~ অযুত নিযুত জীবনের অপার আনন্দ – জীবনানন্দ ~

[ প্রিয় কবির ১১৮তম জন্ম দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি ]

কুসুমকুমারী দাশ যখন লিখেছিলেন – “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে / কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?” তখন নিশ্চিত তাঁর জানা ছিল না আপন গর্ভে তিনি কত বড় মাপের একজন মানুষকে, বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবিকে ধারণ করবার মহিমা অর্জন করবেন।

পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশাল গিয়ে আবাস গড়েন। বাবা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। সেইসাথে আরো ছিলেন বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক এবং এর মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী ধান-নদী-খালের দেশ বরিশালে জন্ম নেন জীবনানন্দ। বাবা স্কুল শিক্ষক হলেও বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত হয় নিজ বাড়ীতে মায়ের কাছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাবার কন্ঠে শুনতেন উপনিষদ আবৃত্তি। অন্য সময়ে মায়ের কাছে শুনতেন গান। বাবা-মায়ের এই দীক্ষা-সান্নিধ্যে কৈশোরেই জীবনানন্দ বাংলা ও ইংরেজীতে লেখালেখির সূত্রপাত ঘটান। ছবি আঁকার দিকেও তার ঝোঁক ছিল। লাজুক স্বভাবের হলেও খেলাধুলা, ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল জীবনানন্দের।

বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান জীবনানন্দের ছিল এক ভাই ও এক বোন। ভাই অশোকানন্দ-এর জন্ম ১৯০৮ সালে, বোন সুচরিতা দাশ-এর জন্ম ১৯১৫ সালে। পারিবারিক পরিসরে জীবনান্দের একখানা আদুরে ডাকনাম ছিল। বাবা সেই মিলুকে আট বছর বয়সে একবারে ভর্তি করান ব্রজমোহন স্কুলে। সেই স্কুল থেকে ১৯১৫ সালে মেট্রিকুলেশন আর তার দুই বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। দুটোই প্রথম বিভাগে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করলেও ব্রজমোহন কলে থেকেই ১৯১৯ সালে ইংরেজীতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯২২ সালে ইংরেজীতে এমএ পাশ করেন। ইংরেজীর পাশাপাশি জীবনানন্দ আইন পড়তে শুরু করলেও পরে তা ছেড়ে দেন।

এমএ পাশ করে সে’বছরই ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সিটি কলেজে। ছ’বছরের মাথায় (১৯২৮) ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে ছাত্র অসন্তোষের জের ধরে ছাত্রভর্তি কমতে থাকলে শিক্ষক ছাঁটাইয়ের প্রথম খড়গটি সর্বকণিষ্ঠ হিসেবে জীবনানন্দের ঘাড়েই নেমে আসে। এর মাঝে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাতে নিজ নামশেষে পদবী ‘দাশগুপ্ত’ ছেঁটে ‘দাশ’ করে দেন। তাতে কিছু কমেনি কবিতা লেখাকে ঘিরে কর্মক্ষেত্রে তাকে নিয়ে নানান পরিহাস। ওটা বরং সারা জীবনই তার পিছু নিয়ে ছিল।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে লেখা ‘দেশবন্ধুর প্রয়ানে’ কবিতাটি ছাপা হয় ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। সেসময় ‘প্রবাসী’ ও ‘বিজলী’-তেও তার কবিতা ছাপা হয়। তবে তিনি বরাবরই সমালোচকদের নির্দয় তীর্যক শরে বিদ্ধ হয়েছেন। একদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট অন্যদিকে সমালোচক ও সাহিত্য আলোচকদের অবিরাম নির্দয় খড়গ তাকে অচিরেই কলকাতা ছাড়া হতে বাধ্য করে। এবার তিনি ছোট্ট শহর বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অবশ্য তিন মাস পরেই তিনি আবার কলকাতায় ফেরেন। কাজ খোঁজার পাশাপাশি তিনি টিউশানি করে জীবনধারন করতেন। এটা তিনি করে গেছেন পুরোটা জীবনই। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় জুটে যায় কাজ। দিল্লীর রামযশ কলেজে অধ্যাপনার কাজ জুটে যায় তার ১৯২৯ এর ডিসেম্বরে।

এর ভেতর ১৯৩০ সালের ৯ মে লাবন্য দেবীর সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাটুকুন হয় ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরীতে। পারিবারিক ভাবে আয়োজিত এ বিয়ের পর দিল্লীতে ফিরে না গিয়ে ঢাকায়ই থেকে যান কবি। দিল্লীর চাকরীটা তাই সহজাতভাবেই খোয়াতে হয় তাকে। এবারের চাকরীবিহীন পর্বটি ছিল তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের। এই সময়টায় কিছুদিন জীবনানন্দ ইনশিউরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। ছোট ভাই অশোকানন্দ-এর কাছ থেকে টাকা ধার করে ব্যবসার চেষ্টাও করেছিলেন জীবনানন্দ। কোনো উদ্যোগই তার যদিও সাফল্যের মুখ দেখেনি।

