যখন বাজলো গেমস এর বাঁশী (৪)


হাফটাইমে নীলদের দলের সবাইকে একটু বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। একটু ঠান্ডা খেয়ে রাশেদ, নীল আর সবুজ মাঝে বসে বাকিদেরকে গোল করে নিয়ে বসলো মাঠের এক পাশে। পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করতে করতে সবুজ বললো- আর কোন গোল করতে দিমুনা মাইরি। ওর কন্ঠে অস্বাভাবিক দৃঢ়তা ছিল। রাশেদ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললো- নীল। একটা সুযোগ-একটা সুযোগ পাওয়া গেলে ঐটাকেই কাজে লাগাতে হবে রে। ৯০ মিনিটের খেলায় এইরকম একটা দুইটা সুযোগেই নির্ভর করে পুরা খেলার ভাগ্য। নীল উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে ফেললো। ওর হৃদয়ের পুরো একাগ্রতাটুকু জড় করে একান্ত মনে প্রার্থনা করলো কিছুক্ষন।

ঐ দিকে ফেভারিট দলের সবার মাঝে প্রশান্তির বিশ্রাম। শুধুমাত্র ওদের ক্যাপ্টেন কে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সে বললো- আমরা ওদেরকে অনেক দূর্বল ভেবেছিলাম ! ওর ভাইস বললো- আরে দূর ! যা হয়ে গেছে তা চলে গেছে। এই হাফে শালা বাবুদের সাইজ করে ফেলবো। অন্যরাও সায় জানিয়ে পরিবেশটা হাল্কা করে তুললো।

সময় হলে বাঁশী বাজলো। প্রথম কিছুক্ষন নীলে’রা পুরা ডিফেন্সিভ খেললো। বলও গড়ালো ওদের হাফে বেশীক্ষন। নিজেদের হাফ সামলাতেই ব্যস্ত দেখে ঐ পাড়ার দলের প্লেয়াররা বুঝে নিল যে নীলে’রা এখন আক্রমনে যেতে ভয় পাচ্ছে। তাই ওদের ক্যাপ্টেন একটু আশ্বস্ত হলো। সে আর তার ভাইস মিলে ওয়াল পাসিং করে একের পর এক আক্রমন চালিয়ে গেল। সবুজের প্রাচীর ভেদ করা অতটা সহজ ছিল না। বারবার বাঁধা পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছিল ওদের। ততক্ষনে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। বারংবার
আক্রমন নস্যাৎ হয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেনদের দলের সবার মাথায় রক্ত চেপে গেল। ওরা তখন অল আউট অফেনসিভ এ চলে গেল।

আর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল রাশেদ আর নীল। অপর দলের একটি সাঁড়াশি আক্রমন প্রতিহত করেই বিদ্যুৎ বেগে সবুজ বলটা ঠেলে দিল রাশেদ কে। আর রাশেদ নিমিষেই তার এ যাবৎ কালের শেখা সকল কৌশল কাজে লাগিয়ে এঁকে বেঁকে নামে মাত্র ডিফেন্সকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেল উপরে। ততক্ষনে ক্যাপ্টেন ভুল বুঝতে পেরে প্রানপণে ফিরে এসে ঘর সামলানোর চেষ্ঠা করতে চাইলো। কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গিয়েছিল অনেক। নিঁখুত মাপা একটি পুশ করে বল গড়িয়ে দিল রাশেদ। নীলও তৈরী ছিল। সজোরে দৌড়ে গেল ও……। আহ ! আরেকটু খানি। না ঠিক পায়ে আসলো না। সাথে সাথেই নীল স্লাইড করে ওর ডান পা দিয়ে শেষ মূহূর্তে ছোট্ট একটা টোকা দিয়ে দিল বলে। আলগোছে বল জড়িয়ে গেল বিপক্ষের জালে। মাঠের এতক্ষনকার স্তিমিত দর্শকেরা লাফিয়ে উঠলো। গো…ল…গো…ল !

