সত্যিকারের প্রেম ছিলো আমাদের সেই কালে । সেই অতীতের কথা বলছি। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ, রোমিও-জুলিয়েট । আহা ! কি সব প্রেম ! কি ? তাও ভাবছেন আমাদের মানে, কোন কালের কথা বলছি ! তাহলে অন্যকে আর টেনে কি লাভ ! নিজের কথাই বলি । প্রেম শব্দটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হলো যখন ।
ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে নানা বাড়ী গিয়েছি । ছোটো বেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা । যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম । কারণ গন্ডায় গন্ডায় খালাতো মামাতো ভাই বোনের মেলা আর ডজন ডজন ধরনের শীতের পিঠা । সেবার আমি আর আমার এক থেকে চার বছরের বড় খালাতো মামাতো ভাই মিলে চার-পাঁচ জনের ছোটো-খাটো একটা দল । অকারণ ছুটোছুটিতেও তখন ছিলো সাত রাজ্যের মজা ।
প্রথম সকালে পিঠেপূর্ণ উদর নিয়ে বাড়ী ছেড়ে সামনেই এক স্কুলের পাশে পুকুর পাড়ে ঘুর ঘুর করে শাপলা শালুক তোলার প্ল্যান হচ্ছে । এক সময় স্কুল ঘরের ভেতর উঁকি মারতে ছুটলো সবাই । একটা ক্লাসে অন্যদের চেয়ে একটু বড় সরো এক মেয়েকে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছি ও অন্যদের চেয়ে এতো বড় কেনো ! আমাদের দলে সবচেয়ে বড় যে ও আমাকে ক্ষেপাতে শুরু করলো … মেয়েটাকে আমার আসলে পছন্দ হয়েছে ।
দিন গেলো । সন্ধ্যায় গুজ গুজ ফুস ফুস করে আলাপ থামলো প্রেমপত্র লেখার প্রসঙ্গে এসে । এই প্রথম শুনলাম এ নতুন শব্দ জোড়া । এর মধ্যে বাংলা খাতার পাতা ছিঁড়ে এনে প্রস্তুতি নেয়া হলো লেখার । তখন সবার মধ্যে আমি আবার বুক চিতিয়ে থাকি, আমার হাতের লেখা সবার চেয়ে বেশ ভালো । স্কুলে হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। তো লেখার গুরু দায়িত্ব পড়লো আমার হাতে । নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিলো । কিন্তু এমন কিছু তো জনমেও লিখিনি । তাতে কি ! বড়রা আছে না । কথায় কথায় এক এক জন একএক শব্দ জুড়লো আর তৈরী হয়ে গেলো আমার হাতের লেখা প্রথম প্রেম পত্র । সবাই বেশ কবার পড়লাম, খুব তুষ্ট হলাম । চিঠিটাকে ভাঁজ করে এক বিছানার বালিশ বা তোষকের তলায় খাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখা হলো । পরদিন সকালে ক্ষুদে বাহিনী গিয়ে ওই চিঠি হস্তান্তরের একটা ব্যবস্থা হবে ।
পরদিন সকালে নানান পিঠার ভোজ শেষে হঠাত টের পেলাম খালারা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আর হাসা হাসি করছে । কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমার ডাক পড়লো এক রুমে । মার ছোটো তিন খালা আরো কে কে বড়রা যেনো ছিলো । দেখি এক জনের হাতে সেই চিঠি । চিঠিতে মেয়েটার নাম লেখা । নীচে একটা আবোল তাবোল নাম লেখা । তাতে কি ! হাতের লেখা মুক্তোর মতোন ঝকঝক করছে আমার । ভাবলাম পিঠা আর কাজিনদের মিছিলের প্রিয় নানা বাড়ী বেড়াবার দিন বুঝি আমার এখানেই জীবনের জন্য শেষ হলো ! প্রথম প্রশ্নটা উচ্চারণ না হতেই আমি গড় গড় করে পুরো কাহিনী বলতে থাকলাম প্রাণপনে । আমাকে অবাক করে হেসে গড়াগড়ি যেতে যেতে খালারা বিদায় করলো আমাকে সেই রুম থেকে । বাইরে বেরিয়ে এসে আমি আর কারো সাথে কথা বলি না । পরে বুঝেছিলাম আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় জনের মনের ইচ্ছা পুরন করতে গিয়ে আমার এই হেনস্তা ।
সেই অত্তটুকুন বয়সে অমন হাতে খড়িতে যার শুরু ! বুঝতেই পারছেন । তারপর লম্বা ফিরিস্তি। এই ধরুন দীর্ঘ অনেক দিন পৃথিবীতে একমাত্র প্রেম ছিলো আমার মা । তারপর ফুটবল । তারপর দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা, কুয়াশা । তারপর গল্প । কবিতা । আঁকাআঁকি । লেখালেখি । তারপর এইচএসসি শেষে অকস্মাত এক প্রেম এসে আমার উপর পড়লো । সেই চিঠি লেখার শৈলীতে শনৈ শনৈ ভরে যেতে থাকলো টনকে টন কাগজ । তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিতে না দিতেই প্রেম পৌঁছে গেলো এক মোটর সাইকেল ডাইরীতে । তারপর ! তারপর আর থেমে থাকেনি ।
যাক যা বলছিলাম … চিঠি । আজ তা ক্ষুদে বার্তা, এসএমএস, এমএমএস, চ্যাট, মেসেঞ্জার, স্কাইপ, হোয়াটস এপ । ধরন পাল্টেছে । যা যুগে যুগে আগেও পাল্টেছে । রানারের যুগে পৃথিবী যখন থেমে থাকেনি । মানুষ কোথায় থামবে ! মানুষ থামেনি । তার ভাবনা আর যাতনার ধরন পাল্টেছে মাত্র । প্রকাশের রঙ বদলেছে কেবল । এখনো মানুষের হৃদপিন্ড অকস্মাত ঢিপ ঢিপ করে টাল-মাটাল অচল হয়ে যাবার উপক্রম হয় । নাওয়া-খাওয়া কিচ্ছু ভালো লাগে না অনুভূতি পুড়িয়ে ছাই করে দ্যায় ভেতর ভেতর ।
যাতনার রকম ফের নতুন নতুন দ্যোতনার জন্ম দ্যায় ঠিক । আগুন আর তার দহন যন্ত্রণা আপন স্বরূপ কিছুটাও পাল্টায়নি । যে পোড়ে শুধু সে ই বোঝে ! আগুন ও ছাই তার রঙটুকু হাজার বছরেও এক বিন্দু পালটায় নি ।
ভাবছি সেই ছাই ভষ্ম একটু একটু করে ঘেঁটে দেখবোই দেখবো কি তার ভেল আর ভেলকি ! অনাদিকাল ধরে কি সে ধারন করে বুকের ভেতর যা নিয়ত এভাবে পোড়ায় … পুড়িয়ে মারে …
[ লেখার সময়কাল ~ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ | প্রথম প্রহর ]
প্রেমে যার হাতখড়ি অত কাঁচা বয়েসে -- তাকে তো কবি হয়ে উঠতেই হব একদিন না একদিন।
ও ভাই ওটা তো স্রেফ রসিকতা। আর সেই ফাঁকে নিজেরে বাড়িয়ে নেয়া।
আসলে কিছু কি বোঝার বয়স হয়েছিলো তখন ! হাতের লেখার কল্যাণে বড়দের কথাগুলো লিখেছিলাম কেবল।
ঘটনাটা মনে আছে। কি সব লেখা হয়েছিলো তার কি বিন্দু বিসর্গ কিছুমাত্র আছে মনে !
তবে হ্যা, এই প্রসংগ আর শব্দ এবং শব্দদ্বয় শেখা হয়ে গিয়েছিলো। সেই অর্থে প্রথম সবক অবশ্য বলাই যায়।
ভাই, সত্যিকারের প্রেম একালেও আছে, শুধু খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে যায়, টিকতে পারেনা, এই আর কি............
