায় অসাম্প্রদায়িক বা বহু সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ায় বড় হয়ে ওঠার ফলেই হয়ত তাঁর কাব্য ও গীতি-দর্শনে সাম্প্রদায়িক-বিরোধী একটা বলিষ্ঠ ধারার সৃষ্টি হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় শাস্ত্রেই তাঁর বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল বলে দুটি ধারার কদর্য দিকগুলো হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিপক্ষ। তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এসবের বিরুদ্ধে, আরেকদিকে আঘাত করেছেন ইসলামের অন্ধ গোঁড়ামি আর অজ্ঞতার মূলে। দুঃখের বিষয় এদেশে এখন নজরুলকে নিয়ে মাতামাতি হলেও তাঁর সাম্যবাদের দর্শন থেকে যাচ্ছে পুরোই অন্ধকারে। নজরুলকে মুসলমান কবি বানিয়ে তাঁর কবর জিয়ারত করার চাইতে তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করতে পারলেই হয়ত তাঁর আত্মা বেশি শান্িত পেত।
খুব গভীরে এক ধরনের মুসলমান বিদ্বেষ শিপ্রার ভেতর কাজ করে। নজরুলকে তার এতো অপছন্দ একজন মুসলমান কবি বলেই। শিপ্রাদের পরিবার খুবই ধার্মিক। নানা রকম ধর্মীয় আচারে নিজেদের খুব আলাদা করে রাখে। শিপ্রা আমাকে বলেছে কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা ওর এক মেসো-মশাই নাকি বলেছে যে বাংলাদেশের হিন্দুরা কলকাতার হিন্দুদের থেকে বেশি ধার্মিক। শিপ্রাকেও দেখেছি উঠতে বসতে অনেক ধর্মীয় আচার পালন করে। শিপ্রার মনোবেদনার সাথে সহানুভূতি জানানোর জন্য বললাম, ’তুই আমাকে প্রায়ই বলিস আমার খুব সুখের জীবন। আমার কোন কষ্ট নেই।’
’ঠিকই তো বলি। তোর আবার কষ্ট কিসের?’
’কথাটা ঠিক নারে। আমার জীবনের একটা বড় কষ্ট হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর নন্দিনী হতে না পারা। ফজলু ভাই একসময় ঠিক করেছিলেন শাপলা শালুক থেকে রক্তকরবী নামাবেন। তা আর হল কই?’
’ফজলু ভাই তো চাইলে তো এখনও তা করতে পারে। তুই ছাড়া নন্দিনী আর কাউকে মানাবেও না। নন্দিনী হলেই তোর সব দুঃখ দূর হয়,তাই না?’
প্রসঙ্গ পালটাতে বললাম, ’এই দাউদকান্দিতে যে খাল কাটার কর্মসূচি হচ্ছে যাবি সেখানে? ফজলু ভাই তো মহা আয়োজন করছে। একটা বাস নিয়ে শাপলা শালুকের সবাইকে নিয়ে যাবে। একটা পিকনিক আমেজ হবে।’
’তারপর সেই কাটা খালে কুমির সাঁতরে বেড়াবে।’
শিপ্রা আমার সব কথায় সায় দিলেও এই একটা জায়গায় আমাদের মেলেনা। এই যেমন খাল কাটা, গাছ লাগানো নিয়ে এমনভাবে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা করেন যে তা শুনলে খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি। মনে হয় দেশটা বুঝি খুব শীঘ্রই ’ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ দ্বিজেন্দ্র নাথ রায়ের সেই গানটার মতো হয়ে যাবে। অথচ এ ব্যাপারটায় শিপ্রার কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। ওর কথায় যেটা বুঝি যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সাথে সাথে ওদের এই দেশে নিশ্চিন্ত মনে বাস করারও মৃত্যু ঘটেছে। দেশটা যদি পাকিস্তানের মতোই চলবে তবে এতো কষ্ট করে স্বাধীনতা আনা কেন? সে যে সংখ্যা লঘু শুধু তো তাই নয় ওর তো আরও অনেক দুঃখ রয়েছে। এই যেমন দেখতে সুন্দর না, লেখাপড়াতেও যেমন তেমন, পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নড়বড়ে, শক্ত কোন অভিভাবক নেই, তার উপর আবার সাদামাটা দেখতে ওর ছোট আরও দুটো অবিবাহিত বোন রয়েছে।
স্কুলে পড়ার সময় কোন ব্যাপারে শিপ্রার সাথে আমার দ্বিমত হলে আমি তর্ক চালিয়েই যেতাম যতক্ষণ পর্যন্ত না শিপ্রা আমার সাথে একমত হচ্ছে। শিপ্রা এক সময় তর্কটা থামিয়ে দেয় ভেতরে ভেতরে একমত না হয়েও।
‘ তাহলে তুই যেতে চাচ্ছিস না?’
