রাজপুরুষ

টিউশনী যারা করে, কেবল তারাই জানে এর জালা কিরকম।বিশেষ করে যারা খুলনায় টিউশনী করে, একে তো দূরত্ব, তার উপর সারা বছর ভ্যাপসা আবহাওয়া।সেদিন ছিল আমার জন্মদিন।বাস্তবতার টানে সেদিনও বিকেল হতেই টিউশনীতে যেতে হল।এমনিতে সারাদিন ক্লাস, ল্যাব তারপর ক্লাস টেস্ট; এরপর কারো মেজাজ ঠিক থাকে না। সে অবস্থাতেও অতি কষ্টে একটা কেক আর কলা খেয়ে তারপর চা সিগারেট হাতে চিন্তা করছিলাম, মাস চলবে কিভাবে।আজও টিউশনীতে না গেলে পরে মাস শেষে টাকা নিতে গায়ে বাধে। তাই কি আর করা, জন্মদিনেও টিউশনিতে যেতে হচ্ছে। বেচে থাকলে একদিন নিশ্চই এক আনন্দময় জন্মদিন আসবে।সিগারেটটা শেষ করে কাম্পাসের বাইরে এসে সেনানিবাসগামী লোকাল বাস ধরলাম।আজকের টিউশনিটা ওখানেই।আর্মি সার্ভিস কোরের সদর দপ্তরের সামনে নামার সময় এক বৃদ্ধকে নামতে দেখছিলাম, কিছু একটা চোখে পড়ায় তাকে নামতে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে গেলাম ।আমার খেয়াল হল যে তার ময়লা শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবীর আলগা ছেড়া পকেটে কতগুল নোট।কোনদিন কাউকে কিছু না বলেও বোধহয় নেই নি। কিন্তু শয়তান তখন তার সমস্ত প্রতিভা আমাকে দিয়ে দিয়েছে।সাফাই করে দিলাম,একটুও বুক কাপলো না।ছোট বড় নোট মিলিয়ে পরিমানটা খারাপ না। সিগারেটের দাম বাড়ছে।বহুদিন আমার প্রিয় সিগারেট “555 london” কেনা হয় না। এ টাকা দিয়ে কাল এক প্যাকেট অনায়াসে হয়ে যাবে।সেনানিবাসে চেক ইন করার সময় মনের আনন্দে কর্তব্যরত সার্জেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম,“ভাইজান, খবর কি?” তার অবাক চোখের সামনে দিয়ে এগোতে থাকলাম অফিসার্স কোয়ার্টারের দিকে। ষ্টেশন সদর দপ্তর আর তার সাথের মসজিদকে ডানে রেখে এগোচ্ছি, এমন সময় মাথায় এল কামালের কথা। ব্যাটা আস্ত ছাগল একটা। বড়লোকের ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পোকার খেলা শিখেছে। হঠাৎ সঠাৎ খেলতে আসে। আমরা ২০০-৩০০ টাকা ধরতে না ধরতেই ও ৫০০ টাকা ধরে বসে। প্রতিবারই দুই নম্বরি করি,যার ফল হচ্ছে ওর সব টাকা আমার পকেটে। তারপর সেটা দিয়ে মাস শেষে খুলনা শহরের পি টি আই মোড়ের মিনি চাইনিজে ভূড়িভোজ! ওটাই আমার একমাত্র বিলাসিতা, তাছাড়া কোন বিলাসিতা নেই আমার জীবনে। আজ রাতেও ওকে ডেকেছি, নতুন কৌশল শেখাব বলে। কচু শেখাব! ভাবতে ভাবতে ডানে মোড় নিয়েছি, আমার বাম পাশে একটা ছোট্ট সুন্দর খাল। আমি তা খেয়াল করি না,হাটতে থাকি। খালের শেষে শুরু অফিসার্স কোয়ার্টার। শেষ বিল্ডিংয়ে পৌছে গেলাম।

টিউশনী করতে আজ ভালই লাগল। প্রতিবার জন্মদিনের দিন স্বর্গীয় বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে, কিন্তু আজ পকেটে গরম জিনিস! টিউশনি শেষ করে বেরিয়েছি। ক্লান্ত শরীরে ঘুমের তীব্র পিপাসা। যেহেতু পকেটে জিনিস আছে, ভাবলাম একটু বিলাসিতা করি, বেবিট্যাক্সিতে যাই। মেইন গেট দিয়ে বেড়িয়ে রাস্তার ডান দিকের প্রথম গতিরোধকের পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে ডান দিকে ঘুরে আছি, এমন সময় খুন হলাম। পেছন দিক থেকে ছোরা মারল। হিরা কেটে বানান দামি রাশিয়ান ছোরা। তীব্র ধারে পুরোটাই ঢুকে গেল একেবারে বুকের পাজর অবধি। একটা টু শব্দও বের হল না, কাটা কলাগাছের মত ধব্সে পড়লাম রাস্তার পাশে। কয়েক ঘন্টা চলে গেল। শরীরের সব রক্ত বের হয়ে জমাট বেধে গেল রাস্তার ধূলোর ওপর। কিন্তু আশ্চর্য! নীল ডুমো মাছির দল ভন ভন করতে এল না। আধারে পড়ে ছিলাম, তাই কেউ খেয়ালও করল না আমার লাশ। এমনকি, রাতে রুটিন চেক করতে আসা সৈনিকরাও!