১৯৩১ সালে কবি জনক হন তাঁর প্রথম সন্তান ‘মঞ্জুশ্রী’র এবং বিখ্যাত ‘ক্যাম্প’ কবিতাটির। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হলে অশ্লীলতার দায়ে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে হয় কবিকে। জোছনা রাতে হরিণ শিকার – এমন আপাতসত্য বিষয় আঙ্গিকের এই কবিতাটিও জীবনানন্দের সমালোচকদের ভুরু বাঁকা করেছে। হয়তো বরিশালের ছোট্ট গ্রাম্যগন্ধ মাখা একটা শহর থেকে আসা জীবনানন্দকে সেভাবে মেনে নেয়ার মানসিকতাটুকুনই অনুপস্থিত ছিল জাঁকজমকপূর্ণ কলকাতার সবার মাঝে। সম্ভবত বুদ্ধদেব বসু একাই জীবনানন্দের প্রতি তার চারপাশের সমস্ত মানুষের বৈরী আচরণকে পুষিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। তার অনন্য সম্পাদকীয় সামর্থ্যে কি মানবিক ও সুস্থ্য বিবেচনায় তা সে যে কারণেই হোক, বুদ্ধদেব বসু বাদে জীবনানন্দকে সেভাবে কেউই মূল্যায়ন করেনি। না কাছের, না দূরের, না আত্মীয়, না পরিজন, না সহকর্মী, না তার জীবনসঙ্গীনী; কেউই না।

‘ক্যাম্প’ নিয়ে বিতর্কের সময়টাতে জীবনানন্দ গল্প-উপন্যাস লেখায় তৎপর হয়ে ওঠেন। এ লেখালেখি অব্যহত থাকলেও তার ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্পের কোনোটিই তার জীবদ্দশায় প্রকাশের মুখ দেখেনি, গ্রন্থিত হয়নি। শোনা যায় পাণ্ডুলিপি উদ্ধারপর্বে একখানা আস্ত ট্রাঙ্কই ট্রেন স্টেশন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ওটা থাকলে গল্প, উপন্যাস, কবিতা তার সংখ্যা ও কলেবরে নিশ্চয়ই আরো বাড়তো। ১৯৩২ এর মার্চে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ এবং ‘নিরুপম যাত্রা’ উপন্যাস দুটো লেখেন। মাত্র দশ দিনে ‘মাল্যবান’ এবং এক মাসে ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাস দুটি লিখে ফেললেও কোনো কোনো কবিতার সংশোধন পরিমার্জনে জীবনানন্দ সময় নিয়েছেন বছরাধিক।

১৯৩৪ এর মার্চ মাসে লেখেন ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা। ১৯৩৫ সালে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বি এম কলেজে্। এ সময়ে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তার কবিতা ‘মৃত্যুর আগে’ এবং দ্বিতীয় সংখ্যায় মুদ্রিত হয় ‘বনলতা সেন’। ‘মৃত্যুর আগে’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে বুদ্ধদেব বসুকে বলেছিলেন কবিতাটি ‘রূপচিত্রময়’। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে সরাসরি যে চিঠিটি অন্য সময়ে লিখেছিলেন তাতে অবশ্য নন্দিত হননি জীবনানন্দ, হয়েছিলেন কঠোর সমালোচিত। প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সজনীকান্ত দাশ বা সে সময়ের উল্লেখযোগ্য কোন কবি-লেখক-আলোচক-সমালোচক তাকে নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলেন নি বা লিখেন নি। একমাত্র বুদ্ধদেব বসুই করেছেন উল্টোটা, লেগে ছিলেন তার পেছনে, লেখা আদায় করবার জন্যে। আশ্চর্য সম্পাদকীয় সামর্থ্যে শুধু তিনিই সম্ভবত বুঝেছিলেন যারা তাকে অবহেলা করছে, তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছে তাদের অনেকেরই নাম হয়তো সময়ে ম্লান হয়ে যাবে কিন্তু জীবনানন্দই থেকে যাবেন কালাকাল পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। সেই সুত্রে হয়তো বুদ্ধদেব বসুর কল্যাণে আজ আমাদের পাওয়া হলো জীবনানন্দকে।

