একটি আদর্শ মন্দ দিন

দিনের শুরু দুইভাবে হতে পারে। সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অথবা রাত বারোটার পর থেকে। যেহেতু খারাপ দিনের সূচনার পিছনে আগের রাতের বিষয়টা জড়িত, তাই এখানে নতুন দিন বলতে রাত বারোটার পর বুঝাবো।

এশার নামাযের পর পরই কাছের কোন এক মসজিদ বা মাজার থেকে ওয়াজ মাহফিল শুরু হলো। শুরু হলো তো হলো, শেষ হওয়ার নাম নেই। অবশেষে রাত বারোটার দিকে ওয়াজ শেষ হলো। এবার ঘুমানো যাবে ভেবে বিছানায় গেলাম। চোখটা বন্ধ করার একটু পরেই শুরু হলো হারমোনিযাম আর তবলা বাজিযে কাওযালী গান। ভাবলাম ওয়াজ শেষ হলো, দুই/চারটা গান গাওয়ার পর হয়তো শেষ হয়ে যাবে। ভাবনাটা ঠিক হলো। কয়েকটা গানের পর নীরবতা নেমে এলো। চোখটা যখন লেগে আসছে ঠিক তখনই হারমোনিয়ামের শব্দে আবার চমকে জেগে উঠলাম। বুঝলাম এটা ছিল, যাকে বলে – “এক ছোটি সি ব্রেক”। সারাটা রাত এভাবে ব্রেক দিয়ে দিয়ে গান হলো আর প্রত্যেকবার ব্রেকের পর চমকে চমকে উঠলাম।

ফযরের আযান দেয়ার সাথে সাথে গানের পালা শেষ হলো । কিন্তু কাজ যা হওয়ার হয়ে গেলো, ঘুম আর এলো না। রাতে ভালো ঘুম না এলে যা হয়, মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো আর চোখে ঢুলুঢুলু ভাব লেগে রইলো। কোনোভাবে নাস্তাটা সেরে নিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলাম।

সকালে অফিসে যাওয়া একটা যুদ্ধযাত্রার মতো মনে হয়। বাসে তো যায়গা পাওযা যায়ই না, সিএনজিওয়ালারা এমন ভাড়া চেয়ে বসে যে মাথায় রক্ত উঠে যায়্ । আজ শাহবাগ মোড়ে এসে ১ম সিএনজি যেটাকে জিগ্যেস করলাম সে একবাক্যে মিটারে যেত রাজি হলো। মর্র্নিং শোজ দ্যা ডে । সকালটা তাহলে ভালভাবেই শুরু হলো। রাতে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আজকের দিনটা ভালই যাবে মনে হচ্ছে।

কাওরান বাজার মাছের আড়ত এর জ্যাম পার হয়ে সাতরাস্তায় আসতেই সিএনজিটা থমকে দাড়িয়ে পড়লো।
“কি ব্যাপার ? “ বিরক্ত আমি জিগ্যেস করি।
“ব্রেক এর তারটা ছিড়ে গেছে । পাচটা মিনিট বসেন স্যার। ঠিক হয়ে যাবে।“সিএনজিওয়ালা আমাকে আশ্বস্ত করে।

আধাঘন্টা পর পাঁচ মিনিট শেষ হযে যখন সিএনজি চলতে শুরু করলো, ততক্ষণে বুঝে গেছি আজ লেট এটেনডেন্স ঠেকানোর কোন উপায় নেই। অফিসের লিফটের সামনে য়খন পৌছলাম তখন সাড়ে নয়টা পার হয়ে গেছে।

সময়টা খুব বিপদজনক।আমাদের এমডি স্যার খুব পাংচুয়াল। উনি প্রতিদিন সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মাঝে আফিসে আসেন।লিফটের সামনে উনাকে না দেখ একটু স্বস্তি পেলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট থামতে উঠলাম। উঠে সামনে ফিরতেই দেখি এমডি স্যার। বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে আমি চুপচাপ দাড়িয়ে থাকি।

‌পাঁচতলায় এসে লিফট খালি হয়ে যায়। আবার যখন উঠতে শুরু করে তখন স্যার হাসিমুখে আমার দিক তাকিয়ে জিগ্যেস করেন – “আজ বোধহয় তেআমার একটু দেরি হয়ে গেল, না?”

আমি পাংশুমুখে বলি – “ জি স্যার। রাস্তায় সিএনজিটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেল।“

“ও আচ্ছা।“ স্যার বেশ সহানুভূতির সাথে মাথা নাড়েন।

অফিসে গিয়ে লাঞ্চ ফ্রিজে রেখে নিজের ডেস্কে এসে বসি।

দশ পনের মিনিট পর স্যার ফোন করেন -“গত মাসের এটেনডেন্স রিপোর্টটা কমপাইল করে আমাকে একটু দিও তো।“
“ওকে স্যার। কখন দিব?”
“ ১২টা/১টার মধ্যে দিলেই হবে।“
“ওকে স্যার।”

একটু পর বস ডেকে পাঠান। কয়েকটা আর্জেন্ট রিপোর্র্ট দিতে হবে। কিছুক্ষন পর আরো কিছু কাজ হাতে আসে। সবগুলোই ফিগার নিয়ে কারবার। ঘুম ঠিকমতো না হওয়ায় যা হবার তাই হলো। এখানে সেখানে তালগোল পাকিয়ে বসের ঝাড়ি শুনতে শুনতে বারোটা বাজলো।

ঠিক বারোটার সময় স্যার আবার ফোন করে জানতে চাইলেন, “রিপোর্ট রেডী?”
“জি স্যার।“
“ঠিক আছে, তুমি একঘন্টা পর এসে দিয়ে য়েও।“

একটার সময় স্যারের রুমে ওটা দিয়ে লাঞ্চ রুমে যাই। লাঞ্চ বক্স খুলে দেখি ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। রাতে হয়তো ভাত ঠিকমতো ঠান্ডা না করেই ফ্রিজ এ রেখে দিয়েছিলো।
এক কলিগ পরার্মশ দিলেন, “পিয়ন দিয়ে দোকান থেকে শুধু ভাত নিয়ে আসেন।”

খোঁজ নিয়ে দেখলাম, যে পিয়ন রোজ লাঞ্চ নিয়ে আসে সে অলরেডী চলে গেছে। ফিরতে অন্তত আধঘন্টা।ফ্রন্ট ডেস্কে বলে দিলাম ও আসলে যেন আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় একঘন্টা পর সে এলো। তাকে টাকা দিয়ে বললাম ভাত নিয়ে আসতে।
“শুধু ভাত তো দেয় না স্যার“, পিয়ন জানায়।
অগত্যা ভাতের সাথে ডালের অর্ডির দেই।

আরো আধঘন্টা পর সে ফিরে আসে। লাঞ্চ করতে যাব এমন সময় বসের ফোন, জরুরী মিটিং আছে। চোদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে মিটিং এ য়োগ দিলাম। মিটিং শেষ করে য়খন লাঞ্চ করতে নামি তখন সাঢ়ে চারটা।

পাঁচটায় অফিস শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু হাতে যে কাজ আছে তাতে এই সময় বের হওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। সব কাজ শেষ করে বের হতে হতে সাড়ে সাতটা বাজলো। অফিস থেকে বের হয়ে সিএনজি পাওয়া হচ্ছে আরেকটা যুদ্ধ। গুলশান মোড়ে পয়তাল্লিশ মিনিট দাড়িয়ে থাকার পর একটা সি এনজি পেলাম।

তেজগাওয়ের ভিতর দিয়ে আসার সময় একটা অন্ধকারমত জায়গায় হঠাৎ সিএনজি থমকে দাঁড়ায়। সিএনজিওআলা কিছু একটা ঠিক করার জন্য পিছনে যেতেই দুই দিক থেকে দুই জন উঠে বসে। একজন পেটে ছুরি চেপে ধরে, আরেকজন পকেট হাতড়ে সবকিছু বের করে নেয়।

আমি অনুরোধের সুরে বলি, “ ভাই, যা নেয়ার নেন, চোখে মলম দিয়েন না।“

অফিস থেকে বের হোয়ার সময় হাজার পাঁচেক টাকা তুলেছিলাম বাড়ি ভাড়া দেয়ার জন্য। সবটাই এখন তাদের হাতে। তাই হয়তো তারাএকটু খোশমেজাজেই ছিলো। মলম দিলোনা, উল্টা আরো পঞ্চাশ টাকা দিলো বাসা র্পযন্ত যাওয়ার জন্য।

ওরা নেমে যাওয়ার পর আমি নেমে পাশের গলি থেকে রিকশা নেই। বাসায় যখন পৌছাই তখন রাত দশটা।

দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আমি টেবিলে ভাত দিতে বলি। আমার গলা শুনে বড় আপা ড্রইং রুম থেকে বের হয়ে আসে।
“আজ সারাদিন গ্যাসের চাপ ছিলোনা। বাসায় কিছু রান্না হয়নি। দুপুরেও আমরা বাইরে খাইছি।“
“ও। তাহলে এখন উপায়?”
“তোর দুলাভাই আজ আবার গেছে ঢাকার বাইরে। তোকেই একটু যেতে হবে বাইরে। একটু হাতিরপুল তেকে কিছু নিয়ে আয় না!”

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক!

বড় আপার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে আমি হাতিরপুলের দিকে পা বাড়াই। বাসার আশেপাশে কোন হোটেল নেই।

হোটেল থেকে ভাত আর তরকারি নিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবি, য়াক, কোনরকমে আজকের দিনটা পার হলো। বাসায় গিয়ে ভালমতো একটা গোসল দিয়ে সোজা বিছানায়।

গোসল করার কথা ভাবতেই বিদ্যুৎচমকের মত একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে যায়। সারাদিন গ্যাস ছিলোনা।পানি আর কারেন্ট ছিলো তো?

গোসল করার পানি পাব কিনা এই চিন্তা করতে করতে আমি ধীর পায়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি ।

২,৮৯৭ বার দেখা হয়েছে

৩৭ টি মন্তব্য : “একটি আদর্শ মন্দ দিন”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আসলেও কি ঢাকা এতো ভয়ংকর হয়ে গেছে? দেশ থেকে লোকজন এসে যা বলছে তাতে খুব নিরাশ হয়ে পরছি।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  2. টুম্পা (অতিথি)

    ব্যাপার না,ম্যান!! বিরাট বাঁচা বাঁচছো যে মলম দেয়নাই (নাকি তোমার চশমার আড়ালে খুঁইজা পায়নাই? :-B )
    আমারো আজকে সিএনজি তে যাইতে হবে ,আল্লায় জানে কি আছে কপালে... :-/

    জবাব দিন
  3. আদনান (১৯৯৪-২০০০)
    ছিনতাইটা কাল্পনিক কিন্তু বাকিগুলা মাঝেমাঝেই ঘটে……

    শালা তোকে মাইর দেয়া লাগবে । যাক আল্লাহ বাঁচাইছে আসলেই ছিনতাই হয়নাই, তবে সাবধানে থাকিস ।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।