~ দৃশ্য-এক
দীনবন্ধু মিত্র যখন নীলচাষীদের কান্নার ধ্বনিকে শব্দের সৌকর্যে সাজালেন কালোত্তীর্ণ সাহিত্য উপস্থাপনায় তখন রাজা রামমোহন বললেন “নীলচাষের জমির নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান অন্যান্য অঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের তুলনায় উন্নততর। নীলকরদের দ্বারা হয়তো সামান্য কিছু ক্ষতি সাধিত হতে পারে, ……. নীলকর সাহেবগণ এদেশীয় সাধারণ মানুষের অকল্যাণের তুলনায় কল্যাণই করেছেন বেশী”। দ্বারকানাথ বাবু বললেন, “নীলচাষ এদেশের জনসাধারণের পক্ষে সবিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে। জমিদারগণের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষকদের বৈষয়িক উন্নতি সাধিত হয়েছে।” বৃটিশ শাসনের কল্যাণে এভাবে পশ্চিমা সুবাতাসে যখন আধুনিক ভারত জন্ম নিচ্ছিল গ্রাম্য কৃষকদের জীবন-শ্রম-ঘামের বিনিময়ে। তখন বঞ্চিত, বিধ্বস্ত, লুণ্ঠিত কৃষকরা আধুনিকতার মোহমগ্ন লাভবান বাবু আর রাজাদের পেছন থেকে সরে দাঁড়াবার মতোন একটা অবস্থায় কোণঠাসা হতে থাকলো।
সংগ্রাম আর লড়াইয়ের পেছনে চিরকালীন উৎস শ্রেণীস্বার্থ তাই অচিরেই খুঁজে নিলো তাদের নব্য নেতৃত্বকে। সংখ্যাগুরু মধ্যবিত্ত যখন স্বার্থের টানাপড়েনে হুশ জ্ঞানে সম্বিত পেলো, সরব হলো – তখন অচিরেই নেতৃত্ব সমর্পিত হতে চললো সংখ্যার বেদীতে। রাজাবাবুদের পেছন থেকে সরে মানুষ সারিবদ্ধ হতে থাকলো সোচ্চার মধ্যবিত্তের পেছনে। কৃষক বিদ্রোহ আর সচেতন মানুষের স্রোত সাধারণের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলো শিক্ষিত বাবুদের। অসহায়, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, চাষী, মজুর যখন বুঝলো বাবুদের শোষণের খড়গ হাত থেকে নিস্তার নেই, তার দুঃখ যন্ত্রণার গান শোনার জন্যেও কেউ অপেক্ষায় নেই, আকুতি জানাবার জন্য পাথরের দেবতা ছাড়া আর কেউ নেই, সমর্পণের স্রষ্টা ছাড়া বিকল্প নেই, তখন ধর্ম আর ধর্মের আলখাল্লায় মোড়ানো অন্ধবিশ্বাসে তাদের আস্থার শিকড় প্রোথিত হতে শুরু করলো। অনায়াসে ছিন্নমূল মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকলো ধর্মীয় নেতাদের।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসব প্রেক্ষিতের চাপে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন ব্যাপকতা লাভ করছিলো। তখন ইংরেজরা সেই বিখ্যাত ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসির সুকৌশলী প্রয়োগে সচেষ্ট হলো। ইংরেজদের অস্ত্র ভান্ডারে এবার তারা যোগ করলো হিন্দু-মুসলিম বিভেদ বৈষম্যের কলকাঠি। চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ এই তিন বিভাগের সাথে আসামকে যুক্ত করে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক বোধকে অখন্ড ভারত বিভাগের নিউক্লিয়াস হিসেবে সৃষ্টি করা হলো।
ক্রমশ দুর্বল হিন্দু রাজাদের বাদ দিয়ে মুসলমানদের দলে টানবার জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকা এসে মুসলমানদের জন্য নানান প্রলোভনের ফাঁদ পাতলেন। বললেন বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানদের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে, ঢাকা হবে নতুন প্রদেশের রাজধানী।
চাকরি-বাকরি-শিক্ষা-প্রতিষ্ঠা সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা প্রভাবিত হলো অনেকটা। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ খুব উৎসাহী হলেন। শিক্ষিত মুসলমানরা যেন সৌভাগ্যের সকাল দেখলেন। সর্বাগ্রে তাদের নিজেদের স্বভাবেই সুবিধাভোগী অবস্থানপুষ্ট হিন্দুরা করলো বিরোধিতা। সত্য আর আপাত সত্যের দ্যোদুল্যমানতায় অনেক হিন্দু অনেক মুসলমান তারপরও চাইলেন অখন্ডতা।
সূত্রপাত হলো স্বদেশী চিন্তার, বিকাশ ঘটলো চরম পন্থার, চরমপন্থীরা বিদেশী দ্রব্য বয়কটের ডাক দিলো। কংগ্রেস হলো দ্বিধাবিভক্ত। স্বদেশী আন্দোলনে সমর্থন দিলেও বয়কটের আন্দোলনকে সমর্থন দিলেন না সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এমনি অনেকে। দরিদ্র হিন্দু-মুসলমানদের অনেকেই কম দামী বিদেশী পণ্য বাদ দিয়ে দেশী পণ্য ব্যবহারের বাস্তবতায় আসতে পারলেন না।
শুরু হলো সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-ক্ষতির টানাপোড়েন। শুরু হলো শ্রেণী বৈষম্যের রূপরেখায় পরিস্ফুটন। তখনো এদেশের মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না যে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিদ্রোহ কখনো সুশৃঙ্খল পথে আগায় না। স্বদেশী আন্দোলনোর ভেতর থেকেই ক্রমান্বয়ে অহিংসতা ছাপিয়ে জন্ম নেয় সহিংসতা। স্বর্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর বৃটিশ শাসককূলের কল্যাণে মরিয়া হয়ে আপামর জনসাধারণ যখন সহিংসতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো, তখন, শাসক-শোষক তন্ত্রের ভাষায়, জন্ম নেয় ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন’। সময়ের চক্রে চরমপন্থীদের শ্লোগান ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় আন্দোলনও দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু বিপ্লবীরা এর মধ্য দিয়েও চাইলেন হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা; বিপ্লবী দলের সদস্য হবার জন্যে চালু হলো কালীমূর্তির সামনে প্রতিজ্ঞা, গীতা স্পর্শ করে পশথ গ্রহণ। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণে মুসলমানরা হলো অসুবিধার সম্মুখীন। ক্রমশ নেতৃত্ব কুক্ষিগত করতে থাকলো হিন্দুরা।
মাওলানা আবুল কালাম, যিনি প্রথম মুসলিম হিসেবে সন্ত্রাসবাদী দলের সদস্যপদ লাভ করেন, তিনি লিখেছেন “বিপ্লবী দলগুলোর সদস্য সংগ্রহ করা হতো হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে। প্রকৃতপক্ষে তখন সবগুলো বিপ্লবী দল ছিল সক্রিয়ভাবে মুসলিম বিরোধী। … বিপ্লবীরা অনুভব করতো যে, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে মুসলিমরা বাধাস্বরূপ। আর তাই অন্যান্য বাধার মত তাদেরকেও অবশ্যই অপসারণ করতে হবে”। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শিক্ষিতরাও এভাবে হিন্দু মুসলমান বিরোধ সৃষ্টি করলো। ১৯০৬-০৭ সালে দাঙ্গা এই সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে তীব্রতর করলো। দেশপ্রেমের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত অথচ ভিন্ন সম্প্রদায়কে সহ্য করতে অপারগ!
