[ অণুগল্প ]
: ডিঙ্গিটা উজানের দিকে ঠেল এইবার।
: অহনই যাইবাগা বাজান ! মাছ তো বেশি উডে নাই। জাটকাডি কি রাইখ্যা দিবানি !
জমির শেখ ঘাড়টা ঘুরায়া পোলা কলিমুদ্দিরে দেহে।
: বাপরে মাছ যা উডনের হেইট্টুকই উডবো। কপালে থাহন লাগে। হের থে বেশি কি আর উডবো নি ! জাটকাডিরে আমি রাহুম ক্যারে। অহন তো জাটকা ধরন নিষেধ।
: আইজকা তাইলে বেলা থাকতে যাওন হইবো। আমি হেইলে ঘাটো নাইম্মা বাজান তোমার লগে বাইত যামু না।
: কই যাবি !
: কানু ব্যাপারীগো বাড়ীর লগের মাঠটায় চৈত্র সংক্রান্তির মেলা হইতাছে। আমি ওইহানদা এট্টু ঘুরণা দিয়া আসুম।
: আইজকা যাওনের কাম কি ! কাইলকা বৈশাখী মেলায় যাইস।
কলিমুদ্দির মাথায় খালি ঘুরতাসে কয়খান ফিতা-আলতা কিননের খোয়াব। কুলসুমের লাইগা একখান কইরা আর জরিনার লাইগা; লগে কয়খান রেশমী চুড়ি দুইজনের লাইগাই।
: বাজান কুলসুমের লাইগগা চুড়ি-ফিতা কিনুম। কাইলই কইয়া রাখছি। না লইয়া গেলে মনডা খারাপ করবো।
বইনের কথাডা গড়গড়াইয়া কয় পোলায় বাপের কাছে, জরিনার কথাডা বুকের সিন্ধুকে সামলাইয়া রাখে।
দেখতে দেখতে আরো দুইবার জাল মারা শেষ। শেষের আগেরবারে ভালই মাছ উঠছে। খুশি মনে শেষবারের লাইগা জাল মারে নাইজুদ্দি শেখের পোলা জমিরুদ্দি শেখ।
বাপের আমলের নৌকাডার দিন শেষ। ট্যাকা জমছে যেট্টুক হেট্টুক দিয়াই নতুন নাও বান্ধনের বায়না করন লাগবো। বর্ষার আগে বৈশাখের ধাক্কা নিবার পারতনা মনে হয় পুরান নাওখান।
দুই চাইর বছরের মইধ্যে কলিমুদ্দিরে নাও দিয়া মাছ মারনের কামডা বুঝাইয়া দিব। হের পরে বিয়া শাদী দেখবো। আগে কুলসুম, পরে কলিম। আলিমুদ্দির সময় আইতে দেরী।
আনমনা হইয়া জাল টানতে যাইয়া বল লাগনের ফেরে হুশে ফিরে জমিরের। কায়দা কইরা জাল টাইন্না উঠানের মাঝখানে টের পাইলো দুইডা বড় মাছ লাগছে জালে।
বাপ-বেটায় মিল্লা সামাল দেয় – বিশাল এক কাতলা মাছ মনে হয় যেন জালডা ছিড়া বাইর হইয়া যাইবো। আর একখান পাঁচ কেজি সাইজের কালিবাউশ। শৈল আর মাঝারী রুই কয়ডা, চিতলও আছে একখান।
বাপ-বেটার চোখগুলান চকচক করে খুশীতে। বৈশাখের বাজারে দামডা ভাল পাওন যাইবো।
ঘাটে নাও লাগাইয়া দৌড়ের উপরে হাটে বইসা যায় দুইজনে। বেচা হইতে সময় লাগে না পয়লা বৈশাখের আগের দিন। চিতল মাছটা আর লগে আরো কয়ডা মাছ বাকী। কলিমুদ্দির ছটফটানি দেইখখা জমির হেরে একশ ট্যাহা দিয়া কয়, তুই যা। তাড়াতাড়ি বাইত আইস।
বড় কাতলা আর কালিবাইশ দুইডাই লইয়া গেছে মোল্লা চেয়ারম্যানের গোমস্তায়। হেগো বাইত বাইরের থন মে’মান আইসে কাইলকা রাইতে।
