~ বকুলের ঘ্রাণ ~

মধুমাসে মৌ মৌ ফুল গন্ধের সাথে
বাতাসে উড়ছে ধবধবে এপ্রোনের খুঁট
ঘরের ভিতর টুকরো মেঘের ভেলা
যেনো খুঁজে পেয়েছে
সংসারে ফেলে যাওয়া তার
অতল স্মৃতির ঘাটে বাঁধা অমূল্য পল্টুন
পড়ার ঘরে আধো আলোয় নিস্তব্ধ ছেলেটার
উড়ুক্কু বইয়ের পাতায় খেলা করে শুধু
নিস্পন্দ নিথর বাবার ঘুমন্ত মুখ
টিপয়ে সাজানো ফুলদানি খানি
ফাঁকা গল্পের আলপনা ভেবে
এক মনে ধরে থাকে দেবযানী
শেষ চুম্বনের গন্ধ তখনও তাজা
কপোলে তার যতোই ভাসুক
শেষ দেখা না হবার অব্যক্ত বেদনা

মায়ের চোখে ভিজেছে প্রার্থনার হাত
স্মৃতির ফলায় যতোটা ছিঁড়ে নিলে
ভেসে ওঠে উপড়ানো বৃক্ষের শিকড়
বল্কলের প্রলেপে প্রলেপে মিশে
গায়ে লেগে থাকে প্রথম চুম্বনে মাখামাখি
সন্তানের অমূল্য ভাপখানি
সেই মাপে ভেঙেচুরে উপচে ওঠে
পাঁজর দাপানো জলোচ্ছ্বাস

শয়ানে গিয়েছে যে ফেলে রেখে পাতলুন
রোজকার হাতে বাঁধা কলম কিংবা ঘড়ি
স্তব্ধ মুঠোফোনে সহস্র কথার বুনন ঘিরে
ছড়িয়ে রাখা সখ্যের সালতামামি
এই যে এতো সব বাগান উঠোন এলো ঘরদোর
এইখানে আজও এলো ভোর
তোমার সিথানে ভেঁজা মাটি জানি
আলিঙ্গনে বেঁধেছে নতুন ডোর

তুমি নিরালায় ফিসফাস
ছুঁড়ে দিচ্ছো না বলা কথার দীর্ঘশ্বাস
সহস্র সংলাপ গাথা অনুক্ত ভালোবাসা
বুকে তুলে রাখা অযুত কলতান
গোনাগুনতিহীন আনন্দ উচ্ছ্বাস দুঃখ বেদনা
সখ্যের দুরন্ত আলাপ
যা কিছু যতনে
তুলে রাখা ছিলো গভীর গোপনে
কখনো কোনো নিরালা দুপুর সন্ধ্যা কিংবা
পড়ন্ত বিকেল জুড়ে
একলা প্রহরে নিমগ্ন গভীর স্বরে
একাগ্রে কাউকে বলবে বলে

কিছু অনুযোগ
খুনসুটির ময়ান মাখা বাখরখানি
চারকোলের তপ্ত আঁচে আঙুল ছোঁয়া
স্পর্শ আঁকা কথার বকুল
যেটুকু জানতো শুধুই দেবযানী
কিংবা ধুন্ধুমার এক ঝগড়া
জমিয়ে রাখা সাতশো গালাগালের মরমী মাখা
ওই অতটুকু শৈশবের চাতালে
হাফ প্যান্টের পকেট ভর্তি মার্বেলে
খুব মারকুটে এক খেলার বিবাদ
গলার সবক’টা রগ ফুলিয়ে তীব্র বিসম্বাদ
মিহি মসলিন একটা সকাল ফালি ফালি করার মতো
তীব্র স্বরে রাগ সপ্তমী সাধার তান
বোনের কিংবা ভায়ের
আম-কাঁঠালের ভাগ-বাটোয়া’
মিললো না যা এই জনমে
রইলো পড়ে অনাদরে
ভালোবাসার বদ্ধ খামে

বার্তা বিহীন সব ফেলে আজ
এই অবেলায় খুব অকস্মাৎ
বকুল ফুলটি ঝরার মতো
পাঁজর জুড়ে অবলীলায়
একেঁ দিলে হেলা ফেলায়
অনপনেয় মস্ত ক্ষত

#লুৎফুল_হোসেন
১৩ জুন ২০২০

(উৎসর্গঃ অতিমারির ছোবলে অকালপ্রয়াত অনুজ ডা. আরিফ ও সকল চিকিৎসাসেবীদের)

৩,৩১০ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “~ বকুলের ঘ্রাণ ~”

  1. রেজা

    লুৎফুল ভাই,
    আপনার কবিতা মারাত্মক হইসে। বকুল ফুল দেখে কলেজের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। আমাদের কলেজে আমাদের হাউসের ক্লাস টেন ডাইনিংহলের সামনে যে জায়গায় দাঁড়াতো, তার সামনে একটা বকুল গাছ ছিল। প্রতিদিন গাছের নীচে বকুল ফুল পড়ে থাকতো। বকুল ফুলের গন্ধ মারাত্নক তীব্র। আপনার কবিতার মতো। যতো বাসি হয় ততো তার বাসনা ছড়ায়। বকুল ফুলের গন্ধে বলে সাপ আসে।

    বকুল ফুল যত বাসি হয় তত গন্ধ ছড়ায়, আপনি যাদের উদ্দেশ্যে কবিতা উৎসরগ করেছেন যত সময় গড়াবে ততই আমরা তাদের অভাববোধ করবো। ভালো থাকবেন।


    বিবেক হলো অ্যানালগ ঘড়ি, খালি টিক টিক করে। জীবন হলো পেন্ডুলাম, খালি দুলতেই থাকে, সময় হলে থেমে যায়।

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    হৃদয়মথিত পংক্তিমালা।
    কবিতার নামকরণ যথার্থ হয়েছে। যত দিন যাবে, ঝরে পড়া বকুলগুলো ততই সুঘ্রাণ ছড়াবে।
    "সখ্যের দুরন্ত আলাপ
    যা কিছু যতনে
    তুলে রাখা ছিলো গভীর গোপনে"
    ফিরে আসবে তারা বকুলের ঘ্রাণে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।