প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে বাতাসে ফোলানো বল নিয়ে খেলাধুলার বিবরণ থাকলেও ফুটবলের জন্মভূমি ধরা হয় চীনকে। তবে খেলাটির বিকাশ, বিস্তৃতি, বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক যে রূপটি আমরা দেখছি সেটা ইংরেজদের কল্যাণে। ক্রমে তাতে যোগ হয়েছে লাতিন নির্যাস, ছন্দের মোহনীয়তা। ইংলিশ ফুটবলের গতি আর লাতিন ছন্দের আড়ালে যেটা প্রায়ই হারিয়ে যায়, তা হলো টোটাল ফুটবল’। রাইনাস মিশেলের উদ্ভাবনী ভাবনা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল ইয়োহান ক্রুইফ নামের এক দুঃখী রাজপুত্রের পায়ে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ক্রুইফকে যে দুঃখীই বলতে হয়! কারণ ক্লাব ফুটবলে অনেক অর্জন তাঁর মুকুটে যোগ হলেও ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানির কাছে ডাচদের ২-১ গোলের হার যে ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি! চলতি মেৌসুমে অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা রবিন ফন পার্সি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন ডাচ ফুটবলের সেই মর্মকথাটা, তারা মানুষের হৃদয় জিততে পারে কিন্তু শিরোপা জিততে পারে না!
মা হোসে একজন চিত্রশিল্পী আর গহনার নকশাদার, বাবা বব তৈরি করেন ভাস্কর্য। এমন শিল্পী পরিবারে জন্মে হাতে রংতুলি কিংবা ছেনি-হাতুড়ি না নিয়ে পার্সি মজেছেন ফুটবলের প্রেমে। ফেইনুর্দে খেলার মাধ্যমে পেশাদার ফুটবলারের জীবন শুরু, ২০০৪ থেকে খেলছেন আর্সেনালে। প্রথম মেৌসুমেই পেয়ে গিয়েছিলেন লিগ শিরোপার স্বাদ, কিন্তু এটা কি জানতেন সামনের সাতটা বছর যে কোনো শিরোপাই আর আসবে না! চলতি মেৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের অবস্থান চার নম্বরে, তাই শিরোপার দেৌড়ে টিকে আছে এই কথা বলা মুশকিল। এফএ কাপ থেকে বিদায় হয়েছে পঞ্চম রাউন্ডে, সান্ডারল্যান্ডের কাছে ২-০ গোলে হেরে। লিগ কাপেও পঞ্চম রাউন্ডে গানারদের ছুটি হয়ে যায় ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ১-০ গোলের হারে। ইংল্যান্ডের মাত্র দুটি ক্লাব পার করতে পেরেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব, সেখানে আর্সেনালও ছিল। কিন্তু প্রথম লেগে মিলানের কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলাটা অলীক স্বপ্নেরই মতো। এত সব হতাশার ভিড়েও ব্যতিক্রম পার্সি, একমনে করে গিয়েছেন নিজের কাজটা। ২০১১-১২ মেৌসুমে আর্সেনালের জার্সি গায়ে ৩২ ম্যাচে তাঁর গোল ৩০টি। যার মধ্যে প্রিমিয়ার লিগেই করেছেন ২৫টি, যে কারণে অন্যদের পেছনে ফেলে শীর্ষ গোলদাতার তালিকায় তাঁর নামটা অনেক ওপরে! দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ওয়েইন রুনির গোলসংখ্যা ১৭, এরপর আছেন ১৬ গোল করা সার্জিও অ্যাগুয়েরো। অথচ এই দুজনের দলই এখন লিগ টেবিলের শীর্ষে!
