অসংলগ্ন গল্প

নাফিস (১৯) আর নাকিব (১১) দুই ভাই। ওদের বাবা মা উভয়েই চিকিৎসক ছিলেন। ছিলেন বলছি, কারণ ওদের মা সদ্য প্রয়াত, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অকুস্থলেই নিহত হন। দুই ভাই এর মধ্যে বয়সের ব্যবধানটা একটু বেশী হলেও ওরা, বিশেষ করে প্রবাসে আসার পর থেকে একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়। আজ থেকে ৮ বছর আগে ওদেরকে নিয়ে যখন ওদের বাবা মা ইমিগ্রেশন ভিসায় আমেরিকার নিউ ইয়র্কে এলো, তখন নাফিস ছিল এখনকার নাকিবের মত, ১১ আর নাকিব ছিল মাত্র ৩ বছর বয়সী। পিতামাতার মধ্যে একজন রুটি রুজির সন্ধানে সাত সকালে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেত, অপরজন রান্নাবান্না করা সহ বাচ্চাদেরকে সামলাতো। স্কুলে ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত ওরা সারাদিন বাসায় থেকেই দুষ্টুমি করতো, কারণ ভাষাগত অসুবিধার কারণে ওদের একা ঘরের বাইরে বের হবার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে, ঘরের ভেতরেই একসাথে খেলতে খেলতে অচিরেই ওরা বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও একে অপরের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়।

ওদের বাবা শান্ত (৫১) আর মা সোনালী (৪৮) দেশে থাকতে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে কয়েক বছর নিজ উপজেলা হাসপাতালে চাকুরী করে। ওরা স্বামী স্ত্রী উপজেলাতেই বসবাস করতো এবং একই হাসপাতালে চাকুরী করতো বিধায় হাসপাতালের রোগীরা একমাত্র ওদেরকেই সার্বক্ষণিক পেত। বাকী অন্যান্য যেসব চিকিৎসক কাগজে কলমে হাসপাতালের পে রোলে ছিল, তারা কোনরকমে হাজিরা দিয়ে কিছুক্ষণ থেকেই যার যার কাজে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত, কারণ ওরা জানতো যে শান্ত-সোনালি জুটি হাসপাতালেই থাকবে, নতুবা বড়জোর কাছাকাছি তাদের বাড়ীতে থাকবে, তাই বিপদে আপদে তাদেরকে বাড়ি থেকে ডেকে আনা যাবে। সপ্তাহে তিন দিনের বেশী ওরা কখনোই হাজিরা দিতেও আসতো না। অসুস্থ রোগীরা হাতের কাছে শান্ত-সোনালী চিকিৎসক জুটিকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত ও আশ্বস্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে ওরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসও শুরু করে দিল। বাড়ীতেও জরুরী ভিত্তিতে রোগী দেখার ব্যবস্থাদি বসালো। চিকিৎসায় শান্ত’র হাত খুব ভাল ছিল। মফস্বলের মত জায়গায় দূর দুরান্ত থেকে তার কাছে রোগী আসা শুরু করলো। সোনালীর কাছে আসতো শুধুমাত্র মহিলা রোগীরা।

এভাবেই ওদের সুখের সংসার চলছিল। নিজ উপজেলায় চাকুরী করাতে শান্ত’র সান্তনা ছিল যে সে একই সাথে বৃদ্ধা মায়েরও দেখভাল করতে পারছিল। এরই মধ্যে যখন ওদের প্রথম সন্তান জন্মলাভ করলো, ওকে দাদীর কেয়ারে রেখে ওরা নিশ্চিন্তে চাকুরী করার বাড়তি সুবিধেটুকুও পেল। পেশাগত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কারণে অচিরেই ওদের সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। উপজেলা হাসপাতালে কয়েক বছর চাকুরী করার পর শান্ত তার ক্যারীয়ার সম্পর্কে ভাবতে শুরু করলো। উচ্চতর ডিগ্রী ব্যতীত চিকিৎসা পেশায় বেশী দূর এগোনো যাবে না, এটা সে নিজেও বুঝতো এবং সোনালীকেও বুঝাতো। আবার প্রথম কর্মস্থলের প্রতি একটা মায়াও জন্মে গিয়েছিল, সেখানকার জনগণকে রেখে দূরে কোথাও যেতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। এসব ভাবনার মাঝেই একদিন শান্ত রংপুর মেডিকেল কলেজে লেকচারার হিসেবে এবং সোনালী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলী হলো। ওরা রংপুর শহরে মেডিকেল কলেজের সন্নিকটে বাসা ভাড়া করে যার যার নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলো।

