বৌদ্ধ ধর্মের প্রাথমিক কথায় কলা হয়েছে পাঁচটা বিষয় থেকে দূরে বা বিরত থাকতে, আর চারটা বিষয়কে আত্মস্থ চর্চায় আনতে। বিরত থাকা বা দূরে থাকার বিষয় কয়টা হলো – ১. প্রাণীহত্যা – না করা, ২. আদিন্নাদানা – অর্থাৎ নিজে অর্জন না করে কোন কিছু ভোগে বা দখলে না নেয়া, ৩. মিথ্যাচার – থেকে বিরত থাকা, ৪. কামেসু মিথাচারা – অর্থাৎ কামের বশবর্তী হয়ে খারাপ কোনো কাজ না করা, ৫. নেশা – করে পাগল না হওয়া। একথা সুনিশ্চিত যে, কোনো ধর্মেই এই পাঁচটি বিষয়কে উৎসাহিত করা হয় নি বরং নিষেধ বা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
আর যে চারটি বিষয়কে আত্মস্থ চর্চায় আনতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো- ১. মৈত্রী ভাবনা – চিত্তে সকলের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব পোষণ করা, ২. করুণা – চর্চায় ও আচরণে সবার জন্য মনোভাবটি প্রকাশ করা, ৩. মুদিতা- অর্থাৎ অন্যের সাফল্যে খুশী হওয়া, ৪. উপেক্ষা- অর্থাৎ আকাঙ্খা ও যৌক্তিকতার বাইরে ঘটে যাওয়া কুলষকে উপেক্ষায় অন্তরের বাইরে রাখা।
এই পাঁচ না আর চার হ্যাঁ বিষয়ের সুস্থ্য ও সুন্দর চর্চায় যে মানুষটির জীবন যাপিত হবে- তার দ্বারা পৃথিবীতে কি কোনো খারাপ কাজ করা আদৌ সম্ভব ! সহজ চিরচেনা প্রবাদ- “জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর”। যদি গভীর অনুসন্ধানে প্রণোদিত হই তবে নিশ্চিত জগতের সব ধর্মেই এই প্রবাদের পক্ষে অকাট্য নির্দেশনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই যে চিকিৎসার প্রয়োজনে ছুটি ভিন দেশে। যদি প্রকৃত ধর্মান্ধ হই তবে তো অন্য ধর্মের ডাক্তার কবিরাজের হাতে চিকিৎসা নেয়াও ঠিক হবে না। কিংবা ডাক্তার কবিরাজ হলে আগে রোগীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে- তার ধর্ম কি ? না মিললে বলতে হবে – দুঃখিত আপনাকে চিকিৎসা সেবা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
অহিংসা পরম ধর্ম – কথাটার সারাংসটা কি সুনির্দিষ্টি কোনো ধর্মের কথা, নাকি সকল ধর্মেরই কথা ? এমন কোনা ধর্ম আছে কি যেখানে হিংসা বিদ্বেষ হানাহানিকে উৎসাহিত আর অনুপ্রানিত করা হয়েছে। কোনো ধর্মই করেনি। করেছে ধর্মের অপব্যাখ্যা কিংবা ধর্মান্ধতা। আর ধর্মকে অপব্যাখ্যার অস্ত্রে সাজিয়ে তার অপপ্রয়োগ করার পেছনে সৃষ্টির আদি থেকেই ছিল কিছু সুযোগ সন্ধানী লোক যারা ধর্মকে বা ধর্মীয় আবেগকে সস্তা পণ্যের মতোন কেনাবেচা করার বিবেকহীন কর্মকান্ডে অগ্রগামী থেকেছে চিরকাল।