’নারে ওদিন পুজো দিতে মন্দিরে যেতে হবে।’
’তোর তো আবার অনেক পুজা।’
’আচ্ছা তুই গান করিস কিভাবে? তোদের ধর্মে তো মানা।’
’গান গাওয়াই যাহার স্বভাব, সেই গানের পাখীকে কোন অধিকারে গলা টিপিয়া মারিতে যাইব? সুন্দরের সৃষ্টির শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে যে, কে তাহার সৃষ্টিকে হেরিয়া কুফরির ফতোয়া দিবে?এই খোদার উপর খোদকারী আর যারা করুক আমরা করিব না।’
’বেশ সাহিত্য করে উত্তর দিলি। শুনতে ভাল লাগলো।’
’আমার কথা না। কাজী নজরুল ইসলামের কথা। গতকাল পড়লাম। আরেকটা সুন্দর কথা শোন। যাহা সুন্দর তাহাতে পাপ নাই। সকল বিধিনিষেধের উপরে মানুষের প্রাণের ধর্ম বড়।’
’বলতে থাক।’
’হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগণতলে সীমাহারা মুক্তির মাঠে দাঁড়াইয়া -মানব! তোমার ক¥ে সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বলো দেখি, আমার ধর্ম মানুষ ধর্ম!’
’বাহ!’ শিপ্রা বেশ মুগ্ধ।
’মানবতার এই মহাযুগে একবার গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো যে, তুমি ব্রাক্ষণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ – তুমি সত্য।’
ঠিক এইসময় পাশে একটা রিক্সা থামল। দেখি রোজিনা আর ওর স্বামী বসে আছে। রোজিনা স্কুলে আমাদের সাথে পড়তো। ক্লাস এইট নাইন থেকেই আমাদের ক্লাসটা ধীরে ধীরে ভাল-মেয়ের দল আর খারাপ-মেয়ের দলে বিভক্ত হয়ে যেতে থাকে। সাধারণত যারা একটু অকালপক্ব তারা ছিল খারাপ মেয়ের দলে। ওরা ক্লাসে পেছনের বেঞ্চিতে বসে গোপনে গোপনে প্রেমপত্র, ছেলে বিষয়ক গল্প, মাসুদরানার বই নিয়ে কথা বলতো। গোয়েন্দাদের রহস্যোপন্যাসের চেয়ে মানব মানবীর সম্পর্কের রহস্যোপন্যাস যাদের আগ্রহের প্রধান বিষয়। রোজিনা ছিল এই খারাপ মেয়েদের দলের মধ্যমণি। এসব মেয়েদের অধিকাংশেরই ক্লাস সেভেন এইটের পর থেকে বিয়ে হয়ে যেতে শুরু করল। দু একজন তো প্রেমিকের হাত ধরে ঘর পালিয়েও গেল। তবে রোজিনার বিয়ে হল মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হবার পরদিন। একজন প্রকৌশলীর সাথে। ওর আব্বা এলাকার বিশিষ্ট ডাক্তার। দুঃখের বিষয় এই যে প্রথম দিকে খারাপ মেয়েদের যাবতীয় সব বিষয়ে আমার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ওদের সব কথা আমার কাছে পৌঁছাত না। আমি ছিলাম ভাল মেয়েদের দলে। নবম শ্রেণিতে উঠার পরে অংকের চাপ কমে যাওয়ায় অন্যান্য বিষয়ে আরও ভাল করতে শুরু করি। বিশেষ করে আমার ইংরেজির নোটখাতা সব শিক্ষকদের মুখে মুখে ফিরত। এর আগে আমি নিজেও বুঝিনি যে ইংরেজিতে আমি এতো ভালো!
