সাথে বড় কেউ থাকলে তো প্রশ্নই উঠত না, তবে একা একা রাস্তায় বের হলে বৈদ্যূতিক থামে সাঁটানো সিনেমার পোস্টারে চোখ যেত। বিশেষ করে “এক টিকিটে দুই ছবি” ট্যাগ লাগানো পোস্টারের সেই সব লোহমর্ষক ছবি! তাকানোর সময় অবশ্য মনে হত, বয়সে বড় কেউ দেখল না তো আবার আমাকে? এখন একা একাই এই মেট্রোপলিটন শহরে ঘুরে বেড়াই। চাইলে যখন তখন নির্দ্বিধায় তাকাতে পারি সেসব পোস্টারের দিকে, কিন্তু এখন আর তেমন তাকাতে ইচ্ছে করে না, তাকালেও সেই লোহমর্ষক অনুভূতি হয় না; তখন বুঝি, বড় হয়ে গেছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল কো-এডুকেশন। তবে একই ক্লাসে ছেলে মেয়েরা আলাদা ভাবে বসত। মেয়েদের দিকে তাকাতে কেমন জানি লাগত, কখনও সহজভাবে কথাও বলতে পারতাম না। এখন তো ফাজলামি করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে সহপাঠীদের সাথে কথা বলার সময় সম্বোধন করি “সুন্দরী” কিংবা “জানেমান/sweet heart” বলে। ওরা জানে যে আমি স্রেফ মজা করছি, তাই ওরাও মজা হিসেবেই নেয়। কারন আমি তাদের স্রেফ একজন বন্ধু। তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে স্কুলে একবার কী একটা অনুষ্ঠানে একটা ডিসপ্লে দেখানো হবে, তার রিহার্সাল চলছে। ডিসপ্লেতে আমারও অংশ ছিল। যে অংশে আমি ছিলাম, আমার দুপাশে দুজন বালিকা। তাদের মধ্যে একজনের নাম মনে আছে, যূঁথী। আরেকজনের নাম মনে নেই। যূঁথীর নাম মনে আছে এই কারনে যে সে আমার সিনিয়ার হলেও আমি সেই তৃতীয় শ্রেণীতেই তার প্রেমে পরেছিলাম যার কাহিনী বিস্তারিতভাবে সিসিবিতেই “আমার স্বীকারোক্তি” নামক ব্লগে উল্যেখ করেছি। একদিন রিহার্সালের সময় সুন্দরভাবে দাঁড়ানর জন্য সবাইকে একে অন্যের হাত ধরে লাইন আড়াআড়িভাবে সোজা করতে বলা হল । আমার ডান পাশে দেখি যূঁথী হাত বাড়িয়ে দিল, কিঞ্চিত শিহরীত ইতঃস্ততের পর হাত ধরলাম। দুই পাশে দুই বালিকার হাত ধরার পর বুকে সেই সিরসিরে অনুভূতি……!!!……আজও বুকে কাঁপুনি দেয়! অন্য নারীর হাত ধরা বলতে এই বাইশ বছরের জীবনের অর্জন ঐটুকুই। এখন চলতে ফিরতে আমার চারপাশে দেখি কপোত কপোতিদের। এখনও একাই আছি। বুকের ভেতর যখন একাকীত্বের ঘন্টা বাজে গীর্জার মত, জানান দেয় বড় হয়ে গেছি। যদি কাউকে দেখে ভাল লাগে, সেই মনোভাব নিয়ে কাছে গিয়ে কথা বলার বা পরিচিত হবার সাহসটুকুই এখনও হয় না। অথচ একসময় ধরেহিলাম বালিকাদ্বয়ের হাত! বড় হয়ে যাচ্ছি।
