নতুন বই এর পর্যালোচনা- আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম

পুরো বইমেলা জুড়ে ঘুড়ে ঘুড়ে অনেক বইই তো কিনলাম, তবে পড়বো কখন? সিরিয়াস পঠন এখন আর ততটা ভালো লাগেনা। কবিতার অঙ্গণে একজন নবাগত কবির কবিতার বই পড়েই এবারের বইমেলা থেকে কেনা বই এর পাঠ শুরু করলাম। আর পড়েই যখন ফেললাম, তখন আর আমার ভাবনাগুলো পাঠকদের সাথে শেয়ার করি না কেন? তবে তাই করছিঃ

বই এর নামঃ আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম
বইয়ের ধরণ : কবিতা
লেখক: গুলতেকিন খান
প্রকাশক: তাম্রলিপি, ৩৮/২ক, বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মুদ্রণেঃ একুশে প্রিন্টার্স
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
দ্বিতীয় সংস্করণঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
মূল্য : ১৩৫.০০ টাকা, (বইমেলায় ২৫% ছাড়ে ১০০.০০ টাকা)
উৎসর্গঃ প্রথম পাঠক, পথ প্রদর্শক, দাদা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খানকে

হুমায়ুন আহমেদ এর “নন্দিত নরকে” প্রথম প্রকাশ পাবার কিছুদিন পরে যখন আমার হাতে এলো, তখন বইটি একটানা, প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছিলাম। বলাবাহুল্য, বইটি খুবই ভালো লেগেছিল, আমাকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। এর কিছুদিন পরে শুনি, কোন এক কিশোরী বালিকা বইটি পড়ে আবেগ বিহ্বলিত হয়ে সরাসরি লেখকের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রেম নিবেদন করেন এবং কিছুকাল সফল প্রেমের পর বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে এ তথ্যটুকু জানার পর আমার খুব ভালো লেগেছিলো, কারণ বইটা পড়ে আমারও লেখকের প্রতি একটা সমীহ জন্মেছিলো। তাঁর গুণমুগ্ধ কোন অনুরাগী পাঠিকার সাথে তিনি সংসার পেতেছেন, এটা ছিল একটা খুশীর খবর। এর পর থেকে হুমায়ুন আর গুলতেকিন বত্রিশ বছর ধরে আদর্শ সুখী দম্পতি হিসেবে ভক্তকূলের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে পরিণত বয়সে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ আর হুমায়ুনের দ্বিতীয় বিয়ের পর নিঃসন্দেহে বহু অনুরাগী পাঠকের সমব্যথী সমর্থন গুলতেকিনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। আমিও সে দলের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে, প্রবাসে হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যুর পর স্বদেশে তাঁর লাশ দাফন নিয়ে যে অনাকাঙ্খিত ফ্যাসাদের সৃষ্টি হতে যাচ্ছিলো, সেই কঠিন সময়ে গুলতেকিন যে উদারতা আর প্রয়াত হুমায়ুনের প্রতি ভালোবাসার মন নিয়ে বিশাল ছাড় দিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত বিরল। এ ধরণের পারিবারিক ঝগড়া বিবাদ নিরসনে তাঁর এ অনুকরণীয় ভূমিকা ভবিষ্যতেও আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখাবে বলে আমার বিশ্বাস।

