একজন পর্বতারোহী ও কিছু কথা….

( www.somewehereinblog.net এ পুর্বে প্রকাশিত ২ টি পর্ব একসাথে… )

r001-027
যাই হোক, প্রথমেই এর শুরু নিয়ে আরেকটু পরিস্কার করে বলা দরকার। ভাগ্যে ছিল বলেই কিনা কে জানে আমার মা রাঙ্গামাটির চাকমা মেয়ে আর বাবা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, তাও আবার যার পোস্টিং প্রায় সময় হতো পার্বত্য চট্টগ্রামে । এমনকি আমার জন্মের সময়ও বাবা পাহাড়ে । ঘুরেফিরে ছেলেবেলার প্রতি বছর ২ মাস হলেও তাই আমার পাহাড়ে কাটতো। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে এই সম্পর্কটা আরো যেন জোড়দার হয়। আমাদের পুরো কলেজটাই যে পাহাড়। যাই হোক, প্রতিটা পাহাড়ের চূড়াই কিভাবে যেন মনে এক অন্য ধরণের আবেগ সৃষ্টি করতে থাকে। একাকিত্বের একটা আলাদা আবেদন সবসময় ছিল আমার কাছে। আর পাহাড়ের চুড়াটা যেন একা বসে থাকার আদর্শ স্থান।

আমরা যারা পর্বতাভিযানের সাথে জড়িত তাদের সবারই হয়ত পাহাড় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে। তবে স্বপ্ন সবার এক। এভারেস্ট এর চুড়ায় দেশের পতাকাটা গেড়ে আসা। আমার দেখা প্রতিটি পর্বতারোহীর অন্তত এটাই জীবনের মূল লক্ষ্য এবং এটা আপাতদৃষ্টিতে শুনতে হয়ত কিছুটা পাগলাটে লাগে। অনেকেই বলবেন এভারেস্ট এ তো অনেকেই আরোহণ করে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, তাই বলে কি তারা পর্বতারোহণ ছেড়ে দিয়েছে? দেয়নি। এভারেস্টে উঠছে, উঠছে তার থেকেও আরো অনেক কঠিন কঠিন পর্বতে। তবে একজন পর্বতারোহী এটাও আশা করেনা যে ব্যাপারটা সবাই বুঝবে। এ ব্যাপারে পর্বতারোহী জন ক্রকারের একটা কথা আমার খুবই প্রিয়– পৃথিবীর সবচাইতে উচু জায়গাটিতে দাড়ানোর ইচ্ছাটা খুবই পাগলাটে একটা ব্যাপার, যাদের মনে এই ইচ্ছাটা জাগেনা, তাদের কে এটা বোঝানো প্রায় অসম্ভব আর যার মনে একবার ব্যাপারটা ঢুকে গেল, তাকে ফেরানো সম্ভব নয়। আসলেই তাই। একবার মনের মধ্যে ঢুকে যাওয়া মানে রাতের ঘুম হারাম। স্বপ্নেতো এভারেস্ট আসেই, আর দ্বিবাস্বপ্নটা তার থেকেও খারাপ। আর কাউকে এটা বোঝানো যে কতটা আসাধ্য তা বোধ করি আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। হাজার হোক আমরা বাঙ্গালী জাতি । ছোটবেলা হতেই শিক্ষা দেয়া হয় গাড়ি ঘোড়া চড়ানোর জন্য। এখন সেই গাড়ি ঘোড়া বাদ দিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা যে অন্তত আমাদের সমাজে অযৌক্তিক এবং হাস্যকর তা আমরাও জানি। মাঝে মাঝে যে সে চিন্তা আসে না তাও নয়। তবে একবার অভিযানের স্বাদ পেয়ে গেলে এর থেকে বেড়িয়ে আসা যে অসম্ভব। পর্বতে চলার সময়ের যেই কষ্ট তা একরকম নেশার মতো। রক্তে ঢুকে যাওয়া মানে নিজের সাথে একরকম স্যাবোটাজ করে ফেলা। সিসটেম এর বাড়োটা বাজানো। বুঝিয়ে বলা খুব কঠিন।শুধু এটুকু বলতে পারি যে যেই আমি হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং এর সময় কানে ধরে বলেছিলাম যে আর কখনো এখানে ফেরত আসব না সেই আমি ট্রেনিং এর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে শিকার হয়েছিলাম চরম ডিপ্রেশনের। রওনা দিয়েছিলাম বান্দরবানের কেউকেরাডং এর উদ্দ্যেশে, ব্যাগে ভরেছিলাম হাতের কাছে পাওয়া যে কোন বস্তু। মনে আশা, অন্তত একদিন যদি ওই সময়কার কষ্টটা অনুভব করা যায়।

