প্রতিবার চুল কাটাতে গিয়ে যখন সেলুনের চেয়ারে বসি, হাসিমুখে প্রশ্ন শুনি, কিভাবে কাটাবেন? আমি তখন ভীষণ বিপদে পড়ে যাই।
আমি আলাভোলা মানুষ নই। যদিও রঙ চং পছন্দ করি না, শুধু খানিকটা পরিপাটী থাকি। তবে সেই পরিপাটীত্বের সিলেবাসে আমার চুল নেই। চুলের জন্যে এমনকি চিরুনিও একটা বিলাসিতা যেন আমার কাছে, গোসলের পরে দু হাতের দশটা আঙুল দিয়েই কাজ চলে যায়। আলাদা ভাবে কখনোই ভাবা হয় না তাই চুলের চেহারা বা নক্সা কেমন হবে। আর সে জন্যেই প্রতিবার চুল কাটাতে গেলে কিভাবে কাটাবো, এই বহু পুরাতন প্রশ্নে আমি বারবারই নতুন করে বিপদে পড়ি।
কপালের ওপরে চুলের শেষ সীমানায় আমার একটা লুকোনো ঘূর্ণি আছে। চুল ছোট রাখি বলে বুঝা যায় না। ব্যাপারটা জিনেটিক, সন্দেহ নাই, কারণ আমার বাবা আর ভাইয়ের মাথায় ঘূর্ণিগুলো স্পষ্ট। আমারো চুল খানিকটা বড় হলেই এই ঘূর্ণির কল্যাণে চুলে নানারকম ঢেউ খেলে যায়। এই ব্যাপারটা এড়ানোর জন্যে ছোটবেলা থেকেই সিঁথি করি ডানদিকে, ঐ ঘূর্ণির অনুকুলে। মাথায় চুল খানিকটা বড় হলেই আমার তাই অস্থির লাগা শুরু হয়। গত কদিন যেমন হচ্ছিল, ঘাড়ের কাছে আর কানের ওপরে চুলবুল করছিলো, বুঝছিলাম সময় ঘনিয়েছে। আরও নিশ্চিত হলাম যখন আমার সহকর্মী পাঞ্জাবী ছেলেটা অবলীলায় আমার আঁকাবাঁকা চুল দেখে ঘোষণা দিয়ে বসলো, তোমাকে একদম অমিতাভ-যুগের সিনেমাগুলোর ভিলেনের মত লাগছে!
আমি সেদিনই সেলুনে দৌড়ালাম। এবং গিয়ে সেই পরিচিত প্রশ্নের উত্তরে বললাম প্রায় দেড় যুগের অভ্যাসে তৈরি হওয়া উত্তর, পেছনে আর দু’পাশে অনেক ছোট, আর সামনে অল্প ছোট।
হু, এটাই আমার এক ও অদ্বিতীয় চুলের কাট।
আমার জন্যে অবশ্য এই অভ্যাসটা কখনোই কষ্টকর হয়ে ওঠে নি। বরং সেভেনে উঠে যখন হস্টেলে চলে গেলাম, সেখানে নিয়ম ছিলো, মাসে দু’বার মাথায় বাটি বসিয়ে চুল ছেটে ফেলা হবে। সত্যি সত্যিই বাটি বসানো হতো না অবশ্য। তবে কলেজ থেকে ঠিক করে দেয়া নাপিতদের হাতের দক্ষতা ছিলো ঈর্ষণীয়। বাটি না বসিয়েই তারা মাথার চারপাশে ঠিক সেরকম একটা ছাঁট করে দিতে পারতো।
জুনিয়র ক্লাশে থাকতে সেসব নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিলো না, আপত্তির সুযোগও ছিলো না অবশ্য। তবে খানিকটা সিনিয়র হবার পরেই আমাদের মধ্যে চেষ্টা ছিলো, চুল কেমন করে খানিকটা বড় রাখা যায়। ছুটি শেষে কলেজে ফিরবার সময় কর্তৃপক্ষকে লুকিয়ে কিছু টাকা নেয়া হতো, তার একটা অংশ অবশ্যই বরাদ্দ থাকতো সেই নাপিতের জন্যে।
সরকারী কর্মচারীকে ঘুষ দেয়ার অভ্যাসটা অনেকে ছোটবেলায়ই রপ্ত করে ফেলেছিলাম আমরা!
