৩০ নভেম্বার, রাত ৯ঃ১০
খুলনা স্টেশন।
ট্রেন প্রায় দুই ঘন্টা লেট। একটা সিগারেট ফুকতে ফুকতে ওভার ব্রীজে পায়চারী করছিলাম আর কয়েকদিন আগে এই স্টেশনে বসে ভাবা ও পরে লেখা স্টেশনের পাগলকে নিয়ে গল্পটার সমাপ্তি নিয়ে ভাবছিলাম। তারপর খানিকটা ক্লান্ত লাগলে নিচে, ২ নং প্ল্যাটফর্মে নেমেছি। প্লাটফর্মের এ মাথা থেকে ও মাথা; অনেক যাত্রী। কেউ ট্রেন দেরী হওয়ায় বিরক্ত, কেউ গল্পে মশগুল। প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে হেটে যাবার সময় দেখছি এইসব মানুষকে, যেন মানুষের জীবনকে দেখছি। একপাশে একদল কুলি বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে আর ন্যাকড়ার মত নেতিয়ে যাওয়া, পুরন মুড়ির মত বাসি হয়ে যাওয়া তাস পিটিয়ে খেলছে। “এই গোলাম দ্যাখ! গোলাম দিইয়ে এই দান মাইর!” :duel: এক গুফো কুলির উত্তেজিত ও জোরাল গলা শুনলাম। ওদের পাশ কাটিয়ে এসে ২ নং প্লাটফর্মের একেবারে উত্তর দিকের বেঞ্চে বসলাম। ব্রিটিশ শাসনের সাক্ষী এই বেঞ্চ।আমার সামনে মোটামুটি ৮ ফুট প্লাটফর্ম, তারপর দুটো ব্রডগেজ লাইন। ওপাশে, ১ নং প্লাটফর্মে একেবারে আমার সরাসরি বসে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক নারী। চাদর পেতে বসে আছেন তারা। কি একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছে, আমার মনে হল কোন পুরন স্মৃতি। তার বাম দিকে উলটে রাখা রেলের এক জোড়া ক্যারিয়ার হুইল এ্যক্সেল, তার ওপর এক তরুন বসে, বিভোর হয়ে আছে মুঠফোনের স্ক্রীনে। আরও ওদিকে, দক্ষিনে প্রথম টি-স্টলের পাশে একলোক সস্তা চাদর বিক্রি করছে। লোকজন মোটামুটি গোল হয়ে তার চাদর নিচ্ছে। শীতের শুরু, এখনও মানুষ ততটা সচেতন হয়নি। তাই রাতের ট্রেনের শীতের হাত থেকে বাচতে ওনেকেই তা কিনছে। আমার কাছে শীতের কাপড় আছে। না থাকলে একটা কেনা যেতকিনলে একটা ব্যাপার হত যে হঠাত করে এত বিক্রি করে লোকটার চোখে মুখে যে আনন্দের আভা, সেটা দেখা যেত। সিগারেট ধরান দরকার……
(ট্রেনের সিটে বসে লিখছি।) সিগারেটটা শেষ হতে না হতেই ট্রেন চলে এল। ২ নং প্ল্যাটফর্মের দিকে ট্রেনের সব দরজা তখনও খোলা হয়নি। তাই ওপাশে যেতে থেমে থাকা ট্রেনের নিচ দিয়ে গেলাম। ট্রেনের নিচ দিয়ে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে ওঠার সময় দেখি দুই আনত নয়না নারী ওবাক হয়ে তাকিয়ে আমার ট্রেনের তল দিয়ে ওঠা দেখছে! চেয়ার কোচে ওঠার সময় দেখি তারাও একই বগিতে! আমার মত প্রেমহীন তরুণ যেটা চাইবে, তাদের কাছাকাছি বসতে, আমি চেয়েছিও তাই- তাদের সীট যেন আমার কাছাকাছি থাকে। চেয়ার কোচের মাঝখানে যে মুখোমুখি সীট, তাতে তারা বসল আমার মুখোমুখি! 