অপূর্ণ শেষ ইচ্ছা

বাইরে সুন্দর একটি আলো আলো দিন। ঠান্ডাও না, আবার গরমও না। আসিফ সাধারনত অফিস থেকে দেরীতে ফেরে। আগে ফিরেও বা কি করবে। অফিসের অন্যরা প্রায় সবাই চলে গেছে তখন। একা অফিসে থাকতে ভালই লাগে আসিফের। জালনা দিয়ে বাইরের দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় তার চার তলার অফিস থেকে। এই দিকেই তার ফেলে আসা জন্মভূমি, তবে অত দূর দেখা যায়না। শুধু মনের চোখ দিয়ে ফেরা যায় সেখানে।

সুন্দর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে মা একবার তাকে বলেছিলঃ

– খোকা, আমাকে একবার পাহাড় দেখাতে নিবি?

– কেন, কোন দিন পাহাড় দেখতে যাওনি?

– না বাবা। তোর বাবা যখন দার্জিলিং-এ বদলি হয়েছিল তখন বলেছিল সামনের ছুটিতে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তারপর যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর আমাকে নেওয়া হলো না।

– কোন যুদ্ধের কথা বলছো?

– কেন? ইংরেজদের সাথে জাপানীদের যুদ্ধ।

আসিফ বুঝলো মা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা বলছেন। মা তার জীবনে কত কিছু দেখেছেন। ব্রিটিশ ভারতে জন্মেছেন, পরে বড় খুশী হয়েছেন যখন দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে ব্রিটিশদের হাত থেকে। তারপর ‘মার-কাটের’ দেশ ভাগ হবার পর পাকিস্তানী হয়েছেন, আবার একই জীবনে আর এক ভীষণ অমানবিক যুদ্ধের পর ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে দেশ আবার স্বাধীন হবার পর হয়েছেন বাঙ্গালী। সেটাও বেশীদিন ঠিক মত ধরে রাখার আগে শিখতে হয়েছে নতুন শব্দ – বাংলাদেশী। কিন্তু তার কাছে তো এটা সেই একই দেশ। তার জন্মভূমি। বাড়ীর সামনের নদী-বিলের কচুরীপানার কোন পরিবর্তন হয়নি তার জীবনে। জীবনে যা জানার, যা দেখার – একই জায়গাতে বসে দেখেছেন সব কিছু। অথচ সামান্য একটু দূরে যেয়ে পাহাড় দেখা হয়নি তার জীবনে।

[ বাংলাদেশের নদীর ছবি – সৌজন্যেঃ শেখ কবিরুল হাসান ]

.
– আমি তোমাকে ঠিকই পাহাড় দেখাতে নেব মা। আমি কথা দিচ্ছি। আর কিছু কি করার বা দেখার ইচ্ছা আছে?

– না বাবা, তোমরা সবাই মানুষ হয়েছো। আমার আর কিছু চাইবার নেই। তোমরা সবাই যেন তোমাদের সংসার নিয়ে সুখী থাক – এইই শুধু আমার প্রার্থনা খোদার কাছে।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য আসিফ মাকে দেওয়া তার কথা আর রাখতে পারেনি।

আমেরিকা আসার পাঁচ বছর পর একদিন নাসরিনকে বললোঃ

– এখন তো আমাদের গ্রীন কার্ড হয়ে গেছে, চলো মাকে কিছু দিনের জন্যে ভিজিটর হিসাবে নিয়ে আসি। আমাদেরকে দেখার জন্যে মা ছটফট করছে। বিশেষ করে তুলতুলিকে মা এখনো দেখেনি।

– সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আমাদের এই ছোট মাত্র দুই বেড রুমের এপার্টমেন্টে উনাকে রাখবে কোথায়?

– তাইতো। তাহলে একটা তিন বেড রুমের এপার্টমেন্ট খুজি?

– ভাড়া দিতে পারবে? কম করে হলেও ১২০০ ডলার লাগবে।

– তাহলে কি করি, বলো তো?

– বাড়ী কিনবে বলেছিলে। একটা ছোট খাট বাড়ী কিনে ফেল আগে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে সেখানে।

– আমিও তো তাই চাই। কিন্তু ডিপোজিটের টাকা যে এখনো জমে নি।

– চিন্তা করো না। আমার চাকরীতে একটা মাইনে বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তখন বাড়তি টাকাটা সব তোমার হাতে তুলে দেব, যাতে ডিপোজিটের টাকাটা তাড়াতাড়ি জমে।

– কিন্তু মাকে কি বলবো?

– সব কথা মাকে বুঝিয়ে বলো। আর তো মাত্র কয়েকটা বছর।

টেলিফোনে মাকে বলার পর মা আস্তে করে বললেন – বাবা, তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর।

– এই তো আর কয়েকটা বছর মাত্র, একটু কষ্ট করে সহ্য করো। আমার সিটিজেনশীপ হয়ে গেলে স্পন্সর করে তোমাকে একেবারের মত এখানে নিয়ে আসবো। ততদিনে আমাদের নিজেদের বাড়ীও হয়ে যাবে। ইচ্ছামত যতদিন খুশী তখন থাকবে এখানে। পাহাড়ের কাছেই একটা বাড়ী নেবো, যাতে তুমি নিজেই একা একা হেটে বেড়াতে পারবে সেখানে আর মনের ইচ্ছা মত পাহাড় দেখতে পারবে।

– তত দিন কি আর আমি বাঁচতে পারবো বাবা?

মায়ের এই শেষ কথাটাই সত্য হয়েছিল। কোন পাহাড় বা তুলতুলিকে না দেখেই মাকে মারা যেতে হয়েছিল। জীবনে তার একটাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর পূরণ হয়নি। মারা যাবার সময় কোন ছেলে-মেয়েও তার পাশে ছিল না। সকালে কাজের বুয়া যখন -“নানী ওঠেন, অনেক বেলা হয়েছে” – বলেও নানীর ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি, তখনই শুধু বোঝা গেল যে নানী তখন চিরদিনের জন্যে চরম নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

আসিফ আজ ভাবে – খোদা তার মার প্রার্থনার কতটা রেখেছেন তাও বলা মুশকিল। তার জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ, বাড়ী, গাড়ী, ব্যাংক ব্যালান্স, সমাজে সন্মান লাভ – সবই হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি আসিফ সুখী হতে পেরেছে?


৩২ টি মন্তব্য : “অপূর্ণ শেষ ইচ্ছা”

  1. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    বড্ড দেরী হয়ে গেল......


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    চমৎকার গল্পটা একটানে পড়ে ফেললাম। বিষণ্ণ করা লেখাটার মাঝে আমার নানীর কথা মনে পড়লো। সেই ১৯৯০ সালের কথা । আমার মামাতো ভাই হামাগুড়ি দেয় তখন। আমার নানী বারবার তাঁর নাতিকে দেখতে চাইতেন। আমার মামা তখন সিলেটে বদলি। আমার নানী মৃত্যু শয্যায় খুঁজেছিলেন বারবার তার নাতিকে। তখন টেলিফোন ছিলো না। তাই টেলিগ্রাম করা হলো। সেই টেলিগ্রাম পৌছায় যখন ততদিনে আমার নানীর প্রস্থানের সাতদিন হয়েছে। আমার মামাতো ভাইটিকে দেখলে আমার সেই কথাই বারবার মনে হয়।

    জবাব দিন
  3. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    এই গল্পটা পড়ে হেলসিংকি (ফিনল্যান্ড) থেকে এক জন আমাকে যে চিঠি পাঠিয়েছে তার কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি - "আজ আপনার লেখা পড়ে এই চিঠিটা না দিয়ে পারলাম না। এই প্রথম কারও কোন লেখা পড়ে সত্যিকার চোখের পানি আসলো। অনেকক্ষণ খুব খারাপ লাগলো।

    কারণ আমরা দুই ভাই মাত্র - তাও আবার দু'জনেই দেশের বাইরে। বাবা মা দেশে আছে। আমার আম্মাও এই ধরনের ইচ্ছার কথা বলেন আমাকে। তিনি কখনো সমুদ্র দেখেননি। আসলে হয়ে ওঠেনি নানা কারনে। তাই এই ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন আমার কাছে। জানিনা শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবো কিনা।

    আসলে আমাদের বাবা-মাদের চাওয়া খুব সীমিত। কিন্তু সেই সীমিত চাওয়াটাই যেন আমাদের অনাদর আর অবহেলায় হয়ে ওঠে না। ইচ্ছা আছে দেশে গেলে আম্মাকে নিয়ে ঘুরে আসবো। অথচ আমার বাসা থেকে এখানে সমুদ্র মাত্র দেড়শো ফিট দূরে। সব সময় মনে হয় আম্মা আব্বাকে আনি এখানে।

    যাহোক ভাই, আপনার লেখাটা আমার মনকে সত্যি খুব নাড়া দিয়েছে। বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা..."

    এই চিঠিটা পড়ে আমার মনও বিক্ষিপ্ত হয়েছে। নতুন ভাবে চোখ খুলে দিয়েছে আমার। যদিও আমার লেখাটা নিছক একটি গল্প ছিল - কারণ আমার মায়ের মৃত্যুর ৫ বছর পর আমি দেশ ছেড়েছি। তবে তার বেঁচে থাকার সময় কতটুকু সময় তার প্রতি ব্যয় করতে পেরেছি? তাকেও তো আমি সাথে করে কক্সবাজার বেড়াতে নিইনি।

    আমার পক্ষে হাজার চেষ্টা করেও এখন আর মাকে সঙ্গ দেবার সূযোগ হবে না। কিন্তু তোমরা যারা এখনো সৌভাগ্যবান, অথচ সময় বা সূযোগের অভাবে এই দিকে চিন্তা করতে পারছো না - তারা কি আজকের এই ঈদের দিনে এই দিকে একটু চিন্তা করবে?

    জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    আমার পক্ষে হাজার চেষ্টা করেও এখন আর মাকে সঙ্গ দেবার সূযোগ হবে না।

    আগে যদি বুঝতাম...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।