মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসঃ কেবলই কি ভ্রম?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর হয়ে গেল! আনন্দের ব্যাপার, গর্বের ব্যাপার, আমরা স্বাধীন জাতি। কেউ কেউ অবশ্য বলেন “স্বাদহীন” জাতি। কেননা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আমরা এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি বিশ্বের বুকে! কেননা আমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করি, নিজেদের ইতিহাস বিকৃত করি এবং তারপর বলি “অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবেনা! ভবিষ্যতের কথা ভেবে এগিয়ে যেতে হবে।” আর ভুলে যাই যে অতীত আমাদের শিক্ষা দেয় ভবিষ্যৎ এর জন্য। অবশ্য অতীত থেকে শিক্ষা নেবার ব্যাপারটা এদেশে বেশ গোলমেলে, কেননা শিক্ষার উপকরনেই আমাদের সমস্যা। আমরা পাঁচ বছর প্রাথমিক আর পাঁচ বছর মাধ্যমিক শিক্ষা জীবনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিভিন্ন ভার্সন পেয়েছি এবং একেক সময়ে পরিমার্জিত পাঠ্য বইয়ের সংস্করনে একেক রকম ইতিহাস পেয়েছি। একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস কীভাবে দু’রকম হতে পারে তা কখনই ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য হয়না। এ নিয়ে তারা শিক্ষক কিংবা এমন কারও শরণাপন্ন হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়ঃ তাদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। যা আরো ধাঁধার সৃষ্টি করে! যে নিজের মূল সম্পর্কে জানেনা সে কিভাবে ভবিষ্যতে দেশের হাল ধরবে? কথায় কথায় আমরা বলি তরুন প্রজন্ম এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর সেই তরুন প্রজন্মের কারও জানা নেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস!

জাতি হিসেবে গর্ব করার মত কী আছে আমাদের খুঁজতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আসলে কিছু পাওয়া যাবেনা। কারন গর্ব করার মত যা কিছু আমরা অর্জন করেছি আমরাই আবার সেগুলো ধ্বংস করেছি। আর তার থেকে কষ্টের ব্যাপার হল আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে গর্ব করব তারও উপায় নেই। কারণ এদেশে এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নাঙ্গ তালিকা তৈরি হয়নি। ভাগ্যাহত অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা সামান্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতাটাও পান না! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য মানুষ! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটি কষ্ট ও বেদনাময় রক্তাক্ত ইতিহাস। একই সাথে এটি একটি গৌরবের ইতিহাস। কারণ এই যুদ্ধ ছিল সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের যুদ্ধ। বাংলার আপামর জনতা এক হয়ে প্রতিরোধ করেছে পাক হানাদার বাহিনীকে। কিন্তু আমরা সর্বদাই এই প্রেক্ষিতে একটা ব্যাপার এড়িয়ে যাই। তা হলঃ ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য না পেলে কতদিন ধরে এ যুদ্ধ চলত তা বলা যায় না। তেমনি বলা যায় না আমরা আদৌ স্বাধীন হতাম কিনা! যে মানুষ গুলো তাদের দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রান দিলেন তাদের সম্মানে কয়টি মনুমেন্ট আমরা তৈরি করেছি? একথা গুলো বলতে গেলে সবাই আজ হয়ে যায় ভারতের দালাল নয়তো রাজাকার! সেলুকাস! কি বিচিত্র এ দেশ! এদেশে রাজনীতির আদর্শ(!) তৈরিই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কে কেন্দ্র করে। সেটা কোন সমস্যা নয়, সমস্যা হল দলের মহত্ব বাড়াতে সবাই যার যার মত করে তৈরি করে নিয়েছে ইতিহাস!

ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এর একটা নিয়ম হচ্ছে কোন বস্তুকে থ্রি ডাইমেনশনাল প্রোজেক্ট করলে সেটার মেইন আর্কিটেকচারাল ভিউটা পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি ইতিহাসকেও বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে এবং নিজের বুদ্ধি এবং যুক্তি খাটালে ইতিহাসের সত্যতা জানা যায়। ইতিহাসের ধর্মঃ ইতিহাস বিকৃত হবে, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাসে যার যতটুকু পাওনা ততটুকুই তাকে দিবে। ইতিহাস মিথ্যা বলে না। শুধু সঠিকভাবে জেনে নিতে হয়। মজার (কিংবা কষ্টের) ব্যাপার হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বেলায় এই প্রক্রিয়ায় এগোলে শুধু ভ্রমই তৈরি হয়! কারণটা হতে পারে এই যে আমরা ইতিহাসে যার যার প্রাপ্য স্থানটুকু তাদেরকে ঠিক মত দিইনি। কখনো অতিরঞ্জন হয়েছে এবং কখনোবা কাউকে খাটো করা হয়েছে। এবং ভুলে যাওয়া হয়েছে যে কাউকে তার প্রাপ্য সম্মান দিলে অন্য কেউ খাটো হয় না! দলীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ব্যাবহার করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করেছি। কেননা তরুন প্রজন্ম এসব দেখে এর ওপর বীতশ্রদ্ধ।

তবে আশার ব্যাপার একটাই যে এখনও অনেকে আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসতে পারেন। পথ দেখাতে পারেন নতুন প্রজন্মকে। যারা উন্মুখ হয়ে আছে সত্যকে জানার জন্য। তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে, দল মত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হোক! এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

১৩ টি মন্তব্য : “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসঃ কেবলই কি ভ্রম?”

  1. শেখ সাদী (০৬-১২)

    একটা কৃতজ্ঞতা স্বীকারের ব্যাপার ছিল, "ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এর...... ইতিহাস মিথ্যা বলে না। শুধু সঠিকভাবে জেনে নিতে হয়।" এইলাইন গুলা কার জানি ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল। (সম্ভবত দিবস ভাই, এস সি সি ) ভাল লাগাতে আমি কোট করে দিসি! 😛


    \"why does the weasel go pop? does it matter?
    if life is enjoyable, does it have to make sense?\"

    জবাব দিন
  2. দিবস (২০০২-২০০৮)

    সাদী, লেখা ভাল হইছে। তবে আশার কথা হল, এখন অনলাইনে বসলে মুক্তিযুদ্ধের মোটামুটি সব তথ্যই পাওয়া যায়, তাই আর কোন রাজনৈতিক দলের দিকে তাকায় থাকতে হয় না। সেই সাথে জামাতিদের তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদেরও প্রচারণা আছে এই বিষয়ে আর এর থেকে রক্ষ পেতে ঐ যে ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এর রুলটা খাটাতে পার 🙂


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
    • শেখ সাদী (০৬-১২)

      ধন্যবাদ, এবং সহমত! ( তবে অনেক তথ্যই বায়াসড, কাকে রেখে কাকে বিশ্বাস করাব সেটাই প্রশ্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এর নিয়মটাই মনে হয় ভরসা! এই নিয়ে জাফর ইকবাল স্যারের একটা কলাম ছিল। কয়েকটা বইয়ের কথা বলেছিলেন, সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার আর কি কি জানি!)


      \"why does the weasel go pop? does it matter?
      if life is enjoyable, does it have to make sense?\"

      জবাব দিন
  3. আন্দালিব (৯৬-০২)

    নিজে পড়ো। যে কোনো জ্ঞান নিজে না নিলে ভুল শেখার সম্ভাবনা প্রচুর। আমি নিজেও দুই রকম ইতিহাসের ভার্সন দেখে বুঝেছি এর কোনোটাই পুরোপুরি ঠিক না। একটা বই পড়ে দেখতে পারো -

    মূলধারা '৭১। দেশে থাকলে এখানে কিনতে পারবা - http://www.rokomari.com/book/30660;jsessionid=B15581CBE784D97C38EDF26A83FE7D86

    মঈদুল হাসান বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সহকর্মী ছিলেন। তাঁর লেখা বইটা।

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভাল বই অনেক পাওয়া যায় বাজারে আর নেটে। ডীপেন্ড তুমী কোনটা নীতে চাও।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।