এহেন একজন সম্মানীয় ব্যক্তির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, এ কথাটা যেদিন প্রথম শুনলাম, সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বইটি আমি সংগ্রহে রাখবো। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ রাতে বইমেলার সময় শেষ হবার ঠিক আগে আগে আমার বই “গোধূলির স্বপ্নছায়া” এর প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম, গুলতেকিনের বইটি কোথায় পাওয়া যাবে। আমার বই এর স্টল ‘জাগৃতি প্রকাশনী’র খুব কাছেই ছিল গুলতেকিনের প্রকাশক ‘তাম্রলিপি’র স্টলটি। তিনি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে বললেন যে তিনি ওখানে বসে তাঁর বই এ শুভেচ্ছা স্বাক্ষর দিচ্ছেন। মেলা শেষ হবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আমি বইটা কিনলাম। বিক্রেতা জানালেন, কবি সেখানে উপস্থিত আছেন, আমি চাইলে বইটিতে শুভেচ্ছা স্বাক্ষর নিতে পারি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, গুলতেকিন একটা কালো হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসে ক্রেতাদের বই এ স্বাক্ষর দান করছেন। আমি তাঁর বইটিতে স্বাক্ষর দানের অনুরোধ জানালে তিনি সহাস্যে রাজী হলেন। স্বাক্ষরের পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমার সাথে দুটো ছবিও তুললেন। আমারও প্রথম কবিতার বই ‘জাগৃতি’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, একথা শুনে তিনি সেটা ক্রয়ের জন্য তাঁর এক সহকারীকে নির্দেশ দিলেন।

বই সম্পর্কে মন্তব্যঃ
বই এর নামকরণ ভালো লেগেছে, তবে প্রচ্ছদটা খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পীর অন্যান্য কাজের তুলনায় সাধারণ মানের মনে হয়েছে। আরেকটু আকর্ষণীয় হতে পারতো। বই এর অভ্যন্তরীণ অলংকরণও আমার কাছে ততটা দৃষ্টিনন্দন মনে হয়নি। প্রথম কবিতা “ভালো লাগা, এ আকাশ ভরে” ভালো লেগেছে এবং এটি প্রথম কবিতা হিসেবে নির্বাচিত হওয়া যথাযথ হয়েছে। কবির দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো শুভার্থীদের প্রতি কবির বিনম্র, বিনয়ী শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। একইভাবে, বইটির শেষ কবিতা “কেন যায়” পড়ে স্নেহাষ্পদেষু আদিয়ান এর চিরবিদায়ের বেদনায় পাঠকের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবি তাঁর মোট পঁয়ত্রিশটি কবিতা এই বই এ সন্নিবেশ করেছেন। কবিতাগুলোকে তিনি মোট ছ’টি গুচ্ছে ভাগ করেছেন, প্রথম পাঁচটি গুচ্ছে ছ’টি করে আর শেষ গুচ্ছে পাঁচটি কবিতা রেখেছেন, যার মধ্যে একটি কবিতার ব্যাপ্তি দু’পৃষ্ঠা জুড়ে। প্রতিটি গুচ্ছের প্রথম কবিতার কোন একটা পংক্তি থেকে গুচ্ছনামটি নেয়া হয়েছে। এভাবে গুচ্ছবিভক্ত করাকে আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি, কারণ কেবলমাত্র পঞ্চম গুচ্ছটি ছাড়া একেকটি গুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোকে একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে হয়নি, আবার গুচ্ছের নামের সাথেও কবিতাগুলোকে খুব একটা সাযুজ্যপূর্ণ বলে মনে হয়নি।

প্রথম গুচ্ছের বাকী কবিতাগুলোর মধ্যে ‘অভিধানঃ এক’ ভালো লেগেছে, যদিও শিরোনামের যথার্থতা প্রশ্নাতীত হয়নি। ‘শাপমোচন’ আর ‘সাতকাহন’ও ভালো লেগেছে, তবে ‘শুদ্ধ’ ও ‘তর্ক’ ভালো লাগেনি। “নদীর কিনার আছে, লোকালয়ে এ ভেলার ঠাঁই নেই কোনো”- শাপমোচন কবিতার এ চরণটি পাঠকের মনে এক বিমূর্ত চিত্র এঁকে যায়। সাতকাহন কবিতায় বাঙলার এক দুঃখিনী নারীর কথা বলা হয়েছে, যার চোখের জলে কলম ব্যর্থ হয়ে যায় বলে কবি জানিয়েছেন। দ্বিতীয় গুচ্ছের প্রথম কবিতা ‘নতুন নূপুর’ এর ছন্দ খুব সুন্দর হয়েছে, তবে মর্মার্থ সহজবোধ্য হয়নি। ‘রাত্রিবিষয়ক’ কবিতাটিতে নির্ঘুম রাত কাটানোর যন্ত্রণার অভিব্যক্তি সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃ্তির ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সচরাচর বাঙালীর মুডেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাই ‘ঘন বরষায়’ এর শেষ পংক্তি ‘সবকিছু বদলে যায়, ঘন বরষায়…’ এর সাথে দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশ নেই। ‘সাহস’ কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে, হয়তো এর শিরোনামটি ‘সাহস’ না হয়ে অন্য কিছু হলে ভালো হতো। ‘মৌন অন্ধকার’ এ বর্ণিত মুখরিত খেয়াঘাটে বসে থাকা নিঃসঙ্গ পথিকের ভাবনাগুলো বেশ ভালো লেগেছে। ‘ক্ষণস্থায়ী, যা কিছু দেখি’ এর শেষ তিনটে চরণ চমৎকার হয়েছে।

তৃ্তীয় গুচ্ছের ‘খেলা’ কবিতার একটি পংক্তি থেকে-“কেউ হাঁটে অবিরাম আজো”, বইটির শিরোনাম গ্রহণ করা হয়েছে। ‘জলের হৃদয়’ কবিতাটির ছন্দ খুব ভাল, বক্তব্যও সাবলীল। পুরো কবিতাটাই ভালো লেগেছে। এটা এ বই এর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘সামান্য সঞ্চয়’ কবিতাটি অনেকটা প্রথম পংক্তি “জলরঙে আবছায়া কুয়াশার মতো”ই কুহেলিকাময়। শেষ চরণ-“গোধূলীর জলরঙ হয়েছিলো ভাষা” খুব আবেদনময় হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘পরবাস’ একটি স্মৃতি ভারাক্রান্ত কবিতা, যা পাঠক হৃদয় স্পর্শ করে যায়। ‘স্থান’ কবিতার পুরোটা আর ‘অতিথি’ কবিতার শেষ তিন পংক্তি চমৎকার হয়েছে। কেবল একটি বাক্য দ্বারা কোন প্রেমিক হৃদয় কতকিছু করতে পারে, তার আবেগময় অভিব্যক্তি ঘটেছে চতুর্থ গুচ্ছের ‘একটি বাক্যে’ কবিতাটিতে। ‘শরতের দীর্ঘশ্বাস’ কবিতায় মোট চারটি স্তবক রয়েছে, প্রতিটিই খুব সুন্দর হয়েছে। ‘পরিচয়’ কবিতায় কবি তার ‘বন্ধু’কে যেভাবে আশ্বস্ত করেছেন, তার ব্যঞ্জনা খুবই মনোমুগ্ধকর। একইভাবে ‘অপেক্ষা’র শেষ পংক্তিটিও একটি স্বস্তিদায়ক অভিব্যক্তি। ‘কাকস্য’ শিরোনামে দুটো কবিতা দেয়া হয়েছে, দুটোই চমৎকার। এ দুটোকে হয়তো অনেকে কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত বলে ভাবতে পারেন, তবে সে ভাবনাটা সঠিক হতেও পারে, আবার নাও পারে। ‘কাকস্য’ এর ন্যায় ‘সত্য’ কবিতাটিকেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা বলে মনে হতে পারে, যেখানে কবি বলেছেন, “কৌ্তূহলী মানুষেরা মহাকাব্য লিখতেই পারে”। ‘কাকস্য’ এর দুটো কবিতার মধ্যে প্রথমটার দুটো পংক্তি আর পরেরটা পুরোটাই আমার ভালো লেগেছে, যা এখানে তুলে দিলামঃ

১। সন্ধানী, শঠ, কোকিলের মিছিলে
ধ্রুপদী কাক উজান কেনো ওড়ে?”