সেখানে বছর দুয়েক চাকুরী করার পর শান্ত Internal medicine এ MD কোর্স করার জন্য BSMMU এ ভর্তি হয় এবং সোনালী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই সদ্য চালু হওয়া M Phil কোর্সে (Physiology) ভর্তি হয়। সাফল্যের সাথে প্রথম খন্ড পাশ করার পর শান্ত মেডিসিন এর প্রফেসর আব্দুল্লাহ’র অধীনে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। সোনালীও সাফল্যের সাথে প্রাথমিক দুটো স্তর পার করে তার থীসিস লেখার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শান্ত বিভিন্ন লাইব্রেরী, হাসপাতাল এবং আর্কাইভ ঘেটে ঘুটে সোনালীর থীসিস লেখার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে দেয়। ঠিক এ রকমের একটা পর্যায়ে ওরা আমেরিকান দূতাবাস থেকে ইমিগ্রেশণ ভিসা সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিকতাদি সম্পন্ন করার ডাক পেল। ডাক টা যে তারা আচমকা পেয়েছিল, তা নয়। এ প্রক্রিয়াটা তাদের বিয়ের পর পরই শুরু হয়েছিল। সোনালীর মামারা বেশ কয়েক যুগ ধরে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রথমে ওর মা, পরে বাবা ও ভাইরা আমেরিকা চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ওদের পরিবারের সবাই চাচ্ছিল, ওরাও মাইগ্রেশন করুক। শান্ত প্রথমে একেবারেই রাজী ছিল না, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সোনালীর এবং ওর নিজের পরিবারের সবাই ওকে বুঝিয়ে রাজী করায়, অন্ততঃ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যানের কথা মনে রেখে আমেরিকায় চলে যাবার জন্য।

শান্ত’র জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা বেশ কঠিন ছিল। ও এমনিতেই কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের। নিজ দেশে ও ঠিক ট্র্যাকেই চলছিল। অল্পদিনে চিকিৎসা পেশায় বেশ সুখ্যাতিও অর্জন করেছিল। কোর্সেও বেশ ভাল ফলাফল অর্জন করে চলছিলো। তাছাড়া আমেরিকায় ওর দু’জন ফার্স্ট কাজিন ছাড়া রক্তের সম্পর্কের আর কেউ ছিল না। সবচেয়ে বেশী দ্বিধান্বিত ছিল সে মাকে নিয়ে। এই বৃ্দ্ধ বয়সে মাকে দেশে একা রেখে বিদেশ যেতে তার মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না। তার পরেও সবার অনুরোধে প্রথমে সে নিমরাজী, পরে রাজী হলো। শুরু হলো দেশান্তরের প্রস্তুতি। খুব কম সময়ের মধ্যে সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হলো। দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ওরা যখন শেষ বারের মত বিদায় নেয়ার জন্য উপজেলায় গেল, তখন সহজ সরল দরিদ্র এলাকাবাসীর মাঝে দুঃখের আহাজারি শুরু হলো। যেদিন রাতে ওরা উপজেলা ছেড়ে চলে আসবে, সেদিন রীতিমত কান্নার রোল ঊঠেছিল। পরিবারের আত্মীয় স্বজন নীরবে অশ্রুপাত করেছিলেন, কিন্তু আশে পাশের এবং দূর দুরান্ত থেকে আসা সাধারণ জনগণের অনেকে শব্দ করে কান্নাকাটি শুরু করেছিল এবং ওদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করেছিল। ট্রাকে মালপত্র উঠিয়ে ওরা যখন রওনা দিবে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। শান্ত’র মা হাতে একটা হ্যারিকেন নিয়ে ধীর পায়ে ওদের গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন। হ্যারিকেনের সলতেটা একটু বাড়তি থাকায় চিমনীর অধিকাংশটাই কালো কালিতে আচ্ছন্ন ছিল। তিনি নির্বাক ছিলেন। তার গন্ডদেশ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নীঃশব্দে প্রবাহমান ছিল। তাঁকে দেখে শান্ত’র চোখ বেয়েও জলের ধারা নামতে শুরু করলো। ওর মনে হচ্ছিল, হ্যারিকেনের কালো চিমনীটা যেন মায়ের কালো মুখের প্রতীক, সেখানে কেবলই তার মায়ের কালো মুখটা বার বার ভেসে উঠছিলো। মাকে ফেলে রেখে যাওয়াতে তার বুকটা একটা অস্বস্তিকর ব্যথায় খচ খচ করছিল।

আমেরিকা এসে কালচারাল শক কাটিয়ে উঠতে উঠতে শান্ত’র বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। পুঁজিবাদী নির্দয় সমাজ ব্যবস্থায় সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। কিন্তু পিছু ফেরার উপায় ছিল না। এ সময়টাতে সোনালী তাকে নিষ্ঠার সাথে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে ওরা নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিল। প্রথম দু’বছর ছেলেদেরকে এলাকার একটা সাধারণ মানের স্কুলে পড়িয়েছিল। ভাল ফল করায় ওদেরকে অপেক্ষাকৃত ভাল অন্য আরেকটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সেখান থেকে নাফিস ভাল ফল অর্জন করে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্য Stony Brook University তে ভর্তি হয়। টুকটাক কাজ করেও সে পড়ার খরচের কিছুটা অংশ চালিয়ে নিতে পারে। ওরা আমেরিকা যাবার চার বছর পর একবার দু’সপ্তাহের জন্য দেশে বেড়াতে এসেছিল। ঐ দু’সপ্তাহ নাফিস তার পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পেরে খুবই খুশী হয়েছিল। আর ওদেরকে পেয়েও দেশের আত্মীয় স্বজন এবং এলাকাবাসী সবাই খুব খুশী হয়েছিল।

এবারের রোযা শুরু হবার কয়েকদিন আগে মাকে ফোন করে শান্ত ও সোনালী জানায় যে ওরা আগামী আগস্ট মাসে ১৫/১৬ দিনের জন্য দেশে আসছে। এ খবর পেয়ে পরিবারে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। মা আশায় আশায় দিন গুনতে থাকেন। তিনি কয়েকদিন থেকেই এ কথা ভেবে হা হুতাশ করছিলেন যে ওদেরকে তিনি বোধ হয় আর এ জীবনে দেখে যেতে পারবেন না, কারণ আজকাল তার শরীরটা বেশী ভাল যাচ্ছে না। এ খবর পেয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশী খুশী হন। দ্বিতীয় রোযার দিন সেহেরী খেয়ে সোনালী তার শাশুড়ীকে টেলিফোন করে জানায় যে সে এ যাত্রা দেশে আসতে পারছেনা, কারণ সে ফেডারেল সরকারের অধীনে একটা ভাল চাকুরী পেয়েছে, দু’দিন পরেই যোগদান করবে। দূর থেকেও সোনালী টের পায় যে এ কথা শুনে তার শাশুড়ী দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ছেন। তাই সে সাথে সাথে তাঁকে আশ্বস্ত করে বললো, ‘আমি যেতে না পারলেও আপনার ছেলে এক নাতিকে সাথে করে নিয়ে যাবে, আর আমি ডিসেম্বরে অপর নাতিকে সাথে করে দেশে যাব’। এ কথা শুনে তার শাশুড়ী আশ্বস্ত হন। এ কথা বলার পর সোনালী দু’কাপ চা বানিয়ে শান্ত’র সাথে একসাথে বসে পান করে। একটু পরেই তাকে কাজে বেড়িয়ে যেতে হবে। সে অন্যান্যদিন কমিউটার ট্রেনেই যাওয়া আসা করে। তার খেয়াল হলো, ঐদিন কি কারণে যেন ট্রেনের শিডিউল একটু হাল্কা। একটা মিস করলে পরেরটা পেতে বেশ খানিক সময় লাগবে। চা খেতে খেতে তাই সে শান্তকে অনুরোধ করলো ওকে একটু গাড়ীতে করে ড্রপ দিয়ে আসতে। এমন অনুরোধে সাড়া দিতে শান্ত অন্যান্যদিন গড়িমসি করলেও সেদিন এক কথাতেই রাজী হয়ে গেল।

সোনালী যে হাসপাতালে কাজ করে, সেখানকার একজন বাঙালী সহকর্মী ওদের বাসার কাছাকাছিই থাকে। সোনালীর অনুরোধে শান্ত তাকেও গাড়ীতে তুলে নিল। তার পর সোনালীর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথে একটা ইন্টারসেকশন ছিল। ঐ ইন্টারসেকশনটা দুর্ঘটনার জন্য ইতোমধ্যে বেশ কুখ্যাত হয়েছে। ওটা ধরেই ওদের ছোট ছেলে নাকিব প্রতিদিন পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করে। শান্ত যখন গাড়ী চালায়, তখন সে কোন রিস্ক নেয় না। কারণ, ওর চেনা জানা অনেকেই আমেরিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, নতুবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওর মনে পড়ে ইন্টারসেকশনে সবুজ বাতি দেখেই ও এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে সাইড থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা আরেকটা গাড়ী ওদেরকে সজোরে ধাক্কা মারলো। সোনালী সামনে চালকের পাশের আসনে বসা ছিল। আঘাতের কারণে ওর মেরুদন্ড ভেঙে যায় এবং মস্তিষ্কের সাথে মেরুদন্ডের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ও অকুস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শান্তও সাথে সাথে সংজ্ঞা হারায়। পেছনে বসা সোনালীর সহকর্মীর পাঁজরের কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়। ঘন্টা তিনেক পর শান্ত’র যখন জ্ঞান ফিরলো, ও তখন বুঝতে পারে ও হাসপাতালে শয্যাশায়ী।

নাফিস আর নাকিবকে ঘুমে রেখে ওরা সাত সকালে বাড়ী থেকে বেড়িয়েছিল। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে টেলিফোনের শব্দে নাকিবের ঘুম ভেঙে যায়। কুইন্স হাসপাতাল থেকে ওকে জানানো হয় যে সড়ক দুর্ঘটনায় ওর বাবা মা মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। টেলিফোন রাখতে না রাখতেই ও দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পায়। দরজা খুলে দেখে পুলিশ, একই কথা বলছে। ওদের দুই ভাইকে গাড়ীতে তুলে পুলিশ দুর্ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কুইন্স হাসপাতালে। কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স সবার চোখে পানি দেখতে পেয়ে নাফিস চমকে ওঠে। ওর সরু বুকটা ভয়ে ঢিবঢিব করতে শুরু করে। ডাক্তার ওকে খুলেই বললেন, ওর মা আর এ পৃথিবীতে নেই, পরীরা এসে তাঁকে অন্য ভুবনে নিয়ে গেছে। ঊনিশ বছরের ছেলে নাফিস কাঁদতে ভুলে গেল। এগার বছরের নাকিব মৌন হয়ে গেল। নাফিস শঙ্কাভরে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলো। ডাক্তাররা জানালেন, উনি পাশের কক্ষে আছেন, বেঁচে আছেন।

শান্ত অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল। মাথায় ও বুকে কিছুটা আঘাত পেয়েছিল, কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা তাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করে বিকেলের দিকে ছেড়ে দিল। শান্ত’র বড় ভাই এর এক বন্ধু নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে কর্মরত। ভাই এর অনুরোধে এই পুলিশ কর্মকর্তা আপন ভাই এর স্নেহ নিয়ে তাকে হাসপাতালে দেখতে এলেন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড় করিয়ে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। মা/স্ত্রী বিহীন বাসায় ওরা সবাই খুব অস্বস্তি বোধ করছিল, কিন্তু কারো চোখে কান্না নেই! একে অপরের দিকে মাঝে মাঝে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কে কাকে সান্তনা দেবে! শান্ত’র বুকে তখনো আঘাতের ব্যথা চিন চিন করছে। ধীরে ধীরে পাড়া প্রতিবেশীরা বাসায় আসতে শুরু করলো। বন্ধু বান্ধব সতীর্থরা আসতে শুরু করলো। কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া নিয়ে এলো। ওদের সাথে কথা বার্তা, আলাপচারিতা যখন শুরু হলো, তখন একে একে ওদের চোখ বেয়ে কান্নার বন্যা শুরু হলো। নাকিব এমনিতেই মিতবাক, তদুপরি ঘটনার আকস্মিকতায় সে একেবারে স্তব্ধ, হতবাক হয়ে গেল। সে জীবন থেকে কী হারিয়েছে, এটা বুঝতে তার বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।