আমাদের দেখে রোজিনা হই হই করে বলে উঠলো, ’দেয়া তোদের ওদিকটাতেই যাচ্ছিলাম। তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস?’
’নীলিমাদির ওখানে। একটা গান তুলতে হবে। সামনে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করতে যেতে হবে।’ শেষ কথাটা রোজিনার বরকে শোনানোর জন্য বলা। ভদ্রলোক ঝকঝকে শাড়ি-গয়নার আবৃত ঝলমল করা সুন্দরী স্ত্রীর পাশে গর্বিত ভঙ্গিতে বসে আছেন।
’দাড়া খালাম্মার সাথে কথা বলে তোর গান বন্ধের ব্যবস্থা করছি।’
’তুই দুলাভাইকে নিয়ে এখনই বাসায় যাবি? আমিও আসছি। শিপ্রা তুই নীলিমাদিকে বলে দিস আমি বিকেলে আসবো।’
’না তোর সাথে দরকার নাই। তুই না থাকলেও চলবে। খালাম্মার সাথে কথা বলা দরকার। ওদিকে আমার এক মামাশ্বশুরের বাসাও। সেখানে দুপুরে আমাদের দাওয়াত।’ রোজিনার মুখে একটা অর্থপূর্ণ হাসি। বিয়ের পরে যতবার দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে রোজিনা একটু বড় বড় ভাব করছে। বোঝাতে চাচ্ছে যে সে আর আমাদের সমানটি নেই। সেই সাথে শ্বশুরবাড়ির বড়লোকির গল্প তো আছেই। অন্যান্য বান্ধবীরা অল্পবিস্তর হিংসা করতে শুরু করে দিলেও আমার মনে হতো এতো অল্প বয়সে কেউ বিয়ে করে?
রোজিনাদের রিক্সা চলে যাওয়ার পর শিপ্রা বলে উঠলো, ’তোর সাথে একটু বেরুলেই খালি লোকে পথ থামায়। এরপর আর বের হওয়া যাবে না। আর তোরই বা আজকে এতো হাটার শখ হয়েছে কেন?’
শিপ্রার রাগের কারণটা আমি বুঝি। রোজিনা একটা কথাও শিপ্রাকে জিজ্ঞেস করলো না। অথচ তারাও তো একসাথে পড়তো। এরকম প্রায়ই হয়। আমার সাথে থাকলে লোকে কি শিপ্রাকে একদমই চোখে দেখে না?
