গোলকিপার আলিমুজ্জামান
“নবীন কিশোর
তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙ্গার মেঘলা আকাশ
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট
আর ফুসফুস ভরা হাসি
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা
রাত্রীর মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা।
…………………..
তোমাকে আমার তোমার বয়সী
সবকিছু দিতে বড় সাধ হয়” ।- (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
আমার অনেক দিনের ইচ্ছা নিজের সম্পর্কে লিখি। কোন অটোবায়গ্রাফি নয়, এমনিতেই নিজের সম্পর্কে প্যাচাল পারা!অথচ লিখতে গেলে প্রতিবারেই একটা অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে। যাদের সম্পর্কে আমি কখনই লিখতে চাইনি বা যাদেরকে আমি শুধুমাত্র নিজের ভেতরেই নিবিড় করে রাখতে চেয়েছি, তারা এসে প্রবলভাবে ভিড় করে আমার লেখার সকল ভাবনাগুলোকে ওলট পালট করে দেয়। যখন আমার লেখা শেষ হয় অথবা লেখার সময় শেষ হয় আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি আমি লিখেছি এমন একজন অথবা এমনদের সম্পর্কে যাকে/যাদেরকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি।
মানুষের শৈশবে বুদ্ধিলগ্ন বলে একটা সময় আছে বলে আমার মনে হয়, যখন মানুষ তার বুদ্ধি বা চিন্তা দিয়ে নিজকে, চারপাশের প্রিয়জনদেরকে, এমনকি তার ভাললাগার পরিবেশ প্রতিবেশকে চিনতে শিখে। এই সময়টা থেকেই হয়তবা তার স্মৃতির শুরু। এসময়েই আমি বুঝলাম আমার বাবা একজন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান হেড মাস্টার যাকে দেখলে তার ছাত্ররা শ্রদ্ধায় দূরের রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে। আমি বুঝলাম আমার মেঝো চাচা চান মাস্টার একজন বিখ্যাত ফুটবল রেফারী যার দৃষ্টিকে কোনদিন ফাঁকি দিতে পারেনি অফ সাইডে যাওয়া কোন স্ট্রাইকার, রাইট ফরওয়ার্ড অথবা লেফট ফরওয়ার্ড। আমি আরও বুঝলাম আমার ছোট চাচা নুরুজ্জামান একজন দুর্দান্ত ব্যাক প্লেয়ার এবং আলিমুদ্দিন ভাই একজন সর্বকালের সেরা একজন গোলকিপার!
আলিমুদ্দিন ভাইকে মাঠের বাইরে আমাদের বাড়িতেই বেশি দেখেছি আমি। আমাদের কাচারিঘরে ঝাড় কাঁটা স্কুলের খেলোয়াড়দের মিলন মেলা। সর্বক্ষণ ৫/১০ জন প্লেয়ার এখানে বসবাস করে, খাওয়া দাওয়া করে, আনন্দ ফুর্তি করে। আমার মেঝো চাচা চান মাস্টার এদের পৃষ্ঠপোষক। তার প্রবল নেতৃত্ব গুন দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন স্কুলের দুর্দান্ত ফুটবল দল যারা থানা, মহকুমা এবং জেলার (তখনও মেজর জিয়া বা এরশাদ সাহেবের সময় আসেনি)। তার দল থানা, মহকুমা এবং জেলার সীমানা ছাড়িয়ে ঢাকা বিভাগ আন্তঃ স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান দখল করে এসেছে। আলিমুদ্দিন ভাই আমার এই চাচার বন্ধু। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন, কেউ জানেনা। কিন্তু সত্তুরের দশকে ফুটবল যখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা তখন তিনি ঝাড় কাঁটা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতির দুর্ভেদ্য গোল কিপার। স্কুলের মতন এই সমিতিও তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার ভেতরে শ্রেষ্ঠ ফুটবল দল। বিপরীত পক্ষের খেলোয়াড় দল যত শক্তিশালীই হোক না কেন, আলিমুদ্দিন ভাইকে অতিক্রম করে গোলবারের ভেতরে বল ঢোকানোর সামর্থ্য তাদের নেই। শীর্ণ দেহের আলিমুদ্দিন ভাই যখন তার প্রবল ক্ষিপ্রতা নিয়ে গোল পোস্টের সামনে চলাফেরা করেন, বিপরীত পক্ষের খেলোয়াড়রা বুঝতেই পারেনা কতটা দ্রুততার সাথে কত বেগে বল ছুঁড়লে আলিমুদ্দিন ভাইকে পরাজিত করা সম্ভব। আলিমুদ্দিন ভাই যখন টাই ব্রেকারে ৫ টার মধ্যে ৩/৪ টা বলই বিদ্যুতের বেগে ফিরিয়ে দেন, এই এলাকার হাজার হাজার দর্শকের হৃদয় স্বর্গীয় আনন্দে দুলতে থাকে। পৃথিবীর কোন দুঃখ বেদনাই তখন তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনা। ঝাড় কাঁটা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি দলের খেলা মানেই আলিমুদ্দিন ভাইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য। আলিমুদ্দিন ভাই আমাদের বাড়িতেই থাকেন, খাওয়া দাওয়া করেন, বিকেলে স্কুলের ছেলেদের সাথে মাঠে নিজে প্র্যাকটিস করেন, নবীন প্লেয়ারদের প্র্যাকটিস করান। তার বাড়ি স্কুলের পশ্চিম পাশের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। এখানে তার পরিবার আছে, আমার বয়সী তার একটা ছেলেও আছে। আর আছে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান তার বাড়ির উঠোনে। মাঝে মধ্যে তিনি সেখানে কাজ করেন। এই কাজ দিয়ে তার সংসার চলে কি করে তা আমার জানা নেই।