প্রিমিয়ার লিগ শুরুর দ্বিতীয় মেৌসুমে ৩৪ গোল করে যে রেকর্ড গড়েছিলেন অ্যান্ড্রু কোল, সেটা এখনো অক্ষত। ২০০৭-০৮ মেৌসুমে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ৩১ গোল করে প্রিমিয়ার লিগ ও ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জেতার পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কোনো ফুটবলারই গোলসংখ্যায় ৩০ ছাড়াতে পারেননি। গত মেৌসুমে কার্লোস তেভেজ ও দিমিতার বারবাতভ সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন ২০ গোল করে, অন্যদিকে স্প্যানিশ লিগে গত বছর রোনালদো করেছিলেন তাঁদের গোলের যোগফলের চেয়েও একটি বেশি অর্থাৎ ৪০ গোল! দ্বিতীয় স্থানে থাকা লিওনেল মেসির গোলও ছিল তাঁদের চেয়ে বেশি, ৩১টি। তারও আগের বছর অবশ্য ব্যবধানটা ছিল কম, প্রিমিয়ার লিগে দিদিয়ের দ্রগবা ২৯ গোল করে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা, লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসির গোল ছিল ৩৪টি। তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, মেসি-রোনালদোর গোলসংখ্যায় পরসপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু’টা থেকে যাচ্ছে স্প্যানিশ লিগের খেলোয়াড়দের পায়েই। এই মৌসুমে হিসাবটা বদলে দেওয়ার সম্ভাবনাটা ছিল রবিন ফন পার্সির। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর ক্লাব যে সে সুযোগটা দিতে পারল না।
চলতি মৌসুমে ৪১ ম্যাচে ৪৩ গোল মেসির, যদিও এই আর্জেন্টাইন খেলেছেন স্প্যানিশ সুপার কাপ, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপসহ অনেক প্রতিযোগিতায়। ৩৬ ম্যাচে রোনালদো করেছেন ৩৭ গোল। অনুপাতের হিসাবে পার্সিও তাঁদের পাশে, ৩২ ম্যাচে করেছেন ৩০ গোল। প্রিমিয়ার লিগে ২৫ গোলের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগে ৩টি ও এফএ কাপে করেছেন ২টি গোল। আর্সেনালের এফএ কাপ পঞ্চম রাউন্ডেই শেষ হয়ে যাওয়ায় ম্যাচের সংখ্যা কমে যায় পার্সির, যেখানে মেসির বার্সেলোনা খেলছে কাপের ফাইনালে আর রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়েছে বার্সেলোনার কাছেই হেরে। চ্যাম্পিয়নস লিগেও গানার’দের বারুদ ভিজে গেছে এসি মিলানের গোলবৃষ্টিতে, প্রথম লেগে ৪-০ গোলের হার হয়তো রাউন্ড অব সিক্সটিনেই থামিয়ে দেবে তাদের। তাই শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিতে পারবেন না রবিন ফন পার্সি, হতে পারবেন না ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু কিংবা ব্যালন ডি’অরের দাবিদার। কারণ হিসেবে বলা যায় অনেক কিছুই! নতুন স্টেডিয়াম বানানোর খরচের দেনা এখনো শোধ করে যাওয়া আর্সেনাল দলে আনতে পারছে না বড় কোনো তারকাকে। নতুনদের নিয়ে গড়া দল নিয়েই লড়ে যাচ্ছেন আর্সেন ওয়েঙ্গার, প্রতিপক্ষে তখন মার্কিন ডলার আর আর দিনার-রুবলের ছড়াছড়ি! তাই আর্সেনাল চমক দেখায়, আনন্দে হাসায় আর আক্ষেপে বুক ভারী করে সমর্থকদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অলক্ষ্যে হেসে ওঠে নিয়তি, পার্সি যে ডাচ! আর ডাচ রাজপুত্রদের তো দুঃখীই হতে হয়।