‘দেবী চৌধুরানী’ আর ‘আনন্দমঠ’ লিখে বৃটিশ শাসনমুক্ত রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন তা ছিল অন্য অর্থে হিন্দু রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রেরণায় বিকৃত এক সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার নথিবদ্ধতা। প্রাজ্ঞ আহমদ ছফা তাই লিখেছিলেন ‘শতবর্ষের ফেরারী ; বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’। মুসলমান সমাজকে ইতিহাসবঞ্চিত করার এক প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা এভাবে মুসলমান সম্প্রদায়কে আরেকটি ধর্মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছে। শাসক শক্তির বিরুদ্ধে পরাজিত সাধারণ মানুষ যখন একদিকে ধর্মীয় চেতনার কাছে সমর্পিত হচ্ছে অন্যদিকে শোষিতের সংগ্রামে সাহসী শরীয়ত উল্লাহ আর তীতুমীরেরা সামগ্রিকতার অভাবে সাহসের সৌকর্য হারালেন বিজিতের এপিটাফে। মানুষ তখন আলোড়িত হলো, কাঁদলো। কিন্তু জয়ী হতে পারলো না।
ইংরেজ রাজকর্মচারী, গোয়েন্দা প্রধান হিউম শিক্ষিত শ্রেণীকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে নিপীড়িত কৃষক ও দরিদ্র মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াসে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা হলেন। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় তাই ভারতের বাহাত্তর জন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে বৃটিশ ন্যায়পরায়ণতা ও মহানুভবতার প্রতি আস্থা ব্যক্ত করেন। ওই সভার প্রত্যেক বক্তাই ছিলেন এই বক্তব্যের সমর্থক ও অনুসারী। পরবর্তীতে ধর্মীয় দ্বন্দ আর ইংরেজ প্রেরণায় হিন্দু রাজনৈতিক আবেদনের যুগে মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণ আর অবস্থান গঠনের দাবীতে সৃষ্টি হয় মুসলিম লীগ। এই দলও ছিল ইংরেজ শাসকদের আশীর্বাদ পুষ্ট।
ইংরেজরা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিতে সফল হলেও দীর্ঘ সহিংস সংগ্রামের পথ থেকে সরে গান্ধীর অহিংস মতবাদ আর জিন্নাহর সংখ্যালঘু মতবাদের কল্যাণে উভয় দলই জমিদার শ্রেণী, ব্যবসায়ী আর ইংরেজ শাসনের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে থাকে। সাম্যবাদীদের কৃষক সমর্থনপুষ্ট ও অধিকার সচেতন আন্দোলন তাই বার বার গান্ধী আর জিন্নাহর রাজনৈতিক মতবাদের চাপে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর তাই স্বভাবতই ক্রমশ শোষিতের ও বঞ্চিতের স্বার্থে গড়ে উঠতে থাকে বামপন্থী রাজনীতি।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিম জোতদার আর অন্যান্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা গঠন করে প্রজা সমিতি। পরিণতিতে মুসলিম লীগ অনেকটা শক্তি হারায়। বামপন্থীরা জমায়েত হয় প্রজা সমিতির সমর্থনে। বামপন্থীদের চাপে ১৯৩৩ সালে প্রজা সমিতির নাম পরিবর্তিত হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে।
অনেক বিরোধের পরও নির্বাচনের স্বার্থে কৃষক প্রজা পার্টি আর মুসলিম লীগ এক হয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রীসভা গঠন করে। মন্ত্রীসভা গঠনের পর কৃষকদের পক্ষে কিছু আইনও পাশ করে। বিষয়টা এ পর্যায়ে কৃষক প্রজা পার্টিকে দুর্বল করে দেয়। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের করায়ত্বে ধরাশায়ী ফজলুল হক ক্রমান্বয়ে ম্রিয়মান ও মুসলমান জমিদারদের স্বার্থ ক্রমশ জোরদার হতে থাকে। বাঙালি চেতনার ধারক ও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত লাভ করা ফজলুল হক এভাবেই হয়ে ওঠেন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রস্তাবক। পাথর চাপা পড়লো বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা।
~ দৃশ্য-দুই
বঙ্গভঙ্গকে যারা মানেননি ১৯০৫ সালে, অভাবনীয় হলেও সত্যি যে, তারাই ১৯৪৭ এর বিভাজনকে স্বাগত জানালেন। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনে মুসলমানদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক হিন্দুর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। হিন্দুদের কেউ কেউ মনে করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে হিন্দুরা নির্বাচনে বরাবরই মুসলমানদের সাথে পেরে উঠবে না।
১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতির মধ্য দিয়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বঙ্গভঙ্গের দাবী তুললেন। নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালনী ১৯৪৭ সালের মার্চে প্রকাশ্যে বঙ্গভঙ্গ দাবীর সমর্থন করেন। একই বছর ৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হিন্দুবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবী উত্থাপিত হয়। কংগ্রেসের হিন্দু-মুসলমান সব নেতারা ক্রমানয়ে এই একই দাবীতে সোচ্চার হলেন।
১৯০৫ সালে অখন্ড ভারতের কর্তৃত্বের দাবীদার হবার আশা-আকাঙ্খা যে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য হন্যে করেছিলো, সেই মানুষগুলোই নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে সোচ্চার হলেন এবার বিভাজনের দাবীতে। উভয় সময়েই অগ্রণী হলেন শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়। বঙ্কিমচন্দ্র আর শ্যামাপ্রসাদের স্বপ্ন ঠিক ঠিক না ফললেও অখন্ড ভারত ভাগ হলো। সৃষ্টি হলো বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের গৌরবের রাষ্ট্র পাকিস্তান। ইংরেজ শাসক আর স্বার্থন্বেষী মহলের কৃপায় অনেকটা বিনা কষ্টেই জন্ম হলো পাকিস্তানের। যেনবা এক রকম অনায়সেই স্বাধীন রাষ্ট্রের অবয়ব পেলো ‘লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলন।
~ দৃশ্য-তিন
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবার নব্য জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাতলেন নতুন নেশায়। দুই শতকের গোলামীর রেশ ধরেই সম্ভবত, ইংরেজী ভাষায় দিলেন এক অভিনব বক্তৃতা, বললেন, উর্দুকে করতে চান রাষ্ট্রভাষা। স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টির দুই-তিন বছরের মধ্যেই ঘটে গেলো এমনটা। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠা করলো যে পাকিস্তানের, সেখানে তাদের স্বাধীনতা অচিরেই হতে শুরু করলো কন্টকিত। বাংলার মানুষ এবার আবার জাগলো নতুন সংগ্রামে। অবাক হবার মতো হোক আর নাইবা হোক, বাঙলার দাবী নিয়ে উর্দু শব্দ ধার করে সৃষ্টি হলো নতুন রাজনৈতিক পরিচয়, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
