কাঁচামরিচ- বিগতযৌবনা এক তারকা ও অন্যান্য

কাঁচামরিচ ওরফে কাঁচা লংকা। শুনেচি আকাশদার দেশের দাদারা নাকি নংকা বলে ডাকেন! শোনা কথা মিছেও হতে পারে, সে যাই হোক । বছর ঘুরে সংযমের মাস রমজান এলেই আমাদের দ্রব্যমুল্যের পাগলাঘোড়াটি যেন আরো অসংযমী হয়ে ওঠে। ফলে কাঁচামরিচ হয়ে ওঠে রমজানের সুপারস্টার! লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে তার দাম, কারণ বিপুল চাহিদা! ইফতারে মুড়িমাখা খাবেন ছোলা দিয়ে, সাথে কুঁচানো কাঁচামরিচ না হলে যে মুখে রুচবে না। পেঁয়াজু খাবেন , তাতেও যে লংকার উপস্থিতি ! ডাল কিংবা বেসনের মিশ্রণে কুঁচানো পেঁয়াজের সাথে একটু কাঁচা লংকার কুঁচি মিশিয়ে দিন, স্বাদ বেড়ে যাবে বহু গুণ। দশাশই সাইজের একখানা কাঁচা মরিচ বেসনে গুলে তেলে ভেজে ‘মরিচা’ বানিয়ে খেয়ে দেখুন, কথা দিচ্ছি খারাপ লাগবে না। আপনি স্বাস্থ্য সচেতন, তাই ভাজাপোড়া কিছু খান না। তাই বলে বাটি ভর্তি ধোঁয়া ওঠা হালিমের ওপর একটি কুঁচানো লংকার গার্নিশ না ছড়িয়ে দিলে কি ভালো লাগে?

এতো গেলো ইফতারের কথা। ভাত খেতে বসে টেবিলে পঞ্চ ব্যঞ্জনের সাথে একটা বাটিতে লেবু-কাঁচামরিচ না থাকলে টেবিলটাই যে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ঝোল দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা খেয়ে সাথে বাঁ চোয়ালে কাঁচামরিচে একটি কামড় দিলে তবেই না আসল স্বাদ ফুটে বেরুবে। এত গেলো সুশীল সমাজের কথা। একটু ‘প্রলেতারিয়েত’দের পাতে তাকাই। কাঁচা পেঁয়াজ, লবণ আর পান্তা ভাত ( নাকি এক্সট্রা চিলড আ্যকোয়া রাইস) দিয়ে খেয়েই যে তাদের দিনের শুরু। আর এই হেভি ডিমান্ড এর কারনেই তো রোজার শুরুর দিকে কাঁচামরিচ হয়ে উঠেছিলো কাঁচাবাজারের তারকা। মুল্য ২০০ টাকা কেজি মাত্র। এককেজি কাঁচামরিচে ২০০টা মরিচ হয় কি না এ নিয়ে কারো সন্দেহ থাকলেও দাম নিয়ে কারো সন্দেহ ছিলো না। কারণ দেশের দূরদর্শণ ও বেতার মাধ্যমের খবর ও বাজারদর বিষয়ক অনুষ্ঠানে কাঁচা মরিচ এর দামই হয়ে উঠেছিলো ‘হট’ খবর। টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে,কেউ কাঁচামরিচ কিনছেন এবং কিনে বুক পকেটে পুরছেন। কারণ থলেতে পুরলে কোথায় যে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে সে খবর আর পাওয়া যাবে না।

শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আটমণ চাল পাওয়া যেত এই বাক্যটা পড়লে আমাদের কাছে যেমন আজগুবি ঠেকে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো “এককালে বাংলাদেশের খাবারের হোটেলগুলোর টেবিলে সবসময় বাটিতে অনেকগুলো কাঁচামরিচ এমনিতেই দেয়া থাকতো! নীলক্ষেতের তেহারীর দোকানে গামলা ভর্তি পানিতে প্রচুর কাঁচামরিচ চুবান থাকতো। যার যত ইচ্ছা খেত” এমন লাইন পড়ে চোখ কপালে তুলবে।

কিনতু বিধি বাম! কাঁচামরিচের নামের মধ্যেই যেহেতু “কাঁচা” শব্দটি রয়েছে তাই তিনি বেশী দিন আর টপ চার্টে থাকতে পারলেন না। শীর্ষ স্থান থেকে নেমে এখন প্রায় রেলিগেশনের মুখে, ২০০ টাকা থেকে ২৬/ ২৮ টাকা। কারণ বাজারে আরেক তারকার আগমণ। “চিনি আপা” নামে আরেক উঠতি তারকার কাছে শীর্ষস্থান হারালেন আমাদের এই গ্রীন হট তারকা । একই অবস্থা রোজার আরেক ‘তারকা খেলোয়াড়’ বেগুনেরও।“বে” উপসর্গ গূণ এর আগে বসে গুণহীনতা প্রকাশ করলেও ইফতারের টেবিলে বেগুনী হবার অসাধারণ যোগ্যতায় তিনিও হয়ে ওঠেন মাহে রমজানের অন্যতম তারকা। কিন্তু তারা এখন শাবানা-ববিতার মতোই বিগত যৌবনা। কারণ সামনে আসছে ঈদ! আর ঈদে খেতে হবে সেমাই, পায়েস, ফিরনী সহ মিস্টি মিস্টি সব খাবার, আর তাই “চিনি আপার” চাহিদাও তুঙ্গে! শ্বেত শুভ্র মিষ্টি এই তারকার সুমিষ্ট স্বাদে আটকে আছে সবাই! কবি লিখেছেন, “দূর দ্বীপবাসিনী…চিনি তোমারে চিনি..”। কবির লেখনীতে যার নাম সে কি আর পেছনে পরে থাকতে পারে! তাইতো ঢালিউডের বক্স অফিস কুইন নায়িকা ‘অপু বিশ্বাসের’ এর মতো ঈদের বাজারের সবচাইতে কাংখিত বস্তুটি এখন বোধ হয় চিনি! আর চিনির ট্রাকের সামনে পিঁপড়ের মতো মানব-সারী।

