হালিমা ম্যাডাম ও আলিমুজ্জামান স্যার


সবাই আমাদের ব্লগ পড়ে হয়ত ভাবছে আমরা স্যার-ম্যাডাম দের দেখতেই পারিনা। কলেজে এমন কিছু স্যার-ম্যাডাম পেয়েছি যা পেয়ে আমি গর্ব করি। এদের একজন হালিমা ম্যাডাম। ওনার আলাদা কোন টিজ নেম ছিলনা। ওনার টিজ নেম একটাই ছিল হালি মা। কোথা থেকে যেন শুনেছিলাম ওনার ৪ কন্যা ।৪ কন্যার মা হিসেবেই হালি মা নাম এর উৎপত্তি। তারা সবাই নাকি গার্লস ক্যাডেটে পড়ে। ওনারা যদি এই লিখা পড়ে তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে সত্যি কথা হল ম্যাডামকে অপছন্দ করে এমন ক্যাডেট আমি দেখিনি। আর ঐ টিজ নেমটা দিতে হবে বলেই দেওয়া। ম্যাডাম আমাদের ক্লাস নিতেন না। আমরা তখন ১২ এ এবং একেবারে পরীক্ষা সামনে। আমি তখন সারারাত পড়ি আর সকালে ব্রেকফাস্ট করে এসেই একটা ঘুম দেই। ব্রেকফাস্ট করে ডাইনিং হলে আর থাকিনা। খাওয়া শেষ হওয়ার বেল বাজার সাথে সাথে বের হয়ে যাই। (আমি আবার একটা ছোটখাট প্রিফেক্ট ছিলাম। কি ছিলাম লজ্জায় বলতে পারছিনা যারা আমার কলেজের তারাই শুধু বুঝবে লজ্জাটা কেন সেটা নিয়ে আলাদা লিখব।) তো সেদিন আমি এসে শুয়ে পড়েছি কম্বল মুড়ি দিয়ে। হাউসের ভিতর দিয়ে আমাদের একাডেমী ব্লকে যাওয়া যেত আমার রুমটা সেই পথেই পড়ত। তো সবাই তখন সবে ডাইনিং হল থেকে বের হচ্ছে, সেদিন কেন যেন সবাই হাউসের ভিতর দিয়েই একাডেমী ব্লকে যাবে হয়তবা বৃষ্টি হচ্ছিল। হালিমা ম্যাডাম যাওয়ার সময় দেখলেন আমি শোওয়া এবং প্রায় ঘুমে ঢলে পড়েছি। আমার রুম মেট তখন রুমে এসেছে। ম্যাডাম রুমে ঢুকলেন। এসে ওকে জিজ্ঞেস করছে ওর কি হয়েছে নাস্তা খেতে যায়নি? শরীর খারাপ? আমি শুনছি কিন্তু ঘুমের ভান করে আছি। ও বলল না ম্যাডাম ও তো রাত জেগে পড়েছে নাস্তা খেয়ে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ম্যাডাম আমার পাশে আসলেন এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, ” আহারে ছেলেগুলা বাসায় থাকলে মা না জানি কত আদর করে দিত পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেছে”। আমি জেগে থেকেও ম্যাডামের আদরটুকু নিলাম। আমার মনে হচ্ছিল সময়টা আরো অনেকক্ষণ থাকুক। আজও আমি এই কথা মনে পড়লে ম্যাডাম এর সেই আদরটুকে অনুভব করি। ম্যাডাম, যেখানেই থাকুন অনেক ভাল থাকুন।