পনের
কবি, সাহিত্যিকদের যৌবনকে নিয়ে বন্দনা এবং বিশেষণ দুটোই অগুনিত। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এরকম যে যৌবন হচ্ছে রাজপথ দিয়ে ছুটে চলা একটা দ্রুততম পরিবহন। সেই পরিবহনটা যদি হয় ঝাঁ-চকচকে তবে চালকের সময় কাটে ভাল। দুপাশের বিমুগ্ধ দর্শককে পেছনে ফেলে সে চলতে থাকে রাজসিক গতিতে,রাজেন্দ্রাণীর মতো। আমি এখন সেই রাজেন্দ্রাণী। রাস্তাঘাটে বেরুলে আমার এখন এই অনুভূতি হয়। অনেকের মাঝে থাকলে নিজের অজান্তেই রাজহংসীর মতো গ্রীবা উঁচিয়ে চলি। চারপাশের অনেক চোখের ভিড়। তারপরও সেই একজোড়া চোখকে ভুলতে পারি না। কিম্বা হয়তো ইচ্ছে করেই ভুলতে চায় না। দুঃখ বিলাস বিষয়টা খুব একটা খারাপ না। অপরূপা চাঁদে কলঙ্ক থাকলে তাও আলোচিত হয়। তাই সুখী মানুষ তার দুঃখকে খুব সযত্নে লালন করে। সেদিন দাদামনু হটাৎ করেই হিরণ ভাইয়ের কথা তুললেন। আমার লালিত দুঃখ মনের আনন্দে ছলকে উঠলো। আমার এই আনন্দের কথা দাদামনু বুঝে যাবে এই ভয়ে একটু অভিনয় করলাম, ‘কোন হিরণ ভাইয়ের কথা বলছিস?’
‘তুই আবার কয়টা হিরণকে চিনিস?’ দাদামনু পারেও সাথে সাথে বোল্ড করে দিতে।
অপ্রস্তুত ভাব লুকাতে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ অনেক বছরের ব্যাপার। মনে হতেও তো একটু সময় লাগে। তা উনার ব্যাপারে কি বলছিলি?’
’জানিস হিরণ ভাইরা আবার ফেরত আসছে।’দাদামনু বলে গেলো, ’খান দাদা এখানে যেসব দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়েছেন হোসনা চাচী নাকি সেসব দেখাশুনা করতে চান। এজন্য দেশে আসার পর চাচা ঢাকায় থাকলেও চাচী কুমিল্লা মহিলা কলেজে পোস্টিং নিয়ে এখানেই থাকবেন বলে ঠিক করেছে।’
‘আর হিরণ ভাই?’
‘হিরণ ভাইও সাথে আসছে। আবার চলে যাবে। ইকোনোমিকসের উপর পড়াশোনা করবেন।’
লন্ডনে স্কুল অফ ইকোনোমিকস কি জিনিষ জানিনা। উনি আসছেন, আমাদের আবার দেখা হবে এটাই আমার কাছে বড় খবর। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে শীষ মামার মাজারের এতো ক্ষমতা! সাথে সাথে পাঁচ টাকার মানত করে ফেললাম।
’তুই এতো কিছু জানলি কি করে?’দাদামনুকে জিজ্ঞেস করলাম।
’আছে আমার সোর্স আছে।’ নিজে থেকে কিছু না বললে দাদামনু হাজার জোরাজুরিতে এর থেকে বেশি কিছুই বলবে না।
’কবে আসবেন ওনারা?’
’এখনও দিন ঠিক হয়নি।’
আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। শাহপুর থেকে আবুল চাচির পাঠানো মুড়ি-ভাজা খাচ্ছিলাম। দাদামনু ভেতর থেকে হঠাৎই এসেছিল। লুঙ্গি পড়া। খালি গা। গলায় গামছা জড়ানো। বোঝা যাচ্ছে গোছলের প্রস্তুতিতে রয়েছে। ভেতর থেকে ‘বাথরুম খালি হয়েছে।’ আম্মার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সাথে সাথে দাদামনুও গোছল করতে চলে গেল। আমি আবার আগের মতো বারান্দায় একা বসে রইলাম। সবকিছু আগের মতোই রইলো। শুধু আমার ভেতরে আলোড়ন। তার বেগ তুমুল এবং প্রচণ্ড। শান্ত চোখে বাসার সামনে দূরের দেবদারু গাছটার দিকে তাকালাম। গাছটা সামাদ স্যারের বাসার একদম সামনে। সেখানেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিচিত্র মন নেচে নেচে তার মতো করে ভাবনাচিন্তা করতে লাগলো। গাছটাকে আমার একটা উপন্যাসের মতো মনে হয়। রহস্যোপন্যাস। সেখানে ঘন পাতার ঝোপের মধ্যে ডালপালার ভেতরে ঝাঁক ঝাঁক বাদুরের বাসা। দিনের বেলায় সব ঘুমোয়। তখন শুনশান নীরবতা। সন্ধ্যে হলেই তারা সব জেগে উঠে। তখন চারদিকে ত্রিসুর -মসজিদের আজানের ধ্বনি, হিন্দু বাড়ির তুলশী তলার উলু ধ্বনি আর বাদুরের পাখা ঝাপটানোর শব্দ। আমার উত্তেজিত মন দেবদারু গাছ ছেড়ে এবার দাদামনুর গোছলে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলো। আমাদের এ বাসায় ঘরের মধ্যে বাথরুম। কল ছাড়লেই পানি। এখন মোল্লা হাবেলির সেই গোছলখানা কিভাবে ব্যবহার করতাম সে কথা মনে করলে অবাক হই। আচ্ছা হিরণ ভাইয়ের কি সেই কথা মনে আছে? একটা বদ্ধ গোছলখানায় দুটি শিশু মৃত্যুর আতংকে আটকে রয়েছে? এর মধ্যে চারবছর পার হয়ে গেছে। এতদিন লন্ডনে থাকার পর এই মফস্বল শহর কি উনার কাছে আর আগের মতো লাগবে? ঢাকা থেকে এসে জেঠাত ভাইরাই কেমন উন্নাসিক দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের দেখে মনে হয় আমাদের বাসার সবকিছুই যেন অস্পৃশ্য। আমার ভেতরের উত্তেজনা ঠুস করে চুপসে যায়। আমার রাজহংসী গ্রীবা নত হয়ে আসলো। যে হিরণ ভাইকে চিনতাম এতো আর সে নয়। এ যে সাহেব হিরণ ভাই। আমার মতো মফস্বলের এক ক্ষ্যাত মেয়েকে উনার মনে থাকার কথা নয়। ক্ষণিকের মধ্যে মচমচে মুড়ি নেতিয়ে পড়লো।
(চলবে)
উনি আসছেন, আমাদের আবার দেখা হবে এটাই আমার কাছে বড় খবর। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে শীষ মামার মাজারের এতো ক্ষমতা! সাথে সাথে পাঁচ টাকার মানত করে ফেললাম।
আমার ভেতরের উত্তেজনা ঠুস করে চুপসে যায়। আমার রাজহংসী গ্রীবা নত হয়ে আসলো। যে হিরণ ভাইকে চিনতাম এতো আর সে নয়। এ যে সাহেব হিরণ ভাই। আমার মতো মফস্বলের এক ক্ষ্যাত মেয়েকে উনার মনে থাকার কথা নয়। ক্ষণিকের মধ্যে মচমচে মুড়ি নেতিয়ে পড়লো।
আপু সিসিবির একজন ফেরিওয়ালা আমি আজ প্রথম হলাম।তোমার এই উপন্যাস নিয়ে মন্তব্য পুরোটা শেষ হলে করব।আর উপরে যে কথা গুলো পেস্ট করলাম তা এতটাই ভালো লাগলো যে না পেস্ট করে পারলাম না।
অসাধারণ উপমা।
আমি নিজে মানত জিনিশটাতে বিশ্বাস করি না। তবে কাকতালীয় অনেক কিছু ঘটে যায়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের চাওয়াকে পেতে মানুষ অলৌকিত্বের পেছনে ছোটে। আমাদের দেশে সচা্রচ এমনটা দেখা যায়।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
শান্তা,
আমাদের এক বন্ধু আমেরিকাতে বাংলাদেশ দূতাবাসে 'ডিফেন্স এডভাইজার' নিযুক্ত হয়ে ছিল। দু'বছর পর দেশে ফিরলে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম আমেরিকার কোন জিনিসটা তার বেশী চোখে পড়েছে। সে একটা মজার উত্তর দিল - এ সব দেশে থাকলে কোন কিছুর জন্যে মানত করা লাগে না।
- মানে?