মাঝে মাঝে টাকা পয়সার টানাটানি থাকলে শ্যাম্পুর বোতল অথবা আধ-ব্যবহৃত আফটার শেভ দিয়েও কাজ চলে যেত।
আরেকটু বড় ক্লাশে উঠার পরে আমরা আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের ক্লাশের দুজন কেমন করে যেন এক ছুটিতে বাসায় গিয়ে চুল কাটাবার ট্রেনিং নিয়ে এলো। ব্যস, তখন আর আমাদের পায় কে? লুকিয়ে চুরিয়ে একটা চুল কাটাবার মেশিনও চলে এলো। তারপর থেকে চুল কাটাবার সময় এলে আমরা নিজেরা আলাদা একটা রুমে ঐ দুই বন্ধুর হাতেই চুল কাটিয়ে ফেলতাম।
সবসময়েই যে পার পেয়ে যেতাম এমন নয়, তবে যে কবার যেতাম, সেটুকুই লাভ ছিলো!
ঐ ছয়বছরে আমাদের চুল কাটা নিয়ে হাজারখানেক আনন্দ বেদনার স্মৃতি, লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে নির্ঘাৎ।
চুলের প্রতি অবহেলার অভ্যাসটা পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিলো সেই সময়েই। হোষ্টেলে যাবার সময় আর সব জিনিসের সাথে একটা চিরুনীও কিনতে হয়েছিলো মনে আছে, কিন্তু ছ’বছর শেষ করে যখন চলে আসি ওখান থেকে, তখনও সেই চিরুনী ছিলো নতুনের মতই ঝকঝকে!
চুল নিয়ে সর্বশেষ কান্ড ঘটলো বছরখানেক আগে।
এক সপ্তাহ পরেই আমার বিয়ে। হবু বউ চুল নিয়ে আমার উদাসীনতা বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তাই বিবাহ-পূর্ব চুল কাটানোর যখন প্রয়োজন দেখা দিলো, আমি পাড়ার মোড়ের কোন সেলুনটা সবচেয়ে দ্রুত এই ঝামেলা শেষ করে সেই খোঁজ নেয়া শুরু করলাম, কিন্তু আমার হবু বউ জানালো, অসম্ভব, এবারের চুল কাটাতে হবে হাবিব পারসোনায়, এবং তার অত্বাবধায়নে থাকবেন কর্ত্রী স্বয়ং!
মূর্খ আমি, হাবিব শুনেই বুঝি এক হাবিবুল বাশার। সে বেচারার চুল কি রকম থাকে মনে করতে পারলাম না, তার নাম দিয়ে বানানো সেলুন কেমন হবে? কিন্তু এ কথা আর বাড়ানো গেল না, তার আগেই বউয়ের ঝাড়ির সহযোগে আমি জেনে গেলাম, এই হাবিব হাবিবুল নয়, আরো হাবিব আছে।
তো গেলাম চুল কাটাতে। ওদের ঝকমকি চেহারা দেখেই বুঝে গেছি, লম্বা সময় আমাকে নাপিতের ছুরির নিচে মাথা পেতে রাখতে হবে। দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে অবশেষে বসলাম চেয়ারে। আর তারপরে শুনলাম সেই অমোঘ প্রশ্ন, কিভাবে কাটাবেন?
আমি আমতা আমতা করে কিছু বলবার আগেই দেখি আমার বউ এসে হাজির। উনি আধা-গম্ভীর আধা-হাসি মুখে যেই নির্দেশনা দিলেন, তাতে আমার আক্কেলগুড়ুম! কোথায় কিভাবে কেমন কাট হবে, তার উপসংহার টানা হলো এভাবে, ‘ মানে, স্বদেশ সিনেমায় শাহরুখ খানের যেমন কাট ছিলো, সেরকম আর কি!’