২। শুনিয়ে গান
কেউ দিল হাতছানিঃ
ভাঙল বাড়ী, নিভলো বাতি,
পোড়ালে সংসার—

তুমি কেবল সারাটা দিন
ডিমেই তা দিলে—
কোকিলারা গান শুনিয়ে
নামাল আঁধার।

পঞ্চম গুচ্ছের প্রথম কবিতা ‘আয়নাশিল্প’ এর শেষ স্তবকটা অসাধারণ হয়েছে। একইভাবে, ‘ভাটার টানে’র শেষ দুটো পংক্তিকেও অসাধারণ বলা যেতে পারেঃ “জলের টানে জাগলো বালিয়াড়িঃ ফিরবে জোয়ার শামুক গেল ভুলে”। তবে একই রকমের ভাবনা নিয়ে লেখা পরপর তিনটে কবিতার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে ‘শামুক’ কবিতার দুটো পংক্তির কথাঃ “শামুক ছাড়া জলের চিহ্ন খুঁজে বেড়ায়, কে আর বলো স্বপ্ন রাখে পায়ের তলায়”। কবিতা মনের কথা বলে। তাই ‘কী যায় আসে’ কবিতায় কবির যে উষ্মা প্রকাশ পেয়েছে তার কারণ পাঠকের অনেকেই হয়তো সহজেই বুঝে নেবেন। এই গুচ্ছের সবগুলো কবিতাই যেন কেমন একটা মায়াবী আবেদন রেখে শেষ হয়েছে। যেমন ‘উঠোন’ কবিতার শেষ দুটো পংক্তির কথাঃ ‘সাক্ষী উঠোন কান্না রাখে চেপে, রোদটি এখন শুধুই আনমনা’। আর ‘অমসৃণ’ কবিতার শেষ কথাগুলোঃ ‘জল অমসৃণতা ঢেকে দেয়, গভীরতাকেও। এমনি নিয়তি’ এক অপূর্ব দর্শন। সবকিছুর শেষে এসে যেন একটু তাড়াহুড়ো হয়ে থাকে। ষষ্ঠ গুচ্ছের প্রথম কবিতাটা পড়ে আমার সেরকমই মনে হলো। তবে না, তার পরের কবিতাটিতেই-‘সেই বনলতা, এলো চুলে’ একটা চমৎকার ছন্দময় গতি এসেছে। ‘পাঁজর’ কবিতার শেষ চরণে “জাম গাছে কি আঙুর ফলে” এর জায়গায় “আম গাছে কি আঙুর ফলে” দিলে হয়তো অনুপ্রাসের মিল হতো। আর ‘হয়তো কিছু নয়’ কবিতায় দেশের তৎকালীন পরিস্থিতির কিছু চিত্র পাওয়া যায়, তবে বক্তব্যটা আরেকটু বলিষ্ঠ হলে চমৎকার হতো।

কবিতার অঙ্গণে কবিকে জানাই সুস্বাগতম! প্রথম কবিতার বই প্রকাশ উপলক্ষে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। প্রথম প্রকাশেই বই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হয়েছে, একজন কবির কাছে এর চেয়ে সুখকর ব্যাপার আর কী হতে পারে? জীবনের যে পথে কবি গুলতেকিন খান হেঁটে চলেছেন অবিরাম, তার কথা বইটি পড়ে জানলাম। কবিতার পথেও তাঁর হাঁটাচলা অব্যাহত থাক অবিরাম, আর তা হোক নিখাদ আনন্দময়, ফলপ্রসূ। সে আনন্দ ডালপালা ছড়াক পাঠক মনেও।

ঢাকা, ০৩ মার্চ ২০১৬
(ইতোপূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত)

12791118_10153313784752623_3171502225504896001_n

12733995_10153298951707623_4185257120598329520_n

12734197_10153298951772623_5725005914586727012_n

12795463_10153313784682623_2212624661579054263_n

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।