আমাদের বাবা

ছিঁচকাঁদুনে বলতে যা বোঝায় আমি হুবহু ওইরকম। মাঝে মাঝে আমি নিজের উপর ই মহা বিরক্ত। ছোটবেলায় নাকি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে একবার মরতে বসেছিলাম দম আটকে। সেই থেকে আমার বাপ মা হাজার অপরাধ করলেও আমাকে একটু প্রয়োজনের বেশি ই ছাড় দিত। ফলাফল হচ্ছে এখনকার একগুঁয়ে আমি । বাড়িতে লাটসাহেবের মত আরামের জীবন ছেড়ে  ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার ছিলনা। তাও যখন আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কলেজে পাঠাইল, আমি ও জেদ করলাম আমার বাপ মার জন্য একফোঁটা ও কাঁদবো না। কিভাবে কিভাবে যেন আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দিন সফল ও হয়েছিলাম। সেইখানেও বিপদ। আমার মা পরেরবার ছুটি তে আসার পর আমাকে ধরে যখন কান্নাকাটি তে ব্যস্ত, এক ফাঁকে বলেই ফেললেন ,আমি ক্যামনে এত নিষ্ঠুর হয়ে গেলাম, ওদের জন্য একটু ও কান্নাকাটি করিনা।  এই কথা শুনে আমার আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখে আমার মায়ের মন টা আরও খারাপ হইল। তারা কি আর জানত, লাইটস অফ এর পর প্রতি রাতে  বালিশ ভেজাতাম নিঃশব্দে , কত রাত প্ল্যান করেছি পরেরবার কলেজে আসার সময় বড় ট্র্যাভেলিং ব্যাগ টা তে ভরে আমার পিচ্চি বোন কে নিয়ে আসব। আর অনেক অনেক বিস্কুট চানাচুর আনব আরেকটা ব্যাগ এ যাতে ওর না খেয়ে থাকতে না হয়। মনে পড়লে এখনো পেট ফেটে হাসি আসে।

জেদ বজায় রাখার জন্য বাবা মার সামনে কখনই কাঁদতাম না আমি,একবার আর্মি স্টেডিয়াম এ বাবা আমাকে দিতে এসেছে। সেইবার কি জন্য যেন বনানী তে অনেক জ্যাম।গাড়ি কিছুদূর এগিয়েই জ্যামে আটকে বসে আছি অনেকক্ষণ ।তখন ভয়ানক ইচ্ছা হচ্ছিল গাড়ি থেকে নেমে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরে যাই। চোখের পানির রিজার্ভার থেকে ততক্ষণে টুপ টুপ করে পানির বন্যা। হঠাৎ দেখি ফুটপাত ধরে বাবা এগিয়ে আসছে আমার বাসের দিকে,তাড়াহুড়া করে চোখের পানি মোছার আগেই বাবা দেখে ফেলেছে,বাবা বাসের জানালার কাছে এসে মলিন হাসি দিয়ে শুধু বলে, যাই রে মা।বলেই বাবা হনহন করে হাঁটা ধরে,একবারের জন্য ও আর পিছনে ফিরে তাকায় না। কিন্তু এই দৃশ্য টা অনেকদিন ধরে আমাকে জ্বালিয়েছে কলেজে। বাবার চিঠি পাইলেই ওই ঘটনা মনে পড়ত সবার আগে।

আজ ১৩ বছর পর আবার যে কেন পুরনো খাতা খুলে বসলাম,তার ও কারণ আছে। কাল একটা ব্লগে পড়ছিলাম বাবাকে নিয়ে এক মেয়ের লেখা। পড়েই মনে হল, মাকে নিয়ে সুখ দুঃখের লাইন আলাদা করে লেখা লাগেনা, আমি যখন যেরকম অনুভব করি,মা ঠিকঠাক সব বুঝে ফেলে। কিন্তু বাবারা সবসময় সন্ত্রস্ত থাকেন কখন যেন সন্তানেরা তাদের বুকে জমানো ভালবাসা বুঝে ফেলে তাদেরকে বিব্রত না করে ফেলে!

আমি যেমন ছিঁচকাঁদুনে ,তেমনি আবার একটু সমস্যা ও আছে।কিছু পরিস্থিতি আছে,যেখানে অন্যের কান্নায় ব্যথিত হয়ে কাঁদাটা শোভন বা উচিত,ঠিক ওইখানে আমার কোনমতেই কান্না পায়না। আমার আশঙ্কা ছিল এত বছর বাড়ির বাইরে থাকার পর নিশ্চয় বিয়ের দিন আমার কান্না পাবেনা আর সবাই ভাববে, কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা !গত মাসে বিয়ের আসরে মনে মনে যখন সাতপাঁচ ভাবছি হঠাৎ সামনে বাবাকে দেখে আবার অনেকদিন আগের সেই দৃশ্য টা চোখে ভেসে উঠল। বাসে আমি,একবার বাবার বুকে ছুটে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব আর বাবা তড়িঘড়ি করে হেঁটে  যাচ্ছেন ফুটপাত ধরে। এরকম উদ্ভট ভাবনার মাঝে ঠিক তখন ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বাবা কে সবাই বললেন, মেয়ে কে জামাইয়ের হাতে তুলে দেন।নিয়মটা হচ্ছে( সম্ভবত আঞ্চলিক নিয়ম,হিন্দু বিয়ের কন্যা সম্প্রদানের রীতি থেকে এসেছে) , কন্যার বাবা জামাইয়ের হাতে মেয়ের হাত দিয়ে বলবে ,বাবা তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিলাম।তুমি ওর খেয়াল রেখ। বাবা আমার হাত নিয়ে যেই কথা বলা শুরু করেছেন, অমনি বলা নেই কওয়া নেই,বাবার গলা ধরে এলো। সেই প্রথম আমি বাবাকে কাঁদতে দেখলাম। এরপর নতুন বউ এর দুর্নাম ঘুচাতে অশ্রুবন্যা বয়ে যাবার আর কোন কারণ লাগেনি । তখন পাশে থেকে আমার এক ভাবীর কথা কানে গেল, প্রথম মেয়ের বিয়ে তো, মায়ের আগে বাবাই কাঁদবে।