আলিমুদ্দিন ভাইয়ের সাথে বিকেলে ফুটবল খেলতে খেলতেই আমিও একসময়ে ভাল খেলোয়াড় বনে যাই। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়েই আমাকে স্কুল দলের ব্যাক হিশেবে নির্বাচন করা হয়। ক্লাস সেভেনে আমি তদানীন্তন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে চান্স পাই। গ্রামের ছেলে হওয়াতে আমি কালচারাল পারফরমেন্সে খুবই দুর্বল। আমার পারফরমেন্স শুধুমাত্র খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে আমাদের কলেজ ফুটবল টিমের জন্য ঢাকার আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের জন্য কোচ আনা হয়েছে। তাসনিম ভাই (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তাসনিম) তখন আমাদের নজরুল হাউজের হাউজ ক্যাপ্টেন। আমার মনে হয় ক্যাডেট কলেজ তার মতন বহুমুখী প্রতিভা আর কখনই পায়নি। ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেট বল, ক্রিকেট, কবিতা আবৃতি, উপস্থিত বক্তৃতা, গান বাজনা, ছবি আঁকা সবকিছুতেই অনন্য! তিনি আমাকে কলেজ টিমের প্লেয়ার হিশেবে নির্বাচন করলেন। একদিন প্র্যাকটিসের ফাঁকে আমাকে বললেন, “ তোমার শ্যুট এর বেগ দেখে আমি অবাক। কার কাছ থেকে শিখেছ?” আমার সাথে সাথেই মনে পরে যায় আলিমুদ্দিন ভাইয়ের কথা! তিনি আমাকে নিয়ে প্রতিদিন খেলা শেষ হয়ে যাবার পর অন্তত ৫০ টা গোলপোস্টে শ্যুট প্র্যাকটিস করাতেন, যেখানে তিনি থাকতেন সেই দুর্ভেদ্য গোল কিপার হিশেবে।
আমি তখন সেনাবাহিনিতে ক্যাপ্টেন। চাকরি করি আর্মি স্ট্যাটিক সিগন্যাল ব্যাটালিয়নে। থাকি আর্মি হেড কোয়ার্টার অফিসার্স মেসে। আলিমুদ্দিন ভাই মাঝে মধ্যেই আমার কাছে আসেন। আমরা দুজনে মিলে নিবিড় আলাপে মেতে উঠি। তার ছেলের চাকুরি হয়েছে পুলিশে। ছেলে তাকে খুব একটা দেখাশুনা করেনা। ওদিকে আমাদের বাড়িতেও খেলোয়াড়দের মিলন মেলা ভেঙে গেছে। আমার মেঝো চাচা চান মাষ্টার স্কুলের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রাম্য সালিশের মধ্যমনি হয়েছেন। আমাদের স্কুলের সহকারী হেড মাষ্টার যিনিও একজন প্রবল খেলোয়াড় ছিলেন তিনি স্কুল ছেড়ে এসে ঢাকার সেগুনবাগিচা স্কুলের হেড মাস্টার হয়েছেন। আমার এখান থেকে আলিমুদ্দিন ভাই প্রায়ই তার বাসায় যান। তিনি একদিন আমাকে বললেন, “আলিমুদ্দিন কি তোমার কাছে যায় নাকি?” আমি হাঁ বলতেই তিনি বললেন, “তোমার কাছে সে টাকা পয়সা চাইলে দিওনা। অভাবে ওর স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। তার এই অযথা ঘুরে বেরানোর স্বভাব আমি পছন্দ করিনা”। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। ছোট বেলায় যখন আলিমুদ্দিন ভাই আমাদের বাড়িতে সারাদিন থাকতেন, খাইতেন-দাইতেন তখন তো কেউ তার স্বভাব নষ্ট হয়েছে একথা বলেনি!
একদিন ছুটিতে বাড়িতে যেয়ে স্কুলের মাঠে ছেলেদের কাছে শুনলাম আলিমুদ্দিন ভাই ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমাকে কেউই তার মৃত্যুর খবর জানায়নি, এমনকি আমার মেঝো চাচা চান মাস্টার অথবা ছোট চাচা এক সময়ের ব্যাক খেলোয়াড় নুরুজ্জামানও না !
– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
মন ছুঁয়ে গেল।
আসাদ ভাই,
একের পর এক মর্মান্তিক লেখা লিখে চলেছেন। বিষণ্ণতার সঙ্গে আপনার সখ্য। তাই না?
ভাই, খুব মনছোঁয়া লেখা।
আমার বেড়ে ওঠাও আপনার মতই এক ফুটবল-পাগল পরিবারে, তাই অনেক টুকরো ঘটনাগুলো কানেক্ট করতে পেরে ভালো লাগলো।
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
কষ্টের মেঘে ঢেকে গেছে সেই মাঠ
জীবনের ডিঙ্গি চাইলেই রাখবো বেঁধে,
আছে কি এমন ঘাট !
তার চেয়ে ভেসে যাক ভেলা
কিছুই না হয় আর ভাববোনা এই বেলা ...
~ মনটা তো দিলেন খারাপ করে ভাই ।
অপূর্ব কথন / কবিতা !
🙁
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
ধন্যবাদ