আবারো সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ইস্যু বাঙালী হিন্দুদের মতোন গ্রাস করলো উর্দুভাষী পাকিস্তানীদের; সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের চাপিয়ে রাখার জন্য তাই রাজধানী ইসলামাবাদকে ঘিরে উর্দুভাষীরা চালু করতে থাকলো একের পর এক শোষণ নীতি।
চাকরী-বাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দুদের সাথে পিছিয়ে পড়া বাঙালীরা এবার অবদমিত হতে থাকলো উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে। বঞ্চিত হতে থাকলো বাঙলার কৃষক বাংলার শ্রমিক। ধর্মের কড়িকাঠ ছেড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ জায়গা করে নিতে থাকলো সব বাঙালীর মনে। শিক্ষিতরা চাকরী-ব্যবসা-প্রশাসন কোথাও স্থান না পেতে পেতে কোণঠাসা হলো। কল-কারখানা-ব্যাংক-বীমা সব পশ্চিমাদের দখলে। কৃষকের ঘামঝরা শ্রমের ফসল সোনার পাহাড় জমাতে থাকলো পশ্চিমাদের ঘরে। খাদ্য-বস্ত্র-আবাসনের বঞ্চনার পীড়নে মানুষ যখন দিশেহারা হবার যোগার, তখন যুক্ত হলো মাতৃভাষা কেড়ে নেবার মতোন দমন নীতি। অনেকটা অবধারিত ভাবেই ধর্মের বদলে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা হলো শ্লোগান। ধর্মকে পুঁজি করে হাজার বছর পৃথিবীময় শাসনের ইতিহাস বাঙালীকে বিক্ষুব্ধ না করলেও, ধর্মের নামে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের মায়ের ভাষা কেড়ে নেবার মতোন দুঃসহ অপচেষ্টা রুখে দাঁড়াতে সোচ্চার হতে থাকলো আপামর মানুষ।
১৯৫০ এর ৭ জুন মুক্ত এলাকা দিবস পালিত হলো, পোস্টারে উঠে আসলো হাতুড়ি ও কাস্তে। স্পষ্ট হতে থাকলো বিভেদের নতুন রূপেরেখা – বাঙালী আর অবাঙালী।
~ দৃশ্য-চার
নতুন রাষ্ট্র, নতুন স্বাধীনতা চার বছর না পেরোতেই স্বাধীন দেশের রাজপথ রঞ্জিত হলো স্বদেশী নব্য শাসকের ঘাতক হাতে। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন-অত্যাচার নতুন করে আবারো জাগালো সমগ্র বাঙালী জাতিকে। বাঙলার মাটি বাঙালীর রক্তে ভিজে যেনো আরো বলীয়ান হলো তেজে।
এভাবেই দানা বাঁধতে থাকলো পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার জন্য একটি জাতির ব্যতিক্রমী নতুন আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯০৪, ১৯৪৭ এর পর আবারো আরেক ফেব্রুয়ারি এলো ১৯৫২ সালে এই বাঙলায়। ইতিহাসের পাতায় সৃষ্টি করে গেলো আরেক অমর অধ্যায়। বাঙলা ভাষার জন্যে আন্দোলনে উদ্বেল সারা বাঙলা, সমগ্র বাঙালী জাতি। অভাবনীয় উন্নাতাল আন্দোলন ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু’ প্রতিরোধে সরব রাজপথ, জনপদ, গ্রাম, বন্দর। পোষ্টারে, ফেস্টুনে, ব্যানারে, শ্লোগানে, মিছিলে, মিটিঙে, ঘরে, বাইরে বাঙালীর আকাশ কাঁপানো দাবী – ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’। মুখরিত জনপদ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতায়। অক্ষম-অপারগ শোষক ও শাসনযন্ত্র বেছে নিলো অত্যাচার, নিপীড়ন, গ্রেপ্তার, জেল, হত্যার মতোন অকথ্য হাতিয়ার।
দৃশ্য-পাঁচ
একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ – সকাল থেকে মিছিল শ্লোগানে প্রতিবাদ মুখর বাঙালী। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ, ব্যারিকেড, টিয়ার গ্যাস। শ্রান্ত দুপুরের ঢাকা শহরময় কাঁদানে গ্যাসে ভারী বাতাস, ক্লান্তিহীন মানুষেরা তখনো রাজপথ ছাড়েনি। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠে-রাস্তায় আলাপ-তর্কে মশগুল ছাত্র, নানা বয়সের মানুষ, পথচারী। রাজপথের দখল নিতে যেনো নেমে এলো সবুজ হেলমেট আর খাকী পোষাকে সজ্জিত সশস্ত্র পুলিশ। মনে হয় গুলির সহজ দূরত্বে নেই বলে কাছে ডাকবার ছলে দূরত্ব কমিয়েই পুলিশ ছঁড়তে শুরু করলো গুলি। মুহুর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো সব ছাত্র-জনতা। ছুটলো যে যার মতোন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ভয় আর বিহবলতা না কাটতেই আবিস্কৃত হলো ছাত্রাবাসের ব্যারাকগুলোর দক্ষিণ দিকে শোকার্ত মানুষের জটলা। লম্বা, শ্যামলা, ক্লীনশেভ একটা মানুষ তলপেটে রক্তের কল খুলে দিয়ে তৃষ্ণা-কাতর হা করা যন্ত্রণাকাতর কন্ঠে আধো স্পষ্ট উচ্চারণে বলে – পানি! পানি!
টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্যে ভেজানো রুমাল নিংড়ানো কয়েক ফোঁটা পানি হয়তো রাখতে পারে তার শেষ একটি ইচ্ছা পূরণের দাবীর কিয়দংশ! শেষ উচ্চারণে দেবশিশু দিয়ে যায় নিজ পরিচয় – ‘আমার নাম আবুল বরকত। পল্টন লাইন …. আমার বাড়ীতে …. খবর দিবেন …..
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে যখন পৌঁছালো এই দেবশিশু। তখন পাশেই ক্যানভাসের স্ট্রেচারে শায়িত আরেক স্বর্গের সাথী – যার মাথার খুলির ওপরটা নিখোঁজ।
চারপাশ ঘিরে আছে আহত মানুষের আর্তনাদ। আর যাঁরা হত বা আহত নয়, তাঁরা ভাষাহীন রুদ্ধবাক, দৃষ্টি অস্পষ্ট, হৃদয় ভাষাহীন আকুলতায় দুমড়ে, মুচড়ে যাচ্ছে। আকাশে বাতাসে নিঃশব্দ আবেগে ছড়াচ্ছে অমোঘ ডাক – জাগ্, বাঙালী জাগ্। মাতৃভাষার দাবী তোদের সংগ্রামে-সংকল্পে অনিমেষ সফলতা পাক। এই সব দেবশিশু এ মাটির বুকে চেতনার অনির্বাণ হয়ে থাক।
~ দৃশ্য-অযুত
হাসান হাফিজুর রহমানের একুশের সংকলনের পথ ধরে বাঙলার আবেগ বহমান। কবিতায়, গানে, গল্প ও কথকতায় বাঙলা আবহমান। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারির বপিত বীজে আজ স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন দেশ বিশ্ব ভাষা দিবসের সৌকর্যে দীপ্ত দীপ্যমান। সেই থেকে রক্তে রক্তে নদী স্রোতস্বিনী এদেশ, মানুষ, সকলি স্বাধীন। অভিবাদন – সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত তোমাদের। তোমরা জানো কী এ বাঙলা মাটিতে কতটুকু তোমাদের অবদান! তোমরা দুঃখী – তোমরা এটুকু জানো না। আর তোমরা সুখী – কেননা জানো না, অমন ত্যাগের অর্ধ শতাব্দী পরও আমরা আদপে কতটা সুখ, কতটা অসুখ পেলাম।
~ দৃশ্য-নিযুত
মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, সজাগ সত্তা, সচেতন বিবেক যাদের আছে তারা বুঝি ক্রমাগত কোনঠাসা। তাদের কলম ও কণ্ঠস্বর বুঝি ক্রমশঃ নীরব ও নিশ্চল হবার পথে হাটছে। তাদের বর্তূমান নোনাজল ও রক্তে ভাসছে। তাদের উত্তরাধিকার হতবিহ্বল। মাটি ও শিকড়ের বন্ধন আজ যেনো তাদের শ্বাস রুদ্ধ করতে তৎপর।
জন্ম কি এতোটাই অভিশাপ! বেঁচে থাকবার জন্য কি আজ মা-মাটির বন্ধন ছিন্ন করে তাদের পালাতে হবে! এমন জীবন তবে কেনইবা যাপন!