চা কিংবা কফি অথবা এই গরমে শরবত। অতিথি আপ্যায়ণে এই তিনের উপস্থিতিতো থাকবেই আর সবার মাঝেই থাকতে হবে চিনি। কিন্তু মিষ্টি চিনির তিক্ত দামের কারনে অনেককেই আজ তেতো চা সোনামুখ করে খাচ্ছেন। ফ্রিজ খুলেই হোক আর দোকানে গিয়েই হোক মিষ্টি খেতে ভালো বাসেন সবাই, এমনকি ডায়বেটিক যারা তারাও! ডাক্তারের বিধি নিষেধের কারণে যারা চিনি দেয়া খাবার খেতে পারতেন না , শাওয়ালের চাঁদ দেখার আগেই তাদের ঈদ! কারণ , সবাই যে এখন তাদের মতোই “সুগার ফ্রি” খাবার খাচ্ছেন। এতে তাদের কাটা ঘায়ে কিছুটা হলেও যে মলম পড়ছে । ব্যাটারা খেয়ে দেখ, চিনি ছাড়া চা কেমন বিস্বাদ। খুবতো রসগোল্লা আর মিষ্টি দই সাঁটিয়েছিস, এখন বোঝ ঠ্যালা।

সিন্ডিকেট শব্দটা প্রথম প্রথম খুব গম্ভীর মনে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভা, শুনলেই মনে হয় অনেক চশমা পড়া জ্ঞানী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিতু এখন “সিন্ডিকেট” শব্দটি বহু ব্যবহারে মলিন। সিন্ডিকেটের মানেই এখন কিছু ব্যবসায়ী যারা কারসাজী করে দাম বাড়ায়।

কাঁচামরিচে সিন্ডিকেট, ভোজ্যতেলে সিন্ডিকেট, এখন চিনির বাজারও নাকি নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। সবাই ভূতের মতো এদের অস্তিত্ব জানে, বিশ্বাস করে কিন্তু কেউ চর্মচক্ষে তাদের দেখতে পায় না। এমনকি শাসনযন্ত্রের উপরের স্থানীয়রাও না। শুধু দেখা যায় তাদের কারসাজী। তাদের অস্তিত্ব “টক শো”তে, খবরের কাগজের পাতায়। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিরা “কানে দিয়েছেন তুলো আর পিঠে বেঁধেছেন তুলো”। তাদের কানের তুলো ভেদ করে চিনি নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলার আওয়াজ যাচ্ছে না।

অনেক তো বাজে বকা হলো, এবার একটা কাজের কথা বলি, ওসব সিন্ডিকেট -টেট বাদ দিন। তিন চাকার তারকা, নির্মানের তারকা অনেক তো হলো! এবার আসুন সব ছাপিয়ে আমরাই নির্বাচণ করি “কাঁচাবাজারের তারকা”। “এই রমজানে কে হচ্ছে কাঁচাবাজারের তারকা ?” পেটমোটা পটল, লিকলিকে বরবটি, কচকচে শশা নাকি অন্যকেউ? আপনার পছন্দের সবজিকে ‘কাঁচাবাজারের তারকা’ হিসেবে দেখতে চাইলে a, b, c অথবা d লিখে পাঠিয়ে দিন……

৩২ টি মন্তব্য : “কাঁচামরিচ- বিগতযৌবনা এক তারকা ও অন্যান্য”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    :))

    আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশীনি


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    পেটমোটা পটল, লিকলিকে বরবটি, কচকচে শশা

    তাহলে লাউ, কুমড়া, বাঁধাকপি এইগুলোকে কী বিশেষণ দিবি?


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    সামীউর লেখা ফাটাফাটি হইছে... শুধু ২য় লাইনের ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, তবে লেখা ভাল লাগায় আপাতত খালি প্রিতিবাদ জানায়েই ছাইড়া দিলাম


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. এহসান (৮৯-৯৫)

    দারুণ সামীউর! আগেও লিখেছো এবং ভবিষ্যতে এরকম আরও পোস্ট পাব তোমার কাছ থেকে- এই প্রত্যাশা সবসময় আছে। স্টেডিয়ামের পর আরেকবার তোমার লেখায় ৫ তারা দিলাম। তোমাদের চাক্রী উরফ নেট ব্রাউজিং কেমন চলছে!!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।