: বাজান তুমি চিতল মাছডা বাইত লইয়া যাও। হগগলতে খুশী অইবো।কুলসুম আর আলীমে অইবো সব থেইক্কা বেশী।
: লইয়া যামুনে। আর এট্টুহানি দেহুম। বেচা না হইলে যা থাকবো লইয়া বাইত যামুগা। আইজকা তো কপাল ভালা। ভালা টাইমে কামাই হইসে কয়ডা ট্যাহা।
লুঙ্গিডা ঝাইড়া মুইচ্ছা পলিথিনের পোটলা থেইকা সবুজ রঙের ফতুয়াটা গায়ে দেয়। গামছা গোছ কইরা কান্ধে লইয়া মেলার দিকে রওনা দ্যায় কলিম।
: বাজান গেলাম। তুমিও বাইত যাইওগা তাড়াতাড়ি। তুফান আইবো মনডায় কইতাছে। মেঘের অবস্থা দেখছনি।
কদম ফেলার লগে লগে কলিমুদ্দির মাথার মইধ্যে রঙ-বেরঙের খেলা চলতে থাকে। মনে হয় জানি আইজাকা সে আর জমিনের ‘পর দিয়া হাটে না। বইনডার মুখ মনের মইধ্যে ভাসে। মনের মধ্যে ডুগডুগি বাজায়া আসে তার পরাণডাঙার মানুষডার ছবি। মুখখান যেন চোখ্খের সামনে ভাসতে থাকে জরিনার।
জলদি পাও চালায় কলিমুদ্দি। হাঁইজ হওনের আগে আগে জরিনার কাছে পৌঁছান গেলে তারে এট্টু দেহন যাইতো।
মেলার কাছে আইয়া পড়ছে। দেহন যাইতাসে না, তয় আওয়াজ জোর হইতাছে। সামনের মোড়ডা ঘুরলেই মেলার মাঠ। শোরগোল, বাজনা-বাদ্যি, ঢোল, বাঁশি, মানুষের গমগমা উৎসব আলাপ; তার সাথে বাতাসে ভাসতাসে কদমা, মুরালি, মুড়ি, মুড়কি, খেজুরের গুড়ের বাতাসা সব কিছুর গন্ধ। মানুষের গন্ধ, জীবনের গন্ধ।
মোড়ের কিনারে আইসা হাটায় আরো জোর বাড়ে কলিমুদ্দির। চোখের কোণা দিয়া দেখে ফিটফাট কালা পাঞ্জাবী পইরা কয়জন খাড়াইয়া আছে আসমানীর বাপের চা দোকানডার কিনারে। উলটা দিকে মেলার গান-বাজনা পার্টি গোছগাছ করতাসে মেলায় ঢুকনের লাইগগা। এতক্ষণে ঢোল বাদ্যির দলের কিনারে আইসা পড়সে কলিম। চোখের কোণা দিয়া সে দেখে ওগুলারে কি সুন্দর রঙিন নকশা কাটা জামা পরাইয়া রাখছে, সবগুলানেরে।
হঠাৎ মনে হইলো কেউ জানি খুব জোরে ঢোলের মাইধ্যে বাড়ি মারলো। ম্যালা জোরে, কান ফাইট্টা যাওনের রহম জোরে। তাকাইয়া দেহে হ ঠিকই, একখান ঢোল ফাইটা টুকরা হইয়া যাইতাছে। হায় হায়, এইডা কি ! ঢোলের লগে তো ঢোলকও য্যান টুকরা হইয়া যাইতাছে।
কি সব দেখতাসে কলিমে, নিজেই বেকুব হইয়া ভাবে। এর মাইধ্যে এইরহম জোরে জোরে শব্দ হইলো আরো কয়ডা। তাকাইয়া দেহে সবগুলান ঢোল আর ঢোলক টুকরা টাকরা হইয়া ছড়াইয়া ভরাইয়া যাইতাসে। দেখতাসে দুইন্নাডা কেমন কাইত হইয়া আউলাইয়া যাইতাসে। দেখতাসে অর সবুজ জামাডার গায়ে লাল গোল একখান রঙ আস্তে আস্তে ছড়াইয়া বড় হইতাসে। য্যান জামাডারে কেউ আস্তে আস্তে পতাকা বানাইতাসে। দেশের পতাকা।
