বাংলাদেশে এখন শৈত্য প্রবাহ বইছে বলে আমার এক বন্ধু আমাকে জানিয়েছে। আমেরিকাতেও বর্তমানে চলছে শৈত্য প্রবাহ। এই মুহুর্তে ঘরের বাইরের তাপমাত্রা ফ্রিজিং পয়েন্টের নীচে। আমাদের বাড়ীর নিকটের পর্বতচূড়াগুলি সাদা তুষারাবৃত হয়ে আছে। এমনিতেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০০ ফিট উচ্চতায় থাকি আমরা। শীতকালে ঠাণ্ডা পড়াটাই স্বাভাবিক। সেন্ট্রাল হিটিংয়ের বদৌলতে ঘরের মধ্যে শুধু একটা জামা পড়ে আছি এবং সাটেলাইট টিভিতে বাংলাদেশের চ্যানেলে উত্তর বাংলার মানুষের কষ্ট দেখছি। এমন সময় মনে পড়লো মেরীর কথা। কষ্ট পাবার যেন কোন ভৌগলিক সীমা রেখা নেই। দুর্বলই সব সময় বেশী কষ্ট পেয়ে থাকে।
চোখে দেখে মেরীর বয়েস বোঝা মুশকিল। তার বয়স ৭০ হতে পারে অথবা তার চেয়ে বেশী বা কম। অথচ দূর থেকে দেখলে সহজেই তাকে একটি ছোট মেয়ে বলে ভুল করা সম্ভব। সে যখন বাসের সীটে বসে, তখন সম্পূর্ণ ঢেকে যায় সীটের মধ্যে। সে যথেষ্ঠ ক্ষীণ এবং দুর্বলও বটে। হয় সে যথেষ্ঠ খেতে পায় না অথবা তার গঠনই ওই রকম। আমার ছেলে সাঈদ যে রিহ্যাব কেন্দ্রে যায়, মেরীও সেখানে যায়। সেই সূত্রেই তার সাথে আমার পরিচয়। সাঈদ কথা বলতে পারে না, কিন্তু মেরী পারে। তার সব কথা অবশ্য আমি সব সময় বুঝতে পারিনা। স্পেশাল বাস রোজ সকালে প্রথমে মেরীকে তোলে তারপর আমার ছেলেকে নিতে আসে। আমি তাকে তার হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাসের রাম্পে উঠিয়ে দিই, তারপর বাসের ড্রাইভার হুইল-চেয়ার সহ তাকে বাসে উঠিয়ে নেয়। পথে আরও কয়েকজনকে একই ভাবে উঠিয়ে বাস তাদেরকে নির্দিষ্ট গন্তবে পৌছে দেয়।
বিগত কয়েক দিন মেরীকে ঠিক মত দেখিনি তাই আজ ড্রাইভারকে প্রশ্ন করলাম মেরীর খবর। জানলাম সে সামনে বসে আছে। তাই বাসের সামনের দরজার কাছে যেয়ে তাকে দেখে বললাম –
– How are you Mary?
আমাকে দেখে মনে হলো সে খুশী হয়েছে। তার দুর্বল ছোট দুটি হাত আমার দিকে বাড়িয়ে স্পর্শ করলো আমার হাত। দেখলাম তার হাত খুব ঠাণ্ডা। হঠাৎ সে বলে উঠলো –
– I like you
– I like you too – বললাম আমি।
আমার মনে পড়লো গত বছরের কথা। এক দিন তার চোখে পানি দেখেছিলাম আমি। বাসের মহিলা ড্রাইভারকে প্রশ্ন কোরেছিলাম মেরীর চোখে পানি কেন? কি হয়েছে? কাঁদছে কেন সে? ড্রাইভার যা জানালো তা এক হৃদয়বিদারক কাহিনী। মেরীর কোন নিকট আত্মীয় নেই। তার এক ভাগ্নি তার অফিসিয়াল ’কেয়ার-গিভার’। ভাগ্নি ও তার বয়-ফ্রেন্ড মেরীকে দেখে রাখার জন্যে কিছু টাকাও পেয়ে থাকে। তবে কতটা তারা দেখে সেটা সন্দেহজনক। হয়তো ঠিক মত খাবার না পাবার ফলে মেরীর এই দুর্বল শরীর। সকালে তারা মেরীকে তাদের বাসার গ্যারেজের সামনে বসিয়ে রাখে বাসের অপেক্ষায়। সেদিন বাস আসতে অনেক দেরী হয়েছিলো। ফলে ৪৫ মিনিটের বেশী তাকে একাকী বসে অপেক্ষা করতে হয়েছে এই ঠাণ্ডার মধ্যে। যারা শীতের দেশে বাস করেন তারা জানেন যে, এমন কি যথেষ্ঠ শীতবস্ত্র পড়ে থাকলেও, ঠাণ্ডা অসহনীয় হয়ে পড়তে পারে যদি একটু বেশী সময় বাইরে থাকতে হয়। মেরীর দুর্বল শরীর ওই ঠাণ্ডা সহ্য করার উপযুক্ত ছিলো না। বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে বসে সে একাকী শীতে কেঁপেছে আর নিঃশব্দে কেঁদেছে। অবশেষে যখন বাস এসে তাকে উঠিয়ে প্রশ্ন করেছে সে কাঁদছে কেন।
উত্তরে সে শুধু বলেছে – ”আমার খুব শীত লাগছে”।
😀
স্যরি ভাইয়া প্রথম হওয়ার চক্করে ভুল ইমো দিয়ে ফেলেছি। 🙁
ওল্ড হোম-এ গিয়ে উনি থাকতে পারেন না? নাকি এটা শুধু যাদের ইন্সুরেন্স আছে তাদের জন্যই ফ্রি?
লেখাটা পড়ে শেষে এসে একটা ধাক্কার মত খেলাম। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল শেষটা পড়ে। বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের বয়সের ছেলেরাই লন্ডনের ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে কষ্ট পায়, আর ওনার কষ্ট যে কতটা বেশি হয়েছে ধারনা করতে পারি। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের যথেষ্ট সম্মান আর যত্ন যদি আমরা না নেই তবে বৃদ্ধাবস্থায় আমাদের যত্ন কে নেবে??
আমার দেশী উষ্ণ রক্ত পজেটিভ টেম্পারেচারেই কাত। সবচেয়ে বড় কষ্ট হয় রোদ না দেখলে। মাসের পর মাস রোদ ছাড়া কিভাবে থাকা সম্ভব আমি বুঝি না। রোদের অভাবে মনে হয় আমার চোখও ছোট হয়ে আসছে 🙁 দিনদিন 🙁
মেরীর গল্প শুনে খুব কষ্ট পেলাম। আমি যখন কারফুর এ শপিং করতে যাই, এক অশিথিপর বৃদ্ধাকে প্রায়ই দেখি শপিং করতে। খুব কষ্ট লাগে পশ্চিমাদের একাকীত্ব দেখলে।
মিশেল - মেরী এক জন প্রতিবন্ধী (disabled) মহিলা, যদিও সে মোটামুটি নিজে থেকে চলাচল করতে পারে এবং কথা বলতে পারে। ওল্ড হোম-এ গেলে আমাদের চোখের সামনে থেকে হয়তো সরে যাবে, কিন্তু সে যে আরো ভালো থাকবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
বস্, আমি আপনার প্রথম ব্লগটা মিস করেছিলাম। তাই স্বাগতম জানাতে পারিনি। আপনি এত সিনিয়র যে, আপনাকে ভাই ডাকতেও দ্বিধা হচ্ছে। আপনি আমার বাবার ছোট হলেও চাচার চেয়ে বড়। ব্লগে এত সিনিয়র একজনকে পেয়ে খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছি। মাঝে মাঝে আসবেন এখানে, আমাদের খুব ভাল লাগবে।
একটা ছোট ডাউট ছিল, আপনার নামের পাশে ৬১-৬৫ সাল কেন? আপনি কি কলেজে ৪ বছর ছিলেন নাকি এটা প্রিন্টিং মিসটেক?
আপনার লেখাটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত বয়স্ক একজন মানুষকে অবহেলা করা হচ্ছে। তিনি যেহেতু প্রতিবন্দী, তাকে কি কোন বৃদ্ধাশ্রমে বা নিরাপদ কোন স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা যায় না?
কুদ্দুসুর রহমান -তুমি জানো যে পশ্চিমা দেশে একে অন্যকে নাম ধরে ডাকাটা খুব স্বাভাবিক। আমাকে তোমরা ভাই বললেই যতেষ্ঠ।
কলেজে প্রথম দিকে ছাত্র সংখ্যা বেশী কম থাকায় নবম শ্রেনীতে অতিরিক্ত ১০ জনকে ভতি করা হয় যাদের মধ্যে আমিও এক জন ছিলাম।
🙁 🙁
খুব মন খারাপ হয়ে গেল লেখাটা পড়ে। 🙁 🙁
লেখাটা পড়ে মন খুব বিষণ্ণ হয়ে গেলো। একাকীত্ব আমরাই সহ্য করতে পারি না, সেখানে বুড়ো বয়সে, সংসার, ছেলেমেয়ে সব হারিয়ে একা একা কেমন লাগে! আমার দুঃস্বপ্নেও এই কল্পনা আসে না।
বৃদ্ধদের শরীর শিশুদের শরীরের মতোই নাজুক। মনটাও ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসে, মৃত্যুর কাছে যেতে থাকেন বলে। জীবনের অর্থ আর অভিজ্ঞতাও তাঁদের বেশি। আমরা শিশুদের এতো দরদ দেখাই, কিন্তু বুড়ো বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানীদের কেনো অবহেলা করি? কেনো তাঁদের ওল্ড হোমে রেখে আসি! 🙁 🙁
নাহ, মন টা আসলেই খারাপ হলো।
সাইফুদ্দাহার ভাই, আপনি লিখতে থাকেন। আপনার পোস্টগুলো অন্যরকম।
একাকীত্ব সহ্য করা কঠিন বিশেষ করে শেষ বয়সে যাদের সামনে আর কোন স্বপ্ন থাকে না। আমরা যারা একা থাকি তাদের অন্তত সামনে স্বপ্ন থাকে। ভাইয়া আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। নিয়মিত লেখবেন প্লিজ।
ভাইয়া, এটা বোধহয় পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা উত্তর আমেরিকার বেশ তিক্ত একটা রূপ। আমি যেখানে কাজ করি তার পাশেই একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। ঠিক এমনই এক প্রতিবন্ধী মহিলাকে চিনি ক্যাথি নামে; বয়স প্রায় ৬৫-৭০। একা-অসহায়। মন খারাপ লাগে দেখলে।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
শার্লী, মান্নান, মেহেদী, তানভীর, আন্দালিব, রকিব ও কামরুল,
তোমাদের এতো সুন্দর ও সংবেদন মনের পরিচয় পেয়ে এবং তোমাদের বয়েসে আমার নিজের ব্যবহার স্মরণ করে লজ্জা হচ্ছে। এমনকি নিজের বাবা মার সঠিক যত্ন নিতে পারিনি আমি। পরে নিজেকে সান্তনা দিয়েছি এই বলে যে এটাও বাবা মার দোষ। তারা কম বয়েসে ক্যাডেট কলেজে পাঠিয়ে আমার মনকে কঠিন করে দিয়েছে। কিন্তু তোমরা আমার ভুল ভঙ্গিয়ে দিলে।
মানুষের সবচেয়ে অসহায় সময় একেবারে শিশুকাল এবং বৃদ্ধ সময়টা। শিশুকালের তুলনায় বৃদ্ধকালেই বরং কেন জানি মনে হয় একজন মানুষের আপনজনের পরিচর্যা খুব বেশি জরুরি। সকলের অবহেলা খুবই অভিমানী এবং অসহায় একটা অবস্থার মধ্যে নিয়ে যায় ভুক্তভোগীদের। মেরীর গল্প তাই খুবই মন খারাপ করে দেয়া, বিশেষ করে কনকনে পশ্চিমা ঠান্ডার মধ্যে ৪৫মিনিট খোলা আকাশের নীচে এভাবে পড়ে থাকা তার অফিসিয়াল ’কেয়ার-গিভার’দের প্রতি ঘৃণাই বাড়ায় শুধু 🙁
সাইফ ভাই, আন্দালিবের সাথে সুর মিলিয়েই বলি, আপনার লেখাগুলো আসলেই অন্যরকম। আশা করি এরকম লিখতেই থাকবেন আমাদের সবার জন্য। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
সিসিবির একটা বড় পাওয়া মনে হয়, এর মাধ্যমে আপনার মত সিনিয়র ভাইদের খুঁজে পাওয়া, তাদের লেখা-অনুভুতি-স্মৃতি গুলোর অংশ হতে পারা।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আহারে....
গত পরশু আমাদের এলাকার একটা স্কুলের মাঠে কারা যেন কম্বল বিতরণে এসেছিল। অনেক লোকের ভীড়ে বিশৃংখল অবস্থায় বয়স্করাই সবচেয়ে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। তবুও একসময় একে একে সবাই কম্বল পেয়ে বা না পেয়ে চলে যায় স্কুল মাঠ থেকে।
এক বৃদ্ধ মাঠের এক কোণায় বসে ছিলেন ভীড় কমে গেলে কম্বল পাবার আশায়। সবাই চলে যাবার পরও উনি সেভাবেই বসেছিলেন। কেউ একজন উনাকে খেয়াল করে কাছে গিয়ে বললেন, চাচা, সব কম্বল তো দেয়া শেষ, আপনি পান নাই? এখনো বসে আছেন?
বৃদ্ধের কানে সে ডাক পৌঁছোয় নি। উনি তার অনেক আগেই চলে গেছেন এ পৃথিবী ছেড়ে, ঠান্ডায় জমে, কষ্ট পেয়ে, হয়ত অনেক অভিমান বুকে নিয়ে।
ভাল লাগে না...
এসির গরম বাতাস খাইতে খাইতে এই "ভাল লাগে না" লিখতেও লজ্জা করতেসে...
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
ক্যাডা এইডা? ভাই আপনে যেন কে? আপনারে কি আমরা চিনি? ইন্দিয়ার্নাইন্টিন্সিক্সটিনাইন ডাইনোসরের আমলে অবশ্য এই নামে একজন ছিলেন... :grr: :grr: :grr:
ভাল আছেন ভাই? তা এতদিন পরে কি মনে কইরা? :grr: :grr: :grr:
ধুর!
এইসব বেদপ পোলাপাইনের খোচা খাওয়ার ভয়েই আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকি ~x(
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
মানবিক বোধগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, পথ চলার প্রেরণা যোগায়। বৃদ্ধদের একরকম অবহেলা পশ্চিমে আছে। আবার আমাদের প্রাচ্যে এই দিকটা অন্যরকম। অনবরত অপমানের মধ্যে বেঁচে থাকা। পাশ্চাত্যে তো তবু প্রবীনদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে তাও নেই। সেটা নজর এড়ালে চলবে না।
সাইফ ভাই, মানুষ দেখার মতো সম্ভবত সুখের আর কিছু নেই। এতো বৈচিত্র্য, এতো বৈপরীত্য, এতো ভালোবাসা আবার তীব্র ঘৃণা- আর কোনো প্রানীর মধ্যে নেই। আপনার লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল। গত দুদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম। ফিরেই আপনার লেখাটা পেলাম। মেরির জন্য ভালোবাসা।
মেরির মতোই এক নারী আমার নানী। বিয়ের ১৬ বছর পর স্বামীকে হারান। আমার জন্মের সময়। তারপর থাকতেন বাবার কাছে। আমার মা আর মামা তার দুই সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের পর মামা পাকিস্তান থেকে ফিরে এলে নানী ওনার সঙ্গে থাকতেন। মামা মারা গেলেন ১৯৯৭ সালে। এর আগে আমার বাবা মারা গেলেন ১৯৯২ সালে। মামার মৃত্যুর পর নানী থাকেন আমাদের সঙ্গে। আমরা ভাই-বোনরা সবাই তাকে ভীষণ ভালবাসি। হয়তো মাও তার সন্তান মানে আমাদের কাছ থেকে এতোটা ভালোবাসা হয়তো পান না।
আবার আমার ছোট ফুপু এবং ফুপা- দুজনকেই কোনো ছেলে রাখতে চাইছে না। ছেলেদের অর্থবিত্তও তেমন নেই। কিন্তু আমরা কাজিন এবং চাচারা সাহায্য করবো অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু তাতেও হোলো না, শেষ পর্যন্ত কয়েকমাস আগে আলোচনা করে তাদের একটা ওল্ড হোমে রেখে আসতে হয়েছে।
মানুষের জীবনটা যেন কেমন!!
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"