আচ্ছা এসব ভাবনাগুলোও কি সমাজ সমষ্টির কাছে অবান্তর প্রসংগ আজ! নাহয় কোথাও কেউ কিছু বলছে না কেন! কিছু করছেনা কেন! আমাদের আশা আকাঙ্খা আর স্বপ্নগুলোর গায়ে যেনো দ্রুত জমছে ছত্রাক। তবে এই দৃশ্যই জেগে থাক। মানুষ ঘুমাক।
[মূল লেখা ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৫ দৃশ্য নিযুত সংযোজন ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৬]
ভাল লেগেছে।
বেশ কিছু জায়গায় ভিন্নমত আছে।
সময় করে জানাবো।
রামমোহন রায় আর দ্বারকানাথ ঠাকুর এর বিষয় টা অজানা ছিলো।
আনন্দমঠ এর বিষয়ে শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম শত্রু বৃটিশ বদলে যবন করা হয়।
অবশ্য ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে যবনেরা তো শত্রুই।
আমি নিজে প্রথম সেভাবে দেখি প্রদোষে প্রাকৃতজন পড়ার পরে।
আমাদের বাঙলাদেশে ইতিহাস যা পড়ানো হয় তা মুসলিম দের চোখে দেখা ও লেখা ইতিহাস।
ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশে ইসলামের ইতিহাস উচ্চ শ্রেণিতে পড়ানো হয়। অথচ এদেশিয় রাজাদের বা দেশের ইতিহাস সেভাবে পড়ানো হয় না।
সুলতান মাহমুদ পড়ানো হয়। অথচ মাহমুদের নাম আসতে পারে শুধুমাত্র শাহনামা লেখানোর জন্য ফেরদৌসি কে বলেছিলেন বলে। তাও আবার এই লুটেরা রাজা পদসংখা অনুযায়ী স্বর্ণমুদ্রা ফেরদৌসি কে দেন নি। প্রথমে রূপা দিয়ে কাজ চালাতে চান। ফেরদৌসি সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিলে অবশ্য মাহমুদ পরে সোনার মুদ্রা পাঠান। ততদিনে ফেরদৌসি মারা গেছেন।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
খুব ভালো পর্যবেক্ষণ নি:সন্দেহে। আসলেই আমাদের ইতিহাসতো লেখা সব আমাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে, ইচ্ছেঘোড়ায় চড়িয়ে। আমরা তাই ভালোবাসি ঘৃণ্য অপরাধীসমকে। আবার হয়তো ঘৃণা করি মমতা প্রাপ্য জনকে। এই অতীতকে আমরা সত্যিকারের চেহারায় কজনইবা দেখতে পেরেছি।
চমৎকার সব পর্যবেক্ষণ !
অনেক অনেক ধন্যবাদ আসাদ ভাই।
লুৎফুল ভাইকে অনেক ধন্যবাদ একুশে উপলক্ষ্যে বাংলাদেশীদের জাতীয় পরিচয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরার জন্য। জানা অনেক তথ্যের সাথে অজানা কিছু তথ্য এবং ঝরঝরে বর্ণনার জন্য আপনার বক্তব্য অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। আমার ধারণা, সিসিবির অধিকাংশ পাঠকই এই ব্লগ পড়ে আনন্দ পাবে, ইতিহাস জানা ত' হবেই।
বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠে একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় প্রায় সব সময়ই খুঁজে পাই- সমাজের উঁচুতলার আর নিচুতলার বাঙালির বিভেদ। আপনার এই বর্ণনাতেও এটা এসেছে নীলকরদের প্রসঙ্গে দীনবন্ধু মিত্র আর রামমোহনের মধ্য দিয়ে, বঙ্গভঙ্গ আর স্বদেশীদের মধ্য দিয়ে, কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা পার্টি আর মুসলিম লীগের মধ্য দিয়ে। এই যে বিভাজন, এর স্বরূপ কি? আপনার ব্লগের শুরুতে উল্লেখ করেছেন উঁচুতলা (রাজা+জমিদার) আর বঞ্চিত, লুণ্ঠিত গ্রাম্য কৃষক। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন আর দেশভাগের মধ্যে দিয়ে এই বিভাজনটা হঠাৎ করে সমাজিক শ্রেণী থেকে সড়ে গিয়ে ধর্মে আশ্রয় নিলো, সামাজিক বিভাজনটা হঠাৎ করেই উচু/নিচুর বদলে হিন্দু/মুসলমান এ পরিণত হলো। কেন? - প্রচলিত জনপ্রিয় ন্যারাটিভ অনুযায়ী এটা হয়েছে কুচক্রী ইংরেজদের 'ডিভাইড এন্ড রুল' নীতির কারণে যেটা আপনিও উল্লেখ করেছেন। এই ব্যাখ্যায়, তথা বাংলায় হিন্দু/মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কারণ হিসেবে ইংরেজদের শাসননীতি চিহ্নিত করলে কমপক্ষে আরও দুটো প্রশ্নের মীমাংসা করা দরকার।
এক, বাংলায় বিদ্যমান উচু/নিচু সামাজিক শ্রেণীবিভাজন (যেটা আপনিও উল্লেখ করেছেন শুরুতে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে) বাদ দিয়ে ইংরেজরা ধর্মীয় বিভাজনকে কেন ব্যবহার করলো?
দুই, রাজনৈতিক নেতারা নাহয় ভোটের বিবেচনায় মুসলমানদেরকে বাদ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রই বা কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে শুধুমাত্র হিন্দুদেরকে অন্তর্ভুক্ত করলেন? (উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে বঙ্কিমকে আলাদা করে মুসলিম-বিদ্বেষী ভাবাটা খানিকটা তার প্রতি অবিচার, কারণ অন্যান্য আরও অনেক সাহিত্যিকই মুসলমানদেরকে সময় সময় বাঙালি মনে করেননি, যেমন শরৎচন্দ্র)।
এই দুইটা প্রশ্নের সাথে আরও একটা সম্পূরক প্রশ্ন হলো এই যে, মোটাদাগের এই বিভাজনে উঁচু শ্রেনীর জায়গায় হিন্দু আর নিচুশ্রেণীর জায়গায় মুসলমান চলে আসলো, এদের ভৌগলিক+ঐতিহাসিক পরিচয় কি? এরা কি ইংরেজদের বিভাজন নীতির কারণেই এমন আলাদা আলাদা সামাজিক স্বত্বায় পরিণত হলো, নাকি তারও আগের শাসনামল থেকেই আলাদা সত্বায় বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে?
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই, "মহেশ" পড়ার পর শরৎবাবুর প্রতি আপনার অভিযোগটা একটু নরম হয়ে যায়না? উনি কিন্তু মুসলমান বাঙালির উপর অত্যাচারকে লুকান নি... একটু ব্যাখ্যা করবেন? শরৎচন্দ্রের সব উপন্যাস পড়া হয়নি 🙁
মাসরুফ,
শরৎচন্দ্র আমার সবথেকে প্রিয় সাহিত্যিক। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ৫ খণ্ড শরৎ রচনাবলীর সবগুলো দুইবার পড়া, এর বাইরেও তার একক লেখাগুলোর অনেকগুলো অনেকবার পড়া। এইসব বললাম এইজন্য যে, শরৎচন্দ্রের প্রতি আমার কখনোই কোন অভিযোগ নেই, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বঙ্কিমের সাথে তারও উল্লেখ করেছি এইটা নির্দেশ করার জন্য যে, সেসময়কার সাহিত্যিকদের লেখায় বাঙালি আর মুসলমান দুইটা আলাদা স্বত্বা হিসেবে এসেছে। সূত্র মনে নেই, কিন্তু নীরদ চৌধুরীও উল্লেখ করেছেন বাঙালি আর মুসলমানদের আলাদা স্বত্বা হিসেবে। অর্থ্যাৎ, আমি বলতে চাইছি যে, বাঙালি আর মুসলমান আলাদা আলাদা স্বত্বা হিসেবে আগে থেকেই পৃথক হয়ে বাংলায় বাস করছিল, ইংরেজরা সেই ভিন্নতাকে তাদের সার্থে কাজে লাগিয়েছে মাত্র।
সাহিত্যিকদের লেখা তাদের সময়কার সমাজের দর্পণ। আর তাই বঙ্কিম বা শরৎ বা আর কারো সাহিত্যকর্মের মধ্যে দিয়ে আমরা সে সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখি। এই জন্যই আমি শরৎচন্দ্রের বরাতে বলেছি যে, সেসময় বাঙালি আর মুসলমানরা আলাদা আলাদা স্বত্বা হিসেবে ছিল। কারা কোথা থেকে এসেছে, বা উদ্ভূত হয়েছিল, সে আরেক প্রসঙ্গ।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ তোমাকে দেয়া জবাবটা দেখি নীচে পৃথক পোস্ট হয়ে বসে আছে।
দারুন পর্যবেক্ষকের মন্তব্যটির জন্য প্রথমে অগুন্তি ধন্যবাদ। উঁচুতলা আর নীচুতলার বিভেদ পৃথিবীময় বিদ্যমান। আমি প্রাসংগিকতার কারণে এ উপমহাদেশের প্রেক্ষিত ও বিষয়াদির উল্লেখ করেছি এই যা।
বিভেদ সৃষ্টিতে লাগে কোনো কার্যকরী মূলা যা দামনে ঝুলালে মরফিন বা মারিজুয়ানার মতো কাজ করে। নাহয় জানতে হবে আবেগের স্পর্শকাতর জায়গাটা কোথায়, যেখানে ছুঁয়ে দিলে ঘোট পাকানোর ষোলকলা পূর্ণ হয় সহজে।
ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত কারণ এবং সিংহভাগের অশিক্ষা ধর্মীয় অনুভূতিটাকে সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটা জায়গা বলে যথাযথ চিহ্নিত করতে পেরেছিল ইংরেজরা। এবং আরো বুঝেছিলো ধর্মের প্রশ্নে এদেশের মানুষ অন্ধ আবেগপূর্ণ।
আর একটা বিষয়, বাঙালি মধ্যবিত্ত আজো উচ্চবর্ণ হিন্দু মানসিকতাটিই পোষণ করে। সতেরো ও আঠারো শতকে হিন্দুরাই পড়াশোনায় এগিয়ে ছিলো। তাই ইংরেজী শিক্ষা বা ইংরেজদের দফতরে কাজ-কর্মে হিন্দুরাই একচেটিয়া ছিলো প্রথম দিকে। এতে করে পিছিয়ে পড়বার বিষয়টা অনুধাবন করে মুসলমানদের একাংশ এগিয়ে আসতে সক্রিয় হলেও একটা বড় অংশ বৈরী মনোভাবের ঘেরাটোপে আঁটকে ছিলো। পাশাপাশি উচ্চবর্ণ ও শিক্ষিত হিন্দুদের একাশ মুসলমানদের রাইয়ত বা প্রজা হিসেবেই ভাবতো। কারণ বাস্তবেই নায়েব গোমস্তা সরকার খাজাঞ্চী সব পদে হিন্দুরাই ছিলো সংখ্যাধিক্যে।
একই পথ ধরে ব্যবসা-বানিজ্যেও হিন্দুরা এগিয়ে যেতে থাকে। (উল্লেখ্য আমি যা বলছি তা শতভাগের কথা নয়, তবে বহুলাংশের কথা)।
ফলত পদ পদবী বানিজ্য আধিপত্য সকল ক্ষেত্রে নিজের জায়গাটা পাওয়ার সুযোগ তৈরীর জন্য ধর্ম ভিত্তিক বিভাজনের ভিতটা তৈরী ছিল জনে জনে মনে মনে। পরে এসে তা উন্মোচিত হলো ভৌগলিক বিচারে।
ইংরেজরা এসব যেমন বুঝেছিলো ঠিক। তেমনি এ ও তাদের জানা ছিলো যে কলমের দাগে মানিচিত্রে যেমন খন্ডিত করা সম্ভব লহমায়, সেভাবে বসত বাটি বিভাজিত ভূভাগে সুবন্টিত নয়।
ভাইয়া,
"ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত" কারণ এবং তার সাথে বাঙালির অশিক্ষা কিভাবে ধর্মকে তাদের সবথেকে স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত করেছিল সেটা যদি একটু খুলে বলতেন তাহলে ভালো হতো; অথবা, কোন সূত্র ধরে আপনি এই অনুমানে উপনীত হয়েছেন সেটা যদি বলতেন। কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইংরেজদের সময়ে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে সমাজ অলরেডী উচুতলা আর নিচুতলায় বিভক্ত এবং মুখোমখি অবস্থায়। সেখান থেকে হঠাৎ করে সেই বিদ্যমান ভেদাভেদের বদলে ধর্ম এসে হিন্দু/মুসলমান বিভক্তি বসিয়ে দিল কিভাবে সেটা বাংলার ইতিহাসে অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অফিসে বসে কাজের ফাঁকে লিখতে গিয়ে (সেলফোনে) কিছু শব্দ / কথা ছুটে গেছে দেখছি। গুছিয়ে দিচ্ছি আর একবার ...
ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত কারণে এমনিতেই এ ভূখন্ডের মানুষ অধিক আবেগপ্রবণ। তার উপর সিংহভাগের অশিক্ষা কেন্দ্রিক অন্ধকারাচ্ছন্নতা যৌক্তিক বিবেচনাকে দূরে ঠেলে দিতো অনায়াসে। এ দুটোর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ধর্মীয় অনুভূতিটাকে এদেশের মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটা জায়গা বলে যথাযথ চিহ্নিত করতে পেরেছিল ইংরেজরা। এবং আরো বুঝেছিলো ধর্মের প্রশ্নে এদেশের মানুষ অন্ধ আবেগপূর্ণ।
ধর্মীয় অনুভূতি তাই কেবল ইংরেজরাই নয় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও নানান ভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
সেই ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন আজ এই উন্নয়নের যুগে এসেও উলটো আরো শেকড়ে গোত্রের মূলে প্রোথিত হয়েছে।
ডেস্ক ওয়ার্কার আর ফিল্ড ওয়ার্কার এর মতোন স্তর বৈষম্যও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন কারীদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়। যার ভিত্তি ছিল ধর্ম। সেই হিসেবে আন্দোলন সখ্যতাও মুসলমানদের বেশী ছিলো নিম্নবর্ণ হিন্দুদের সাথে।
এগুলো সব সুস্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল সমাজে। কেবল তা দেখবার বা বুঝবার চোখ যাদের ছিল তারা বুঝেছে সেইভাবে। সর্বসাধারণ সবাই নয়।
ইংরেজরা প্রাজ্ঞের মতো সেই জ্জানকে কাজে লাগিয়েছে প্রয়োজন মাফিক। এর বেশী কিছু নয়।
হিন্দু মুসলমান বিভাজনটা তো আর ইংরেজদের মেনুফ্যাকচার্ড বিষয় নয়, বরং ইনহারেন্টলি গ্রোন আপ আস্পেক্টস। যে ফ্যাক্টর ও ফিচারগুলো ইংরেজরা রিড করে যথাযথ ধুর্ততার সাথে কাজে লাগিয়েছে কেবল।
ভাইয়া, এইবার পরিষ্কার হলো। তাহলে আমরা এইকথা বলিতে পারি যে, বাংলায় যে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু/মুসলমান বিভেদ, এইটা ইংরেজরা তৈরি করেনি। এটা সমাজের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সতন্ত্র্যভাবে। এই গড়ে ওঠার সামাজিক ম্যকানিজমটা জানতে চাই- ঠিক কখন, কি প্রকৃয়ায় এই ধর্মীয় বিভেদ দেখা দিলো যাকে ইংরেজরা সুচতুরভাবে ব্যবহার করে গেছে?
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
পপুলার ন্যারেটিভ হলো "ইংরেজরা বিভেদ তৈরী করে তাঁর ফায়দা লুটেছে"।
আসলেই কি তাই?
নাকি বিভেদ একটা দীর্ঘদিনে গড়ে উঠে তা চলছিলই, ইংরেজরা শুধু সেটা ধরিয়ে দিয়ে তা থেকে নিজেদের ফায়দাটা বের করে এনেছে?
আমার কাছে পরেরটাই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনেহয়...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
এই হইলো গিয়া শিক্ষক আর ছাত্রের মইধ্যে তফাত।
আমি কইলাম লম্বা কইরা আর তুই দুই লাইনে।
কথা সেই। দ্বিতীয় কথাটাই হইল গিয়া আসল কথা।
😀 😀 😀
এই বিষয়ে আরও আলাপ আছে।
পরে করা যাবে, আজ ঘুমাই!!!
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই,
এইখানে আপনার সাথে একমত, লুৎফুল ভাইয়ের সাথেও।
আমার জানার ইচ্ছে এই বিভেদটা যে গড়ে উঠছিল, তাঁর সময়কাল+সামাজিক প্রক্রিয়া।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই, আপনার প্রশ্নটা যদি ঠিক বুঝে থাকি এ ব্যাপারে আমাদের সময়ের ('৯৭, '৯৮) ক্লাস ৯/১০ এর সামাজিক বিজ্ঞান (ইতিহাস, পৌরনীতি, ভূগোল, অর্থনীতি' ইত্যাদির জগাখিচুরি) এ ব্যাপারে কিছুটা বলা ছিল।
ইতিহাসের আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায় মুসলমানরা যখন উপমহাদেশে আসল তখন বেশিরভাগ রাজা-বাদশা'ই ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী। এরপর রাজ্য বা শাসকের স্থান দখল করে নিল মুসলমানরা। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম শাসন চলল। আপাত দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে থাকলেও ব্যাপারটা কিন্তু শত্রুতার পর্যায়েই রয়ে গেল।
ইংরেজরা আসার পর ওরা ক্ষমতার দিকে হাত বাড়াতেই হয়ে গেল মুসলমানদের শত্রু। শত্রুর শত্রু হিসেবে হিন্দু-ইংরেজ জুটি ভালই জমে গেল। সাথে ছিল বেশ কিছু স্বার্থপর, উচ্চাভিলাসী মুসলিম চরিত্র। একই সাথে মুসলিম শাসকদের নির্বুদ্ধিতা ও অপরিণামদর্শীতা তো ছিলই। ফলাফল মুসলমানরা ক্ষমতা হারাল।
ক্ষোভে, অভিমানে মুসলমানগণ ইংরেজদের সহযোগিতা, তাদের অধীনে চাকুরি করা, ইংরেজী শিক্ষা ইত্যাদি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আরবী, উর্দু, ফারসি নিয়ে পড়ে রইল। ফলাফল- ধীরে ধীরে তৈরি হল অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অভিমানী, নির্বোধ, সবদিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এক বিশাল জনগোষ্ঠী! নির্দিষ্ট কিছু পরিবার ছাড়া বাকি প্রায় সবার স্থান হল সমাজের নিচু স্তরে... এরপর তো বঙ্গভঙ্গ...