শারীরিক কষ্টের কাছে আসলে আমাদের ওই ছোটখাট ছেকা খাওয়া দার্শনিকতার কোন মুল্য নেই। পর্বতারোহনের অনেকগুলো শিক্ষার মধ্যে এটাও একটা, প্রতিদিন যখন এই একটা শিক্ষা ঘুরেফিরে মনে আসে তখন জীবনটাকে যেন কেমন আজব মনে হয়, মনে হয় এতদিন যা দেখেছি, যা শুনেছি তার অধিকাংশই ভুল। আমি যত চেষ্টাই করি না কেন, কনকনে শীতের রাতে রাস্তায় খালিপেটে শুয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটার কষ্ট অনুভব করতে পারবো না, কিংবা আমার ক্ষমতা নেই ওই so called বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কারোর পরিবারের মনের অভিমান্টা বোঝার। কষ্ট যে কতটা আপেক্ষিক একটা ব্যাপার! এমন কমপক্ষে ৭/৮ টা দিন আমার গেছে যখন মনে হয়েছিল আজই জীবনের সবচাইতে কষ্টের দিন। ট্রেইনিং থেকে ফিরে ডাইরি খুলে যখন পড়তে বসেছি, তখন সব উলট পালট। ওই কষ্ট যে আমি বেশ ভুলে বসে আছি ।
এমনই একটি দিনের কথা আজ ডাইরি থেকে তুলে দিলাম।

২৪-১১-০৯
হায়রে জীবন। Hardwork এবং Courage সম্পর্কে যে ধারণা আমার ছিল তার সব ভুল। HMI তে এসেছি ৭ দিন হলো। ট্রেনিং যে এতটা কঠিন হবে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও আমার ছিলনা। ১৭ তারিখ রাতে পৌছলাম আর ১৮ তারিখ সকাল ৪ টা ৫৫ তে কিনা দৌড়ের জন্য ডাক। ৫ কিমি আমি বাসায় সপ্তাহে ৪ দিন দৌড়াতাম। কিন্তু এখানে ওই আপহিল রানিং টা শুরু হলেই মনে হয় যে আর বোধহয় পারলাম না। ঢাকা থেকেই মড়ার শর্দিটা লেগে আছে আজ ১২/১৩ দিন। এভাবে চলতে থাকলে বেইস ক্যাম্প এ পৌছাতে পারব কিনা সন্দেহ। আর মেডিক্যাল এ আউট করলে তো আমার সব শেষ। আজ দুদিন হলো আমার রাতে জ্বর আসছে। সকালে সিক রিপোর্ট করে পিটি মাফ । পারভেজ না থাকলে এ যাত্রায় আমার কি হতো কে জানে। সকালে ব্রেকফাস্ট আর চা নিয়ে এসে না খাওয়ালে আমার ক্ষমতা ছিল না নিজে গিয়ে খাওয়ার। যাই হোক, এভাবেই ভাগ্যবশত আজ রক ক্লাইম্বিং ক্লাস থেকে মুক্তি পাওয়া। গ্রেড দেওয়ার সময়ই হয়ত বোঝা যাবে ভাগ্যবশত না দুর্ভাগ্যবশত। অবশ্য এই মুহূর্তে আমি বেইস ক্যাম্প পৌছানো নিয়েই বেশি চিন্তিত। কোর্স শেষ না করতে পারলে যে আর জীবনেও এখানে আসা হবে না তা বেশ বুঝতে পারছি। এখন বাজে ৯টা। সবাই ১০ টার মধ্যে হোস্টেলে ফিরে আসলে আজ আমাদের আউটিং। কাল হতে বেইস ক্যাম্প এর উদ্দ্যেশে ট্রেকিং শুরু হলে আমরা প্রায় ২০ দিনের জন্য চলে যাচ্ছি নেটুওয়ার্কের বাইরে। কি হবে কে জানে। আমি চিন্তিত বাসা নিয়ে। বাসায় তো বেশ বলে আসলাম যে ইন্ডিয়া যাচ্ছি বেড়ানোর উদ্দ্যেশে। এখন ২০ দিন ফোন না পেলে যে কি ভাববে। আসার সময় এত ঝামেলার মধ্যে দিয়ে না আসতে হলে ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে আসতাম।
r001-018
যাই হোক, বেশি ভাবতে চাইনা। সামনে লক্ষ্য একটাই। বেইস ক্যাম্প এ পৌছানো। কাল আমাদের টাইগার হিল ট্রেকিং এ গিয়ে কেমন যেন আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি টের পাচ্ছি। ২২ কিমি। ট্রেকিং এই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পরে গিয়ে কি হবে আল্লাহই জানে। তাও আবার ব্যাগের ওজন এখন ২০ কেজি। বেইস ক্যাম্প এ যাওয়ার সময় আরো কত কিছু জমা হবে। ট্রেক শেষ করে গতকালই তো রুমমেট নিরাজ তার বেশ কিছু চকলেট বিলি করছিল সবার মাঝে। জিজ্ঞেশ করতেই উত্তর দিল – ‘’ইয়ার মুঝে ইয়ে সাব ক্যারী ইই নেহি কারনা হ্যায়” । হিন্দি ভাষাটা কেমন যেন জোকার একটা ভাষা। এ কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে ওর চকলেট গুলোর ওপর ঝাপিয়ে পরলো । কালকের ট্রেকিং আসলে অনেকের মনেই ভয়ের সঞার করেছে। ধুর শালা, কেন যে আসলাম হটাৎ করে। আরো পরেও আসতে পারতাম। এর মধ্যে আমার ওজন হলো ৫২ কেজি। শালার ওই ব্যাগের ওজন বেইস ক্যাম্প এ যাওয়ার সময় থাকবে ২৩-২৫ কেজি। ভাবতেই জ্বর এসে যাচ্ছে। জানিনা, ভাগ্যে কি আছে। তবে এইবারকার মতো যদি এই কাজ শেষ করে ফেলি তবে আর কোন কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না এটা বেশ বুজছি।
দেশের কথা মনে করার সময় পাইনা। সারাদিন দৌড়ের মধ্যে থাকা। দুপুরের ক্লাসগুলো করতে গিয়ে সেই কলেজের কথা মনে পড়ে যায়। ভার্সিটি লাইফে কখনো এভাবে ঘুম এসেছে বলে মনে পড়ে না। আজ একটু বিশ্রাম পেয়ে হোস্টেল এ একা থাকতে পেরে খুব মনে পড়ছে সবার কথা। নিলয় ভিসার গ্যাঞ্জামে পরে আসতে পারলো না। ও আসলে পারভেজ এবং আমার দুজনেরই সুবিধা হতো। মনে পড়ছে সবার কথাই। কেউ কি মিস করবে আমাকে ? মনে হয় না। সময় এত ফাস্ট যায়, তার মধ্যে আমার মত একজনের কথা মনে না পড়ারই কথা। রানা, চয়ন মিস করবে, নিলয় তো করবেই, বরং ওকে আমরা এখানে বেশী মিস করি বলা যায়। বন্ধু জাবের এবং উৎস অবশ্যই একবার হলেও ভাববে আমার কথা। লাক খারাপ না ভাল জানিনা, আমাকে ওই ভাবে মিস করার কেউ নেই। জীবনটা কেন যেন সব দিক থেকেই ভারডিক্টলেস থেকে গেল। ডেস্টিনি সম্পর্কে মনে নেই কোন ধারণা। যা করছি তাই বা কেন করছি তা নিয়েও মাঝে মাঝে সন্দেহ দেখা দেয়, তবে এভারেস্ট না দেখা হলে পুরো জীবনটাই বৃথা। কি আছে ওখানে যা দেখার জন্য ২১৫ জন মানুষ মৃত্যুর পথে এগিয়ে গেল? এ জিনিস না দেখতে পারলে যে পৃথিবীতে আসাটাই সার। যাই হোক, হয়ত এটাও পর্বতারোহণের একটি শিক্ষা। আমি সবাইকেই মিস করব, আমাকে মিস করবে না কেউ। The irony of it.
ওদিকে মুসা ভাই Sponsor এর ব্যাপারে কতটুকু আগালেন কে জানে। দেশে গিয়ে কি কোন ভাল খবর পাব নাকি বৃথা যাবে এই ট্রেনিং! নাহ, সে চান্স নেই, এই কোর্স যদি সারভাইভ করতে পারি তাহলেই বুঝবো আমি সফল। আমার রুমে ১০ জনের মধ্যে সামরিক আধা-সামরিক বাহিনীর লোকের সংখ্যা ৭। দিল্লীর জয় আজ চলে যাচ্ছে কোর্স ছেড়ে। একে ফেইসবুক এ একটা গ্রুপ খুলতে বললাম। শুনে খুব লজ্জা পেল, তারপরেও সাহস দিলাম কিন্তু ভাল কোন সাইন দেখলাম না। ছেলেটার আত্মবিশ্বাস বেশ আঘাতপ্রাপ্ত। I just hope I dont end up like him. আউটিং এ গিয়ে ইন্টারনেট এ বসি একটু। মেইল টেইল করি, দেখি কি অবস্থা।

২,৬২৯ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “একজন পর্বতারোহী ও কিছু কথা….”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    ব্লগে স্বাগতম ওমর। :hug:

    তোমার কথা আমি অফিসে, বন্ধুদের সবার কাছে বলে বেড়াই। আমার এখনও ভাবতে অবাক লাগে তুমি এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে!
    অবশ্য আমি নিশ্চিত তুমি এভারেস্ট জয় করতে পারবে, গেঁথে দিতে পারবে বাংলাদেশের পতাকা।

    আমরা তোমাকে নিয়ে গর্ব করি ওমর। 🙂

    অফটপিকঃ এখন থেকে এই ব্লগে প্রথমে লিখবা, তারপর অন্য ব্লগে দিবা। 🙂

    জবাব দিন
    • ওমর (৯৫-০১)

      বস, thanks a lot, আপনি বস আমাকে সবসময় প্রেরণা দিয়ে এসেছেন, ইনশাল্লাহ ওখানে কোনদিন উঠতে পারলে একটা পাথর বা কিছু আপনার জন্য নিয়ে আসব। হেহে, যাই হোক, অনেক ধন্যবাদ বস পাশে থাকার জন্য, দোয়া করবেন যেন ভাল কিছু করতে পারি। 🙂
      এই ব্লগেই বস প্রথমে লিখব, পাসওয়ার্ড হারানোর জন্য এইবার এই ফল্ট হয়ে গেল । ক্ষমাপ্রার্থী।

      জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    গৌরকিশোর ঘোষের "নন্দকান্ত নন্দাঘুটি" পড়েছিলাম, তাই এভারেষ্ট অভিযান কত কঠিন আর কেমন কষ্ট, আনন্দ, হতাশা ও সাফল্যের মিলিত অনুভূতি তা একটু একটু আন্দাজ করতে পারলাম।

    পর্বত অভিযান সফল হোক। অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। 🙂


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।