নীলের দলের সবাই ছুটে এলো। বল্টুটাও ঐ পোস্ট থেকে বেরিয়ে এসে গেল এই হাফে। চিৎকার করতে করতে সবাই নীল’কে জড়িয়ে ধরতে এলো। নীল নীচু হয়ে ওদের ফাঁকি দিয়ে ছুটে গেল রাশেদ এর দিকে। কাছে যেয়ে ঝাপিয়ে পড়লো রাশেদের উপর। আচমকা ঝটকা সামাল না দিতে পেরে পড়ে গেল রাশেদ। আর যায় কই ওরা – সবাই একে একে এসে ওদের উপরে লুটিয়ে পড়লো। গুটি কয়েক দর্শকেও যেন মাঠ ফাটিয়ে ফেললো হাততালি আর উল্লাসে।

১-১ হয়ে গেল খেলার ভাগ্য।
আবার হুইসেল পড়লো। ক্যাপ্টেন সেন্টার করলো। এতক্ষনে ওদের টনক নড়লো। আন্ডার-এস্টিমেট করে ওদের কৌশলে মার খেয়ে গোল খেয়ে একটু দিশেহারা হয়ে পরলো ওরা। ম্যাচ টেম্পারমেন্ট এ টান পড়লো। ওরা এগ্রেসিগ খেলা শুরু করে দিল। ফাউল করে চললো একে একে। রেফারী ঐ দলের দুজনকে হলুদ কার্ড দিল। ওদের লাগাতার ফাউল করা দেখে পাগলা সবুজ আরও ক্ষেপে গেল। ওদের মিড ফিল্ডার কাছে আসতেই মেরে বসলো তার পায়ে দুম করে। ফলাফল- লাল কার্ড। দশ জন নিয়েও নীলেরা সমান তালে খেলে যাচ্ছিল। এরপর একবার যখন রাশেদ ওদের মেইন ডিফেন্সকে কাটিয়ে আবার বল নিয়ে ঢুকে পড়লো বড় ডি এর মধ্যে। পেছনে থেকে ছুটে এসে ডিফেন্স স্লাইডিং চার্জ করে সাংঘাতিক একটা ফাউল করলো। ছিটকে পড়লো রাশেদ। এটা দেখে সাইড লাইনে বসা সবুজ দৌড়ে ঢুকে পড়লো মাঠে। সোজা ঐ ডিফেন্ডারের উপর ঝাপিয়ে পরে সমানে কিল ঘুষি চালাতে লাগলো। এর পরের পরিস্থিতি বাঁশীতে ফুঁ দিয়ে রেফারীর নিয়ন্ত্রন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো। সে ফলাফল ড্র ঘোষনা করে খেলা শেষ করে দিল। তারপরও কিছুক্ষন হাতাহাতি চললো। সাথে উত্তপ্ত বাক্যালাপ। কিঞ্চিৎ খিস্তি খেউরও বাদ গেল না। পরে রাশেদ উঠে দাঁড়ালে পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়।

বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে নীলেরা বসে রইলো সাইড লাইনে। রেফারীর সাথে ঐ দলের ক্যাপ্টেন কথা বলছিল। রেফারী ডেকে পাঠালেন নীল কে। ও কাছে যেতেই রেফারী ইশারা করলো ঐ দলের ক্যাপ্টেন এর সাথে হ্যান্ড শেক করার জন্য। নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত মিলাতে যেয়ে নীল ঐ ক্যাপ্টেনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকলো। ওর জেদ দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্যাপ্টেন বললো- হুম্‌ম। ভাল। তোমরা ভাল খেলেছো। তোমরা বেশ ভাল খেল। এ সময় ক্যাপ্টেন এর চেহারায় আগেকার সেই অহমিকা খুঁজে পেল না নীল।
বরং স্পষ্ট একটা সমীহের ছায়া দেখা গেল। হাল্কা মাথা নেড়ে ও একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে; ফিরে এলো বাকি দের মাঝে।
:clap:

😐
পরিশিষ্টঃ
সেই রাতে পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়েছিল নীল। ক্লান্ত ছিল হয়তো। তাছাড়াও ঐ দলের ক্যাপ্টেন এর চোখে মুখে দেখা সমীহটুকু টনিকের মত কাজ করছিল ওর রক্তের ধারায়…।
পরে নীল জানতে পেরেছিল। ঐ পাড়ার ক্যাপ্টেন, রাশেদ আর সবুজ আলতাফ ভাইদের সাথে সেকেন্ড ডিভিশনে খেলেছিল।

৩৬ টি মন্তব্য : “যখন বাজলো গেমস এর বাঁশী (৪)”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    শেষ ??
    শেষ করলেন ক্যান বস ...
    কোন খেলা বিষয়ক আমার পড়া one of the best সিরিজ এইটা। শেষ, জানি ... তবুও অপেক্ষা করতে মঞ্চায় ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    পাড়ার ম্যাচ গুলা আসলেই অন্যরকম। থ্রিলিং। হঠাৎ করে আমি আমার পাড়াতো জীবনটাকে মিস করছি 🙁

    লেখা দুর্দান্ত হইসে। পুরা সিরিজেই একটা টান ছিল। যার আকর্ষণ এড়ানো দু:সাধ্য। :grr:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. অনেক ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনীর একটা বই পড়ছিলাম, 'মানিকজোড়'। একটা ক্রিকেট ম্যাচ নিয়া টান-টান উত্তেজনার উপন্যাস। আপনার পুরো সিরজটা পড়ে সেই কাহিনীটা মনে পড়ে গেলো।

    দারুন হইছে ভাইয়া। :thumbup: এই রকম কয়েকটা গল্প আরো নামান। 😀

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    জটিল লিখেছ। মনে হচ্ছে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছ। তুমি ফুটবল প্রেমিক বুঝাই যাচ্ছে।

    ১। বর্ননা অসাধারন। নীলে মানসিক অস্থিরতা ফুটিয়ে তুলেছ সুন্দর।

    ২। ভাল লেগেছে নীলের উপর পুরা খেলা ডিপেন্ড করেনি। তুমি রাশেদ আর সবুজকে এনেছ। আর স্বাভাবিক মনে হয়েছে যখন বলেছো এরা সেকেন্ড ডিভিশনে খেলত, যেটা নীল জানে না। তাছাড়া প্রফেশনাল টিমের সংগে পাল্লা স্বাভাবিক মনে হত না।

    ৩। আমাদের সময় এটা একটা কমন ঘটনা ছিল। খেলা হবে এবং মারামারি হবে।

    ৪। তুমি খুব দ্রুত সিরিজ শেষ করেছ। এর জন্য :salute: । অন্যরা এটা অনুসরন করলে আমরা পাঠকরা বেচে যাই।

    একবারে সবগুলো পড়ে কমেন্ট করলাম। কমেন্ট অনেক কমে গেল। প্রথম মনে হয় এবার হতে পারলাম না। 🙁

    আবার বলি তোমার এই সিরিজটা খুব ভালো লেগেছে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    শেষ??? 🙁
    ওবায়দুল্লাহ্‌ ভাইএর ব্যান ভাই... 😀

    অন টপিকঃ এ রকম অসাধারণ সিরিজ সিসিবি'র ভান্ডারকে নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ করবে... :salute: :clap:
    পরের পর্বের অপেক্ষা শেষ হলেও, পরের লেখার অপেক্ষা করতেই থাকব...করতেই থাকব... :-B


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আমি একটানা ২-৩ টা ব্লগ পড়তে পারিনা। এক এক বার আসি এসে একটা করে পড়ে যাই। এই সিরিজের লেখাগুলা একটানা পড়ে গেলাম। আমার খুব ফুটবল খেলতে ইচ্ছা করছে এখন । এইটার কি সমাধান হবে? সাইডলাইনে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ক্যাডেট কলেজে থাকতে এইটে ইন্টার হাউসের সময়। আমার মনে হত আমি খুব ভাল প্লেয়ার কিন্তু ক্লাস নাইনের ভাইয়ারা নিজেদের সবাইকে নিয়ে টিম বানিয়ে প্র্যাকটিস করে, আর প্রিফেক্ট এবং স্যারদের বুঝাবার জন্য আমাদের ২ জনকে এক্সট্রা হিসেবে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখে। খেলাধুলায় এক্সট্রা থাকা আমার খুব প্রেস্টিজে লেগে গেল। দুদিন পরে ৩ দিনের দিন ইন্টার হাউস খেলব না বলে বাস্কেট খেলতে চলে গেলাম। পরে ইন্টার হাউসের সময় এত আফসোস লাগছিল।

    জবাব দিন
  7. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অসাধারন বস :boss: :boss: :boss:

    খেলাধূলা নিয়ে আমার পড়া সেরা গল্প এটা, তার উপর আবার ফুটবল... শুধু একটা কথাই বলার আছে আর...
    এই মন চায় যে more....


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  8. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    চমৎকার একটা সিরিজ বস্ :boss: :boss:
    ওবায়দুল্লাহ ভাইকে :salute:
    এত কুইক সবগুলো পর্ব দিয়ে দিবেন কল্পনাও করিনাই 😀
    একটা একটা কইরা আবার পড়লাম এবং আবারো সকার প্লেয়ারগুলো সহ আপনাকে :salute: :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  9. তানভীর (৯৪-০০)

    ভাইয়া, এক কথায় অসাধারণ হয়েছে।

    অতিনাটকীয়তা না এনে গল্পটাকে যেভাবে শেষ করেছেন তারজন্য আপনাকে :salute:

    এই সিরিজ তো শেষ, কিন্তু আপনার কাছ থেকে অন্য আরো অনেক সিরিজের প্রতীক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।