রাতের ঘ্রাণ

চার নম্বর সিগারেটের শেষের ধোঁয়াটুকু আর সহ্য হচ্ছে না, শেষ অংশটা ফিল্টার আর ছাইয়ের দঙ্গলে গুজে দিতেও প্রবল অনিহা। ওপর থেকে ওটাকে অ্যাশট্রের ওপর ছেড়ে দিয়ে মগের তলানীর কফিটুকু তার ওপর ঢেলে দিল তরুন। ছ্যাঁৎ করে একটা ক্ষণস্থায়ী শব্দ, সিগারেটের অঙ্গারটা নিভে গেল, ধোঁয়া থেমে গেল। অঙ্গার থেকে উঠতে পারা শেষ ধোঁয়াটুকু ধিঙ্গি নাচতে নাচতে তার চোখের সামনে পর্যন্ত উঠে তারপর হালকা হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল চারপাশে।

অনিদ্রায় আক্রান্ত তরুন লেখক চাইছে তার মাথায় জমে থাকা ভারগুলো এভাবে মিলিয়ে যাক, ঘুম আসুক। কিন্তু হচ্ছে না, বরং অ্যাশট্রেতে পড়ে থাকা পনের বিশটা ফিল্টার আর জমে থাকা ছাইয়ের মত বিশ্রিভাবে জমে আছে, থেকে থেকে একটা ভ্যাপসা দূর্গন্ধ দিচ্ছে মাথার ভেতর। ফলাফল, কয়েকদিন ধরে অনিদ্রা। কৈশোর আর তারূন্যের সন্ধিক্ষণ থেকেই তার স্বপ্ন লেখক হওয়া, তবে সেটা লক্ষ্য নয়। জীবনের স্বপ্ন আর লক্ষ্যকে সে সবসময় আলাদা করেই দেখে। প্রায় দেড় বছর হয়ে যাচ্ছে তার স্নাতক সম্পূর্ন হয়েছে, বিজ্ঞানের একটা ফলিত বিষয় নিয়ে। তারপর এক ভাল কোম্পানীর একটা ফ্যাক্টরীতে চাকরী। এখন পর্যন্ত সব একরকম মনমতই হয়েছে। কোলাহলপূর্ণ রাজধানীতে না গিয়ে তার কর্মস্থল নিজের শহরেরই কাছে আরেক শহরে। ফলে কোলাহল থেকে দূরে থাকা আর রুজি রোজগার, দুটোই হয়েছে।

তরুন লেখালেখি করে সেই কলেজ জীবন থেকেই। তবে সেসব তেমন কিছু ছিল না। সুগঠিত লেখার শুরু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঢুকে, তৃতীয় বর্ষ থেকে। চতূর্থ বর্ষে এসে সে দুরু দুরু বুকে লেখা পাঠায় উদিয়মান ও নবীন লেখকদের লেখা নিয়ে বাংলা একাডেমির একটা প্রকাশনায়। দুটো ছোট গল্প পাঠিয়েছিল, পর পর দুই সংখ্যায় দুটোই ছাপানো হয়। তারপর আত্নবিশ্বাস পেলে আরও কিছু লেখা বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে শুরু করেছিল, বেশ কিছু ছাপানও হয়েছিল। পরে বাংলা একাডেমীর সেই প্রকাশনার বার্ষিক সংখ্যায় কয়েকজন জ্যেষ্ঠ লেখকদের সমালোচনায় বছরের অন্যতম উদীয়মান লেখক হিসেবে তার কথা উঠে আসে। ও হ্যা, আমাদের গল্পের এই তরুন গল্পই লিখে। এটা তার জীবনে একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল, দুটো প্রথম শ্রেণীর পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায় তার লেখা উঠে আসে দেশের নামকরা লেখকদের পাশাপাশি। বই আকারে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনায় উদীয়মান লেখকদের একটা লেখা সমগ্রয় তার লেখা বের হয়। একটা দারুন সময় যাচ্ছিল, একটা আরও দারুন সময়ের ইঙ্গিত পেয়েছিল সামনে। সেসময় তরূণের মাথায় শুধু নিজের লেখা নিয়ে বই প্রকাশের কথা আসে। “শুধু উপন্যাস আর প্রেমের কবিতা নিয়ে সবখানে কাজ হচ্ছে খুব।” মনে মনে ভাবত সে, “গল্প নিয়ে নতুন কিছু করা উচিত।” প্রকাশনার জন্য এক প্রকাশকের সাথে কথাও হয়েছে কয়েকদিন আগে। নিজের লেখাগুলো বাছাই করে আর কিছু পরিমার্জন করে তার দৃষ্টিতে ছাপাতে পাঠানোর মত লেখার সংখ্যা যা দাড়াল, তা নেহায়েত খারাপ নয়। কিন্তু শুরুটা অনবদ্য না হলে নয়, আরও কিছু লেখা, যা নিজের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে লিখতে হবে।