তাই, যদি বিভেদের কথা সত্যিই আসে- আমার মতে তা ছিল মূলত একেবারে শুরু থেকেই। অর্থাৎ যেদিন থেকে মুসলমানরা হিন্দুদের কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নিল।
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
টু দ্যা বুলস আই (সম্পাদিত)
জুনায়েদ,
আমি আর্টস পার্টি, তাও আবার সিসিআর এ হাসান স্যারের হাতে গড়া 🙂
হাসান স্যারের কল্যাণে আমাদের ৯/১০ এর টেক্সট এর পাশাপাশি যে বই থেকে সেই টেক্সট লিখা হয়েছিল সেইটা পড়তাম 😉
কাজেই, তুমি যে রেফারেন্স দিলে, ঐটা বেশ ভালোভাবে জানি। এছাড়াও ১১/১২ এর ইতিহাসের টেক্সটও বেশ খানিকটা পড়া আছে আমার। তুমি যেভাবে বুঝতেছো, এই বুঝটা আমারও ছিল অনেকদিন। কিন্তু আমার মনে হতো, চলতি এই ইতিহাস খুব বেশি সুলতান-রাজাদের ইতিহাস। আমজনতা যেন আড়ালেই থেকে গেছে। পরবর্তীতে বিদ্যাশিক্ষার উচ্চতর পর্যায়ে এসে ডলা খেতে খেতে জাতি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, জাতীয়তাবাদ, সামাজিক পরিবর্তন, ঐতিহাসিক গবেষণা পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে খানিকটা পরিষ্কার ধারণা লাভ হলে বুঝতে পারলাম যে, আমার আগের জানা ইতিহাসে ব্যাপক ভেজাল আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে নানা বিবেচনায় পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আবার উল্লিখিত প্রশ্নটা চলে এসেছে।
গোলাম মুর্শিদের পুরস্কারপ্রাপ্ত 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' বইটা পড়ছি। শীগগিরই আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া সিসিবি'তে পাবে আশা করি।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আপনার ব্লগের অপেক্ষায় থাকলাম। 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
জুনায়েদ, আমারও ধারনা, এই ব্যাখ্যাটা অতি সরলিকৃত।
জোর করে দুই আর দুই চার মিলিয়ে দেয়ার মতো।
আসল অবস্থা এত সরল হবার কথা না।
আমার ধারনা মুসলমানদের দুইটা স্ট্রিম ছিল।
একটা উড়ে এসে জুড়ে বসা যোদ্ধা স্ট্রিম যারা স্থানীয় দের হটিয়ে শাসকের স্থান দখল করা।
আরেকটা নিম্নবর্ন থেকে কনভার্টেড।
কোনোটারই শুরু থেকে মেইনস্ট্রিম স্থানীয়দের কাছে গ্রহনযোগ্যতা থাকার কথা না।
এরসাথে সম্ভবতঃ যোগ হয়ে থাকবে, তাদের এক্সক্লুসিভ থাকার প্রবনতা।
সেটা ধর্মকর্মে অতি ইনভলবমেন্ট (পাচবেলা নামাজ নিয়ে করাকড়ি, দাড়ি রাখা থেকে শুরু আরও অনেক কিছু হতে পারে) এবং পরকালে বেশি ইমপর্টেন্স দিতে গিয়ে আরবী ফার্সিকে অন্যান্য শিক্ষা থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া ইত্যাদি।
আমার ধারনা, এইসব মিলে মিশে দিন দিন তারা মেইনস্ট্রিম থেকে নিজে নিজেই দূরে সরে গেছে (পিছিয়ে পড়া অর্থে), কারো প্ররোচনা বা প্রনদনা ছাড়াই। (ইওরোপে বসবাস করা বেশির ভাগ দেশের বেশির ভাগ মুসলমানদের আজও এই রকম পিছিয়ে পড়া অবস্থাই নাকি বিদ্যমান। আমেরিকায় মর্মন ও আরও কিছু গোত্র আছে যারা এরকম পিছিয়ে থাকা জীবনযাত্রা নিয়েই থাকতে চায়। এই ব্যাপারটাও আমার কাছে অনেকটা সেরকম মনে হয়)।
আবার প্রাকৃতিক নিয়মে এঁদের সংখ্যা বেড়েছে অন্যদের চেয়ে বেশি হারে।
একই জায়গায় থাকা এরকম দুই ধরনের সুবিধা প্রাপ্তদের একদলকে অন্যদলের বিরুদ্ধে (হিন্দুদের) লেলিয়ে দেয়াটা খুব কঠিন হবার কথা না।
দীর্ঘদিন সৌহার্দে থাকা হুতুদের যেভাবে তুতিসি নিধনে লেলিয়ে দেয়া গিয়েছিল অতি সাম্প্রতিক কালেও...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
পারভেজ ভাই,
আমিও এমন ধারণা পোষণ করতাম। এই নিয়ে সিসিবিতে আমার একটা ব্লগও আছে (//cadetcollegeblog.com/mahmudh/37250)
তবে সম্প্রতি কিছু ঐতিহাসিক বই ও প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ হয়েছে যেখানে এই দুই ধারণাকে তথ্য+উপাত্ত দিয়ে নাকচ কওরা হয়েছে। গোলাম মুর্শিদের 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' বইতেও এগুলোর উল্লেখ করার মাধ্যমে নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে মুসলমানে কনভার্শনের অনুমানকে ভুল প্রমাণ করেছে। আর বাইরে থেকে আগত উচ্চশ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা কখনই শতকরা হিসেবে ১ শতাংশের বেশি হয়নি। (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
কনভার্টেড নিম্নবর্ন কথাটা আক্ষরিক অর্থে না।
স্থানীয়দের মধ্যে যারা মুসলমান, সেটা হিন্দু বিধবাদের বিয়ে করার মাধ্যমে হোক বা অন্য বর্ন থেকে, অন্য ধর্ম থেকে বা অন্য কোন ভাবে সংখ্যা বেড়েই হোক - সবাইকে এর মধ্যে ধরা হয়েছে বলেই মনেহয়।
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
তিন শ্রেণীর মুসলমানরা তৎকালীন ভারতবর্ষে এসেছে বা উদ্ভূত হয়েছে।
এক )ধর্ম প্রচারক, সাহাবী পরিবেষ্টিত।
দুই) হারেরেরে পার্টি, লুণ্ঠনের সংগী ও সাগরেদ সহ
তিন) বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে জাহাজ ভেড়ানো বা পাড়ি জমানো
এদের আবাস গড়া বংশ বৃদ্ধি, অনুসারী ও ধর্মাবলম্বী সৃষ্টি, শাসক হিসেবে রাজ্য দখলের সূত্র ধরে মিত্র-সহযোগী-অনুসারী-সুবিধাভোগী শ্রেণী সৃষ্টি।
তৎপরবর্তীতে দীর্ঘ মুসলিম শাসনের ভেতর দিয়ে প্রসার লাভ।
এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গদিচ্যুত, পরাজিত, অবহেলিত, অবদমিত গোষ্ঠীর সাথে অনুচ্চারিত নি:শব্দ এক বিভেদের শ্রেণী বাড়তে থাকে অদৃশ্য বৈরীতার ভেতর দিয়ে।
সেটাই ধর্মীয় বিভেদের শেকড় যা হয়তো এ ভূখন্ডের হিন্দু মুসলমানরা সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তার ওপর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ওই বিভেদ বিলীন করে এক কাতারে বিপ্লবে-আন্দোলনে শরীক হতে/ সহযোদ্ধা হতে প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিলো যথার্থ। তা অনুধাবন করে বৃটিশরা যথাযথ সময়ে যথাযথ দুর্বল আবেগঘন কায়দায় খুঁচিয়ে বের করে এনেছে বিভেদের চেহারা ও অবয়বকে।
লুৎফুল ভাই,
তিনটা অনুমানের কোনটারই তথ্যগত ভিত্তি নেই। স্বল্পতা সত্বেও যেটুকু তথ্য আছে, তা' এগুলোর বিপক্ষে। আর যৌক্তিকভাবেও এগুলো ভুল প্রমাণ করা হয়েছে। কাজেই, এই অনুমানগুলোর ভিত্তিতে বাংলায় মুসলমানদের উদ্ভবের যে বয়ান প্রচলিত আছে, তা' শুধুই অনুমান নির্ভর। অনেকটা 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি' বইয়ে গোলাম মুরশিদের বয়ানের মতো।