মেয়ের বাবা গুলোর কাহিনী হয়ত সবই একরকম,অনুভূতির কোথায় যেন ভীষণরকম মিল। তবে মেয়ের বাবা হওয়ার মনে হয় অনেক জ্বালা, ঠিকমত শাসন করতে গেলেই মেয়েগুলি ভ্যা করে কেঁদে ফেলে, সেই কান্না দেখেই বাবা গলে মোম আর প্রাণ ভরে ভালবাসতে গেলেই সবাই বলে, বাপে আদর দিয়ে মেয়ের মাথা খাচ্ছে। অবশ্য মেয়েদের ও একটা দুর্নাম আছে,তারা নাকি বাবাকে বেশি ভালবাসে, কে জানে সত্যি কি না !!

৩,৩২৯ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “আমাদের বাবা”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    লেখা নিয়ে কোন কথা নাই... :clap:
    কিন্তু বিয়ার একমাস পরে খবর দেয়া নিয়ে কথা আছে... x-(
    ট্রিট ছাড়া দোয়া করতে মন চাইতেছে না...তাও দোয়া কইরা দিলাম... O:-)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. আহমদ (৮৮-৯৪)

    এই লেখাটা মনে দাগ কেটে গেল।

    আরো দুটো কথা না বললেই নয়। আমার মত অনেকগুলো অন্যায় আমার ছোট বোন করলেও তার কোন বিচার হয় না। আবার এইতো সেদিন আব্বা হঠাৎ বললেন, "আমি একটা নাতনি চাই"। (সম্পাদিত)


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  3. রেজা শাওন (০১-০৭)

    চমৎকার লেখা আপু। সকল বাবা'রা ভাল থাকুক।

    আপনার বাবা দেখি আপনাকে মেলা পেইন দিছে। আমাদের অবশ্য উল্টা কেইস। ভাবতেছি বাপের কাছে সরি বলে একটা স্টেটমেন্ট লিখবো। 😛 😛

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    লেখা নিয়ে কোন কথা নাই… :hatsoff:
    কিন্তু বিয়ার একমাস পরে খবর দেয়া নিয়ে কথা আছে… x-(
    ট্রিট ছাড়া দোয়া করতে মন চাইতেছে না…তাও দোয়া কইরা দিলাম… O:-)


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    আপু, লেখা নিয়ে কোন কথা বলবো না।
    তবে আগে আমার ও মনে হত বাবারা মনে হয় একটু মেয়েদর প্রতি অনুরক্ত বেশী হয় ( ছোট্ট আমার কথা )..................যেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। 🙂 🙂 🙂
    আর নতুন জীবনে শুভ কামনা রইল।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  6. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    তবে মেয়ের বাবা হওয়ার মনে হয় অনেক জ্বালা, ঠিকমত শাসন করতে গেলেই মেয়েগুলি ভ্যা করে কেঁদে ফেলে, সেই কান্না দেখেই বাবা গলে মোম আর প্রাণ ভরে ভালবাসতে গেলেই সবাই বলে, বাপে আদর দিয়ে মেয়ের মাথা খাচ্ছে।

    আমার মেয়ের কপালে তাইলে খারাপ বাপ জুটছে, মোটেই পাত্তা দেই না।

    তবে এইটার সাইড ইফেক্টও মারাত্মক, আমি ভুল করলে ঝারি খাইতে হয়, সরি-টরি বলতে হয়, 🙁


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  7. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    তবে মেয়ের বাবা হওয়ার মনে হয় অনেক জ্বালা, ঠিকমত শাসন করতে গেলেই মেয়েগুলি ভ্যা করে কেঁদে ফেলে, সেই কান্না দেখেই বাবা গলে মোম আর প্রাণ ভরে ভালবাসতে গেলেই সবাই বলে, বাপে আদর দিয়ে মেয়ের মাথা খাচ্ছে।

    দারুন সত্য কথা। আমার বড়টাকে তাও কিছুটা শাসন করা যায়। কিন্তু ছোটটাকে বকা দিলেও হাসি মুখে, "দারুন তো ... আবার চিৎকার করো ......" ভাব নিয়ে তাকায়। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছি।

    জীবনের নতুন একটা স্টেজ শুরু করেছো ...... শুভেচ্ছা রইলো।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।