আছে তো বটেই । আজও আছে ।
তবে সাধারণ বিচারে তোমার কথাটাই ঠিক ।
এটা আমাদের সামাজিক ও মনস্তাত্বিক বিবর্তনের ফসল ।
আর এর জন্য মানুষইতো দায়ী । অন্য কেউ নয় ।
মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ । সাদাত ।
:clap: :clap: :clap: :clap:
টুকরো টুকরো ছবিগুলোকে কত কী যাদুতে বাংময় করে তুললেন নিমেষে।
অলখ প্রেমের গল্প শুনতে পেলে শেক্সপীয়ার মাথাটিকে উঁচিয়ে ঠিক বলবেন,
'Love looks not with the eyes, but with the mind,
And therefore is winged Cupid painted blind.'
(A Midsummer Night's Dream)
::salute::
তোমাদের যারপরনাই নিদারুন সব মন্তব্য একটা শাদামাটা লেখাকে যে কখন কোথায় নিয়ে যায় !
ছবি যে কি সব আঁকি ! অথচ তাতে যা যা তোমরা দেখতে পাও !
লজ্জা পেতে হয় ।
অবশ্য অকপটে বলাই যায়, অনন্য অনুপ্রেরণাও লুকিয়ে থাকে এর মাঝে ।
:boss: :boss:
তোমার মন্তব্যকে স্যালুট ।
প্রেম প্রেম শৈশব 😛
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
হা হা করে হেসে নিলাম তোমার মন্তব্য পড়ে । রাকিব ।
আসলে একটা কথা বলবার জন্য পাঁচ-দশটা প্রসঙ্গের অবতারণা করা ।
সার কথাতো কয়েক শব্দের । তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান তকমায় আর নোটেশনে সাজাবার হেঁয়ালী হলো এইসব লেখা ।
ওই আনাড়ি ডাক্তারেরা যেমন পাঁচ রকম ওষুধ দিয়ে ফন্দি আঁটেন সফল ডাক্তারের সুনাম কুড়াবার । একটা না একটা ওষুধ তো লেগে যেতেই পারে রোগীর ... আর একটা না একটা কথার প্যাচ হয়তো ছুঁইয়ে যাবে কোনো পাঠক-পাঠিকার মন ।
🙂 🙂
শৈশবের প্রেম (আসলে তো ভাল লাগা!)- এর মতন নির্মল ও খাঁটি জিনিস খুব কমই আছে! :-B
আমার শৈশবের (এবং কৈশোরের) বেশিরভাগ প্রেম ছিল বড় ভাই (জুলহাস, জেসিসি/৮৮-৯৪) এর বান্ধবীরা! কয়েকটা আপুকে তো এখনো ভুলতে পারি নি... :dreamy: 😛
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
যাকে বলে "পাপি লাভ" ।
ভেরি ট্রু ।
এখানে বলা প্রসঙ্গটায় অবশ্য অনুভুতি নয় স্টেনোগ্রাফারের ভূমিকায়ই আমার বিচরণ ।
বটে । সেইসব স্মৃতি
যেনো নক্ষত্রের আরতি !
চোখের সামনেই প্রেমপত্রের স্বর্ণালী যুগ শেষ হয়ে গেলো! "আজ তা ক্ষুদে বার্তা, এসএমএস, এমএমএস, চ্যাট, মেসেঞ্জার, স্কাইপ, হোয়াটস এপ" এর যুগে পরিণত হয়ে গেলো! ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়।
"Alas! Long letters are extinct now,
With them have gone the sense of love,
Just in two decades I wonder how
SMS outdid them, stole our treasure trove!"
একেবারে ঠিক কথাটি বলেছেন খায়রুল ভাই ।
কেমন যেনো সব আবেগঘণ মানবিক অনেক কিছু খটখটে যান্ত্রিক হয়ে গেছে ।
সেই প্রাণস্পর্শ যেনো আর নেই কোথাও !!