অতঃপর ব্লগর ব্লগর – ৭


নিজের লেখাগুলো ঘাঁটতেই দেখলাম গত রোজায় ব্লগর ব্লগর -৬ লিখেছিলাম। এক বছর বাদে আজ আবার ব্লগর ব্লগর -৭ লিখতে বসলাম।
ইদানিং বড্ড অনিয়মিত হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে যখন ব্লগে ঢুকি – চোখ বুলাই অনেকের লেখাতে। পড়লেও কখনো কখনো মন্তব্য লেখা হয়ে ওঠে না। সেদিন সাইফের হাঁটুলের ক্রিয়েটিভ টী স্টলের স্বপ্ন দেখে নড়ে চড়ে বসেছিলাম। ভাবছিলাম – সমসাময়িক ক্রিয়েটিভ আর ডিজিটাল ভাবনার ভীড়ে হোঁচট খাচ্ছি প্রায়ঃশই।
কোথায় যেন পড়েছিলাম – “History is always Right but it is often written wrongly.”
তাই যেন কেন মনে হয় ইতিহাস সাক্ষ্য দিতে এসে বড় বিব্রত হয়ে যাবে এদেশে। থাক এসব কথা।
আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। সাধারন জ্ঞানের উপর বিস্তর পড়াশোনাও করি না। খেয়াল খুশী মত লেখা – কবিতা – বা উপন্যাস পড়ি। তাও অনেক ক্ষেত্রে অন্যের অনুরোধে। তাই কোন বিশ্লেষনধর্মী লেখার সীমানা দিয়ে চুপিসারে হেঁটে আসি।

বয়ে যাওয়া জীবনই আমায় বেশী টানে – কখনো ভাবায় – হাসায় – কিংবা কাঁদায়।
জীবিকার ভারে ন্যুজ হয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে যাওয়ার নাম বেঁচে থাকা।
এ পথ চলায় ছন্দ থাকুক বা না থাকুক – সময় ঠিকই পেরিয়ে যায়।
সময়ের সাথে সয়ে যায় সব ব্যথা; ঠিক সয়ে যায় কিনা জানি না কিন্তু ব্যথায় মরিচা ধরে যায় হয়তো।
কিন্তু কখনো কখনো বেদনাটুকু জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে। বিষন্ন হয়ে যাই আমরা। থমকে যাই; ভাবনায় ডুব মেরে থাকি। সময়ের তাড়নায় তারপর আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। ঝাপিয়ে পড়ি জীবন যুদ্ধে।
খুব অগোছালো হয়ে যাচ্ছে লেখাটা।
আসলে এ জীবনটাও কেমন যেন সময় সময় আগোছালো হওয়ার নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে।
অনিশ্চিত জীবনটাকে কাছ থেকে দেখেছি মা যখন টানা পঁচ দিন আই সি ইউ তে ভর্তি ছিলেন। হাসাপাতালের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারত রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের মুখগুলি প্রায়ই ভেসে ওঠে। তাদের হাতে তজবী আর সুরা ইয়াসীনের বই – চেহারায় ক্লান্তি ছাপিয়ে প্রিয়জন হারাবার আশংকা ফুটে থাকত। প্রায় প্রতি রাতেই কেউ না কেউ হারিয়েছে তার আপনজন। মমতা – মিনতি আর ভালবাসাকে পিছে ফেলে নিয়তি চলে গেছে অন্য ভূবনে। আমার ডাক্তার বোন তার ঘর-সংসার ছেড়ে মোটামুটি একাই নিয়তির সাথে যুদ্ধ করে ফিরিয়ে এনেছে আমাদের মা’কে। সাথে ছিল আমার এক ডাক্তার বন্ধু আর তার চেষ্ঠায় সকল সিনিয়র ডাক্তার এবং নার্স/ স্টাফরা।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া। আর সংশ্লিষ্ট সবাইকেই অনেক ধন্যবাদ।
ডায়বেটিক আক্রান্ত আমার মা এখন অনেকটাই সুস্থ। নিয়ম মেনে চলাটাই এখন মূল পথ্য।
শেষে মা’কে ক’দিন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল।

আমি সেদিন মা’কে দেখতে যেয়ে শুনতে পেলাম – আমার এক বন্ধুর এক দিনের ছেলেটা সকালে মারা গেছে। যে পরিবারে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটির জন্য আনন্দের বন্যায় সকলের ভাসার কথা – সেখানে এখন কেবলই কান্না আর হাহাকার। আমি জানতে পেরে এগিয়ে গেলাম।
দৃশ্যটি ছিল এমন –
মর্গের সামনে খালি বারান্দায় এক সারি চেয়ার।
শেষ চেয়ারে নির্বাক বসে আছে আমার বন্ধুটি। কোলে তার ফুটফুটে ছেলেটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো।
তার চোখের জলে আর চেহারার অভিব্যক্তি বলে দেয় – পৃথিবীর সব চেয়ে ভারী জিনিসটি সে পরম যত্নে ধরে থমকে বসে আছে।
ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
সাথে থাকলাম – জানাজা থেকে দাফন পর্যন্ত।
মনে মনে দোওয়া করলাম আল্লাহ যেন এই কষ্ট আর কারুকেই না দেন।
আর আল্লাহ যেন আমার বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে এ শোক কাটিয়ে উঠবার তৌফিক দেন।

এরপর ফিরে আসলাম।
চুপ চাপ কাটলো সারাটা দিন।
রাত পেরিয়ে সুর্য উঠার সাথে সাথেই আবার ঝাপিয়ে পড়লো – জীবিকা।
বাথরুমে আয়নায় দাঁড়িয়ে শেভিং ফোম লাগিয়ে রেজর দিয়ে চেঁছে ছিলে নতুন করে নিই নিজের চেহারা।
আফটার শেভ লাগিয়ে চুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে নেমে যাই রাস্তায়।
তারপর শুরু হয় পথ চলা।
চারিদিকে যাই দেখি-
সবকিছুই চলছে।
লোক চলছে,
ট্রেন চলছে।
লাইট গুলো জ্বলছে।
গপ্পো চলছে,
গাড়ী চলছে।
দিন কেটে যাচ্ছে !


আছি কিন্তু…

আমি আছি-
বেঁচে আছি।
কাজে আছি।
ফাঁকে আছি।
মনে আছি।
মেনে আছি।
জেগে আছি।
ঘুমে আছি।
দিনে আছি।
রাতে আছি।
লোভে আছি।
ক্ষোভে আছি।
পাপে আছি।
পূণ্যে আছি !


অবিরাম অপেক্ষা !

যা জীবনে শেষ হয় না –
তাই ‘অপেক্ষা’।

এক জীবনে অপেক্ষাটুকুই বেশী।

ছোট বেলায় বড় হবার অপেক্ষা
বড় হয়ে পরীক্ষায় পাশের অপেক্ষা
পরীক্ষা পাশের পর চাকরীর অপেক্ষা
চাকরী পেলে বাড়ি-গাড়ির অপেক্ষা
বাড়ি হলে নারীর অপেক্ষা
নারী এলে পিতৃত্বের অপেক্ষা
পিতা হয়ে পিতামহ হওয়ার অপেক্ষা

শেষমেষ ও’পারের অপেক্ষা…।

এক জীবনে অপেক্ষা অনেক …
অনেক অপেক্ষা !

১,৩৩৪ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “অতঃপর ব্লগর ব্লগর – ৭”

  1. জুলহাস (৮৮-৯৪)
    রাত পেরিয়ে সুর্য উঠার সাথে সাথেই আবার ঝাপিয়ে পড়লো – জীবিকা।
    বাথরুমে আয়নায় দাঁড়িয়ে শেভিং ফোম লাগিয়ে রেজর দিয়ে চেঁছে ছিলে নতুন করে নিই নিজের চেহারা।
    আফটার শেভ লাগিয়ে চুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে নেমে যাই রাস্তায়।
    তারপর শুরু হয় পথ চলা।

    এই সব মনে হলে ভাল লাগে না !! 😕 😕 :(( :((

    চমৎকার লেখা দোস্ত... :clap: :clap: :hug:


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন
  2. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    ওবায়েদ ভাই, লেখা মুল্যায়ন করার মত দুঃসাহস দেখাতে যাব না কখনই, খুবি হৃদয়ছোয়া লেখা নিঃসন্দেহে। তবে সবারই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আপনার লেখা পড়ে। জীবনের জটিল দিক গুলো কষ্টের হলেও সত্য। আমরা সসেগুলো এড়িয়ে যেতে চাই সবসময়। আপনি এমনটি করেন নি। খুব ভালো লাগলো লেখা, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গী সবতেই।
    ভাইজান, মুল্যায়ন দেখি করেই ফেললাম 😕


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    জীবনটাতো আলো অন্ধকার মিশিয়েই। অন্ধকারটি এবার পাশ কাটিয়ে যাননি দেখেই হয়তো মন খারাপ হলেও ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেলো।

    লেখার স্টাইলটা অসাধারণ লাগলো ওবায়দুল্লাহ ভাই। কাব্যিক লেখাও যে আমপাঠককে টান দিয়ে বাধ্য করতে পারে যার যার নিজের জীবনের দিকে তাকাতে তার সুন্দর উদাহরণ হয়ে উঠলো পুরো লেখাটাই। আরো লিখুন, নিয়মিত লিখুন আর ভালো থাকুন।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমার মাও ডায়বেটিক পেশেন্ট ছিলেন, সিসিইউ তে ছিলেন অনেক দিন, ফেরেননি আর। তুমি অনেক ভাগ্যবান।

    ভাল থেকো ওবায়েদ।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।