- মানে ৯'টার ট্রেন ঠিক ৯'টাতেই আসে মানত ছাড়া।
কথাটা মনে হয় এতদিন পরেও বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রযোজ্য।
ঈদের বন্ধে এখনো মাকে মানত দিতে হয় - আমার ছেলে ঠিক মত ঘরে ফিরলে (রাস্তায় কোন এক্সিডেন্ট ছাড়া) এক'শ টাকার ছদকা দেব।
সাইফ ভাই অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম। প্রথমেই ঈদের শুভেচ্ছা।
আপনার মন্তব্যটা পড়ে মজা পেলাম। সেইসাথে নিজে কিঞ্ছিৎ খুশি হলাম এই ভেবে যে গল্প ঠিক পথে এগুচ্ছে। আমরা জন্ম থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশে দেখেছি। পরবর্তীতে পৃথিবীর হাজার রকম মানুষ দেখে বুঝেছি মানুষের মৌলিক ইচ্ছাগুলো এক হলেও তার প্রকাশটা দেশীয় এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির মোড়কে প্রকাশ পায়। আমি এই প্রকাশটা দেখাতে ফুটিয়ে তুলতে চাই।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
সাবলীল, গতি এবং ছন্দময়। খুবই ভাল লাগল। Pls carry on.
Smile n live, help let others do!
ধন্যবাদ আজিজ ভাই।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
১৫ পর্ব তো হয়ে এলো।
কয়েকদিন সময় চেয়ে নিচ্ছি। কাজের ব্যস্ততাটা একটু গেলে সব পর্ব একসাথে নিয়ে বসবো।
ভালো থেকো।
দাদা আমার গল্পের প্লট মাত্র খুলতে শুরু করেছে। এটা ২৫ পর্ব পর্যন্ত যাবে। আমি সবচেয়ে কনসার্ন যা তথ্য দিয়েছি তা যাতে ১০০% ঠিক থাকে। বাদবাকী গল্প বানানোতে তো আমার স্বাধীনতা আছে। তবে হ্যাঁ সময় পেলে একটু সাজেশন দিয়েন। পেছনের পর্বগুলোতে ইতিমধ্যে কিছু গতি যোগ করার চেষ্টা করছি।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
শান্তা,
এক. শিপ্রা আমার কোন কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করে না। অজ্ঞতা আমরা হাটতে থাকি।
- আমার মনে হয় তুমি "অগত্যা" লিখতে চেয়েছো।
দুই. প্রেসিডেন্ট জিয়া মহাসমারোহে সরকারি উদ্যোগে নজরুলকে জাতীয় মর্যাদা দিয়ে কোলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাঁকে উপলক্ষ করে গড়ে উঠে নানা প্রতিষ্ঠান, নানা সংঘ-সমিতি, নানা সৌধ-ইমারত।
- কবি নজরুলকে ঢাকায় এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে। জাতীয় কবিও ঘোষণা হয় তখন। তিনি মারা যান ১৯৭৬ সালে। হ্যা, তার মৃত্যুটাকে "কাজে" লাগিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তাকে "মরদে মুসলিম" বানিয়েছিলেন। জিয়ার সঙ্গে এ কাজে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা ছিল। বিএনপি-জামাতিদের দেখবে যে কোনো তর্ক-বিতর্কে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে নজরুলকে প্রতিপক্ষ করতে।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
ধন্যবাদ সানা ভাই আপনার মন্তব্যের জন্য। আমি মূল লেখায় কারেকশনগুলো সাথে সাথেই করে নিয়েছি। পরে মনে হল আপনাকে তা জানাইনি।
ব্লগের এই ইন্টারেকশনটাকে খুবই ভাল লাগে।
ঈদের শুভেচ্ছা।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi