ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ২০১৫-১৬ মৌসুমের শিরোপা জিতেছে লেষ্টার সিটি ফুটবল ক্লাব। মৌসুমের শুরুতে কেউ ঘুনাক্ষরেও এটা কল্পনা করেনি। বিগত শত বছরে তারা কখনো চ্যাম্পিয়ন হয়নি। তাহলে এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটার পেছনে কি কারন থাকতে পারে?
কারন খুঁজতে হলে চলে যেতে হবে ইতিহাসের গহীনে, প্রায় পাঁচ শত বছর আগে। রাজা তৃতীয় রিচার্ড তখন ইংল্যন্ডের সিংহাসনে আসীন। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রান ক্যাথলিক। অত্যন্ত ন্যায়পরায়ন প্রজাবৎসল এই রাজার শাসনামলে গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে ছিল সুখ আর সমৃদ্ধির অপার বিস্তার। তাঁর সময়েই ইংল্যান্ড শৌর্য-বীর্যে ইউরোপের অপরাপর সব দেশ ও জাতির চেয়ে অনেক অনেক দুর এগিয়ে যায়।
রাজা রিচার্ডের এহেন আকাশচুম্বী সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্স এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। ইংল্যান্ডকে করদরাজ্য বানাবার ঘৃন্য অভিলাষ চারিতার্থ করবার জন্য তারা নিয়োগ করে ইংলিশদেরই এক জ্ঞাতি ভাইকে। হেনরী টিউডর নামের এই আধা নাস্তিক কুলাংগারকে বিশাল এক সৈন্য বাহিনী সাথে দিয়ে তাঁরা পাঠিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে। ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দিয়ে এই বেয়াদব নিজেকে সিংহাসনের প্রকৃত দাবীদার বলে ঘোষণা করে। তার সাথে যোগ দেয় ক্যাথলিক বিদ্বেষী কিছু স্থানীয় রাজন্যবর্গ।
কোমলহৃদয় রাজা রিচার্ড বাধ্য হয়ে হেনরীর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! কিছু বিশ্বস্ত মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে যুদ্ধের ময়দানে রাজা রিচার্ডের পরাজয় ঘটে। এক সৈনিকের বল্লমের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে বজ্রকন্ঠে বলে গেলেন, রে অর্বাচীন সৈনিক, তুই তো মামুলি হুকুমের দাস! তুই তো জানিস না তুই কী করেছিস! যাহ, তোকে আমি মাফ করে দিলাম। কিন্তু আমি জানি, তোরা আমার মৃতদেহকে চরম অসন্মান করবি এবং এর ফলে তোরা হবি অভিশপ্ত এক নগরীর বাসিন্দা। আমি হারিয়ে যাবো লোকচক্ষুর আড়ালে। এভাবে অর্ধ সহস্রাব্দের পরে আমি আবার জেগে উঠবো, তখন সেদিনের মানুষেরা আমাকে উপযুক্ত সন্মান দেবে। আর তারপরে তোরা শাপমুক্ত হবি! সেই শাপমুক্তির দলিল হিসেবে তখন তোদের সামনে হাজির হবে এক অভাবনীয় উপহার!
একথা বলার পরে সেই আহত সিংহ, মহানহৃদয় বাদশাহ রিচার্ড আবার লুটিয়ে পড়েন। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। হেনরী টিউডরের হুকুমে বাদশাহ রিচার্ডের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লেষ্টার শহরে। প্রিয় বাদশাহর মৃত্যুতে যখন সমগ্র ইংল্যান্ড মুহ্যমান ঠিক তখনই একদল কুচক্রীর নেতৃত্বে লেষ্টারের লোকজন মেতে ওঠে এক ঘৃণ্য অমানবিক খেলায়। বাদশাহ রিচার্ডের মৃতদেহকে বস্ত্র-সজ্জাহীন করে সারা শহরে প্রদর্শন করা হয়। তারপরে একটি খুঁটিতে গেঁথে সেই দেহ রেখে দেয়া হয় শহরের কেন্দ্রস্থলে। চারিদিকে কড়া প্রহরা থাকা সত্বেও তিন-চারদিন পরে একদিন হঠাৎ করে সবার চোখের সামনে থেকে বাদশাহ রিচার্ডের মরদেহটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
যুদ্ধজয়ী হেনরী টিউডর নিজেকে ইংল্যান্ডের রাজা ঘোষণা করেন। তখন থেকেই ইংল্যান্ডে টিউডর শাসনামলের শুরু। এঁদের হাত ধরেই ইংল্যান্ড ক্রমে ক্রমে এক ধর্মবিদ্বেষী দেশে পরিনত হয়। পোপকে অবজ্ঞা করে তারা ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মনগড়া এক ধর্মব্যাবস্থা চালু করে। এবং ক্ষমতার দাপটে উন্মত্ত হয়ে তাদের এই অধর্ম চর্চাকে চাপিয়ে দেয় গোটা ইংলিশ সমাজের উপরে। এমন কি আশেপাশের দেশ ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও তাদের এই আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি।
এদিকে বাদশাহ রিচার্ডের মরদেহ অদৃশ্য হয়ে যাবার ঠিক পাঁচশ বছর পরে লেষ্টার শহরের এক সরাইখানার পেছনের কারপার্কের নীচে খুঁজে পাওয়া গেল বাদশাহ রিচার্ডের দেহাবশেষ। নিতান্ত অবহেলায় দীর্ঘ অর্ধ সহস্রাব্দ ধরে তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ডিএনএ টেস্টের পরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে, এটিই বাদশাহ রিচার্ডের মরদেহ। লেষ্টারের মানুষেরা এতদিনে তাদের পুরোনো কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই যথাযথ আড়ম্বর করে সম্পুর্ন বাদশাহি মর্যাদায় এই মহান শাসকের মরদেহকে পুনরায় সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগমুহুর্তে তিনি বলে গিয়েছিলেন, অর্ধ সহস্রাব্দের পরে তিনি আবার স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হবেন। সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পুর্ন হল তার সেই ভবিষৎবাণী। কিন্তু তিনি তো এক অভাবনীয় উপহারের কথাও বলেছিলেন? কোথায় সেই প্রতিশ্রুত উপহার?
সেদিনই বিকেলে লেষ্টার রিজিয়নের ডেপুটি চিফ কনষ্টেবল রবিন মরিস নিয়মিত টহলে গেছেন শহরের সীমানার বাইরে, কান্ট্রি সাইডে। মেঘলা বিকেলের ধুসর আলোয় তিনি দেখলেন দুরে মাঠের ওপারে তিনজন ঘোড় সওয়ার তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখলেন খানিকটা অদ্ভুতদর্শন তিনটি ঘোড়ার পিঠে ততোধিক অদ্ভুত পেষাক আশাকে তিনজন বৃদ্ধ। জলদ গম্ভীর স্বরে তাঁরা বললেন, আমরা এসেছি সুদুর কারাকোরাম পর্বত থেকে। আমরা প্রকৃত রাজন্যবর্গের মান সম্মান সমুন্নত রাখার এক অতন্দ্র প্রহরী। আমরা অধর্ম আর অনাচারের বিষাক্ত থাবা থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করি। আমরা এসেছি এই সুসংবাদ দিতে যে, আজ থেকে তোমাদের এই নগরী শাপ মুক্ত হয়েছে। আর এই শাপ মোচনের দলিল হিসেবে অচীরেই তোমাদের কাছে এক অভাবনীয় উপহার এসে হাজির হবে।
হতবিহ্বল রবিন জানতে চাইলো, কি সেই উপহার? তিন বৃদ্ধ কোন জবাব দিল না। রবিন আবারও জানতে চাইলো, কি সেই উপহার? এবার তিন বৃদ্ধের মাঝের জনের ঘোড়াটি সামনে এগিয়ে এসে মাথা দিয়ে রবিনের কাঁধে ধাক্কা দিতে লাগলো। রবিনের পা দুটো যেন মাটিতে আটকে গেছে, প্রচণ্ড রকমের চেষ্টা করছে তবুও নড়তে পারছে না, আর বৃদ্ধের ঘোড়াটা ক্রমাগত কাঁধে ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে!
কি রে! ল্যাপটপ খোলা রেখেই আবার ঘুমিয়ে পড়লি! ওঠ, বিছানায় গিয়ে ঘুমা – মায়ের ধাক্কা-ধাক্কিতে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলো রফিক। ল্যাপটপের স্ক্রীন জুড়ে জুলুজুলু করে চেয়ে আছে তৈমুর লঙ এর সমাধি নিয়ে সিসিবিতে “বিশিষ্ট পণ্ডিত” বড় ভাইয়ের লেখা জমজমাট এক pseudo -ইতিহাস! সেটা দেখতে দেখতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে আর আধো তন্দ্রার মাঝে লেষ্টার ফুটবল ক্লাবের সাফল্যের রহস্য ভেদ করে ফেলেছে! রফিকের বুকটা ধক করে উঠলো – স্বপ্নের ঘোরেও এমন গাঁজাখুরি টাইপের গল্প ফাঁদার কোন মানে হয়? তবে কি আমিও ওদের মত…? ভাবতে গিয়ে রফিকের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল। মা চলে যেতেই চট করে কয়েকটা সেলফি তুলে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো – নাহ কান দুটোর আকার-আকৃতি স্বাভাবিকই আছে। যাক বাবা, বাঁচা গেল। এটা নেহায়েতই একটা বাজে স্বপ্ন ছিল!
😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
:thumbup:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
দূর্দান্ত! লেস্টারের এই মৌসুমের রূপকথা নিয়ে অনেক লেখাই পড়েছি কিন্তু এই রূপকথা সবগুলোকে হার মানিয়েছে :))
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
:bash:
এরকম একটা নিবিড় গবেষণামূলক লেখাকে তুমি রূপকথা ট্যাগ দিলা, আকাশ? আমার তো মাথায় রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা! :brick:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
দারুন হয়েছে।
রীতিমত শিহরন জাগানিয়া ইতিহাসই (?) বটে!!!
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই, মনে আছে নিশ্চয়ই যে, কিছুদিন আগে আপনার একটা ফেবু পোস্টের কমেন্টে Pseudo-Science এর একটা মোক্ষম বাংলা শব্দ খুঁজছিলাম? সেদিন সহসা ঘুমের ঘোরে একটা নতুন বাংলা শব্দ আবিষ্কার করে ফেললাম। Standard-History কে বাংলায় প্রমিত-ইতিহাস বলা হয়, সেই সূত্রানুসারে আমি প্রস্তাব করছি Pseudo-History কে বাংলাতে "প-বাদে-প্রমিত ইতিহাস" নামে ডাকা হোক। একই ভাবে Pseudo-Science কে ও বাংলাতে "প-বাদে-প্রমিত বিজ্ঞান" নামে ডাকা হোক। শুনেছি তিনি নাকি মাঝে মধ্যেই তাঁর দেরাজ থেকে নিত্য নতুন ইতিহাস এবং বিজ্ঞান বিষয়ক পুঁথি-পত্র পয়দা করে থাকেন। 😛
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
"তুমি দেখি লুক বালা না"!!!
এমনে খোঁচায় নাকি?
তবে হ্যা, কেউ খোঁচানি ইনভাইট করলে, না খোঁচায়া উপায় কি???
এই অংশটা সুপার হয়েছে "প-বাদে-প্রমিত..."
এইটার আরেকটা বর্ননা আছে - "প-সাইলেন্ট-প্রমিত" 🙂 😀 😛
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
😀 😀 😀
ভাই, আপনি কিন্তু আমার চেয়ে এককাঠি উপরে দিলেন ... :boss: :boss:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
লেস্টারের শিরোপা জয়টা এ লেখার শেষ প্যারায় দেয়া চমকের মতোই অভাবনীয়।
আরো অভাবনীয় যেভাবে অন্য দলগুলো ক্রমাগত সটকে গেছে শীর্ষে ওঠার সম্ভাবনা থেকে।
ধন্যবাদ উপভোগ্য লেখাটির জন্য।
কোন চমক নাই লুৎফুল ভাই, সবই বাদশা রিচার্ডের আত্মার কারসাজি ...... 😛
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।