মেহমানের মতোন নতুন চেহারার মানুষগুলান দাঁত দেহাইয়া ফটাফট বারুদের গন্ধ মাখা ধোঁয়ার আড়ালে চইলা যাইতাসে। ঢাক ঢোলের আওয়াজ বাদ দিয়া অগোর হাসির দমকে বাতাস কাঁপতাসে।
কলিমুদ্দি দেহে চক্ষের সামনে খালি আকাশখান ভাসতেআছে। তার মইধ্যে কুলসুম আর জরিনা অর দিকে তাকাইয়া ডাকতেআছে। অরা খালি কইতাসে – আমাগোরে থুইয়া অহন আবার কই মেলা দিলা! হাঁইজ নামনের আগে না আইবা কইসিলা …
দেহে মায় ডাকতাসে, বাবায় ডাকতাসে; মনে লয় আরর এট্টু দেরী হইলে বাপে বকবো, বকবো বহুৎ, এক্কেরে ভুল নাই … আইজকা … ভুল নাই, বেগতেই গাইল দিব, বকবো … গাইল দিবো, বকবো … হেষে মায় বুঝি এট্টু কিনারে আইসা …
কিনারে আইসা কি ! কইবো …. বাজান তুই না চিতল মাছের পেটি দিয়া একদিন ভাত খাইবি কইসিলি …
৩০ মার্চ ২০১৭
(প্রকাশিতব্য বৈশাখী সংকলন গ্রন্থের জন্য লেখা)
:clap: :clap: :clap: :clap:
গল্প বরাবরের মতই দারুণ!
বৈশাখী শুভেচ্ছা রইল, ভাইয়া।
অগুন্তি ধন্যবাদ সাবিনা।
লেখা যাই হোক, এমন বললে কলমের পাগলামি বাড়াতে বেশ যুক্তি পাওয়া যায়।
আগাম বৈশাখী শুভেচ্ছা রইলো আমারও।
🙂 🙂 🙂 🙂
কলমের পাগলামি চলুক না
ভাবনার ছবি গুলো আঁকো না!
উড়ে ঘুরে মন খুলে লিখো না!
সিসিবিতে প্রাণ তুমি আনো না!
তাই হবে শীঘ্রই আশা রাখি তাই হবে।
:clap: :clap:
লুৎফুল ভাই, সত্যিই অসাধারণ লেখা। ভালো লেগেছে।
অগুন্তি ধন্যবাদ ভাই সেলিম রেজা।
প্রথমত কষ্ট করে লেখাটা পড়বার জন্য আর তা ছাপিয়ে মন্তব্যে প্রাণিত করবার জন্য। বিশেষ করে সিসিবির মন্তব্য খরার ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে আমি নিজেও যখন মন্তব্য খরায় ভুগছি তখন।
একটা সময় ছিল যখন ভাল লাগা খারাপ লাগা সব আঙ্গিকেই আলাপ জমতো লেখাগুলোর নীচে মন্তব্যের ঘরে ঘরে। তারপর বৈশাখী ঝরে উড়ে যাওয়া ডাল-পাতার মতোন সেসব কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো।
আবারো ধন্যবাদ।
সবসময়ের মতই চমতকার।অামি নিরব পাঠক।নিরবে পড়েই চলে যাই।অাশাকরি এখন এমন নিরব পাঠকরা সরব হবেন অার মন্তব্যগুলি বৈশাখী হাওয়ায় উড়ে চলে যাবেনা।
এমন অভাবনীয় মন্তব্যে প্রাণিত হতেই হয়। অল্পস্বল্প নয় যারপরনাই।
যার সাথে মতের মিল হচ্ছে না, তার ওপরেই অন্ধ আক্রোশে আদিম নৃশংসতায় ঝাঁপিয়ে পড়ার শেষ কোথায়?
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখন তো এটাই শেখাচ্ছে