পূর্নিমা রাতে বিদ্যূৎ চলে গেলে বারান্দায় মাদুর পেতে মা আর বোনরা চাদের বুড়ির গল্প শোনাত। অন্য রাতগুলোতে আকাশের তারা দেখতাম, চাঁদ বাদে একটাই জিনিস চিনতাম, মঙ্গল গ্রহ। একাদশ শ্রেণীতে থাকা কালে কয়েকজন বন্ধু মিলে হঠাৎই শুরু হল আকাশের তারা চেনা। কলেজ লাইব্রেরীর বই ইস্যূ হল বেশ কিছু, সেসব দেখে আকাশের তারা চেনা। ক্যাডেট লাইফ, ইভিনিং প্রেপে সেসব বই দেখে রাতে ডিনারে যাবার যে ছোট্ট সময়, সেসময়ই ডাইনিং হলে যাওয়ার পথে আকাশের তারা চেনা শুরু হল। সপ্তর্ষী আর সন্ধ্যা তারা আগেই চিনতাম, এবার চিনলাম কালপুরুষ, গ্রেট বিয়ার, কৃত্তিকা, ক্যানিস, ধ্রুব তারা। এখন, বাসায় গেলে রাতে বাসার সামনের পুকুর পাড়ের বট গাছের কাছে দাঁড়িয়ে যখন আকাশে তাকাই, বিস্ময়ে হা হয়ে যাই। চেনা তারা গুলোকে খোঁজার কথা মাথায় আসেই না তখন, শুধু অন্ধকারে হাতরে হাতরে কিছু খুজে পাবার মত অনূভব করি শৈশবে তারা দেখার সেই বোবা অনুভূতিটাকে। বড় হচ্ছি, শৈশব অতীত হয়েছে।
শৈশব- চিন্তা নেই, পড়াশোনার ঝামেলা নেই, রুজি রোজগারের ক্ষুধা নেই; শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মনে পড়ে ভোরে বোনদের সাথে হাটতে বেড়িয়ে কামিনি ফুল পারানোর কথা। ছোট ছিলাম, বোনরা আমাকে তুলে ধরত ফুলের শাখার কাছাকাছি। ছোটবেলায় কামিনি ফুলকে বলতাম উপহার ফুল। বহুদিন হল “উপহার ফুল” দেখি না, দেখলেও হয়ত খেয়াল হয় না। নীলফামারীর নানা জায়গায় ঝোপে ঝাড়ে আজও আমার “উপহার ফুল” ফুটে চলছে, কিন্তু আমার চোখে পড়ে শুধু কদাচিৎ এখানে সেখানে গড়ে ওঠা দু’একটা আধুনিক ভবন। বড় হয়ে যাচ্ছি, কলূষিত হচ্ছি আধুনিক শিক্ষা আর সভ্যতায়। বাসার সামনে পুকুর পাড়ের ওপরে আকাশে আজও তারা ওঠে, কিন্তু তারাগুলো বিষন্ন মনে নিচে তাকিয়ে পৃথিবীর মাটিতে খোঁজে তাদের সেই ছোট্ট বন্ধুকে, মাছেরা ঘাই মেরে অস্পষ্ট করে দেয় জলের ওপর তাদের প্রতিবিম্ব। “উপহার ফুল” ফুটে ফুটে ঝরে যায়, সেই ছোট্ট বিস্মিত শিশুটি আর আসে না ফুল পারতে। কয়েক মাস আগে, ছুটির সময় একবার রাতে বাসায় দেরী করে ফেরার সময় হঠাৎ কামিনী ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে গেলাম। যেই মনে পড়ল “উপহার ফুলের” কথা, আকাশের বন্ধুরা আমার পথরোধ করে দাঁড়াল। সবার সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদের চরকা কাটা বুড়ি, অভিমান করে জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের ভুলে গেছিস বাচ্চা?” শিশুর মত কেঁদে উঠল বুকের ভেতরটা। বললাম, “আমার ছুটি হোক, ফিরে আসব। তোমরা ছাড়া আমার কে আছে বল?” বুড়ি বলল, “ঠিক আছে, তোর জন্য খৈ ভেজে আমি বসে থাকব।” তারাগুলোও সমস্বরে জানাল সেই কথা, অপেক্ষায় থাকবে। আমি জানি, ফেরা এত সোজা নয়। যখন পেশাগত জীবন শুরু