😡 মুখোমুখি বলতে কোনাকুনিভাবে মুখোমুখি। একেই বলে ভাগ্য! তারা আত্নীয় স্বজন মিলে মোটামুটি আট-নয়জন। চেয়ার কোচের থ্রী-সীটের একেবারে সামনে বসেছে তারা, সাথে তাদের বাবা। তার পেছন থেকে পরবর্তী দুই থ্রী সীটে তাদের বাকিরা। আর এপাশে টু সীটের মুখোমুখি অংশে তাদের কোনাকুনি বা মুখোমুখি বসেছি আমি, জানালার সাথে। ট্রেন ছাড়ার পর তো তারা চোখের কোনা দিয়ে আমাকে খেয়াল করতে লাগল, আর আমি মাঝে মাঝেই হঠাত তাকিয়ে তাদের অপ্রস্তুত করতে লাগলাম। কয়েকবার কান খাড়া করে আর ইচ্ছা করে যায়গা থেকে উঠে তাদের কথা শুনে বুঝলাম বড়জনের নাম পিউলি আর ছোটজনের নাম বর্ষা। ভদ্রলোক বড়ই বেরসিক। বড়জনের নাম হওয়া উচিত ছিল বর্ষা আর ছোটজন বৃষ্টি। বর্ষা এলে তবে আসে বৃষ্টি :-B । বর্ষা বসেছে জানালার সাথে, তাদের বাবা বসেছে করিডোরের সাথে কর্নার সীটে আর আজকের “Lady of the Train” পিউলি বসেছে মাঝখানে। তাদের কথা বার্তায় যা বুঝলাম, পিউলি এবার স্কুল ফাইনাল মানে SSC দেবে। ভদ্রলোক তো সীটে বসেই ঘুমিয়ে গেলেন, আর দুই নারী চুরি করে আমাকে দেখতে লাগল। ধরা পরে গেলেও থামাথামিনাই। আমার মত ছেলেকে দেখার কী আছে ভাবতে গিয়ে সুনিলের একটা লেখার কথা মনে পড়ল- রক্ষনশীল পরিবারের মেয়েরা এমনিতে অন্য ছেলেদের সাথে মিশতে পারে না বলে যখন তারা ভ্রমণে বের হয়, তখন কাছে যে থাকে, তাকে চোখ ভরে দেখে। এদের অবশ্য ঠিক সেরকম মনে হল না। রাতের ট্রেন, লাইট জ্বালান, তার ওপর জানালার কাচ নামান। ভেতরে আলো, বাইরে আধার। জানালার কাচ খুব সুন্দর আয়না হয়ে গেল। সেই আয়না দিয়ে ওরা আমার দেখতে লাগল, আর আমিও ওদের দিকে! সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মত অনুযায়ী শয়তান সুদর্শন হয়, তাই সে নারীদের কাছে টানতে পারে। আমি তেমন কিছু সুদর্শন নই। বোনরা বলে কাঠখোট্টা বাঙ্গালী, বন্ধুরা বলে কাটখোট্টা সোভিয়েত। যখন আমি তাদের ধরে ফেলি তারা তখন নিজেদের মাঝে ফিসফাস করে আর হাসে। আজ ট্রেনের এই বগিতে যাত্রীর সংখ্যা কম, তার মধ্যে আবার অনেকেই ঘুমান শুরু করেছে। মোটামুটি নিরব অবস্থা। যশরের আগে এক পাড়া গায়ের স্টেশনে ট্রেন থামল ক্রসিংযের জন্য। পাশের সীটের সহযাত্রীর সাথে কথা বার্তা শুরু হল। ভদ্রলোক আমার মতই উত্তর বঙ্গের মানুষ, চাকরি করেন খুলনায়। কথা প্রসঙ্গে আমি কি করি জানতে চাইলে জানালাম যে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। প্রকৌশলিদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তার সাথে কথা হচ্ছিল, এমন সময় দেখি পিউলি হা করে আমার কথা গিলছে। সেনা কর্মকর্তাদের মত না হলেও শুনেছি বিয়ের বাজারে প্রকৌশলিদের অবস্থা খারাপ নয়। পিউলির চেহারার ভাব দেখে মনে হল পাশে বাবা না থাকলে আমার সাথে নির্ঘাত আলাপ জমাত! ইশ! পাশে তার বাবা থাকায় এক নারীকে উদ্ধার করতে পারলাম না! :bash: (পাঠক, আপনারা কি ভাবছেন জানি না, আমি এখানে আমার সত্যিকারের ডায়েরীর পাতাকে তুলে ধরছি, সুস্থ স্বাভাবিক তরূন হিসেবে এরকম অবস্থায় পড়লে এরকম ভাবা যেতেই পারে!)
আমার যাত্রা পথের মধ্যবিন্দু ইশ্বরদী জংশন পার হয়ে ট্রেন এখন নাটোরের দিকে। ওরা দুজনই এবার ঘুমিয়ে। এবার শুধু আমার দেখার পালা! প্রাণ ভরে দেখছি, এমন সময় সে জেগে উঠল। শুনেছি ইশ্বর নারীদের তৃতীয় নয়ন বলে একটা জিনিস দেন। সেটাই তাদের সব অবস্থায় পুরুষদের ব্যাপারে সাবধান করে দেয়। চোখ খোলার সময়েই তার বাম কোনা দিয়ে আড়চোখে আমাকে ধরে ফেলে ইচ্ছা করেই আবার চোখ বুজল। আমাকে সুজোগ করে দিল বোধ হয়! হুমায়ুন আজাদের কবিতা মনে পড়ল- “তুমি যাকে স্বপ্ন দাও তাকে সোনা কর/ যাকে দেহ দাও তাকে গাধা কর…।” পিউলি যদি আমাকে সোনায় ভরে দেয়, আমার আপত্তি কি তাতে? ওকে দেখার জন্যই বোধ হয় আজকে ধূমপান করেছি মাত্র দুবার! নিজের কাছেও বিশ্বাস হয় না। আমার বাসার দিকে ট্রেন জার্নি অনেক লম্বা, সারা রাত লাগে, প্রায় ১১ ঘন্টার মত। এমনিতে ধুমপান অতটা না করলেও একা গেলে তখন বেশি সিগারেট খাই, প্রায় এক ১২-১৩টা! এমনিতে সারাদিনে খাই ২টা বা ৩টা।আজ এতক্ষন পর্যন্ত মাত্র দুই! এক পিউলিতেই এই অবস্থা, তাহলে জীবনে যে আসতে পারে, সে আসলে তো একেবারে দেবদূত হয়ে যাব O:-) ! কয়েকদিন আগে শিশির বিন্দুর প্রতারনা ভুলতে পারিনি তো, তাই যাকেই পাচ্ছি, দু চোখ ভরে দেখছি। ব্যাপারটা হচ্ছে pencil এর দাগ eraser দিয়ে মোছা। দাগ গেল, ইরেজারও গেল। মাঝখান দিয়ে আমি সাদা কাগজ। শান্তি, শান্তি………শান্তি। জগতে শান্তি বর্ষিত হোক :dreamy: । এমন সময় আমার মুখোমুখি বসা ঘোরতর পর্দানশীল, অবিভাবক শ্রেণীর নারী আমার দিকে ভাটার মত জ্বলন্ত দৃষ্টি দিলেন। হায় ইশ্বর! এভাবে অন্যরাও আমার ব্যাপারটা জেনে গেলে তো সমস্যা।উনি আবার মাথা ঘুরিয়ে পিউলির দিকেও চাইছেন। ভাল, ভাল, এরপর কি জিজ্ঞেস করবেন, “এই! ট্রেনে বসে এসব কি লেখ?” জিজ্ঞেস করবেন না জানি কারন আমি পরপুরুষ। জিজ্ঞেস করলে ভাল হত, ডায়েরিটা দিতাম পড়ার জন্য। “নাউজুবিল্লাহ!” শব্দে তাহলে ট্রেন কেপে উঠত। সেই কম্পনে ট্রেন থেকে পড়ে গেলাম আমি, আর পিউলি এসে পড়ল আমার উপর…উমম! কি অসাধারন কল্পনা :guitar: ! ট্রেন নাটোরে পৌছেছে সেই ২০ মিনিট হল। বিরক্তিকর ক্রসিং। অবশেষে ক্রসিং ক্লিয়ার হলে ২৫ মিনিট পরে ট্রেন ছাড়ল। আমি নিজেও ক্রসিংয়ে। আমার আসল জন যে আসলে কে, জানি না। তবে তার কাছে পৌছতে গিয়ে ক্রসিং- একবার শিশির বিন্দুর সেচ্ছাপ্রনোদিত প্রতারনা, আবার রাধার আহভান আবার এখন পিউলির দুষ্টুমি(!) 😀 । ধূর………ক্রসিংযের জন্যই দেশটার উন্নতি হল না। ট্রেন ছারতে গেলে আবার থামে।
(১ ডিসেম্বার, সকাল, সময় অজ্ঞাত; পার্বতীপুর থেকে ট্রেনের শেষ স্টেশন সৈয়দপুরের পথে লেখা)