আমি লজ্জায় চেয়ারের সাথে মিশে গেলাম প্রায়। কিন্তু আমার বউ দেখি একেবারে নির্লিপ্ত, এমনকি ওই নাপিত সাহেবও। বুঝলাম, এইরকম উচ্চাভিলাসী নির্দেশ তারা গরবিনী হবু-বউদের কাছ থেকে নিয়মিতই পান।
চুল কাটা শুরু হলো। এত ধীর তার গতি আর এত মোলায়েম স্পর্শ যে অচিরেই আমি ঝিমুনিতে আক্রান্ত হলাম। লম্বা সময় বাদে যখন একটা প্রায় সফল ঘুম শেষ করে এনেছি, তখন জানলাম আমার চুল কাটাও শেষ। নাপিত আর হবু বউয়ের মুখের বিস্তৃত হাসি দেখেই বুঝলাম ব্যাপারটা তাদের একদম মন মত হয়েছে। তাই হোক, আমার এত মাথাব্যাথা নেই, শেষ হলেই আমি খুশি।
আয়নার দিকে আমার কেমন জানি একটু সন্দেহ হলো। না, ঠিকই আছে, পুরোনো সিনেমার ভিলেন থেকে আমি রাতারাতি শাহরুখ খান হয়ে যাই নি, তবে কোথাও কি যেন গোলমাল আছে। ঠিক ধরতে পারছি না।
ভালো করে তাকাতেই হঠাৎ টের পেলাম, কি সাঙ্ঘাতিক, ব্যাটা আমার সিঁথি বদলে দিয়েছে!! ডানের বদলে বাম দিকে জ্বলজ্বল করছে সিঁথি!
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এটা কোন কথা? আরে একবার আমাকে জিজ্ঞেসতো করবি?
আমি কড়া গলায় জানালাম, কেন এরকম হলো? নাপিত সাহেব মিনমিন করে কি যেন বললেন, আমার কানে গেলো না। আমি রাগে ফুঁসছি। বউ অবশ্য খুশি, চুলের নকশা তার পছন্দ হয়েছে, সে-ই আমাকে টেনে নিয়ে এলো।
লিফটে করে নীচে নামা পর্যন্ত দাঁত মুখ খিচে অপেক্ষা করলাম। সিএনজি ট্যাক্সি ডাকতে ডাকতে যেটুকু সময় লাগে, ওটায় চড়ে বসে আর দেরি করলাম না। ‘ধ্যুত্তোর নিকুচি করি’ – এই বলে দুহাতের আঙুল ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চালিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেকের শিল্পের বারোটা বাজিয়ে দিলাম। দশ সেকেন্ডের চেষ্টায়ই আমার চির অনুগত চুল কথা শুনলো, সিঁথি ডানদিকে চলে এলো নিমেষেই!
পাশে বসা আমার হবু বউ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, তার চোখে কিং খানকে হারানোর বেদনা!
‘আমি নিজেও খুব দুঃখিত’- মুখে এরকম একটা ভাব এনে তাকে বোঝাতে বোঝাতে চললাম। আর খানিক বাদে বাদেই আড়চোখে ট্যাক্সির রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে সেই চিরচেনা ডান দিকে সিঁথিওয়ালা আমাকে দেখতে পেয়ে মনে মনে বলছিলাম, আহ, কি শান্তি!
ক্যাডেট কলেজ ব্লগ তৈরির অনেক আগের লেখা এগুলো। মুলত সচলায়তনের জন্যে লেখা। ভাবলাম, এখানে আবার তুলে দিই।
brother ki ccc er naki....chobite mone hoi sharif r monjur ke dekhlam..nyway congratulation for getting married..
আদনান ভাই, কনফু ভাইও কিন্তু অস্ট্রিলিয়া থাকে...
মজা পাইছি। চুল কর্তন করতে পারত কে কে? জানতে ইচ্ছা করতেছে। শরীফ ভাই এখন কোথায়?
এই সব কিং খান এর কথা বলে তো বুকের ভিতর টা খান খান করে দেন 🙁
চুলোচুলি ঘটনা আমাদের বেলায়ও অনেকটা একই রকম।আমাদের ব্যাচ এ নাপিচ ছিল দুইজন।এবং দুজনই ছিল আমার রুমমেট।এবং দুজনই বর্তমানে হাটু বাহিনীতে কর্মরত।
আমাদের ব্যাচেও ছিল...তবে তারা নিপুন কারিগর না...আমি একবার তাদের দিয়ে চুল কাটিয়ে তিনটা ইডি খাইছি...ঠাঙ্কু...
"কপালের ওপরে চুলের শেষ সীমানায় আমার একটা লুকোনো ঘূর্ণি আছে। চুল ছোট রাখি বলে বুঝা যায় না।"
আমারও সেইম কেইস।
jottil hoise mamu!