হবে, জীবন আরও কঠিন হবে। তবে শৈশবের যেমন সমাপ্তি হয়েছে, ব্যস্ততারও একদিন সমাপ্তি হবে। যেদিন সব দায় ফুরিয়ে আবার অবসর আসবে, অনেক দূরের পথ সেদিনের পানে। সেদিন শৈশবের স্মৃতি আঁকড়ে আবার ফিরে আসব, উপহার ফুল পেরে দেব পরের প্রজন্মকে। সেদিন চাঁদের বুড়ি আবার ডাক দেবে, রাতে একা একা কথা বলব, গল্প শুনতে চাইব। বুড়ি তখন বলবে, “বোকা ছেলে, বুড়ো হলি, বড় হলি না!” ঘুরে ফিরে বয়সকালে সবাই শিশু। তাই যতই বড় হোক, কেউ আসলে শেষ মেশ বড় হয় না। সবাই শিশু, এটা যারা বোঝে, তারাই সরল শৈশবের মত জীবন ফিরে পায়। পাঠক, শৈশবের অপাপবিদ্ধতায় আলোকিত হোক আপনাদের সবার জীবন।
২৬ জুন, ক্লাস টাইমে ব্যাকবেঞ্চে বসে লেখা
মেশিন টুল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস, সময় অজ্ঞাত।
:clap: :clap: :thumbup:
খেয়া (২০০৬-২০১১)
১ম (সম্পাদিত)
People sleep peaceably in their beds at night only because rough men stand ready to do violence on their behalf.
শেষ প্যারাটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো ভাইয়া...... 🙁 🙁
অসাধারন... :thumbup: :thumbup:
তোমাদের সাথে অনুভূতি ভাগাভাগি করতে পেরে ভাল লাগছে। সবাইকে ধনবাদ। 🙂
তোর লেখা পড়ার অনুভুতিটা কিরকম জানিস? অনেক মসৃণ ......সহজ ভাষায় লেখার ক্ষমতা সবার থাকেনা :hatsoff:
আপু, আমাদের জীবনকে সহজভাবেই দেখে যাই প্রতিনিয়ত। আমাদের জীবন যেন থাকে আমাদের ভাষার মত সহজ, শৈশবের মত অপাপবিদ্ধ। আপনাদের অনুপ্রেরনা... :hatsoff:
ভালো লেগেছে ছোট ভাই। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)
কিছু খাবার আছে, মুখে নিলেই পেটে চলে যায়, সুস্বাদু ও সহজ,
তোমার লিখাটাও এমনই ভাল লেগেছে। :clap:
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂
কী রে রোমিও হয়ে গেলি??? তোর সব পোস্টইতো দেখি নারিঘটিত!!! ভাল আছিস???
আরে ভাই, এটায় মেয়েদের নিয়ে লিখেছি কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে শৈশব থেকে কিভাবে বেড়ে উঠলাম, সেটা নিয়ে। আছি মোটামুটি।
দোস্ত অসাধারণ লেখা ... তুই এত ভাল লেখস জানতাম না। তবেঁ সব লেখার শেষে/শুরুতে একটা সামারি দেয়া লাগে যেটা এইখানে নেই ... এরপর থেকে মকরা এক্সক্যাডেটদের জন্য অবশ্যই লেখার শেষে একটা সামারি রাকবি ... 🙂
তোর মত মকরা কাডেটদের সংখ্যাই তো বেশি, ঠিক আছে দিমু নে সামারি। পড়ার জন ধনবাদ।
🙂
দিলি রে মনটা খারাপ করে। :boss: :boss:
ভাই, আমাদের সবার জীবনের শৈশববোধ হয়ত একেক রকম, কিন্তু সেই হারিয়ে যাপ্যার অনুভূতিগুলো হয়ত একই রকম।