তারপর থেকেই সমস্যার শুরু। শহরের একটু বাইরে এক তিনতলা বাসার দোতলায় থাকে আমাদের এই তরুন লেখক আর তার তিন সহকর্মী কাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি। সারাদিন অফিস আর ফ্যাক্টরীর ডিউটি শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা। নতুন কিছু লেখার চিন্তা করার পর থেকেই সন্ধ্যায় বাসা ফেরার পর আর না ভাল লাগছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া, না ভাল লাগছে লেখার টেবিলে বসে নতুন কিছু নিয়ে ভাবা। ঘুরতে ফিরতে, এখানে ওখানে বিভিন্ন সময় লেখার ব্যাপারগুলো সে এমনিতেই পেয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে বিভাগীয় শহরে পড়ত, সেই শহরের রাস্তার পাগল, ভিখারী, ল্যাম্প-পোস্ট, স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নবিত্ত ছাত্রের জীবন সংগ্রাম, রাজনীতিসহ কতকিছুই এসেছে তার লেখায়। এই যে এই কর্মস্থলের শহর, এখানকার ফুটপাত, মধবিত্তের বাজার করা বা রিকশা ভাড়া নিয়ে তর্ক- এসবও অনায়াসে উঠে আসে তার লেখায়। কিন্তু এখন লিখতে বসেও আর কিছু হচ্ছে না। লেখা দরকার কারন আরও কিছু গল্প না হলে ভাল লাগছে না, সামনের সময়টার জন্য সামনে হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার। সেজন্য উত্তেজনায় রাতের ঘুম হারাম করে দিয়ে এসেছে অনিদ্রা, কিন্তু লেখা কই?

মন হচ্ছে ঘুড়ির মত, তাকে তার দরকার মত সুতো ছেড়ে উঠতে দাও ওপরে। তারপর একসময় কোন এক ঘুড়ির মাঞ্জা দেয়া সুতোয় তোমার ঘুড়ির সুতো কেটে যাবে, ঘুড়িটা তখন বাতাসে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পড়বে এক অজানা যায়গায়। যেখানে পড়বে, সেখানে আছে একটা নতুন গল্প । ঘুড়িটা কুড়াতে গেলে তবেই তুমি সেই গল্পটা পাবে। আমাদের এই গল্পের তরুন লেখক অন্তত তাই বিশ্বাস করে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব চিন্তা ঝেড়ে মনকে একটু দূরে কোথাও ওড়াতে। কিন্তু দৈনন্দিন কাজ, চিন্তা ভাবনা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর সেটা ভাঙার আশঙ্কা আর আরও কিছু কিছু লেখার তাগিদ- সব কিছু একসাথে জমাট বেধে মাথায় ভার হয়ে আছে, ঘুড়ির সুতা আর ছাড়ছে না। জোর করে তো আর কিছু হয় না। এটা বুঝেও পারছে না মনকে মুক্ত করতে।

