ইদানীং কোন লেখকের লেখা পড়তে যতটানা আগ্রহ বোধ করি তার চাইতে কেন জানি বেশি আগ্রহ জাগে ঐ লেখকের নিজের সম্বন্ধে, সেই সাথে তার লেখা সমূহের পেছনের ইতিহাস সম্বন্ধে, যা বেশির ভাগ সময় আমাদের কাছে অজানাই থেকে যায়। কল্পজগতের নাটকের চাইতে লেখকের নিজের জীবন যে ভাবনা তা আমার কাছে অনেক অনেক বেশি নাটকীয় মনে হয়। সেই সব অজানা কাহিনী যতই একের পর এক পাপঁড়ি মেলে ধরে ততই বিস্মিত হই। সাধারন জনমানুষের ভিড়ের মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা একজন লেখক যে অসাধারন পর্যবেক্ষন শক্তি আর অনন্যসাধারন বিশ্লেষনী ক্ষমতা ধারন করেন তা এক কথায় ব্যাখ্যাতীত।
যাই হোক কোন এক একুশে বই মেলায় হাতে নিলাম মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “লেখকের লেখা ও বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা” বইটি। সে বইটিরই একটা প্রবন্ধ আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। অবশ্যই সংক্ষিপ্ত রূপ। যাতে করে আপনাদের ধৈর্য্যচূ্তি না ঘটে। তবে এর মাঝেও মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে তার ভাবনা চিন্তার কিছু আইডিয়া পাবেন সে আশা রাখি।
গল্প লেখার গল্প
লেখক হবার ইচ্ছে সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হইনি। স্কুল জীবনের শেষের দিকে ইচ্ছেটা অল্পে অল্পে নিজের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে হাত মেলেছিল বহু দূরের ভবিষ্যতে – সঙ্গে সঙ্গে লেখবার তাগিদ যোগায়নি। অধিকাংশ স্কুল কলেজে হাতে লেখা মাসিকপত্র থাকে। সারা বাংলায় ছড়ানো গোটা দশেক স্কুলে আর মফস্বল ও কলকাতায় গোটা তিনেক কলেজে আমি পড়েছি। লিখবো? এই বয়স আমার। বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখবো? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়। বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে।
১৩৩৫ সালেও – যে বছর আমি প্রথম লেখা লিখি, – আমার এ মনোভাব বদলায়নি। বরং আরও স্পষ্ট একটা পরিকল্পনা হয়ে দাড়িয়েছে। বয়সের সীমা ঠিক করেছি। তিরিশ বছর বয়সের আগে কারো লেখা উচিত না – আমি সেই বয়সে লিখবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে সব দিক দিয়ে। কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নয়। নিশ্চিন্ত মনে যাতে সাহিত্য চর্চা করতে পারি তার বাস্তব ব্যবস্হাগুলিও ঠিক করে ফেলবো।
হ্যাঁ তখন আমার বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক পড়েছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? তখনও বিশ্বাস করিনি, আজও বিশ্বাস করি না যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ আছে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্বন্ধ এযুগের অতি প্রয়োজনীয় যুগধর্ম।
স্বীকার করছি, ১৩৩৫ সালে এসব তত্ত্বকথা মানতাম না – অস্পষ্ট অনুভূতি ছিল মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রেমের সঙ্গেই দৃঢ়তর হতো লেখার সঙ্কল্প। কলেজ থেকে তখনকার বালিকা-বালীগন্জ্ঞের বাড়িতে ফিরতাম, আলোহীন পথহীন অসংস্কৃত জলার মতো লেকের ধারে গিয়ে বসতাম – চেনা অচেনা কোন একটি প্রিয়ার মুখ স্মরণ করে একটু চলতি কাব্যরস উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ভেসে আসতো নিজের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শীর মুখ, জীবনের অকারন জটিলতায় মুখের চামড়া যাদের কুচঁকে গিয়েছে। ভেসে আসতো স্টেশনে ও ট্রেনে ডেলি প্যাসেন্জ্ঞারদের মুখ – তাদের আলাপ আলোচনা, ভেসে আসতো কলেজে সহপাঠীদের মুখ – শিক্ষার খাঁচায় পোরা তারুণ্য-সিংহের সব শিশু, প্রাণশক্তির অপচয়ের আনন্দে যারা মশগুল। তারপর ভেসে আসতো খালের ধারে, নদীর ধারে, বনের ধারে বসানো গ্রাম – চাষী, মাঝি, জেলে, তাঁতিদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখ। লেকের জনহীন স্তব্ধতা ধ্বনিত হতো ঝিঁঝির ডাকে, শেয়াল ডেকে পৃথিবীকে স্তব্ধতর করে দিতো, তারারা চোখ ঠারতো আকাশের হাজার ট্যারা চোখের মতো, কোনদিন উঠতো চাঁদ। আর ওই মুখগুলি – মধ্যবিত্ত আর চাষাভূষো – ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও।
আমি কি জানি ভাষা দিতে?
চলবে……..
মানিক বন্দোপাধ্যায় আমার অসম্ভব প্রিয় একজন লেখক।লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।
আশা করি বাকি পর্ব গুলো তাড়াতাড়ি দিবেন।
স্বাগতম দোস্ত।
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কি খবর?
ব্লগে স্বাগতম ভাইয়া।
মানিক বন্দোপাধ্যায় আমার নিজেরও খুব প্রির লেখক। তার জীবন ঘনিষ্ঠতাই টানে বেশি। তার কিছু গল্প আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে মুগ্ধতাও ছড়িয়েছে। তবে গল্পের পিছনে যে গল্প তাও যে লেখা আছে জানতাম না।
সেটা জানার সুযোগ হলো। আপনাকে ধন্যবাদ।
আপডেট গুলো আরো বড় করা যায় কি? এমন চমৎকার জিনিস এতো অল্পতে শেষ হয়ে গেলে মন ভরে না ঠিকমতো।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ ব্লগিং ভাইয়া।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি প্লিজ ...
দারুণ বিষয়বস্তু। সাহিত্যে ফিকশন লেখকদের জীবনী নিয়ে খুব মাইক্রোস্কপিক আলোচনা হয়। কাল্পনিক আর বাস্তবিক জগত মেলাবার জন্য বোধহয়।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
দারুন!
তাত্তাড়ি পরের পর্ব। আর হাত-পা ঝেড়ে লিখতে থাকুন, রশীদ ভাই।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
রশীদ,
সিসিবি'তে স্বাগতম। কি যে ভালো লাগছে সিসিআর-১৬ এর বন্ধুদেরকে এখানে দেখে!
কিন্তু অন্যদের মতো আমি ৫-তারার বদলে ০-তারা দিলাম ফাঁকিবাজী ব্লগের জন্য। সামুতে কত কত ব্লগ পোষ্ট করে এখানে এই ব্লগ!? x-(
এক সপ্তাহের মধ্যে একটা দূর্দান্ত মৌলিক ব্লগ না পোষ্ট করলে "না...+সা... যুক্ত গণ" ইস্যু হবে কইয়া দিলাম x-(
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
আমি ইচ্ছে ছিল লেখা নিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একান্ত অনু্ভূতি অথবা মানসিকতা যাই বলি না কেন তা শেয়ার করা। সে জন্যই তার লেখাটি তুলে ধরা।
মানিক বন্দপাধ্যায়ের গল্প লেখার গল্পটা পড়ার পর যদি আমি আমার আমার অনু্ভূতির কথা লিখতাম তবে সেটা হয়তো মৌলিক হতো কিন্তু সেটা একান্তই আমার অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই হতো না।
দারুন!
পুরাই :duel:
বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখবো? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়। বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে - এর নাম বিনয়। তাঁর প্রখর বিনয়বোধ প্রশংসনীয়।
ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও - এই চীৎকার যারা শুনতে পারে, তারাই লেখক হয়।