এক.
“পেয়ারা! ঝাল-মশলা দিয়ে পেয়ারা!” আজ সকালে অফিসে যাবার সময় রাস্তায় ফেরিওয়ালা এভাবেই ডাকছিল। পেয়ারা আমাদের দেশের একটি অতি পরিচিত ফল। এই ফল নিয়ে অনেক সুখস্মৃতি আমার মনে এখনও গেথে আছে। তখন আমি এক ঝটকায় ১০ বছর পেছনে চলে গেলাম।
আমাদের ক্যাডেট কলেজগুলোর বিশাল আয়তনের কারণে প্রায় সবগুলো কলেজেই প্রচুর ফল গাছ বিদ্যমান। উদাহরণঃ আম, কাঠাল, জামরুল,পেয়ারা, আমলকী, জাম, ডাব, গাব ইত্যাদি। গাছ কলেজভেদে ভিন্ন হতে পারে। তেমনি আমাদের কলেজেও ২০০৪ সাল পর্যন্ত অডিটরিয়ামের পেছনে প্রায় ৫০টি গাছ নিয়ে এক বিশাল পেয়ারা বাগান ছিল। তাহলে বোঝা যায় ২০০৪ পর্যন্ত সব ইনটেকই কম-বেশি পেয়ারা বাগান থেকে পেয়ারার স্বাদ পেয়েছে।
আমরা যখন প্রথম সেই স্বাদ তখন আমরা ক্লাস নাইন। আমরা সবাই পেইনফুল আফটারনুন প্রেপের কথা জানি। সাধারণত গরমকালেই আফটারনুন প্রেপ হত। লাঞ্চের পর রেস্ট টাইমে একটু ঘুম সবারই ব্যাপক আনন্দ ব্যাপার ছিল। সেই ঘুম কাচা থাকতেই প্রেপের বেল দিয়ে দিত। যাইহোক এবার মূল কাহিনীতে আসি। তেমনই একদিন ক্লাসটাইমে খবর পেলাম পেয়ারা বাগানের পেয়ারা পেকেছে।
তো আমরা ক’জন প্ল্যান করলাম, প্রেপ শুরু হওয়ার ২০ মিনিট আগেই একাডেমিক ব্লকে চলে আসতে হবে শর্টকাটে। এখানে বলে রাখি, অডিটরিয়ামের পাশেই ছিল আমাদের একাডেমিক বিল্ডিং। আমরা চুপি চুপি পেয়ারা বাগানে এসে দেখি সেখানে একদল পেয়ারা চোর আমাদের আগেই চলে এসেছে এবং একের পর এক গাছের পেয়ারা সাফ করছে। আমরাও বিপুল উৎসাহের সাথে পেয়ারা সাবাড় করতে লাগলাম। হাফপ্যান্টের দুই পকেটে বড়জোর তিন তিন ছয়টা পেয়ারা ধরে। আমরা সবাই অগত্যা তাই নিয়েই প্রেপের জন্য ক্লাসে ফেরত চলে আসি।
ক্লাসে বসে বসে পেয়ারা চিবুচ্ছি আর মনে মনে আফসোস করছি, গাছগুলো ভরা পেয়ারা, গাছের নিচে পেয়ারা পড়ে আছে। কিন্তু আমরা প্রত্যেকে মোটে ৫-৬ টা করে পেয়ারা আনতে পেরেছি। সবাই বলাবলি করতেছি পেয়ারা মিশন বিফলে গেল। আমরা পেয়ারা শুধু নিজেরাই খাচ্ছি। অন্য পোলাপানদের কিছুই দিচ্ছি না। এটা আমাদের মিশনের ব্যর্থতা ছাড়া আরকি।
ইউরেকা! ইউরেকা! ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া মাথায় খেলে গেল। না, পলিথিন ব্যাগেও কাজ হবে না। আমাদের আরো বেশি চাই। পেয়ারা বাগানের সব পেয়ারা আমাদের চাই। তো যাইহোক পরদিন আবার আমরা প্রেপের আধাঘন্টা আগেই পৌছে গেলাম। গিয়ে দেখি পুরো বাগানে পোলাপাইন গিজগিজ করছে। সবাই গাছে উঠে বা নিচে দাঁড়িয়ে মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছে। তো আমরা ক’জন বীরের মত পকেট থেকে বালিশের ওয়াড় বের করলাম। তারপর সেটা ভরার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেটা ভরে পকেট থেকে আর একটা ওয়াড় বের করলাম। দুই বালিশের ওয়াড় ভরে আমরা ক’জন দিলাম দৌড়। আমাদের এই কাণ্ড দেখে বাকী যারা পেয়ারা খাচ্ছিল তারা মোটামুটি পেয়ারা খাওয়া বাদ দিয়ে হতভম্ব হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
দুই.
এখনই মনে পড়ে গেল কাঠাল খাওয়ার কথা। আমরা তখন ক্লাস ইলেভেন। এস এস সি এক্সামিনিরা পরীক্ষা শেষে বাড়ি চলে গেছে। ওদের রুমে তালা দেয়া। গরমকাল, গাছে কাঠালের মৌ মৌ গন্ধ। একদিন একটা কাঠাল এনে বাথরুমে বসে ১০-১২ হুটোপুটি করে পেটে চালান করে দিলাম। পরে সবাই মিলে প্ল্যান করলাম গাছের সব কাঠাল পেড়ে এক্সামিনিদের পরিত্যক্ত রুমে জমিয়ে রাখব। একটা করে পাকবে আর আমরা সাবাড় করব। আর ওদের রুমে রাখায় কেউ সন্দেহ করতে পারবে না কাঠালের গন্ধ কোন রুম থেকে আসছে।
তো আমরা তিনজন গ্রিল বেয়ে নেমে গেলাম তিনতলা থেকে কাঠাল গাছের উদ্দেশ্যে। আমরা খুব সম্ভবত ১৪টা কাঠাল গাছ থেকে কেটেছিলাম এ্যান্টিকাটার (ক্যাডেটদের কাটা-ছেড়ার সবছেয়ে কার্যকরী অস্ত্র) দিয়ে। তারপর আরও দু’জন করে নেমে গ্রিল বেয়ে ২তলা ও ১তলার সানসেটে অবস্থান নেয়। এরপর আমরা বেশ সহজেই কোন ঝামেলা ছাড়াই সবগুলো কাঠাল নিয়ে তিনতলায় পৌছে যাই।
এবার কাঠালগুলোকে এক্সামিনিদের একটা রুমে পাচার করতে হবে। কিন্তু দরজায় তো তালা দেয়া। ইন্টারমিডিয়েট ব্লকের রুমগুলোতে দুইপাশে দরজা থাকে। একটায় তালা লাগানো থাকে, আর একটা ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া থাকে। আমাদের মামুন সহজেই সেই দরজা দিয়ে অনায়াসে ভেতরে গলে যেত। সেভাবেই মামুন দরজার ওপাশে চলে গেল আর আমরা বাইরে থেকে কাঠালগুলো ভেতরে পাস করে দিলাম। আমাদের বারী আর ফাহিম দু’জনেই ডাইনিং হল থেকে লবণ নিয়ে এসেছিল। তো আমরা কাঠালগুলো পাকানোর জন্য তাতে লবণ আর কাঠি দিয়ে গোজ (কাঠাল পাকানোর একরকম পদ্ধতি) দিলাম।
এরপর আমরা ১০টি কাঠাল সাবাড় করে দিলাম পাচ দিনের মধ্যে। একদিন লাঞ্চের পর কাঠাল খাব ঠিক করেছি। সেইমত এক্সামিনির রুম থেকে কাঠাল আনতে গিয়ে মামুন দেখে ওই রুমের লকারে আর কোন কাঠাল নেই। আমাদের মনটা একটু খারাপ হল, খোজ লাগালাম কে এই কাজটা করতে পারে। পরে জানতে পারলাম যে আমাদের হাউস বেয়ারা আমাদের হাউস মাস্টার মান্নান স্যারকে নিয়ে বাকীগুলো নিয়ে গেছে। আসলে কাঠালের গন্ধ অনেক বেশি প্রকট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেয়ারা তার হদিস বের করতে পারছিল না। পরে বুঝতে পারে গন্ধটা ওই রুম থেকে আসছিল, তারপরই সে মান্নান স্যারকে নিয়ে কাঠালগুলো নিয়ে যায়।
তিন.