ছবি দিয়ে এর আগে কেউ এখানে ব্লগ দেয়নি। এ ধরণের ব্লগ এটি প্রথম। এর আগে অবশ্য একটি বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। আশাকরি অনেকেই ব্লগে ছবির ব্যবহার শুরু করবেন।
আর তারেক ভাই,
আপনার পরবর্তী ব্লগের অপেক্ষায় আছি কিন্তু।
ক্যাডেট...কেন নাপিত??
লিখাটা অনেক সুন্দর, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।
cumilla r tarek nare zihad porichoi nai..ccc er amader batch er onno onek polapan ke chini...dekhi khoj nibo
সবাইরে থ্যাংকু।
আদনান,
এমসিসি? মির্জাপুরের অনেকরে চিনি। তারমধ্যে তিনজন সম্পর্কে আমার ভায়রা-ভাই( বউয়ের বান্ধবী সুত্রে-)। আমাদের ব্যাচের রাজীব, মাজহার। আর এক ব্যাচ আগে সাকিব ভাই। আমারে অবশ্য চিনবার কথা না- নেভার গুড ইন এথলেটিক্স। 🙂
এই ছবিতে মঞ্জুর নাই। ইনফ্যাক্ট মঞ্জুর নামে আমাদের ইনটেকে কেউ নাই। শরীফ আছে অবশ্য।
ইশতিয়াক-
আমাদের হাউসে এক্সপার্ট ছিলো আশেক আর ফেরদৌস।
শরীফ এখন চাকরীজীবি, হোমরা চোমরা মানুষ। 🙂
shono dosto...monjur ta mone hoi mistake hoye gese...or name ta mone nai..o probably neavy te silo..sharif amar khub bhalo friend...amra aki sir er kase portam plus akshomoy or bashai prochur adda marsi....amar shathe dhor sharif, mashfiq, maruf, faisal, shahed,manna, arefin...racy(or cadet name mone nai)..vaire ar name mone portese na...bolte parish ccc silo amar nxt friend zone...nyway amar phone number hosse 61412516086..call me..valo thakish
কবে বিয়া করুম? ওয়া ওয়া....আর তো ভাল্লাগে না...আউয়া আউয়া...
ধন্যবাদ.... ঢিঁচ্চু...
আদনান দোস্তো,
রেসির ক্যাডেট নাম জুন্নুরাইন। আর নেভী... তাইলে মনে হয় তুই নাঈমের কথা বলতেছিস।
তুই দেখি আমাদের অনেকরেই চিনস। শাহেদতো এখন সিডনীতে থাকে, তুইও কি ওখানেই?
ছেলে ক্যাডেটদের বিলাসিতা ছিল চুল। কতভাবে, কত কসরত করে নাপিতকে ঘুষ দেওয়া হত কিন্তু সবকিছুর পরেও যেই লাঊ সেই কদু...the one and only bati chatt...কনফু ভাই আপনার চুলের উপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা বুঝতে পারতেসি। অতি উপাদেয় লেখনী...। খেয়ে মজা পাইলাম...।। :D(ঢেকুর)
onek boss lekha.chul katanor moto samanno ghotona apnar lekhonir choyai oshadharon hoye utheche.Tobe apnar ak chuler design a je vilen and king khan lukie achhe sheta sobche boss lagse.
haa dosto tarek (confucious) amio sydney tei asi...or name mone hoi morshed...nyway eita kono issue na...tui sydney te na???valo thakish dosto..
sobai sabdhan...........
samim chole asche...ei bar karo nistar nai.. 😀
hehehehe adnan and tareq .... shahed is here ...... khobor ki toder ??? t
tareq adnan hoilo amader ( full MCC er ) mama.... from mcc ...o jodio sydney te thake but amar shathe or dhaka tei beshi dekha hoito .....ami ore class 10 thake chini .....adnan kheyal ase dosto oi din gulir kotha .???shob amar bashae ki addai na ditam..hehehe....
adnan for ur information tareq re ami class seven thake chini ....hehehehehe ... aktuu boring jokes marlam .....hehehe.
ফাটানি লিখসেন তারেক ভাই :goragori: :goragori: :goragori:
দারুণ একটা লেখায় মন্তব্য করে গেলাম 🙂
ঐ