১০ টি মন্তব্য : “ডাচ রাজপুত্রদের তো দুঃখীই হতে হয়! (এই লেখাটা আকাশ’দা’র জন্য )”
মন্তব্য করুন
🙁 🙁 আর্সেনাল এখনো যে চারে আছে, ঐ এক পার্সীর কল্যাণেই।
দারুণ লেখা সামীউর ভাই। আকাশদা কলকাতা থেকে ছুটে আসবে এক পোয়া রসগোল্লা নিয়ে এখুনি 😀
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সিসিবিতে ঢুকেই নিজের নাম লটকে থাকতে দেখে টাশকি খাইলাম, আমার নামে ক্যান্টিন থেকে কেক কুক খাইয়া নিও 😀
পার্সি যা করছে তা রীতিমত অমানবীয়, ওর দূর্ভাগ্য এর পরেও ওর কিছুই জেতা হবে না। এখন আর্সেনাল আগামী মৌসুমে ওকে ধরে রাখতে পারলেই হয়।
এখন আশা একটাই, এই ফর্ম ইউরো পর্যন্ত থাকবে আর হল্যান্ডের হয়ে শেষ পর্যন্ত একটা ট্রফি জিতবে 😀
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আর্সেনালের সাপোর্টারদের মতন আমিও আশা করছি ভ্যান পার্সি ইংলিশ লীগে থেকে যাবে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে মিলানের কাছে এত বড় হারতা আসলেই হতাশাজনক ছিলো। ৩-০ হয়ে যাবার পরে আমি আশা করছিলাম অন্তত দুইটা বা একটা গোল শোধ দিয়ে আসতে পারবে। যা হোক, আশা করি ওয়েঙ্গার পরের মৌসুমে অন্তত একটা ভালো ডিফেন্ডার জোগার করতে পারবে।
পার্সির উচিৎ ভালো টিমে চলে যাওয়া, ফ্যাব্রিগাসের মত। ফর্ম পড়ে গেলে, না ওয়েংগার, না আর্সেনাল, কেউ তাকে পুছবেই না, বেচে দিবে নির্ঘাৎ। তাহলে এখন টপ ফর্মে থেকে কেন সে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য খেলবে না?
গো পার্সি গো,
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
পার্সি এই সিজনে যা খেলছে তা অনেকটা অতিমানবীয় পর্যায়ের। প্রতিবারই আশা করি এই সিজনে আর্সেনাল কিছু জিতবে, কিন্তু নিরাশ হই। 🙁 অপেক্ষা করছি পরের সিজনে কোন চমকের।
সামীউর, তোমার লেখা পড়ে মুগ্ধ। চমৎকার লিখেছ। পাঁচতারা। 🙂
চমৎকার লেখা সামিউর ভাই।
ভ্যান পার্সি'র জন্য আমারও দুঃখ হয়। দুঃখ হয় অভাগা ডাচ লোকগুলোর জন্য। অনেক বারই এরা প্রস্তুতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত উৎসব করতে পারে নাই।
আফসোস... 🙁 🙁
আসলে ইংলিশ লীগটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আগের সেই স্টার রাও নেই। এর মধ্যেই পার্সি লড়ে যাচ্ছে। ......। ভাই হেডিং টা পুরা সুপার লাইক... লেখাও বেশ... :clap:
শুধু বেশ! তবে এটা হবেই, বাজারের যেমন নিয়ম। একটা সময় সিরি এ খুব জমজমাট ছিল, এখন নাই। মেসি-রোনালদো চলে গেলে দেখবা স্প্যানিশ লিগেরও দর্শক হবে না। কারণ লিগ হিসেবে স্প্যানিশ লিগটা ঠিক প্রতিদ্বন্দিতামূলক না। ইংলিশ লিগের খেলার মান পড়ে গেসে,কারণ এখন আসলে পালা বদলের সময়। চেলসি বুড়োদের দল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একটা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ম্যানসিটি টাকা উড়াচ্ছে। চক্র পূরণ হবে আবার।
ইসসিরে ...... আরেকটু হইলেই তো আর্সেনাল বিশাল একটা রুপকথা বানায়ে ফেলতে পারতো ......
আর্,ভি,পি'র উচিত দল্-বদল করা!