১৯৩৬ এ কবি দ্বিতীয় সন্তানের জনক হন। সে বছর প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ১৯৩৭ এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু স্বহৃদয় আলোচনা করেন বইখানি নিয়ে। জীবদ্দশায় পাওয়া সামান্য কিছু স্বীকৃতি জোটে তখন জীবনানন্দের। পরের বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’-এ স্থান পায় জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি। তার ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধটি ছাপা হয় ‘কবিতা’ পত্রিকায়। ১৯৪২ এ কবিতা ভবনের এক পয়সায় একটি সিরিজে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন’। সে বছরই তার বাবা সদানন্দ দাশের প্রয়ান ঘটে। ১৯৪৪ এর জানুয়ারীতে একটি সংকলনে প্রকাশিত হয় সেই সুপরিচিত গদ্য ‘কেন লিখি’। এ বছরই জুলাইএ প্রকাশিত হয় তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’।

১৯৪৬ এ ছুটি নিয়ে কলকাতায় যান জীবনানন্দ। তারপর ১৯৪৭ এ সপরিবারে কলকাতায় চলে যান স্থায়ী ভাবে। সময়টা দাঙ্গার কিছুকাল আগে। তবে তার এ যাওয়ার পেছনে দাঙ্গা নয়, কলকাতা শহর ও সাহিত্যাঙ্গনের টানটাই ছিল মুখ্য। এবছর হুমায়ুন কবীরের ‘স্বরাজ’ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন জীবনানন্দ। যদিও তার এ কাজের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক মাসের।

১৯৪৮ এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’। এবছরই স্বর্গবাসী হন তার মা কুসুমকুমারী। এতো সবের মাঝে মে-জুন দুমাসে লিখে ফেলেন দু-দুটি উপন্যাস – ‘সুতীর্থ’ এবং ‘মাল্যবান’। পরের বছর ১৯৪৯ এ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় Bengali Poetry Today প্রবন্ধটি। ১৯৫০ সালে জীবনানন্দ ‘সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্র’-এর মুখপত্র ‘দ্বন্দ্ব’র সম্পাদনা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন।

১৯৫২ সালে তার পরিবর্তিত ‘বনলতা সেন’-এর সিগনেট সংস্করণ প্রকাশিত হলে বইটি নিখিলভারত রবীন্দ্র সম্মেলনে শ্রেষ্ঠ বইয়ের পুরষ্কার পায়। এর পর পরই জীবনানন্দ অধ্যাপনার কাজ পেয়ে যান বরিষা কলেজে। পরের বছরই অবশ্য তার এই চাকরী চলে যায়। এবার, ১৯৫৩ সালে, তিনি যোগ দেন হাওড়া গার্লস কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রধান হিসেবে। এটাই ছিল তার শেষ পেশাগত সম্পৃক্তি। সারাটা জীবনই তাকে চাকরী ক্ষেত্রে নানান রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে। হতে হয়েছে বহুবিধ গঞ্জনার শিকার। অনেক ক্ষেত্রেই কবিতা লিখেন তিনি এটাও ছিলো তাকে উপহাস করবার বা অযোগ্য পরিগণিত করবার কারণ। আজ তার কবিতা নিয়ে গবেষণা হয় দেশে বিদেশে অগণিত পণ্ডিতদের মাঝে। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তাকেই ধরা হয় এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে।

বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের দশটি কবিতা নেয়া হয়। তার আগে আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’য় তার মাত্র চারটি কবিতা নেয়া হয়েছিল। এ সময়ে ১৯৫৪ সালের জানুয়ারীতে সেনেট হলের কবি সম্মেলনে কবিতা পড়েন তিনি। মে মাসে নাভানা থেকে তার জীবদ্দশায় শেষ বইটি প্রকাশিত হয়। তার এ কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় অনেক কবিতা পরিমার্জন ও পরিবর্তন করেছেন জীবনানন্দ নিজ হাতে। এ গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলোকে তাই সর্বশেষ ও সঠিকতর পাঠ সংকলন বলে মানা যায়। এমনটা মেনেছেন অনেকেই, বলতে গেলে প্রায় সকলেই।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনায় ক্যাচারে আঁটকে তার কণ্ঠা, উরু ও পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে মারাত্মক আহত হন তিনি। প্রায় দলিত শরীর নিয়ে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে সাত দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে পরলৌকিক মহাযাত্রায় চলে যান কবি। বলা হয় এ সময়ে এমনটাই বিমর্ষ ছিলেন কবি যে তার অনবধান পদক্ষেপ তাকে কোথায় কোন অন্তিম গন্তব্যের পথযাত্রী করবে তার কিছু বুঝে উঠবার মতোন অপারগতা অকস্মাৎ তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এই মর্মান্তিক ট্রাম দুর্ঘটনায়।

