বাইরে অনেকে জিজ্ঞেস করত কোথায় পড়ি, উত্তর যখন দিতাম প্রশ্নকর্তার সমীহ পেতাম। মনের অজান্তেই তৃপ্তি ভর করত মনে। আমি অন্যদের কথা জানি না কিন্তু আমার কথা বললে আমি বলব আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল টিভিতে ক্যাডেটদের ডিবেট দেখে আর প্রতি বছর এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি রেজাল্টের দিন পত্রিকায় ইউনিফর্ম পরা ক্যাডেটদের ছবি দেখে। ছোট্ট মনে কি খেয়াল হয়েছিল কে জানে? আমি মোটেও ভাল গোছের কোন ছাত্র ছিলাম না, মাঝারি গোছের চুনোপুঁটি ছিলাম। কেমনে কেমনে টিকে গেলাম। ক্লাস সেভেন, নতুন জায়গা, নতুন মুখ। কলেজের গেট থেকে যে ভাইয়াটি আমাকে নেমপ্লেট আর হাউস রিবন পরিয়ে বরণ করল তাকে নাকি গাইড বলে, আমি অবাক। জানতাম না আরও কত কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য। রুমে ঢুকে আমার ক্লাসমেটকে দেখিয়ে গাইড ভাই বললেন তোমার ছয় বছরের পরিবার। তখন বুঝি নাই কিন্তু এখন বুঝি। ক্যাডেট কলেজের বেশিরভাগ কাজই আমার অর্থহীন লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে তার-ই বড় বড় অর্থ বের হতে লাগল। আমি অলস প্রকৃতির ছেলে, সেই আমি কিনা সকাল পাঁচটায় উঠে দৌঁড়াই!! আমি জুতার ফিতা বাঁধতে পারতাম না, সেই আমি জুতা কালি করি!! কাপড় ধোয়া যে কত কষ্টের তা আমি ক্যাডেট কলেজে গিয়ে টের পেয়েছি। ক্যাডেট কলেজে না গেলে এগুলোর সাথে পরিচয় হতে হয়ত আরও দেরি হত কিংবা কে জানে আদৌ পরিচয় ঘটত কিনা।প্রথম দিনেই আমার গাইড ভাই তালিম দিলেন চেক মারার, আমি অল্প কিছু দেখেছিলাম আগে তাই রক্ষা। এরপর পানিশমেন্ট এর তালিম। পানিশমেন্ট খাওয়া যত না কষ্টের তার চেয়ে হাজার গুন কষ্ট শিখায়। ভিন্ন মানসিকতার ভিন্ন পরিবেশের ভিন্ন ৫১ টি ছেলের সাথে পরিচয়, তখন কি কেও জানত সবার মানসিকতা এক হয়ে যাবে ৬টি বছরের ব্যবধানে। ক্লাস সেভেনের এক একদিন যায় আর আমার অবাক হবার সীমানা বাড়তে থাকে। হাউস ষ্টাফের চিল্লানি কিংবা সিনিয়রের ঝাড়ি বড় সয়ে যায় আস্তে আস্তে। আমার কল্পনার ক্যাডেট কলেজের সাথে যেন বড্ড বেমানান এই ক্যাডেট কলেজ। আসলেই কি সত্যি আমি যা শুনেছিলাম বা দেখেছিলাম ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে? কই সবাই ত দেখি সারাদিন দৌঁড়ের উপরে, তাহলে টিভিতে যে দেখতাম কিংবা পত্রিকার ইউনিফর্ম পরা সেই ছবি। মনের প্রশ্নগুলো ডালপালা গজায় আর আমি যথারীতি প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফট-রাইট, জোরসে পা মারি, ঘাম ঝরাই। যে যত ঊপরে পা উঠাতে পারে সেই-ই হিরো। নাহ আমি মেলাতে পারছি না, এ কই আসলাম আমি। পরের বছরেই ক্যান্ডিডেটস ভাইদের রেজাল্ট দিল, আমি অবাক!! কিভাবে পারে? সারাদিন ত দেখলাম করিডোরে ক্রিকেট খেলতে আর লাইটস আউটের পর ফাজলামি করতে, তাহলে এগুলা কারা? সময় যায় আর কাঁধে একটা করে দাগ বাড়তে থাকে, আমার কল্পনার হিরোগুলোকে আমার আশেপাশেই আবিষ্কার করি। ক্যাডেট সব পারে। নতুন ক্লাস সেভেনের কাউকে দেখলে ভাবতে থাকি এও কি আমাদের দেখে অবাক হয়। কলেজের শেষ সময়ে মনে হতে থাকে সময় কি আমাদের ফাঁকি দিল? এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। কলেজের প্রতিটা ইঞ্চি আমার জানা ছিল। এখনও চোখ বন্ধ করে ঠিক জায়গায় চলে যেতে পারব। অনেক কিছুই মনে নাই কিন্তু কলেজের কোথায় কি আছে না আছে তা ভুলিনি। কলেজে অনেকের উপর অনেক রাগ ছিল কিন্তু সত্যি করে বলছি তার একটাও এখন মনে নেই। লাভ-ক্ষতির হিসাব করাটা অনেকটা অন্যায্য আমার কাছে। আমি অনেক কিছু পেয়েছি ক্যাডেট কলেজের কাছে। ৫১টি জিগরি, কিছু স্নেহপ্রবন মুখ, চাপের সাথে বসবাস, এভাবে লেখতে থাকলে শেষ করা যাবে না। আমার এখানে আসার পিছনে আমার কলেজের অবদান আমি অস্বীকার করতে পারি না। অনেক চিন্তা করেও কোন ক্ষতি খুঁজে পেলাম না। আপনারা হয়ত হাজার ক্ষতি বের করবেন কিন্তু আমি একটাও স্বীকার করব না। আপনারা আমাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলবেন, তা বলেন কিন্তু আমি তারপরেও বলব ক্যাডেট কলেজ ক্ষতিকারক না, লাভজনক।
৯ টি মন্তব্য : “লাভ ক্ষতি”
মন্তব্য করুন
ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে যা করে তাকে আমি বলবো মানুষের অভিযোজনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। কলেজে যে পড়েনি তার পক্ষে এর কিছুই বোঝা সম্ভব না। এই অনন্যসাধারণ অভিযোজনের স্বাক্ষর এক্স-ক্যাডেটদেরও রাখা উচিত। উচিত বলা ঠিক হবেনা। স্বাক্ষর তারা রাখবেই। লেখাটা পড়ে এই কথাগুলোই মনে হল।
চালায়া যা..........
ভাল লাগলো।ক্যাডেট কলেজে পড়ার কিছু নেগেটিভ দিক হয়তো আছে।কিন্তু ভাল দিকের পরিমাণ এত বেশি যে সেগুলো বিবেচনায় না আনলেও বোধহয় চলে...
......কাঁধে একটা করে দাগ বাড়তে থাকে, আমার কল্পনার হিরোগুলোকে আমার আশেপাশেই আবিষ্কার করি...।
very ok, very ok.
হাসনাইন ভাই কোথায় হারিয়ে গেলেন??????
সিসিবি ইজ মিসিং ইউ :(( :(( :((
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
ক্যাডা ছোট ভাইয়া? 🙂
😀 😀 😀
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
🙂
বহুতকাল পর এই লেখাটা পড়লাম। 😀
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সেই মধুময় দিনগুলি।