গত বছরের ১০ নভেম্বর নর্থ আল্পাইন ক্লাব বাংলাদেশ থেকে আমরা ৬ জন নেপালের অন্নপুর্ণা রিজিয়ন এর চুলু ইস্ট (২১,৫৯৫ ফিট ) নামক পর্বতের চুড়ায় উঠতে সক্ষম হই । সেই চুড়ায় পৌছানোর কাহিনী নিয়েই এই সিরিজ লেখার চেষ্টা ।
Life can only be understood backwards; but it must be lived forwards. – Søren Kierkegaard
রাতের বেলা তিন ঘণ্টার চড়াই উতরাই এর পরে একটা ট্যেকনিকাল খাঁজ এর ঠিক আগে এসে আমরা পুরো টিম দাঁড়িয়েছি। এখান থেকেই শুরু হবে সামিট পুশের জন্য আমাদের ট্যেকনিকাল ক্লাইম্বিং। উচ্চতা ১৬৫০০/১৭০০০ ফিটের কাছাকাছি। আরও প্রায় ৩৫০০ ফিটের মতো ক্লাইম্ব করতে হবে বেস ক্যাম্প থেকে দেখা চূড়াটায় পৌঁছাবার জন্য। সামনে কি অপেক্ষা করছে জানিনা কিন্তু একটাবারো এ চিন্তা মাথায় আসেনি যে অল্টারনেটিভ কোন কিছুও এখানে হতে পারে। আমাদের সবারই কি একই অবস্থা নাকি তাও বলতে পারিনা। শুধু জানি যে, এই রাতটা আমার অ্যাডভেঞ্চার জীবনের সবথেকে অন্যরকম রাত। আমি যেন কোন এক উপন্যাসের ছোট্ট একটা চরিত্র, আমাদের পুরো দলটাকে নিয়ে যে উপন্যাসের কাহিনী। সেই রাত একটার দিকে চাঁদের আলোয় সোজা বেস ক্যাম্প থেকে রওনা হই আমরা। প্রচন্ড খাড়া পথ অথচ কোন এক অজানা কারণে শরীর যেন এতটুকুও শক্তি হারায়নি এ পর্যন্ত আসতে। সাথে আছে এক্সপেডিশন গাইড সোম বাহাদুর তামাং, গনেশ আর হলো সোম বাহাদুরের ভাতিজা গাইড মিলন তামাং । আমার খুব ভালো বন্ধু। আর ওর সাথে গল্প করতে করতেই অর্ধেকটা পথ চলে আসা। বাকি অর্ধেক পারভজের সাথে গল্প করতে করতে । টিম লিডার রাজীব ভাইয়েরও আমাদের গল্পে/আলোচনায় বেশ বড় কন্ট্রিবিউশন। আর কেমন যেন একটা অনুভূতি । কেমন যেন সবকিছু থেকে আলাদা, আদিম কোন এক আনন্দ যেন ভয় এর উপর চেপে বসে আছে অথচ ভয়টা এতটুকু ভয় পায়নি। সেও যেন যে কোন সময় মাথাচাড়া দিয়ে বিদ্রোহ করে উঠবে আর নিজের আসন পুনরুদ্ধার করবেই । এই ভয়টাই কি পেটে নাড়াচাড়া করতে চাইছে ! নাহ, পাহাড়ে চলাফেরায় বরাবারের মতোই আমি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী । কি যেন একটা হয় আমার পাথরের ওপর চলার সময়টায় । বুঝতে পারি যে, মনের সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব গুলো কিভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । যেন সত্য মিথ্যা সঠিক ভুল বলে কিছু নেই, শুধু গন্তব্য। এটাই মনে হয় একজন এডভেঞ্চারারের সবথেকে বড় নেশা । সবকিছু সন্দেহের উর্ধ্বে দেখতে পাওয়ার নেশা । শেষ যেই অংশটুকু আমরা আধ ঘন্টা ধরে উঠলাম এটা মারাত্মক কঠিন । পাথরের টুকরোগুলো শুধু পা এর নিচ থেকে সরে যায়, হাল্কা এদিক ওদিক হলেই পিছলে পড়ার সম্ভাবনা । তাই মনের ফোকাসও পুরোটাই পা এর দিকে । তবে হাতের কাজ নেই বললে ভুল হবে, প্রতিটা স্টেপেই একসময় হাতের ব্যবহার জরুরী হয়ে উঠল । প্রচন্ড রিস্কি একটা অংশ হলেও সবাই ঠিকই পার করে ফেললো । তবে যেখানে এসে থামলাম সেটাও ৪৫ ডিগ্রি খাড়া এবং পাথরের স্তুপ ।
মাথায় সবার হেডল্যাম্প জ্বলছে । আশেপাশে বেশিদূর দেখা যায় না বললেই চলে । ডানে তুষার আর বামে পাহাড় হতে ধসে পড়া ছোট বড় পাথরের স্তুপের ওপর আমরা কোনমতে দাঁড়ানো । বিশেষ করে আমি গত ৩০ মিনিট ধরে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে প্রায়ই আমাকে পা বদল করতে হচ্ছে যেন পিছলে পড়ে না যাই । অন্য সবাই এই ৩০ মিনিট ধরে শেরপা এবং সাথে আসা জুনিয়ার গাইডদের সাহায্য নিয়ে তাদের টেকনিকাল যন্ত্রপাতি পরে নিচ্ছে । এর বাইরে চারপাশে কি আছে বলার কোন উপায় নেই । চাঁদের আলোয় দূরে ফেলে আসা বেস ক্যাম্পের ভ্যালীটা দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা আর নিচে ফেলে আসা পথের বরফময় জায়গাগুলো দেখা যাচ্ছে, সাদা কালোর এক অদ্ভুত দৃশ্য । এই দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে পারবো না, এবং হয়তোবা সেটাই ভালো । মাউন্টেনিয়ারিং এর থেকে শেখা অনেকগুলো উপলব্ধির এটিও একটি । আর এখানে আসতে চাওয়ার এটাও একটা কারণ । নিজের অনুভূতিগুলোকে বুঝতে শেখা। আর কোন এক বিশেষ মুহুর্তের অনুভূতিটাকে মনের একটা ফিগার এইট নট দিয়ে এঙ্কোর করে ফেলা । যখনই চাইবো ঠিক তখনই যেন পৌছে যেতে পারি ঐ মুহূর্তটিতে । আর আমি জানি এটা সম্ভব।
অবশেষে আমারও সু্যোগ হলো টেকনিকাল সবকিছু লাগিয়ে নেয়ার । তবে সময় পেলাম অন্যদের থেকে কিছুটা কম । তারপরেও গাইডদের সাহায্য ভোলার নয় । প্রতিটি জিনিস খুব যত্ন করে দেখে নিলো ওরা । অনুভূতিগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে ট্রান্সফরম হয়ে গেলো এরই মাঝে কোন এক সময় । ট্যেকনিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট আমাদের সেফটির জন্য অথচ আমার মনের ভেতর খূব সম্ভবত ভয় ইঞ্জেক্ট করার কাজটি করে এরাই । আপন মনেই নিজেকে প্রশ্ন করি, এমন কি হতে পারে যে মনের গভীরে কোন এক জায়গায় এই ভয়টুকু অনুভব করার জন্যই বারবার পাহাড়ে আসি আমি, শুধু কি আমি, নাকি অন্যরাও ?
বহুদিন পর লিখলেন ওমর ভাই। আপনার এই পাহাড়-অভিযান বৃত্তান্তগুলো দারুণ রোমাঞ্চকর লাগে। আগের সিরিজটার পরের পর্বের অপেক্ষা যে এখনো ফুরলো না 🙁
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
আগের সিরিজটা হয়ত পরে আবার কোন একদিন শেষ করবো ভাই । তবে এবারের টা যেন ওভাবে আটকে না যায় সে চেষ্টা থাকবে । 🙂
প্রায় দু বছর পর !!!
আগের বারের মত এবারো অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম আপনার অভিজ্ঞতা শোনার জন্য...
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
থ্যাংকস ম্যান !! 🙂
দারুন, আবার ওমরের লেখা
থ্যাঙ্কস আশরাফ ভাই । দোয়া করবেন । 🙂
দারুন লিখেছো। :hatsoff:
সবগুলো পর্বত জয় কর, আর এমন সুন্দর করে লিখ। আমরাও ঘুরে আসি চুড়া থেকে ।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ধন্যবাদ বস, অনেক অনেক ধন্যবাদ । 🙂
ওমর, তোমার অভিযানের গল্প শুনে অনেক রোমাঞ্ছিত হলাম। আমি জানি, বাকি অংশগুলো পড়েও আমার একই অনুভূতি হবে।
আমি অপেক্ষায় আছি সেইদিনের, যেদিন তুমি এভারেস্ট জয় করবে। আমি জানি, তুমি ঠিকই পারবে। 🙂
থ্যাঙ্কস বস, আপনি সব সময় আমাকে ইন্সপায়ার করে আসছেন । খুব ভালোলাগার একটা ব্যপার বস !! ইনশাল্লাহ, আমার বেস্ট এফোর্ট টাই দেবো । 🙂
চমৎকার লেখা ওমর ভাই।
থ্যাঙ্কস ভাই । 🙂
দারুন,মনে হল আপনাদের দলের সাথেই আছি
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
😀
সাবাস, সবগুলো পর্বত জয় কর, আর এমন সুন্দর করে লিখ। অভিনন্দন!!!
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া !! আমার জন্য দোয়া করবেন ভাইয়া । 🙂
রেগুলার লেখা দিবি।
নাইলে ওমরের খোঁজে ১, ২, ৩...সিরিজ কিন্তু চালু হয়ে যাবে... :grr:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
নাহ রে দোস্ত । ওরকম সিরিজ যেন চালু না হয়, সেই কারণেই রেগুলার দিবো ইনশাল্লাহ । আমার রাডারের বাইরে থাকার একটা বদ-অভ্যাস আছে কিনা । 😛
সো, খেয়াল রাখবো এই ব্যপারটা । ভাল আছিস তো ?