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কলেজে ফল দিত এমন একটাই আম গাছ ছিল। তো সবারই ওই গাছটার প্রতি নজর ছিল। আর গাছটাও ছিল এমন এক স্থানে যে সব হাউসের প্রায় সব রুম থেকেই গাছটা দেখা যেত। সহজেই কারো চোখ এড়িয়ে ওই গাছের আম খাওয়া সম্ভব নয়।
একদিন সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এমনই বৃষ্টি যে ১০ ফুট সামনে কি আছে দেখা যাচ্ছে না। তো ক্লাসে আমার সামনেই নিচতলার জাহাঙ্গীর হাউসের শামীম আর নাজমুল বসত। ওরা নিচুস্বরে কি যেন আলোচনা করছে। তো আমি ঘুমানোর ভান করে আস্তে করে কানটা পেতে দিলাম ওরা কি বলছে শোনার জন্য। আমি সব শুনতে পারি নাই, শুধু শুনলাম আম, বৃষ্টি, দেখতে পাবে না আর কিছু আবছা আবছা কথা। আমিও গিয়ে আমাদের হাউসের নাঈমকে জানালাম পুরো ব্যাপারটা। আমরা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দিলাম।
লাঞ্চের পর আমরা দু’জন গাছের কাছাকাছি জুনিয়র ব্লকে অবস্থান নিলাম। রেস্টটাইমের মাঝামাঝি সময়ে দেখতে পেলাম ওরা দু’জন বৃষ্টিতে ভিজে গাছের নিচে চলে এসেছে একটা বালতি নিয়ে। আমরাও তৎক্ষণাৎ বাথরুম থেকে একটা বালতি নিয়ে নিচে নেমে গেলাম পাইপ বেয়ে। গিয়ে ওদের চমকে দিলাম। পরে ওদেরকে জানালাম যে ওদের প্ল্যানের কথা আমরা আগেই জেনে গিয়েছিলাম। ওদের উপর কিভাবে নজর রেখেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরে ওদের বললাম একা একা হবে না। আম দুইভাগ হবে, না হলে ২তলার তিতুমীর হাউসকে খবর দিব বলে ভয় দেখালাম। ওরা সহজেই রাজী হয়ে গেল। আমরা দুই দল দুই বালতি আম নিয়ে যে যার হাউসের দিকে রওনা হয়ে গেলাম…………………………(চলতে থাকবে)
:clap:
নষ্টালজিক লেখা
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল আমি সেই ছয় বছরে ফিরে গেছি 🙂
'বালিশের ওয়াড়' পদ্ধতি আমরাও ব্যবহার করেছি, অনেক 🙂
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রথম পছন্দ ছিল অডিটরিয়ামের পাশে দুইটা গাছের পেয়ারা, প্রায় বিকেলেই ঐ গাছগুলোতে চড়ে পেয়ারা খেতাম। একদিন আমাদের 'ছোট ভিপি' নজরুল স্যারের হাতে ধরা পড়তে পড়তেও বেঁচে গেছিলাম উনি সাইজে ছোট হওয়ায় গাছের উপর আমাকে দেখতে পাননি বলে 😀
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
:pira:
:pira: :pira: :pira:
-আলীম হায়দার.1312.
Basketball ground er shamner aam gach er je bhoyonkor took alam hoito Sheita optional games er din basket ball die pere Khawar smriti mone porlo.