সমসাময়িক কবি সাহিত্যিকরা কেউ কেউ ততোদিনে তাকে আবিষ্কার করে উঠতে পেরেছিলেন কিছুটা। সেই শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টা, মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ সুচিকিৎসার ব্যাবস্থা প্রচেষ্টা – এসব কিছুকে নাকচ করে দিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। সবাই উদগ্রীব উৎকণ্ঠায় হাসপাতাল ঘিরে থাকলেও অন্য সময়ের মতোনই স্ত্রী লাবণ্য দাশকে তার সান্নিধ্যে পাওয়া যায়নি। লাবণ্য ব্যস্ত ছিলেন টালিগঞ্জে তার সিনেমার কাজে। ঠিক যেমনটা সারা জীবন লক্ষ্য করেছিলেন জীবনানন্দের শুভানুধ্যায়ী নিকট জনেরা। শোনা যায় মৃত্যু পরবর্তীতে নানান মানী গুণী মানুষের উপস্থিতি দেখে লাবণ্যর মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়, মানুষটা কি এমনই বিদ্যান বা গুণী কেউ ছিলেন ? তার সেই নির্মম জীবনের সত্যটাই বুঝিবা নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী তুলে এনেছিলেন – ‘জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আজো আমি সব কিছু ভুলে যেনো করি লেন-দেন’ গানের কলিতে।

রচনাকালঃ ১২ অক্টোবর ২০১৬

৫,৯০৮ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “~ অযুত নিযুত জীবনের অপার আনন্দ – জীবনানন্দ ~”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেললাম আপনার লেখাটি লুৎফুল ভাই। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তথ্যসম্মৃদ্ধ জীবনানন্দ বেশ সুখপাঠ্য হয়েছে। কবির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
    আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
    পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
    জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
    অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
    আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
    হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
    নক্ষত্রের নিচে।

    এই একটা কবিতার জন্য হলেও জীবনানন্দকে বড় আপন মনে হয় ।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      অনন্য একখানা কবিতার কথা বললে ভাই।
      কবিতা যে ভালবাসে আর বাংলায় যদি সে পড়তে পারে তো জীবনান্দকে ভালো না বেসে কি আর পারে !
      মুগ্ধতার বন্যায় ভাসায় তার অধিকাংশ লেখাই। যখন জানা যায় কি বিশাল ব্যাপ্তিতে কত দ্রুত সে কতো কি লিখে গেছে। তো অবাক হতে হয়। আর যেটুকুন হারিয়েছি আমরা, তার কথাটুকু তো অজানাই থাকবে।

      জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      কি যে বলিস ! লেখার কি কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট আছে, নাকি আছে কোনো স্টাইল। ভালো লেখা কত রকমের ঢঙে হতে পারে।
      এক এক জনার ঢঙ এক এক রকম হবে। কিন্তু যেটা ভাল লেখা হবে সেটা সবাই না হোক সত্যিকারের পাঠক সন্ধান পেলেই পড়বে।
      শঙ্কার বিষয় এটাই যে, অধিকাংশ পাঠক এখন খুব বেশী সহজ পাঠ চায়। যেখানে আমার স্কোর খুব মিজারেবল। একেবারে জরাজীর্ণ। আমি আরো থাকি সে শঙ্কা ও সংকট নিমজ্জিত। সারাক্ষণ ভাবি কি করে সাবলীল হওয়া যায়, আরো মানুষের ভালো লাগায় পৌঁছে যাওয়া যায়।
      আর তখন এমন ভালো লাগার কথাগুলো উদ্বেল করে, সীমাহীন সাহসে বলীয়ান করে আমাকে, আমার কলমকে। ধন্যবাদ বন্ধু।

      জবাব দিন
  3. কৌশিক(২০০৪-২০১০)

    'জীবনানন্দ' সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহী হলাম এটা জেনে যে, তিনি ব্রাহ্মসমাজের এক শোকসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় থিউরি অব রিলেটিভিটি-র অবতারণা করেছেন। শুধু তাই নয়, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে-সব নতুন তত্ত্ব দেয়া হচ্ছিল নিভৃতচারী জীবনানন্দ তার-ও খোঁজ রেখেছেন।

    সময়ের আগে জন্মাবার বিপদ হলো, চারপাশের বামনদের আঘাত সইতে হয়। কে জানে, মুখ বুজে মুক্তো ফলাবার ওটাই হয়তো বীজমন্ত্র!

    যথারীতি চমৎকার, লুৎফুল ভাই! 🙂

    জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      একেবারে খাঁটি কথা। সময়ের অনেক বেশি আগে জন্মেছিলেন এই মহামানব।
      জ্ঞান ও পাঠের পরিবৃত্তে তিনি কতো বিস্তৃতিতে ছড়িয়েছিলেন সেই পরিমাপ আমরা করে উঠতে পারিনি।
      আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর লেখার সবটুকু আমরা পাইনি, পড়িনি।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।