আমার পরবর্তী ব্লগে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করার ইচ্ছা থাকল।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মজার ব্যাপার হলো এই যে এমন বৃটিশ মনোবাঞ্চার কারণেই কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুটোরই গোড়াপত্তনে বৃটিশরা মূল নিউক্লিয়াসে জড়িত ছিল।
এইখানে আমি আরেকটি উদাহরণ যোগ করতে চাই। সেটি হল মুসলিম ইহুদি বিভেদ। আগে মুসলমানদের সাথে ইহুদিদেরই মিল ছিল বেশী। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে যদি এই ইউনিটি থাকতো তাহলে সেই এলাকা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। মুসলমানদের সম্পদ আর ইহুদিদের বুদ্ধি। কিন্তু ব্রিটিশরা বিরোধ লাগায় এমন ভাবে যে এরা এখন মারামারি করতেছে আর ওরা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
মধ্যপ্রাচ্য, আরব মুসলিম, ইহুদী এসব প্রসংকে ঘিরে আমার লেখা আছে সিসিবিতেই। "প্যালেস্টাইনী যীশু এবং গাজায় সন্ত্রাসবাদের নার্সারী" নামে। এ ছাড়াও সিরিয়া নিয়ে লেখা ও অন্যান্য লেখায় বিষয়টা এসেছে।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সহজাতভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা মতাবলম্বীদের মাঝে হয়েই যায় এক ভূখন্ডে থাকতে গেলে। কিন্তু বাদ সাধে কেবল ফায়দা লোটার হারমাদরা।
ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুলের আমাদের উপমহাদেশের কর্মকান্ডের ছায়া সেই মধ্যপ্রাচ্যেও দেখা যায়। এমন কি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মতোন ফিলিস্তিন আর গাজায় এক অবাক করা সাদৃশ্যও বিদ্যমান।
//cadetcollegeblog.com/lutful/50488
"প্যালেস্টাইনী যীশু এবং গাজায় সন্ত্রাসবাদের নার্সারী"
আপনার এই লেখাতই পড়ছিলাম। খুবই ভালো লাগছে। আলোচনাগুলোও। পরে বিস্তারিত লিখব।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
আচ্ছা।
নীলকর, বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭-এর রাজনীতি, ভারত পাকিস্তানের পার্টিশন, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে, যে কঠিন অথচ সুপাঠ্য ধারাক্রম তুলে ধরে হয়েছে। তার জন্য লুৎফুল বাবুকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ভাষার মাসে এমন একটি লেখা আমাকে সমৃদ্ধ করল। লেখাটি বুক-মার্ক করে রাখলাম। আর তা নিজের স্বার্থেই 🙂
অনেক ধন্যবাদ আপা। আপনার মন্তব্যে ঋদ্ধ হলাম।
শুধু বলতে এসেছি, অনেকদিন পর সিসিবিতে একটি লেখা পড়ছি যেটার মন্তব্যের ঘর আরো বেশী মন দিয়ে পড়া লাগছে এবং ভালো লাগছে। আলোচ্য বিষয়ে জ্ঞান শূণ্যের কোঠায় বিধায় এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে পারছিনা। শুধু একটি অনুরোধ, যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখবেন তারা তাড়াতাড়ি সময় করে লিখে ফেলুন। 🙂 :teacup:
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
মোকাব্বির,
বাংলাদেশের পলিটিক্সে নামতেছো নাকি? ইন্ডাইরেক্টলি কথা বলতেছ দেখি। আমি ছাড়া ৎ আর কেউ প্রতিশ্রুতি দেয় নাই। কাজেই, সরাসরিই বলো 🙂
ইশারা-ইঙ্গিতে দাবি-দাওয়া পেশ করা লাগবো না, আমি এমনিতেই লিখতেছি। আজ বা কালকের মধ্যেই সিসিবিতে চলে আসবে।
বাই দ্য ওয়ে, তোমার কি অবস্থা? (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই কি যে বলেন? 😛 আপনারা তিনজন বলসেন বিস্তারিত লিখবেন। আপনি, ওয়াহিদা আপা, এবং রাজিব ভাই। প্রত্যেকের লেখার জন্য বসে আছি। 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
আমি বেঁচে আছি এইটা নিশ্চিত। লেখালেখি একদম থেমে আছে আপাতত। সেটাকে জাম্পস্টার্ট করার জন্য আমার ঘোরাফেরা শুরু করলাম এখানে সেখানে। হাবিজাবি লেখালেখি, টুকিটাকি সঙ্গীত এই দুইটা যতবার একদম ছেড়ে দিয়েছি ততবারই দেখেছি মাথা বিগড়ে গিয়েছে। মাথায় চাপ তৈরী হয়েছে। লাগাম টেনে ধরতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে চিন্তা বেশী করছি। আপনার কি খবর?
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
আমিও বাসায় বসে আছি। স্প্রিং ব্রেক শুরু হইয়েছে ১০ দিনের। কথা ছিল আজ সিঙ্গাপুর যাবো, একটা কণফারেন্সে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম এবং জাতীয় পরিচয় বিষয়ে একটা পেপার প্রেজেন্টেশনের কথা ছিল। ভিসা এখনও না-পাওয়ায় যাত্রা স্থগিত! এদিকে গাড়ির ব্যাটারি বসে গেছে বলে ঘর থেকে বেরু হতেও পারছি না। তাই আমিও ঘরের মধ্যে বসে আছি :bash:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ব্যাপার না ভাই। শীতকাল তো প্রায় শেষ। আর কয়টা দিন পরেই ঝকঝকে গ্রীষ্ম! 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
আমি এখন কাতারে, আমেরিকাতে না 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
খানিকটা চিন্তা করলাম মজা লইতাসেন নাকি। পরে মনে হইলো না নিতেসেন না। :brick:
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
আরে, তাই ত ;;)
তাইলে ত আমার আপাততঃ আমার কয়েকদিন অপেক্ষা করলেও চলে। আমি ইতোমধ্যেই একটা ব্লগ পোষ্ট করে ফেলেছি। ইত্যবসরে রাজীব আর শান্তা আপার ব্লগ আসুক। আমি ঘুমাতে যাই 😛
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
😀 আবার সবার ব্লগে উপস্থিতি জানান দিয়ে বিরক্ত শুরু করতে হবে! থেমে যাওয়া চলবে না! লিখতে থাকেন!
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
উত্তম প্রস্তাব ।
লেগে পড়ো 😀
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমার এ লেখাটি মূলত পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অতীত সূত্র ধরে বর্তমান ও ভবিতব্যের দিকে ইংগিত করবার প্রয়াসে। চিন্তা ও চেতনার উৎকর্ষ এবং কাঙ্ক্ষিত বিকাশের বিপরীতে পলায়নের ক্ষেত্রটি দৃশ্যমান হয়ে উঠবার ইংগিত-প্রশ্ন-সতর্কবাণী উচ্চারণের অভিলাষে। যদিও আলাপটি শেকড়ের প্রসংগে ধাবিত হয়েছে।
তাহলে আমি ঠিক পথেই আলোচনাটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কি বলেন ভাইয়া? 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
শেকড়ের সন্ধান আবশ্যকীয় তো বটেই। আর তোমার প্রাণবন্ত মন্তব্য আলাপ ও শেকড়সন্ধানী আলোচনাগুলো লেখার পিঠে প্রাণসঞ্চারী বলয় যুক্ত করেছে।
তবে আমার লেখার শেষাংশে যে সংকটচিত্রটি কিঞ্চিত তুলে ধরেছি (দৃশ্য অযুত ও দৃশ্য নিযুত-এ) তা যে কাউকে সেভাবে ভাবায়নি সে বিষয়টা এক রকম বেদনাদায়ক পীড়া দিচ্ছে।
আরো শংকিত হচ্ছি।
আমার লেখার শেষ পর্বে এইদিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অপেক্ষায় থাকছি