যে দেশের মানুষ শিক্ষা ও অর্থের সামর্থ্যে যত বেশী পিছিয়ে সে দেশে তত বেশী বর্বর ও বিবেক বর্জিত কার্মকান্ড সম্ভব। অর্থ আর শিক্ষায় দারিদ্রের শিকার এমন কোনো মানুষকে দিয়েই একবেলা খাবারের সমমূল্যের অর্থের বিনিময়ে সম্ভব মানুষ খুন করানো।
এমনতরো অন্ধত্বের কারনেই মানুষ গরু কিনে হুজুরকে বলে ফু দিতে যাতে গরু বেশী দুধ দেয়, মুরগী কিনে হুজুরকে বলে দোয়া-দাওয়া দিতে যাতে মুরগী বেশী ডিম দেয়। ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিচার-বিবেচনায় নয়, আমি বলতে চাইছি এই গরু আর মুরগী কোন জাতের, তাকে দিয়ে কি সম্ভব, কতটুকু সম্ভব, তাকে কি খাওয়াতে হবে – এসব নানান করনীয় উপেক্ষা করে বা না জেনে, না চেষ্টা করে, কখনো কি সম্ভব ফল পাওয়া ? হ্যাঁ সম্ভব, কেবলমাত্র অলৌকিক কিছু ঘটলে। কিন্তু অলৌকিক কিছু তো আর নৈমিত্তিক সম্ভাবনা নয়, নিত্যদিনের জীবনচর্চার শৈলী এবং রীতিও নয়।
আজকে ভয় হয়- যদি সোচ্চার হই ’কর্মই ধর্ম, জীব সেবাই ধর্ম’ এমন নীতি বাক্যের উচ্চারণ দ্বিধাহীন করি- কেউ হয়তো বলে বসবে বিধার্মিক। তবে কি ধর্ম একথাই বলে যে- পথে একজন দুর্ঘটনা কবলিত মূমুর্ষু মানুষকে আগে আমার জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে যে আমার ধর্মের মানুষ কিনা, তারপরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে বাঁচাবার জন্যে আমার কিছু করনীয় আছে নাকি নাই। কিংবা নিজ ধর্মের হলে সৎ মাপে ও পন্থায় বিক্রি করবো, আর অন্য ধর্মের হলে তাকে ঠকিয়ে বিক্রয় করলে আমার ধর্ম প্রগাঢ় প্রোজ্জল হবে !
আজকের যুগে আমি যদি প্রযুক্তিতে বিশ্বাসী আর তার ব্যবহারকারী হই তবে কি বিচার বিবেচনার সব পর্ব ও সামর্থ্য সিন্ধুকে বন্ধ করে জাগতিক শুদ্ধ চেতনায় দরোজা জানালায় খিল এঁটে, চিলে কান নিয়ে যাবার কথা শুনেই চিলের পেছনে ছুটতে তৎপর হবো ! প্রার্থনায় বুঁদ হবো যাতে আমারও পাখা গজায় আর উড়ে গিয়ে ওই চিলকে পাকড়াও করতে পারি ! সেই দোয়া-দাওয়ার জন্য ধর্মগুরুদের (তথাকথিত – যে আমার এই নিদ্রমগ্ন যাপনের ঘোর ভাঙ্গিয়ে দেবে না) কাছে ছুটবো ! নাকি একটুখানি কষ্ট করে হাত নেড়ে কানের অবস্থান বিচার করে নিশ্চিত হবো- কান খানা আমার অদৌ আছে নাকি আদপেই নিয়ে গেছে চিলে !