 

||

রাত ১১টা বেজে৫, মমিন ভাইয়ের চায়ের দোকানে ১ ঘন্টা আড্ডায় ৪ কাপ চা, ৩টা সিগারেট শেষ করে তারপর দেড় ঘন্টা বন্ধুদের সাথে হাটাহাটি করে রুমে ফিরলাম। কামাল চলে এসেছে। ওকে দেখেই হঠাৎ করে মাথাটা ঝমঝমিয়ে উঠল। আজ সন্ধ্যায় কি জানি মনে হল? ও হ্যা, ওকে ঠিক পথে আনতে হবে। রুমের বাইরে ডাকলাম ওকে।“দ্যাখ ভাই, তুই যখন বাবা হবি, কখনও যদি এমন হয় যে তোর ছেলে তোকে মিথ্যে বলে টাকা নিয়ে জুয়া খেলছে, কেমন লাগবে? আজ যদি এই বা-র খেলা না ছাড়িস, সেদিন তাকে ধরতে তোর নিজেরই বাধবে। মনে তোর সেই অধিকার নেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করার।”কি যে হল, কামালকে দেখে মনে হল বিষন্ন দেব শিশুর মত। সে চুপচাপ চলে গেল।

| |

দুই দিন পর আবার টিউশনিতে গেছি, সেনানিবাসে। টিউশনি শেষে সেনানিবাসের গেট দিয়ে বেড়িয়ে ডান দিকে ঘোরা মাত্রই চোখে পড়ল গতিরোধকের পাশে একটা লাশ। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কাছে গিয়ে দেখি লাশের গায়ে নীল গেঞ্জি, আমার কলেজ পূনর্মীলনীর! তবে কি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে আমার কলেজেরই এমন কেউ…? লাশের ঘাড়ে হাত দিয়ে চিৎ করে দেখি, আমার চেহারা! আমি? মাথাটা বনবন করতে লাগল! দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লাম। হড়হড় করে বমি এল। দুপুরের লাঞ্চ, বিকেলের ডিম পোচ, খয়েরি চা, সিগারেটের নিকোটিন- সব বেরিয়ে এল। একটু ধাতস্ত হয়ে উঠে দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক লোক, রাজপুরুষদের মত উজ্জল চেহারা।হাতে একটা ছুরি। দেখে মনে হল হিরের তৈরি, চকচক করছে সেই সন্ধ্যার আধারেও। হাত জোড় করলাম তার কাছে, “দয়া করুন! আমি অনাথ, আমায় মারবেন না।” তারপরই চোখ পড়ল তার চোখের দিকে, দেখলাম সে চোখে জিঘাংসা নেই, শান্ত মোলায়েম একটা ভাব। “তোমার স্বর্গীয় কাছের মানুষেরা তোমার কুকর্ম দেখে বলেছে, এমন ছেলে কেন তাদের কবরে মাটি দিয়েছিল? এর চেয়ে তাদের লাশ নর্দমায় ফেলে দেয়াই নাকি ভাল ছিল। তাই তাদের কষ্ট যাতে আর না বাড়ে…”রাজপুরুষ একটা হাসি দিয়ে বললেন, “তোমাকে দুই দিন আগে সন্ধ্যায় এখানে খুন করে রেখেছি।এই দুই দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম, তোমার লাশ তোমাকে বুঝিয়ে দেব বলে।”  দু চোখ বেয়ে দর দর করে পানি বয়ে এল। “হে মহান দেবদূৎ, আমার মত অন্যদের কবে খুন করবেন?” রাজপুরুষ উত্তর দিলেন, “সেটা জেনে কি করবে? ফিরে যাও।” শান্ত আর হালকা মনে আমি হাটা ধরলাম, নিজের ঐ লাশটার দিকে ফিরেও তাকালাম না। জানি, ওটা হাওয়ায় মিলিয়ে নিশ্চিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

উৎসর্গ- আমার স্বর্গীয় বাবা-মা’কে। সারাজীবন যেন তাদের মত সাদা-মাটা আর সৎ থাকতে পারি।

লেখার সময়- ১৪ মার্চ, বেলা ১২:২০ থেকে ১:১৫ পর্যন্ত।Theory of Machines ক্লাসে, ব্যাকবেঞ্চে।

বি দ্র – এই গল্পে বর্ণীত সকল স্থান সত্য, তবে ঘটনা কাল্পনিক।

 

১,৩০৬ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “রাজপুরুষ”

  1. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    ব্লগে স্বাগতম। ভাল লেখা। তাড়াতাড়ি কয়েকটা দিয়ে ফ্রন্ট রোল দিয়ে ফেল 🙂
    তোমার মেসেজ টা সবার জন্য অনুকরণীয়। লিখতে থাক। শুভ কামনা রইল।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  2. সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

    বিশাল ঝামেলায় ফেলায় দিলি, সকালে তোর লেখাটা পড়ছিলাম, কেন জানি তখন থেকে এইটা মাথাই আস্তানা গাড়ছে । পরের লেখাটা অতি শীঘ্রি দিবি,নাইলে খবর আছে !
    আর লেখার জন্যে :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম রিদওয়ান, লেখা ভাল লেগেছে। নিয়মিত তোমার লেখা এখানে দেখতে চাই।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।