বই নিয়ে আলোচনাঃ “সুপ্ত স্মৃতি”

বই পরিচিতিঃ

বই এর নামঃ ‘সুপ্ত স্মৃতি’
বই এর ধরণঃ আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা
লেখকের নামঃ অধ্যাপক গোলাম রহমান খান
প্রকাশকের নামঃ শ্রাবন প্রকাশনী
১৩২, আজিজ সুপার মার্কেট (২য় তলা),
শাহবাগ, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ দিদারুল দিপু
উৎসর্গঃ “আকরামের জাগ্রত স্মৃতির উদ্দেশ্যে”
গ্রন্থস্বত্বঃ ডাঃ সেলিনা খান
প্রথম প্রকাশঃ জুন ১৯৯৩, দ্বিতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৪
পৃষ্ঠা-১০৪, মূল্য: ১৫০.০০ টাকা

লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

অধ্যাপক গোলাম রহমান খান ১৯১৪ সালে পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ, এমএ এবং ল’ পাশ করে ১৯৪১ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) যোগদান করেন। চাকুরীর দু’বছরের মাথায় বর্ধমান জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত থাকা কালে তিনি রেটিনাল হেমোরেজে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যান। এ কারণে তার চাকুরী চলে গেলে তিনি অসীম মনোবল আর সাহস নিয়ে অন্ধত্বকে পরাভূত করে নিজ যোগ্যতায় শিক্ষক হিসেবে সরকারী চাকুরী পুনরুদ্ধার করেন। কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে শুরু করেন অধ্যাপনার নতুন কর্মজীবন। দেশভাগের পর কালের সাক্ষী হয়ে নাড়ীর টানে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, আজকের বাংলাদেশে। রাজশাহী কলেজ থেকে শুরু করে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজ, ঢাকা কলেজসহ অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণের পর বুয়েটে অনারারি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ঢাকা সিটি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ২০০০ সালের ০৭ নভেম্বর তারিখে এই সাহসী কর্মবীরের জীবনাবসান ঘটে। ‘সুপ্ত স্মৃতি’ অধ্যাপক জি আর খান (এ নামেই তিনি সুপরিচিত ছিলেন) এর সেই সাহসী অভিযাত্রারই এক সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান।

আলোচনাঃ

বই এর শুরুতেই বইটির প্রকাশক এবং গ্রন্থস্বত্বের অধিকারক ডাঃ সেলিনা খান একটা চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন। মাত্র দু’ পৃষ্ঠার এ সুলিখিত ভূমিকাটুকু পড়েই যাকে নিয়ে বইটি লেখা তার বর্ণাঢ্য কিন্তু সংগ্রামী জীবনের একটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ “জীবনের পথে যেতে যেতে বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শ তাকে আনন্দ-বেদনায় সঞ্জীবিত করেছে। তাদের কেউ বা প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ, কেউবা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। নিজের জীবনের কাহিনী বলতে গিয়ে তাদের সবার কথাই উঠে এসেছে বিচিত্র বর্ণে। যে সময়গুলো হারিয়ে গেছে অতীতে, যে সময়গুলোকে আমরা আর কোনদিন ফিরে পাবো না, সেই সমৃদ্ধ এক যুগের ছবি এই ‘সুপ্ত স্মৃতি’।“ লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তার বাল্যবন্ধু, সিভিল সার্ভিস অফিসার আকরামকে, যিনি তার অন্ধ জীবনের শুরুতে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন।

কোলকাতার ‘কলেজ স্কোয়ার’ এ তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে এবং পরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। বই এর শুরুতে তিনি সে আমলের বেশ কিছু প্রথিতযশা অধ্যাপকদের সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, যা পড়ে বোঝা যায় শিক্ষক ভাগ্যে তিনি কতটা ঐশ্বর্যশালী ছিলেন। বই এর প্রথম অধ্যায়টির শিরোনাম “আঁধারের পথে”। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ‘আই ইনফর্মারি’ তে ডঃ টি আহমেদ যখন অধ্যাপক সাহেবের হাতে ‘ব্রেইল প্রাইমার’ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা শেখ, এ রোগ ভাল হবার নয়’, তখন অধ্যাপক সাহেবের চোখের আঁধারটুকু নিমেষেই মনেও সংক্রমিত হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তার আঁধারের পথে যাত্রা, সেজন্যেই এ শিরোনাম। মনের এ আঁধার নিয়েই যেদিন তিনি নতুন করে ভাগ্যান্বেষণে বোম্বের ডঃ হালদার এর আমন্ত্রণে “দাদার স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড” এ যোগদানের উদ্দেশ্যে কোলকাতা ত্যাগ করছিলেন, সেদিন হাওড়া রেল স্টেশনে এসে কোলকাতার মায়ায় তার অন্ধ দু’চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। সে সময়ে তার অনুভূতির একটা সুন্দর বর্ণনা তিনি রেখে গেছেন ছোট্ট এ স্বগতোক্তিতেঃ
“হে মোর ধরণীতল,
তোমার লাগিয়া রাখিয়া গেলাম,
দু’ফোঁটা অশ্রুজল”।

এ নতুন অভিযাত্রার নাম তিনি দিয়েছেন ‘আলোর সন্ধানে’। দুই রাত একদিনের রেলপথ পাড়ি দিয়ে তিনি বোম্বেতে প্রথম কয়েকদিন ডঃ হালদারের আতিথ্য গ্রহণ করেন। বহুপুরুষ আগে খৃষ্টধর্ম গ্রহণকারী ডঃ হালদার ছিলেন “একজন সহৃদয় আদর্শ নিষ্ঠাবান খৃষ্টান”। তাকে পাঠকগণ একজন চিকিৎসক ভাবতে পারেন, কিন্তু তিনি আদতে ছিলেন একজন “এমএস (বোস্টন), পিএইচডি (বোম্বে), ডিপ্লোমা ইন ব্লাইন্ড এডুকেশন (হার্ভার্ড)” এর ডিগ্রীধারী পন্ডিত ব্যক্তি। বোম্বেতে তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ওরিয়েন্টেশন কোর্স শেষ করে লেখক দিল্লীর ডাঃ আগারওয়াল এর শরণাপন্ন হন, মনস্তত্ব ও সূর্যরশ্মির সমন্বয়ে তার বিখ্যাত “সাইকোসোলার” পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণের জন্য। এ চিকিৎসার ফলে তার দৃষ্টিশক্তি সামান্য বেড়েছিল বৈকি, তবে তা কার্যকরী দৃষ্টিশক্তি নয়। অবশেষে তিনি পুনরায় কোলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে, তার যেহেতু ল’ ডিগ্রী ছিল, সেহেতু আইন পেশায় যোগদানের চেষ্টা করতে থাকেন। পাশাপাশি চালাতে থাকলেন অধ্যাপনা পেশায় নিয়োগ লাভের চেষ্টা। একজন অন্ধ ব্যক্তির পক্ষে এসব চেষ্টা চরিত্র করা যে কতটা দুরূহ ব্যাপার, তা সহজেই অনুমেয়।

অবশেষে তিনি নিজ যোগ্যতায় এবং তৎকালীন ডিপিআই আসাদ সাহেব, প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রিন্সিপাল ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল ডঃ আই এইচ জুবেরী প্রমুখের বদান্যতায় ইসলামিয়া কলেজে ইকনমিক্স এর লেকচারার পদে অস্থায়ী নিয়োগ লাভ করেন। এর ফলে খুলে যায় এক নতুন দুয়ার, তিনি দৃপ্তপদে এ নতুন জগতে প্রবেশ করলেন অনেক সংঘাত কাটিয়ে, নতুন সম্ভাবনার আশা নিয়ে। এদিকে দেশ বিভাগের পালা এগিয়ে এলো। তার কাছে অপশন চাওয়া হলে তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। অবশেষে অনেক ভাবনা চিন্তার পর বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে অভিমত দিলেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে কলেজের চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে ১৬ আগস্ট ট্রেন যোগে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এদশে এসে তিনি একাধিক্রমে রাজশাহী গভঃ কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তার এ ছোট্ট বই এ কেবল রাজশাহী আর সিলেটে তার অধ্যাপনা এবং অন্যান্য কার্যাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়, অন্যগুলোর পাওয়া যায় না। তার মধ্যে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ছিল তার সিলেটে অবস্থানকালীন জীবন, কারণ এখানে থাকতেই তিনি আসামের এক ধনী পরিবারের মহিলাকে বিয়ে করে তার অনাড়ম্বর সংসার শুরু করেন। কিন্তু কোন এক ভুল বোঝাবুঝির কারণে সেই মহিলা তার বিরুদ্ধে কপটতা ও শঠতার অভিযোগ এনে তাকে ত্যাগ করে চলে যান। তার সে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা লেখক অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন। এই চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দিয়েই বই এর সমাপ্তি টানা হয়েছে, যেখানে লেখকের শেষ ক’টি লাইনঃ
“তারা তিন বোন বাড়ীর উঠান পার হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে গেট পার হয়ে গেল। আমি রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপ’ থেকে শেষ দু’টো লাইন নিজের মত করে আওড়াতে লাগলামঃ

‘আমি দিনু বর, দেবী,
তুমি সুখী হবে
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি পরম উল্লাসে’।

একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ তার নিজের উপর আস্থা রেখে অদম্য মনোবল নিয়ে কিভাবে শারীরিক প্রতিকূলতাকে পরাস্ত করে জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারে, এ বই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। লেখকের বর্ণনাগুণে বই এর বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাট ইতিহাস উঠে এসেছে- যেমন দেশবিভাগের সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেনসহ ব্রিটিশ শাসকদের মনোভাব; কংগ্রেস, মুসলীম লীগ, গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ আর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এর দৃষ্টিভঙ্গী; নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস এর সাহস ও স্পষ্টবাদিতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়াও, সাহিত্যের প্রতি লেখকের অনুরাগ এবং অগাধ পড়াশোনার পরিচয়ও পাওয়া যায় তার বিভিন্ন উদ্ধৃতিতে। সব মিলিয়ে, মাত্র শ’খানেক পৃষ্ঠার এ বইটিকে আমার কাছে সুখপাঠ্য মনে হয়েছে।

(আমি সফলতার গল্প শুনতে ও শোনাতে ভালবাসি!)

ঢাকা
২৮ এপ্রিল, ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৬,১০১ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।