তখন রাত বারোটা, বাকি দুই বন্ধু যার যার ঘরে ঘুমিয়ে। একজনের ঘরের সিলিং ফ্যানটা আবার কট কট শব্দ করছে। ওর অনিদ্রাকে যেন কটাক্ষ করছে শব্দটা। ঠিক সেসময় আরেক জন নাক ডাকতে লাগল, তার চিন্তাটাকে সম্মতি দিতে লাগল যেন। তরূনের ঘরটা দক্ষিণমুখি। সে বসে আছে তার দক্ষিণমুখি জানালার কাছে স্টাডি টেবিলে। সামনেই লেখালেখির নিউজপ্রিন্ট খাতা। খাতার সাথেই কয়েকটা বই। দেয়ালঘড়িটা দেখতে ডানে তাকাতেই চোখে পড়ল টেবিলের ডানে সচ্ছ  কাচের অ্যাশট্রেটা। কি মনে হতে সামনের বই খাতা সব সরিয়ে ডান হাতে অ্যাশট্রেটা নিজের টেনে আনল। কফি ভেজা ফিল্টার আর ছাইয়ের সাথে কফির কাদাটা কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। মাথা ঝুকিয়ে অ্যাশট্রের কাছে নামিয়ে গভীর একটা শ্বাস টানল। চোখ বন্ধ করে নেয়া সে গন্ধে তরুন হতবাক হয়ে গেল; এক্সপ্রেসো কফির সাথে নিকোটিনের গন্ধের মিশেলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথেই তার যে অনুভূতিটা হল সেটাকে কি বলা উচিত তা এ মুহূর্তে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে সেটা অনেকটা হঠাৎ কিছু পেয়ে যাওয়ার মত। “অনিদ্রার গন্ধ!” কাপা কাপা গলায় বির বির করে বলল তরুন, “তবে নিদ্রার গন্ধ কোনটা?” ভাবতে ভাবতে চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে গেল সে। দুহাতে পর্দাদুটো আরও সরিয়ে দিতেই বাইরের হাওয়া এসে ছোট শিশুকে আদর করার মত তার শরীরে হুটোপুটি দিল। বাইরে বহুদূরে শুণ্য দৃষ্টি দিতে গেল, কিন্তু তার আগেই নিচে বাগানের মাঝে ছোট ধাতব থামের ওপরের সাদা বাতিটা তার চোখকে টানল সহজেই। সেদিকে চোখ নামাতেই দেখে বাতিটার পেছনে ঝোপের মত গন্ধরাজ ফুলের গাছটা, ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। বাতিটার আলোয় তাদের মনে হচ্ছে আজস্র ছোট ছোট বাতি।  “সুগন্ধি বাতি!”বাতাসে গন্ধ্রাজের সুবাস ঠিক টের পাচ্ছে তরুন। কাছে পিঠে একটা প্যাঁচা ডাকতে লাগল। শৈশবে সে একবার ঝরের পরে আম কুড়োতে গিয়ে দেখে ভাঙা ডাল পালায় আটকে আছে একটা প্যাঁচা। পরে সেটাকে ছাড়তে গিয়ে তার ডানা আর গায়ের যে বোঁটকা গন্ধ, আজ বহুদিন পর  অনুভব করল। গন্ধটা ঠিক টের পাচ্ছে কল্পনায়। বাস্তবের গন্ধরাজের সুবাস আর কল্পনায় প্যাঁচার ডানার গন্ধ- সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ। চোখ বন্ধ করে সেই গন্ধকে গভীর শ্বাস দিয়ে ভেতরে নিতে লাগল। ছোটবেলায় মা একটা গল্প বলেছিল তাকে, রাতে ফুল পরীরা পৃথিবীতে নেমে আসে, ফুল ফুটিয়ে দিয়ে যায়। কেউ তাদের দেখতে গেলেই তারা চলে যায়। কত রাত সে চেষ্ঠা করেছে জেগে থেকে চুপ করে পরীদের দেখতে! পারেনি, পরীরা জাদু করে ঘুম পারিয়ে গেছে। গন্ধরাজের গন্ধটা গভীর হতে লাগল। তরুনের মনে হল সামনের বাগানে এখন ফুলপরীরা নেমেছে, তাই চোখ বন্ধ করেই রইল। চোখ খুললে যদি ওরা চলে যায়! পরীদের ডানার ঘ্রাণ কেমন? জানে না তরুন। আবারও একটা গভীর শ্বাস টানল সে। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে ভেসে আসা ফুল, গাছের পাতা, মাটি, ঝোপ আর আরও না জানা অনেক কিছুর অদ্ভুত ঘ্রাণ আর প্যাচার ডানার কাল্পনিক ঘ্রানের যে অদ্ভুত মিশ্রণ, তা থেকে আলাদা করার চেষ্ঠা করল পরীর ডানার ঘ্রাণ, পারল না। কিন্তু তাতে কিছু বয়ে গেল না। “রাতে কত ঘ্রাণই না চারপাশে ঘুরতে থাকে!” ভাবল সে। বাইরে উম্মাতাল রাতের গন্ধ, “নিদ্রার ঘ্রাণ!” “আর ভেতরে টেবিলের ওপর ছাইদানিতে অনিদ্রার ঘ্রাণ।”

একরাশ ভাল লাগা নিয়ে ভাবতে থাকে তরুন, দুই ঘ্রাণের মাঝে এক অদ্ভুত দিশেহারা অবস্থায় বিস্মিত তরুন  এবার নিজের অজান্তেই টেবিলে বসে নিউজ প্রিন্ট খাতা আর কলমটা টেনে নিল। এইসব ঘ্রাণে ভর করে সুতো ছেড়ে ঘুড়িটা উড়তে শুরু করেছে, জমে থাকা জটগুলো এলোমেলো হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ঘুড়ির সাথে সাথে, মনে হয় কেটে যাচ্ছে ঘুড়ীর সুতো। অনিদ্রার গন্ধ নিয়ে ঘুড়িটার হারিয়ে যাওয়া দেখতে লাগল তরুন।

বি.দ্র-এটাকে আসলে কি বলব জানি না। একটা ড্রাফট বলা যায়।

 

১,২৮০ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “রাতের ঘ্রাণ”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আবারো অসাধারণ।
    কোন বিরাট গল্প না বলে শুধু কিছু মুহূর্ত, কিছু ঘ্রাণকে ধরার চেষ্টা। সরাসরি কোন কাহিনী নেই, যা আছে তা আভাসে।
    তোমাকে দিয়ে ছোটগল্প হবে রিদওয়ান।খুবই আশার কথা।

    জবাব দিন
  2. ফজলে রাব্বি নোমান (৮৬-৯২)

    এভাবে ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার সাথে তাল মিলিয়ে কোন এক লেখকের মন ও শরীরের নড়াচড়াকে গল্পে রূপ দেবার ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করলাম। চালিয়ে যাও :clap:

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।