“ক্যাডেট” শব্দটা আমার কাছে “স্পেশাল ওয়ান” কিংবা “অনলি ওয়ান”

“ক্যাডেট” এই শব্দটাকে আমার কাছে মনে হয় – “স্পেশাল ওয়ান” কিংবা “অনলি ওয়ান”। ১১/১২ বছরের একটি কিশোর এর কাছে ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়াটা যেন আনন্দের এক বঙ্গোপসাগর । বাবা-মা’র হাসিমাখা মুখ, পাড়া-প্রতিবেশী সবার অগনিত প্রশংসা, বন্ধুমহলের সবার কাছে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির স্থানলাভ কিন্তু এত আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই চলে আসে কলেজে যাবার ডাক। মনের মাঝে হাজারো স্বপ্ন সাজিয়ে কোন এক সকালে ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে বাবা-মা-ভাই/বোন’কে সাথে নিয়ে সেই কিশোরের যাত্রা শুরু হয় ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্যে । কলেজ ক্যাম্পাসটা দেখে এক অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে তার, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে এবার বাবা-মা-ভাই/বোন’কে বিদায় জানানোর পালা। বুক ভাসানো কান্না, আর বাবা-মায়ের স্বান্তনাকে স্বম্বল করে এবার শুরু হয় এক নতুন জীবন, যেখানে তার পরিচয় শুধুই একজন ক্যাডেট… একদমই অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা, ডাইনিং হলে বেয়ারা চামচ-কাঁটাচামচগুলোকে সামলে কিছু খাবার মুখে চালান করা, পিটি-প্যারেড এর মত ঘাম ঝরানো জিনিসের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে অবিরাম বাম-ডান-বাম করে চলা, ক্লাস ইলেভেন/টুয়েলভ এর সিনিয়রদের ডাকে সাড়া দিয়ে গান-কবিতা-অভিনয় এর পরীক্ষা দেয়া, রুম-লিডার/গাইডের একান্ত বাধ্যগত হয়ে চলা আর অ্যাকাডেমিতে স্যারদের ক্লাসগুলোতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টায় খান্তি দিয়ে কখনও কখনও ডেস্কের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া । এইসব গৎবাঁধা নিয়মে হাঁপিয়ে উঠে কখনওবা ক্যাডেট জীবন’কে বড্ড একঘেয়ে মনেহয় সেই কিশোরের কাছে । তবুও মা’কে চিঠি লিখে জানায় – “মা, আমি অনেক ভালো আছি” । দিনের পর দিন কেটে যায়, একসময় নভিসেস প্যারেড শেষ করে সে মিশে যায় ক্যাডেট কলেজের মূল স্রোতে । ধীরে ধীরে ভোরে ঘুম থেকে উঠা, পিটি কিংবা ড্রিল করা, ব্রেকফাস্ট, অ্যাকাডেমিতে ক্লাস করা, লাঞ্চ শেষে হাউসে ফিরে ক্লান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নেয়া, বিকেলের আফটারনুন প্রেপ, গেমস, টি-ব্রেক, ইভিনিং প্রেপ, ডিনার, নাইট প্রেপ, রাত ১০:৪৫ মিনিটে লাইটস অফ করে ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া… এই ছক বাধা জীবনের ছন্দে মিলিয়ে নেয় তার আপন জীবন । সময় এগিয়ে চলে তার নিজের মতো করে । যে কলেজকে প্রথম দেখে বড্ড অচেনা মনে হয়েছিলো, সেই কলেজ ক্যাম্পাস, তার নিজের ব্যাচের বন্ধুগুলোই হয়ে ওঠে তার জীবনের প্রতিটি সুখ-দুঃখের সাথী । স্কুল জীবনে যে কিশোরের কথায় ছিল লাজুক ভাব, ক্যাডেট কলেজে এসে সেই হয়ে ওঠে বেশি বেশি কথা বলে আড্ডা জমানোর স্পেশালিষ্ট । গ্রাম কিংবা ছোট্ট শহরের পুকুর দাপিয়ে বেড়ান ছেলেটি একসময় হয়ে ওঠে কলেজের সেরা সাঁতারু । যে ছেলে বাবা-মা’র হাজার বকা খেয়েও সারাটা বিকাল কাটাত খেলার মাঠে, সে একসময় হয়ে যায় একজন আন্তঃহাউস প্রতিযোগিতার সেরা অ্যাথলেট । কলেজে ক্লাস সেভেনের ক্যাডেটরা গেমস টাইমে আর যেকোনো খেলার চেয়ে বেশি খেলে ফুটবল, এক মাঠে ক্লাসের সবাই মিলে সেই খেলাতেও মিশে থাকতো অকৃত্তিম আনন্দ। আমার মনেহয় ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনের সাথে সবচাইতে ভালো সম্পর্ক থাকে ক্লাস টুয়েলভ এর, যেকোনো সমস্যায় তারাই এগিয়ে আসেন এই সবচাইতে জুনিয়র ক্যাডেটগুলোর সাহায্যে, তাইতো সব ক্লাস সেভেনই তাদের সময়কার ক্লাস টুয়েলভ এর ক্যাডেটগুলোকে মনে রাখে জীবনের লম্বা একটা সময় । এক-একটা টার্ম পার হয়ে এই ক্লাস সেভেনের ক্যাডেটগুলোও একসময় উঠে যায় ক্লাস এইটে । কলেজে আসে একদল নতুন ক্লাস সেভেনের ক্যাডেট । একদিন যার নিজের কাছে ডাইনিং এর চামচ-কাঁটাচামচগুলো সামলানো ছিল প্রায় অসাধ্য সাধন, একসময় সেও দায়িত্ব নেয় তার জুনিয়রদেরকে সেই অসাধ্য সাধনের চেষ্টায় সফল করার । একটি একটি করে বছর পার হয় আর সেই কিশোরটিও শিখতে থাকে ক্যাডেট জীবনের কত শত নিয়ম, পার হয় অগনিত প্রতিবন্ধকতা । আর সব মানুষের মত ক্যাডেটদের জীবনেও থাকে উত্থান-পতন, আসে খারাপ সময় । কিন্তু এই ক্যাডেট জীবনে সেসব খারাপ সময়গুলো হয় খুব গভীর হতে পারেনা একদল বন্ধুর কারণে । যত কষ্টই মনের মাঝে আসুক না কেন সব নিমেষে হারিয়ে যায় এইসব অকৃত্তিম বন্ধুদের বন্ধুত্বের ইন্দ্রজালে, আসলেই আমরা ক্যাডেটরা খুব ভাগ্যবান… যাই হোক সব ক্যাডেটের কাছেই ক্লাস ইলেভেন এর সময়টা অনেক স্মৃতিময়, হতে পারে সেটা ক্লাস ইলেভেনের এই সাত দিনের শিক্ষা-সফর কিংবা সবক্ষেত্রে অবারিত স্বাধীনতার জন্যে । দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় ক্লাস ইলেভেনের সোনালি দিনগুলো, আসে ক্লাস টুয়েলভ এর সেই চির আরাধ্য সময় । যেন চোখের পলকে পার হয়ে যায় সেই চির আরাধ্য সময়টা, একসময় শেষ হয়ে আসে ক্যাডেট জীবন । ক্লাস টুয়েলভ এর ক্যাডেটগুলোর কাছে মনেহয় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো “ক্যাডেট লাইফ” । মনে মনে ভাবে এইত সেদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রথম কলেজে এসেছিলাম, স্টাফদের কাছে সারাটা দিন ঘাম ঝরিয়ে শিখেছিলাম ড্রিল, গভীর রাতে বালতিতে মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে পার্টি’র আয়োজন, কারনে-অকারনে স্টাফদের হাতে নাম নোটের পুরস্কার হিসেবে এক্সট্রা ড্রিল, শীতের সকালে হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্টের উপর পাতলা খাকি সোয়েটার পড়ে পিটি করা – এমনিভাবে উঁকি দেয় আরও কত স্মৃতিরা । উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে অশ্রুসজল চোখে তারা বিদায় নেয় এত দিনের চেনা, ভালবাসায় ঘেরা ক্যাডেট কলেজ থেকে । এগিয়ে যায় নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে, পেছনে পড়ে রয় চেনা সেই বাস্কেটবল, ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মাঠগুলো, কলেজ অডিটোরিয়ামের স্টেজটা কিংবা সেই চিরচেনা অ্যাথলেটিক্স গ্রাউন্ডের ট্র্যাকগুলো, যেখানে একদিন তারা ধুলো উড়িয়ে মাতিয়েছিল মাঠ । শেষ হয় ক্যাডেট জীবন, গায়ে লাগে এক্স-ক্যাডেটের ছাপ কিন্তু চির অটুট থাকে ক্যাডেট কলেজ আর ক্যাডেট জীবনের বন্ধুদের সাথে গড়ে ওঠা আত্মার সম্পর্ক । আর অটুট থাকবেনা কেন? থাকতেই হবে, কারন এই সম্পর্কের শুরু আছে, শেষ যে নেই… তাইতো “ক্যাডেট” শব্দটা এত স্পেশাল…