যদি বলি এই সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোই ধর্মের সবচেয়ে বড় শত্রু। রামু- উখিয়াতে যারা ধর্মান্ধতার দাবানলে পুড়িয়েছে একের পর এক বৌদ্ধ মন্দির আর বাড়ী ঘর, তারা আদতে ধর্মের বিবেকহীন পসারী, এক বিন্দুও ধার্মিক নয়।
যদি বলি তাদের ঔদ্ধত্বের কারণে কালিমা লেপন হয়েছে ইসলামের গায়ে। তাহলে কিছুমাত্রও কি ভুল বলা হবে ? তাদের কর্মকান্ডে কি কোরআনের সেই চিরচেনা আয়াত মুছে দেবার প্রয়াস স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সেই সূর্যের চেয়ে উজ্জল আয়াত “লাকুম দি নুকুম ওয়াল ইয়া দীন” (সূরা আল কাফিরুন, আয়াত-৬) যার অর্থ ’তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’।
এই আয়াত যদি একজন মুসলমানের কাছে সত্যি হয়, তাহলে একথার মানে তাকে খুঁজে বের করতে হবে যে, তৈরী করা খবর আর ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সৌহার্দ্যপূর্ণ শান্তিময় সহাবস্থানের দেশে অন্য দেশের হানাহানির চর্চা আমদানী করে, ধর্মীয় আবেগকে পণ্যের মতোন বিকিকিনি করে যে ঘৃণ্য ঘটনা কিছু উদ্দেশ্য প্রনোদিত মানুষ রামু-উখিয়াতে ঘটিয়েছে তারা শুধু মানুষ নামের কলংক নয় – তারা দল-ধর্ম-মত নিবির্শেষে মানব সভ্যতার শত্রু। এদের নির্মূল করা মানে – আমাদের নিজ প্রাণ রক্ষা করা, আমাদের সন্তানদের জন্য বসবাস যোগ্য একটা পৃথিবী রেখে যাবার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করা।
যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমাদের ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত সেই রাষ্ট্রের ওপর এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের চাপ অসীম। এই দায়িত্ব পরিহার করা মানে হলো সুদূরপ্রসারী চেতনায় নিজ অস্তিত্বকে অস্বীকার করা শুধু নয়, বিপন্ন করায় নিজেই ভূমিকা রাখা।
তার পরও যদি দেখি নিজের পায়ে কুড়াল চালাতেই আমরা স্বাছন্দ্য বোধ করছি তবে অলীক স্বপ্নের ভরসা ছাড়া আর কিছু থাকে না অবশিষ্ট। তাহলে পরের জন্মে ঈশ্বর হয়ে জন্মাবার আকাঙ্খা ছাড়া আর পথ থাকে না খোলা – অন্য কিছুরই।
১৮ অক্টোবর ২০১২ – উত্তরা, ঢাকা।
~~ সংযুক্তি ~~
~ আর ধর্মান্ধতার ভোঁতা অস্ত্রটিই সম্ভবত বিকৃত ভাবে প্রয়োগ করে চলেছে নব্য ঔপনিবেশিক তত্ত্বের মহারথীরা ~
বার্মায় রোহিঙ্গাদের উপর চাপানো গণহত্যার নির্মমতায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহিংস অংশগ্রহণ। অথচ মানবাধিকারের সোল এজেন্ট ও ডিস্ট্রিবিউটরদের নীরব ভূমিকা। ফিলিস্তিনে রক্তের ফোরাত স্রোতস্বিনী হতে দেখেও আরব বিশ্বের দ্রাক্ষা-মদির-মগ্ন স্বপ্ননিমজ্জিত নির্বিকার দিন যাপন। আইএসাইএস-এর ধর্মের নামে মানবতার বিকৃত ধারার স্পর্ধা ও ধৃষ্টতার অবলীলায় মঞ্চায়ন – আর তার বিপরীতে আরব বিশ্বের গন্ডারের ভূমিকার পাশাপাশি হিটলারের দেশের সাথে মুসলিম ভূখন্ড অধিগ্রহণের নীল-নকশায় ইহুদী পুনর্বাসনের হোতা দেশগুলোর মায়াকান্নায় এগিয়ে আসা। ভয়ংকর ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপালের ওপর ভারতের নীরব নিষেধাজ্ঞায় তাদের জীবন যাপন পর্যদুস্ত হওয়া নিয়ে পৃথিবী জুড়ে পিন পতন নীরবতা। আমাদের মতোন