নাটোরের পরের স্টেশন সান্তাহারে পৌছানর ঘোষনা শুনে চোখ বুজেছিলাম, তারপর মোটামুটি দেড় ঘন্টার গভীর ঘুম। বিরামপুরের কাছাকাছি এসে দেখি, ওরা গায়েব! হায় হায়, তবে কি ওরা সান্তাহার বা জয়পুরহাটে নেমে গেল? ধূর, কি আর করা। “যা পেয়েছ, তা ঢের, বুঝেছ তরুন?” বুঝলাম। কিন্তু বুঝতে না বুঝতেই ধূমপান করার জন্য উঠে যেই পা বাড়িয়েছি করিডরে, দেখি যে সীটে ওরা বসেছিল, তার পেছনের সীটে ওরা বসে আছে। আমার দিকে চেয়ে এবং বোধ হয় আমার মনের ভাষা বুঝতে পেরে পিউলি একটা মুচকি হাসি দিল। বুঝল বোধ হয় আমার মনের ভাব। তখন সকাল ৬:১৫ অতএব করিডরে আমার প্রাতঃভ্রমণ ও প্রাতদর্শন! পার্বতিপুরে এসে ওরা নামল। সেসময় ওদের কথা বার্তা শুনে বুঝলাম খুলনায় আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। নামার সময় পিউলি ইচ্ছা করেই সবার পেছনে থাকল আর বার বার পিছে ফিরে আমার দিকে চাইল। ওরা প্ল্যাটফর্মে নামলে আমি জানালা দিয়ে গলা বাড়ালাম। পিউলিও ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, পিছে ফিরে আমাকে দেখে একটা মধুর মুচকি হাসি দিল, আমি ডান হাতটা হালকা তুললাম :hug: । মুখোমুখি সীটের পর্দানশীলা তখন জানালায় গলা বাড়িয়ে বুঝতে চাইলেন ব্যাপারটা। ভাগ্যিস, পারেননি।
১ ডিসেম্বার, ২০১১, সন্ধ্যা ৬:১৪ (এই অংশটুকু বাসায় বসে লেখা)
তারপর আর কি, সৈয়দপুরে পৌছে এক সপ্তহ পরের ফিরতি টিকেটে একটা আরামদায়ক সীট নিশ্চিত করে তারপর নীলফামারীতে আমার বাড়ী ফিরলাম। আরেকবার উপলব্ধি করলাম, There is no other place sweeter than home, Sweet Home!
(পাঠক, বিশ্বাস করুন আমি ততটা …নই। তেমন হলে এসব নির্দ্বিধায় শেয়ার করতাম না। আগামী ১৩ জুন রাতে আবার বাসায় যেতে হচ্ছে। টিকেট কেটেছি সেই একই সিটে! সে জন্যই মনে হল ব্যাপারটা আপনাদের সাথে শেয়ার করি।)
পড়ে ভালো লাগলো...... বেশ মজা করে লিখছ... :clap:
😡 😡 😡 :thumbup:
খেয়া (২০০৬-২০১১)
শুরু হইয়াও হইলো না শুরু...... 😕 😕
ইসসিরে.....আফনের লেইগ্যা আমারি কষ্ট লাগতাসে.....
😛 😀 😉
😛 😛
ঈদের সিজনে এই রুটে ৯ ঘণ্টা আমার একটানা দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। জয়পুরহাট থেকে খুলনা পর্যন্ত।
এতো বড় একটা জার্নিতে তোমার মোট এমন নোটখাতা নিয়ে লিখতে বসে যেতে পারলে, মনে হয় ভালই হত।
মজা পেলাম রিদওয়ান।তোমার লেখার হাত বেশ সাবলীল।
পরীক্ষায় অবশ্য এ জার্নি বাই ট্রেন রচনায় এই কাহিনী লিখলে ডাব্ব... =)) =))
আরেকটা কথা। এমনিতে ইমোটিকন ব্যবহার আমার তেমন খারাপ লাগেনা। কিন্তু এখানে যেখানে যেখানে তুমি ইমোটিকন বসিয়েছো, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়েছে লিখিত বাক্যই তোমার ইমোশনকে প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
তবে এটা হয়তো একটু পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেলো। এমন দিন হয়তো আসবে যখন আমাদের গল্প কবিতা উপন্যাসেও অকাতরে ইমোটিকন ব্যবহৃত হবে, শব্দবন্ধের বদলে।
নুপূর ভাই, আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন থেকে ইমোটকন ব্যবহার চিন্তা ভাবনা করেই করব। পুরোন দৃষ্টিভংগি হলেও এটাই সত্যি। অনুপ্রেরনার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
খুব সুন্দর লেখা। অনেকদিন পর ব্লগে এসে সুন্দর সুন্দর লেখা পরে খুব ভাল লাগছে