৪,৯৭৫ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : ““ক্যাডেট” শব্দটা আমার কাছে “স্পেশাল ওয়ান” কিংবা “অনলি ওয়ান””

  1. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই দিনে
    নস্টালজিক হয়ে গেলাম
    এক ধাক্কায় ফ্ল্যাসব্যাক এ ১৯৯৮ তে চইলা গেছিলাম 😀
    :thumbup: ভালো লখেছিস বেটা


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    চোখ দু'টো ভিজিয়ে দিলে অনিন্দ্য... ভীষন নস্টালজিক হয়ে পড়লাম... বুকটা কেমন যেন হাহাকার নিয়ে মোচড় দিয়ে উঠলো ফেলে আসা সোনালী ৬ বছর আর নাড়ীর বাধনে বাধা কলেজের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য...।
    আবার যদি ফিরে পেতাম দিনগুলো...

    অনেক সুন্দর লিখেছো ভাই। একদম মনের কথাগুলো গুছিয়ে লিখেছো।
    সাধুবাদ।

    জবাব দিন
  3. শেষের লাইন গুলোতে পথের পাঁচালী-র গন্ধ পেলাম।

    লেখা চমৎকার হয়েছে। আরো লিখতে থাকো.....

    আর প্রথম পোষ্ট করার পর যে নিয়মটা আছে আজকাল মনে হয় কেউ মানছে না। কিন্তু কেন??

    জবাব দিন
  4. মীম (২০০৬-২০১১)

    খুব নস্টালজিক হয়ে গেলাম ভাইয়া। অসম্ভব সুন্দর লেখাটা...... অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেলো......... :boss: :boss:

    “ক্যাডেট” শব্দটা আমার কাছে “স্পেশাল ওয়ান” কিংবা “অনলি ওয়ান” ::salute:: ::salute::

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।