ইদানিং কি সব কিছু ভুলে যাচ্ছি? তাই হবে হয়তো। এটা যে আমার নিজের বাসা সেটা বুঝতেই বেশ সময় লেগে গেল। আমাকে অফিসে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইশশ… কোন টাইটা পরব বুঝতে পারছিনা। আমার কালার কম্বিনেশন এর ধারনা খুবই খারাপ। শার্ট এর সাথে টাই এর ম্যাচিং করতে পারিনা। ওই তো নিতু ডাকছে “খেতে এসো, দেরি হয়ে যাবে তো!” আমি আর দেরি করলামনা। টেবিলে চলে গেলাম। টেবিলে খাবার দিয়ে নিতু বসে আছে। ওকে এতো সুন্দর লাগছে! একটা কালো শাড়ি পড়েছে,কপালে কালো টিপ,চুল পিঠে ছেড়ে দেয়া, মাত্র গোসল করেছে বোধহয়- কেমন স্নিগ্ধ একটা ভাব যেন ঘিরে আছে ওকে। একগুচ্ছ অবাধ্য চুল একপাশে ঝুলে আছে। চুলের গোছাটা বাঁ হাত দিয়ে কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে ও বলল,”অফিসে যাবেনা?” আমার চোখটা ওর বাঁ হাতের অনামিকাতে আটকে গেল। একটা আংটি, রুপার, সুন্দর একটা পাথর বসানো। বেশ ক’ বছর পেছনে চলে গেলাম। তখন মাত্র কলেজ শেষ করেছি। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে, জমিয়ে জমিয়ে কেনা একটা আংটি। এতো দিন আগের কথা, তবু সব স্পষ্ট! একেবারে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কলেজের পেছনে তেঁতুল গাছের নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি, ওইতো নিতু আসছে। সাহস করে ওকে বলে ফেললাম কথাটা। ও মুখটা নিচু করে একটু হাসল। বুঝলাম সম্মতির লক্ষণ। বললাম হাতটা দাও। তারপর আংটিটা পরিয়ে দিলাম। কী কারন জানিনা ও হঠাৎ কেঁদে উঠল। “কি হল?” -সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
“তোমার কি শরীর খারাপ?”
“নাহ”- ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম।
নিতু আজও ঠিক সেরকমই আছে। সেই চিরচেনা চোখ জোড়া, তাকালেই মনে হয় এখনই কেঁদে ফেলবে। কি মমতা মাখা চেহারা! যেন পৃথিবীর সব ভালবাসা এসে ওর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। আটকা পড়েই নিস্তেজ হয়ে যায়নি,সবসময়ই নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চায়। – কথাটা প্রমান করার জন্যই বুঝি নিতু উঠে এল। কপালে হাত দিয়ে বলল,”থাক, আজ অফিসে গিয়ে কাজ নেই। আজকের দিনটা বাসাতেই থাকো।” আমি বললাম, “না,খুব জরুরি একটা কাজ আছে।” ও বোধহয় একটু মন খারাপ করল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শুধু বলল, “ঠিক আছে, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” আমি মেনে নিলাম। ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে নিলাম। কোথায় কোন জিনিসটা রাখি এখনো মনে করতে পারিনা। এতো দিন ধরে একই রুটিন তবুও…! রুটিনের একটা বড় অংশ নিতু। ওই আমার সব কিছু ঠিকঠাক করে দেয়। মনে হয় , ইচ্ছে করেই ও সব কিছু লুকিয়ে রাখে, যেন অফিসে যাবার আগে বারবার ওকে ডাকতে হয়। ও সারাদিন বাসায় একা থাকে, এত লম্বা সময় ও কি করে কে জানে! মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দুপুরে অফিস থেকে চলে আসি, এসে বলি, “নিতু, কী রান্না করেছো? খুব খিদে পেয়েছে।” ও নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে, খুশিও হবে খুব। কিন্তু আসা হয়ে ওঠে না। অফিসে এত ব্যস্ত থাকতে হয়! নিতু টাইয়ের নটটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল, “আজকে না গেলে হয় না?” আমি বললাম, ” আমার শরীর ঠিক আছে, কেন শুধু শুধু চিন্তা করছ? তবু তুমি যখন বলছ, আমি দুপুরের আগেই চলে আসব।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।”
আমি বেরিয়ে গেলাম। বাইরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে একবার ওর দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হেসে হাত নাড়ল। আমি হাত নেড়ে গাড়িতে উঠলাম। অফিসে যেতে যেতে সারাদিন কী কাজ করব সেগুলো ঠিক করে নেব ভেবে নোটপ্যাডটা খুললাম। কি ব্যাপার? আজকের দিনটাতে লাল কালি দিয়ে গোল দাগ দেয়া! পাঁচ এপ্রিল! ধ্যাত, ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ আমাদের ম্যারেজ ডে! কালো শাড়ি আর আমার দেয়া রুপার আংটির রহস্য পরিস্কার হল। ইশ… এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারলাম না? যাই, বাসায় ফিরে যাই। নিতু হয়তো ভেবেছিল, আমার মনে পড়বে- তাই এতো নাটক করা। এখন নিশ্চয়ই মন খারাপ করে বসে আছে। ওর স্বভাব যে কি! তবু মুখে কিছু বলবেনা! “ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও, বাসায় ফিরে যাব।” ড্রাইভার কথা বলল না। একটু পরেই ইউটার্ন করা শুরু করল। হঠাৎ ওপাশ থেকে একটা গাড়ি এসে আমার গাড়িটার সামনে লাগিয়ে দিল। তারপর সব অন্ধকার!
–কেমন একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা মাথায়, ঘুম ভাঙল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। নিজের মনেই একটু হাসলাম। প্রাণহীন, শুকনো হাসি। মানুষের মন কি অদ্ভুত! নিতুর বিয়ে হয়ে গেছে দু’ বছর হল, আরেকজনের সাথে। বিছানার পাশে রাখা টেবিল ক্যালেন্ডার চোখে পড়ল- গোল দাগ দেয়া একটা তারিখ। পাঁচ এপ্রিল, ওকে প্রথম যেদিন আংটিটা পরিয়ে দিয়েছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামলাম। আজকে আবার আমার ইন্টারভিউ। সেই একই কাহিনী, একই গল্প। একটা চাকরি…… শুধু একটা চাকরি………!
বারে বারে ব্যর্থ চেষ্টা। বেঁচে থাকতে হবে তো………!
ওফ্ …… জীবন এতো নিষ্ঠুর কেন?
খুবই ভালো হয়েছে :clap:
...একদিন সবকিছু মুছে যায় হিমেল হাওয়ায়, স্মৃতিমাত্র লিখে নাম...সেইখানে আমিও ছিলাম...
অনেক ধন্যবাদ। :shy:
\"why does the weasel go pop? does it matter?
if life is enjoyable, does it have to make sense?\"
🙂
রিফাত//গ-১৩৬৮//কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ//০৬-১২ ব্যাচ