একখান মানুষে মানুষ কামড়ানো মধু বিহীন দেশে আজ একজন বিদেশী মানুষ ধর্মান্ধতার নামে গুলিতে খুন হবার দু’সপ্তা আগে ইয়োরোপের দেশ থেকে সতর্কবাণী বয়ান করা। আর সেই দেশে এমন ঘটনা ঘটবার পর আইন শৃংখলা বাহিনী কোরবানীর ঘোরে স্তিমিত থাকা। অথচ একই মূদ্রার অন্য পিঠে এই ঈদের বন্ধের মতোন বিকল সময়ে হজ্জ্ব নিয়ে বা অনাকাংখিত অগণন হাজীর মৃত্যু নিয়ে কথা বলায় আহত ধর্মানুভূতির আহাজারিতেতে অন্তর্জালের দেয়ালে অভিব্যক্তি প্রকাশকারীর ৫৭ ধারায় ঝটিকা গ্রেফতার।
এইসব তাবৎ জিনিসের অর্থাৎ ঘটনার মালা গাঁথায় আমি কেবলি সেই একই সভ্যতার নয়া ঔপনিবেশিক এক যাদুকরী সূতার দেখা পাই।
আমি সম্পূর্ণ ভাবেই সন্দিহান, আমরা, এই পৃথিবীর আপামর আম মানুষেরা কি আদৌ বুঝতে পারছি আমাদের পৃথিবী আদপে কোন পথে এগোচ্ছে! আমাদের ভবিষ্যত আসলে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
২৯ অক্টোবর ২০১৫ – উত্তরা, ঢাকা।
[ এ সপ্তাতেই রামু সাথিয়ার ঘটনায় সেই ভয়াবহ দিনের বছর ঘোরার ক্ষণ গেলো। সেই স্মরণের সাথে আমাদের পারিপার্শিক প্রেক্ষাপটকে ঘিরে মনের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকা শংকাটুকু প্রকাশের লক্ষ্যে পুরোনো লেখা আর নতুন সংযুক্তি সমেত এই লেখাটি পোস্ট করলাম। ]
🙂 🙂 🙂 🙂
আমার বন্ধু কাবিল (প্রসেনজিত চাকমা)-এর কাছ থেকে লব্ধ জ্ঞান। লিখাটা লিখতে বসে একবার দূরাভাষ কথনে ঝালাই করতে হয়েছিলো বটে। লাগামহীন ভুলভাল না থাকার তাগিদ বলে কথা। তার উপর প্রসংগটি ধর্ম বিষয়ক কিনা।
ভাইয়া অন্ধরা কিন্তু পথ দেখায় না ফলো করে। বরং যারা পথ দেখায় তারা জেনে বুঝে অন্ধগুলিকে জড়ো করে ঠেলে দেয়।
উপরের ভিডিওটা একটু দেখেন।
অন্ধরা পথ দেখাবে কি করে। ওরাই তো প্রথমে ভুল পথটি নির্মাণের জন্য শ্রমিক হয়েছে ফায়দাবাদীদের, আর পরে হয়েছে সেই পথের পথিক।
পড়া শুরু করেছিলাম আগেই, কিন্তু মাঝে অন্য ব্যস্ততা নেমে আসায় শেষ করতে দেরী করে ফেললাম।
ভাল লিখেছো।
যা যা ঘটছে চারপাশে, আশা ধরে রাখার চেষ্টা করাটা আসলেই একটা কঠিন কাজ।
বিরাট সমস্যা হলো এই যে, আজকাল সব স্বার্থান্বেষি প্রথম টার্গেটই হয় তরুনরা।
আর কে না জানে, পলুটেড তারুন্যের কাছে আর যাই আশা করা যাক, পরিবর্তনের নেতৃত্ব আশা করা যায় না।
তবুও আশায় বুক বাধতে চাই, কারন সবাই কি আর পলুটেড?
যারা তা নয়, হয়ত তারা একসময় এগিয়ে আসবেই আসবে...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
উত্তরনের পথটা খুঁজে পেতে পেতে আমরা যে কোথায়,কতো দূর গিয়ে পৌঁছাবো ! কে জানে !
"সেই সূর্যের চেয়ে উজ্জল আয়াত “লাকুম দি নুকুম ওয়াল ইয়া দীন” (সূরা আল কাফিরুন, আয়াত-৬) যার অর্থ ’তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’" - এ প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআন শরীফে আরেকটি আয়াত আছে- লা ইকরাহা ফী দ্বীন (সুরা ২ঃ২৫৬) যার অর্থঃ
"দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই"
ধর্মের ব্যাপারে নিজস্ব ধ্যান ধারণাগুলো অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাটা আজকের দিনের একটা বড় সমস্যা।
অপার ধন্যবাদ খায়রুল ভাই।
জানা হলো নতুন কিছু।
:boss: :boss: