অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু ও এইসব মানুষেরা

কাক কি কাকের মাংস খায়? কিংবা কুকুর কুকুরের? বহুদিন আগে আমার এক বন্ধুর প্রশ্নে কিছুটা চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাকে জানাই, বিষয়টা জেনে আমি জানাবো। জেনে বলতে বইপত্র ঘেঁটে নয়, কাক এবং কুকুর মানুষের খুব কাছাকাছি থাকায় চাইলেই এদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আমার বন্ধু আলি খুব কাকপ্রিয় মানুষ। কাক সম্পর্কে আলিকে প্রশ্ন করতেই আলি জানায়, তুমি ভালো করে খেয়াল করে দেখো। কাকের মধ্যে ভালোবাসাবোধ অনেক।

বর্ষার এক দুপুরে ফুলার রোড দিয়ে কলাভবনের দিকে যাচ্ছি। হঠাত দেখলাম একটি অসুস্থ কাককে ঘিরে বেশ কিছু কাক। কাকটি যখন যন্ত্রণায় কাতর তখন অন্য কাকরা কা কা করে জানান দিচ্ছে তাঁদের সহানুভূতি। কোন কোন কাক ডানা দিয়ে অসুস্থ কাককে আশ্রয় দিচ্ছে, যেন অসুস্থ কাকের গায়ে বৃষ্টির পানি না লাগে। সোলায়মান(আঃ) এর মতো পশু পাখির ভাষা জানি না তবে মানুষ হিসেবে অন্তত এটুকু অনুধাবন করতে পারি, একজন অসুস্থ কাকের প্রতি অন্য কাকদের কি গভীর সমবেদনা। প্রতিদিন খাওয়ার সময় বেশ কিছু কাক দেখতে পাই। আমি তাদের ভাত ছুঁড়ে দেই। একদিন দেখি, একটি কাক অন্য কাককে ঠোঁটে ঠোঁটে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হলো, এই নগরীতে এখন ঠিক কতগুলো দম্পতি আছে, যারা ভালোবাসে একে অন্যকে সপ্তাহে অন্তত একদিন মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়।

কুকুর প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আমার সুনীলের কবিতার কথা মনে পড়ে। যিনি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকতে চেয়েছিলেন তার ভেতরের কুকুরটিকে দেখবে বলে। তবে আজকাল আর মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই থাকা যায়, তার ভেতরের মানুষটাকে দেখার জন্য। নাহলে, একটি জনসমাগম পরিবেশে স্বামীর রক্তে রাঙ্গা একজন স্ত্রীর আর্তচিৎকার কিভাবে চারপাশের মানুষগুলোর কাছে পৌঁছায়নি? দেখে খারাপ লাগা কাজ করে। যে জায়গায় অভিজিৎ রায় খুন হলেন সে জায়গা দিয়ে প্রতিদিন অজস্রবার যাওয়া আসা করি। কখনো সন্ধ্যায়, কখনো গভীর রাতে। এক সন্ধ্যায় দেখি কাছাকাছি বসে থাকা এক প্রেমিকজুটির কাছে কয়েকজন পুলিশ এসে জানতে চায় এখানে তারা কেন এসেছে? তাদের কি সম্পর্ক?

প্রেমের সম্পর্ক আজো সমাজ স্বীকৃত নয় বলে তাঁরা কিছুটা অপ্রস্তুত এবং বিব্রত হয়। যখন দেখি পুলিশ অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করছে তখন এগিয়ে গিয়ে বলি,
এই জনপদে কি প্রেম করাও অপরাধ? যদি অপরাধই হয় তবে এর চেয়েও আরো বড় অপরাধী চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গিয়ে ধরুন। আপাতত এদের শান্তিতে প্রেম করতে দিন। যে উদ্যানে বসে রুদ্ররা লিখতেন,
ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো
দিয়ো তোমার মালা খানি
বাউলের এ মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে..।

সেখানে কোন এক মায়াবী সন্ধ্যায় ভালোবাসাবাসির কোন কপোতকপোতিকে পুলিশ এসে অপমান করবে বিষয়টা হয়তো প্রেমের কবিরা ভাবে নি। সে পুলিশের সামনে নিরাপত্তাবেস্টনি পার হয়ে খুনীরা চলেও গেলো, একটু ধাওয়াও করতে পারলো না ভাবতেই দুঃখবোধ জন্মায়। এরা হয়তো কোথায় কোন প্রেমিক অন্ধকারে প্রেমিকাকে চুমু খাচ্ছে তা ধরা নিয়ে ব্যস্ত।

মাঝেমাঝে মনে হয়, কাক কিংবা কুকুরের চেয়েও “আশরাফুল মাখলুখাত”রা আজ নিচে নেমে গেছে। এর চেয়ে অস্ত্র আবিস্কারের আগের কোন যুগে যদি চলে যাওয়া যেত, সেই পাথর যুগে খ্রি পু ৫০০০০ বছর আগে, তাহলে হয়তো ভালোই হতো। পুরোপলীয়(paleolithic) মানুষ একদা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শিকারকে সহজ করার জন্য যে হাতিয়ারের উদ্ভব ঘটায়, সে মানুষ কি কখনো ভেবেছিলো এসব হাতিয়ার দিয়ে একদিন মানুষ পশু নয়, মানুষকেই শিকার করবে???

মৃত্যুর পর যখন অনন্ত মহাকালে বিগত সকল মৃত মানুষের আত্মার সাথে আমার আত্মারও পুনুরুত্থান ঘটবে, সেদিন পুরোপলিয় কোন আদিম মানুষের কাছ থেকে জেনে নেব সে উত্তর।

৮৩৮ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু ও এইসব মানুষেরা”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    মৃত্যুর পর যখন অনন্ত মহাকালে বিগত সকল মৃত মানুষের আত্মার সাথে আমার আত্মারও পুনুরুত্থান ঘটবে, সেদিন পুরোপলিয় কোন আদিম মানুষের কাছ থেকে জেনে নেব সে উত্তর।

    :clap:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।