পরের দিন সোনালীর দাফন কার্য শেষে শান্ত তার দুই ছেলেকে দুই পাশে নিয়ে বিছানায় এলো। সে তাদেরকে তার জীবনের কাহিনী শোনাতে লাগলো। ওদের মায়ের গল্প বলা শুরু করলো। এখন ওরা কে কিভাবে থাকবে, কী করবে, সে নিয়ে আলাপ করতে থাকলো। ওরা দুই ভাই খুব মনযোগ দিয়ে ওর কথা শুনতে থাকলো। অশ্রুসিক্ত চোখে কম্পমান গলায় নাকিবকে জড়িয়ে ধরে শান্ত বললো, আজ থেকে সে আর কোনদিন ওকে বকাঝকা দিবে না, এটা তার জন্য আজ থেকে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। নাকিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “হোয়াই নট? ইন দ্যাট কেস আই মে বি ডুয়িং মেনী রংস”! ছোট্ট একটা ছেলের এমন পরিপক্ক প্রশ্ন শুনে শান্ত অবাক হয়ে গেল। সে নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ছোট্ট ঐ ছেলেটাকে বলতে থাকলো, তবুও বকবোনা, আই প্রমিজ! ইউ আর টু গুড ফর দ্যাট! বড় ছেলে নাফিসকে যখন ও বোঝাতে শুরু করলো, সেও চুপ করে সব কিছু শুনে গেল। তারপর ও বললো, আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার যে প্ল্যানটা করেছিলাম, উই মাস্ট প্রসীড একর্ডিং টু দ্যাট। আমাদের সব আত্মীয় স্বজনের সাথে আমাদের সংযোগ বাড়ানো উচিত। শান্ত এতদিন জেনে এসেছে, প্রবাসীদের ছেলে মেয়েরা দেশে বেড়াতে আসতে ততটা উৎসাহী হয়না। তাই নাফিসের এ কথাটা শুনেও সে অবাক হলো, এবং আশ্বস্তও হলো। নাফিস বয়সের চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্ববান হয়ে উঠলো, শান্ত বয়সের কথা ভুলে গিয়ে বালকসুলভ কান্নায় ভেঙে পড়লো। ছোট ছেলে নাকিব তার অনুভূতিকে চেপে রাখলো, কেঊ টের পেল না, তার ভেতরে কী রকম ভাঙচুর হচ্ছে। এই শোকের খবর পেয়ে ওর টীচার ক্লাসে শোক প্রস্তাব এনেছিলেন। ও বড়দের মত সৌম্য বজায় রেখে সবার কনডোলেন্স একনলেজ করছিলো। এইটুকু বয়সেই ও বুঝে গিয়েছিলো, মানুষ একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখ বেদনা কারো সাথে সেই অর্থে শেয়ার করতে পারেনা, কিন্তু তবুও অন্যের সহমর্মিতাকে সম্মান করতে হয়।

সোনালী মারা যাওয়ার আগে নাকিব একা একাই পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করতো, কারণ স্কুলটা মোটামুটি বাসার কাছেই ছিল। কিন্তু সে মারা যাওয়ার পর থেকে শান্ত প্রতিদিন ওকে স্কুলে নিয়ে যায়। ও প্রতিদিন খেয়াল করে, ঐ ইন্টারসেকশনটার কাছে এলেই নাকিব থমকে দাঁড়ায়, কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে, তারপর মুখ কালো করে স্কুলের দিকে এগিয়ে যায়। এটা দেখে শান্ত’র হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে সে নিজেও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ২২/২৩ বছরের সংসারের বহু স্মৃতি তার চোখের পর্দায় সিনেমার মত ভেসে উঠে। সোনালীর অবদান সে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে থাকে। মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও ওরা একসাথে চা খেয়েছে, সংসারের টুকটাক গল্প করেছে- ওটাই ওর শেষ স্মৃতি। কেউ তাকে দেখছেনা ভেবে শান্ত ইচ্ছেমত কাঁদতে থাকে। পরে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নীরবে প্রয়াত স্ত্রীর জন্য প্রার্থনা করেঃ “রাব্বুল ‘আ-লামীন! পবিত্র রমজান মাসে রোযা রাখা অবস্থায় কর্তব্যস্থলে যাত্রাপথে তুমি তাকে এখান থেকেই তুলে নিয়েছো। দয়াময়, তুমি তাকে মা’ফ করে দিয়ে শহীদী মর্যাদা দান করো এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের সম্মানিত অধিবাসীদের সাথে তাকে একই কাতারভুক্ত করে নিও”…..।

ঢাকা
২৮ জুন ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৫,৭৬২ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “অসংলগ্ন গল্প”

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।