আলিমুজ্জামান স্যার। আমার যা কিছু ছোটখাট সাফল্য তার জন্য আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। এমন কি আমি মনে করি স্যার যদি না থাকত আমি আজকে যতটুকুই এসেছি তা আসতে পারতাম না। আমরা সবাই স্যারদের টিজ করতাম। আলিমুজ্জামান স্যার এর ও অনেক টিজ নেম ছিল। তবে সবাই এটা বলতেই পছন্দ করত কামরুল তোর আলিমুজ্জামান স্যার। সেই আলিমুজ্জামান স্যার টিজ করতেন আমাকে। তিনি ক্লাসে এসে কখনো আমাকে কামরুল নামে ডাকতেন না। ওনার কথাটা কানে বাজে আমার, ” এই যে কামরুল, ভীমরুল, জামরুল ……”। ওনার রসগোল্লা গল্পের লেকচার শুনেই প্রথম আমার মনে হয়েছে বাংলাতেও লেকচার follow করার দরকার আছে এবং রূপক গল্প আসলে কি জিনিস।এসএসসির সময় আমাদের সবাইকে উনি জোর করছিলেন বাংলা নোট করার জন্য।কেউই ওনার কথায় কান দিল না। পাঞ্জেরী থাকতে আবার নোট। আমি নোট করলাম স্যারকে দেখালাম। উনি ঠিক করে দেন আমি আবার তা ফ্রেশ করি। এরপর এসএসসিতে মারলাম গোল্লা। বাংলা সাবজেক্টিভে আমি পেলাম ২৬ আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে কম। বাকি সবাই ২৯-৩০। কলেজে এসেছি এসএসসি তে আমাদের ক্লাসের রেজাল্ট ভালনা। যারা ক্যাডেট না তাদের জন্য রেজাল্ট ভাল কি খারাপ তা নির্ভর করে কতটা প্লেস আছে মেরিট লিস্টে এবং প্রথম দিকে আছে কিনা। সবদিক দিয়েই আমরা খুব করুণ অবস্তা। তাই সবাই আমাদের পিছনে খালি গুতায়। লোকনাথ বসাক স্যার আমাকে ডেকে প্রথম দিন বললেন কামরুল তোমার লজ্জা করল না কলেজে আসলা যে। শুনে যাই আর উদাস হয়ে পড়ি। পড়ালিখা করব বলেও চিন্তা করিনা। আমি আবার ১১ এর প্রথম টার্মে কোন বই খাতা না কিনেই কলেজে চলে গেছিলাম। কারণ জানতাম না ওইদিনই যেতে হবে কলেজে। সকালে খবর পেয়েছি আজকেই কলেজে জয়েন। রাতের বেলা ট্রেন ধরেছি। তাই সারাদিন আড্ডা মারি ১২ এর সাথে। গেমসে খেলে এসে ক্যান্টিনের সামনে বসে থাকি আর প্রেপে গল্প করি। সেই টার্ম তেমনই গেল। সেই টার্মের লাস্টের দিকে কিংবা পরের টার্মের প্রথম দিকে এক বৃহস্পতিবারে আলিমুজ্জামান স্যার আমাকে ডাকলেন হাউস অফিসে। আমি তখন ক্রিকেট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মনে হয় ক্যান্টিন ক্রিকেট। স্যার ডাকলেন আমাকে ২ ঘন্টা লেকচার দিলেন। আমি শুনে গেলাম মাথা নিচু করে। আমাকে বুঝালেন এসএসসি তে খারাপ করার কত হাজার কারণ থাকতে পারে। বাংলায় আমার খারাপ মার্ক পাওয়া মানে যে বাংলা পড়ে কোন লাভ নেই এমন কোন কথা নেই। শুধু লেকচার দিলেনই না আমাদের কলেজের লিজেন্ড আশফাক ভাইয়ের উদাহরণ ও দিলেন উনিও এইরকম এসএসসিতে খারাপ করে নাকি আমার মতই হয়ে গেছিলেন। (যদিও আমি জানি স্যার ওটা আমাকে বুঝাবার জন্য বলেছেন কারণ আশফাক ভাই ওইরকম কল্পনাও করা যায়না)। আমি সেইদিন থেকে আবার ট্র্যাকে ফিরে আসলাম। শুরু করলাম বাংলা দিয়েই। সেই থেকে বাংলা নোট করতাম। স্যার কে দিতাম স্যার ঠিক করে দিতেন। আমি আবার লিখতাম। স্যার আমাকে লাইব্রেরীর বই এর নাম বলতেন সমালোচনা পড়তে বলতেন উপন্যাসের। সেগুলো থেকে নোট করতাম (তখন বুঝলাম নোট করা মানেই দুই-তিনটা নোট বই পাশাপাশি রেখে ভালো লাগা লাইনগুলা তুলে দেওয়া নয়)। স্যারকে দিতাম স্যার কম্পিউটার কম্পোজ করে এনে আমাকে দিতেন। আমার সেই নোটগুলা অসাধারণ ছিল আমি নিজেও অনেকদিন অবাক হয়েছি ওইগুলা আমার নোট! যদিও তার অর্ধেকই স্যার এর থেকে শোনা। আমি ইন্টারেও বাংলায় ভালো মার্ক পাইনি। যদিও আমার টেস্টের খাতা দেখে এক স্যার ওই খাতাটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন বলেছিলেন এইটা চোখের সামনে রাখবা এইরকম করে লিখতে পারলে ইন্টারে লেটার পেয়ে যেতে পার। (এখনকার পোলাপান বুঝবা না বাংলায় লেটার আসলে কি জিনিস ছিল আমাদের সময়)। আমি যদিও বাংলায় ভাল মার্ক পাইনি তবুও ওই নোট গুলা আমাকে যে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তার কোন তুলনা হয়না। রেজাল্ট কিরকম হবে সেটা চিন্তা করতে নিলে আমি যখন ভাবতাম বাংলায় আমি ১৫০ পেয়ে যাব তখনই আমার অন্যরকম গিয়ার চলে আসত। (হ্যাটস অফ

১১ টি মন্তব্য : “হালিমা ম্যাডাম ও আলিমুজ্জামান স্যার”

  1. কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

    আমি জানি না , যত ভাল স্যার বা ম্যাডামই হোক, আমাকে দেখলেই তাদের মত হত "এই পোলাডা একটা বদমাইশ"। তাই কলেজের কোন স্যারই আমার সাথে কোনদিন খুব একটা ভাল ব্যবহার করে নি। আর যারা ভাল ছিলেন, তারা খুব বেশি দিন ক্যাডেট কলেজে ছিলেন না। ধন্যবাদ। মনে হয় আমার চেহারাটাতেই শয়তান শয়তান ভাব আছে।

    একদিন এক স্যারকে সালাম দিয়েছিলাম, সাথে সাথে উনি আমাকে ধরে ঝাড়তে শুরু করলেন, কি মতলবে আসছ? আর চিকি পোলাপাইন গেলেই গলায় মধু ঝরে পড়ত

    সিটিসেলের ...." কি রেজওয়ান, লাঞ্চে নাকি..." টাইপ অবস্থা।

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    অনেক দিন পর এই লেখাটা আবার পড়লাম।তপু ভাই, আগামী পরীক্ষাগুলোতে এই লেখা আমাকে উৎসাহ দিবে, যদিও আমি আপনার মত ফার্স্ট স্ট্যান্ড করা "মানসিক রোগী"দের দলে পড়িনা :grr:

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।