একজন সুপারস্টার এর গল্প

২০০৪ সাল! ক্লাস সেভেন এ আমরা তখন। সবে মাত্র কলেজে ঢুকেছি তখন। পান থেকে চুন খসলেই তখন ভয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। একদিন কোন এক ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই কি একটা কাজে আমাকে ১১ নাম্বার রুমে পাঠান। আমাদের কলেজে কোন সিনিয়র এর রুমে ঢুকতে হলে দরজার পাশে দাড়িয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে পারমিশন নিতে হয়। ১১ নাম্বার রুমের জন্য স্পেশাল একটা পারমিশন ছিল। মে আই কাম ইন প্লিস এর জায়গায় আমাদের বলতে হতো,”বলে কাছা আমা সুখ” । এর অর্থ কি তা এখনো জানিনা।প্রচন্ড নার্ভাস আমি সেই পারমিশন নিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলি। রুম থেকে কে জানি আমাকে ভেতরে ঢুকতে বললো। সিটিং প্ল্যান অনুযায়ী ইমিডিয়েট রাফাত ভাই এর বেডের দিকে লুক ডাউন হয়ে যাচ্ছিলাম। এর মাঝেই রুম লিডার ভাই আমাকে ডাক দিলেন। “এই পোলা এদিকে আসো”.. আমি থতমত খেয়ে দৌড়ে রুমলিডার এর বেডের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। দাগ বরাবর পা এলাইন করে লুক আপ হয়ে বললাম,”কাইন্ডলি জি ভাই” । উনি বললেন ,”স্কট কে তোমার? পারমিশন ঠিক মতন শেখায় নাই?” আমি জবাবে আমতা আমতা করা শুরু করলাম। উনি বললেন ,” আমার নাম কি বলো? আমাকে চিনো?” ততক্ষণে আমি ঘামা শুরু করে দিয়েছি। আমতা আমতা করে বললাম,” কাইন্ডলি জি না ” উনি বললেন,” নেক্সট টাইম থেকে ঠিকমতন পারমিশন নেবা। আর তোমার স্কট কে গিয়ে জিজ্ঞেস করো আমার নাম কি। ” আমি কোনমতে ফলআউট হয়ে চলে আসলাম। পরে ফল ইনে গিয়ে স্কট ইসলাম ভাই কে জিজ্ঞেস করলাম যে ওই ভাই এর নাম কি… তখন ইসলাম ভাই বললেন ,” উনি ক্লাস নাইন এর রাহিম ভাই.. উনার সাথে কোন ধরণের ফাক আপ মারবা না.. তাহলে কিন্তু একেবারে খবর হয়ে যাবে”

রাহিম ভাই এর সাথে এটাই ছিল আমার প্রথম দেখা। ক্লাস সেভেন এ উনাকে আমি প্রচন্ড রকমের ভয় পেতাম। সবার মুখেই খালি শুনি যে রাহিম ভাই নাকি মারাত্মক সিনিয়র। এই ভয়ে ই আমি যতো টা পারতাম উনাকে এভয়েড করার চেষ্টা করতাম। ক্লাস সেভেন এর একটা ছেলের জন্য কলেজে আইডল খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হয়না। কয়েকটা স্পোর্টস কম্পিটিশন দেখলেই সবার জন্য কয়েকজন হিরো বের হয়ে যায়। রাহিম ভাই খুব তাড়াতাড়ি ই আমাদের চোখে সোহরাওয়ার্দী হাউজের হিরো হয়ে উঠলেন। যে গেমস হয় সেটা তেই রাহিম ভাই এর জয়জয়কার। ফুটবল , ক্রিকেট , হকি ! আর এথলেটিক্স এর কথা নাই বা বললাম। এথলেটিক্স মাঠ ছিল রাহিম ভাই এর হোমগ্রাউন্ড। উনার ইভেন্ট ছিল ১১০ মিটার হার্ডলস, ৪০০ মিটার হার্ডলস, হাইজাম্প , ১০০ মিটার রিলে র থার্ড ম্যান, ৪০০ মিটার রিলে। সবকিছুতেই উনার গোল্ড মেডেল চোখ বন্ধ করে ! ট্র্যাকের বাকে যে জায়গাটা কার্ভ ওই জায়গায় রাহিম ভাই অমানুষিক একটা দৌড় দিতেন। সেই এক দৌড়েই ১৫/২০ মিটার লিড ! এরপর লাস্ট ম্যান হেসে খেলে রেস শেষ করে দিতেন। ইন্টারমিডিয়েট গ্রুপে থেকেই উনারা ১০০ মিটার রিলে তে নতুন কলেজ রেকর্ড গড়ে বসলেন। বাকে এই বিখ্যাত দৌড়ের জন্য উনাকে সবাই ডাকতেন বাকের ভাই বলে। হাউজ টেন্টে সারাদিন উনার নামে চিয়ার্স চলে ! সে এক অদ্ভুত অবস্থা।
যাই হোক , ক্লাস এইটে উঠার পর রাহিম ভাই আর আমি এক ই টেবিলে পরলাম ডায়নিং হল এ। সিনিয়র হাই টেবিল এর সামনের টেবিলে। প্রতিদিন টেবিলে এসে উনি চামচ দিয়ে প্লেটে ড্রামস বাজাতে বাজাতে হাসতেন। পাশের টেবিল থেকে ফাহিম ভাই প্রায় বলতেন ,” রইস , তুমি শান্ত হও”। জবাবে উনি একটা মুচকি হাসি দিতেন। টেবিলে অনেক কেয়ার ফুল থাকতাম। সো, বেশ মজাতেই দিনগুলো কাটতে লাগলো। এর মাঝে ই সময় আসল আমাদের ফুড মিক্সিং এর পারমিশন চাওয়ার। সাধারনত ক্লাস টেন ক্লাস এইট কে এই পারমিশন দেয়.. ক্লাস এইট এর একজন ক্যাডেট ক্লাস টেন এর নেতা গোছের একজন এর কাছে গিয়ে পারমিশন চায়.. পারমিশন চাওয়ার এই লোকটা ছিলেন রাহিম ভাই.. আর পারমিশন আনতে যাওয়া সেই ক্লাস এইট টা ছিলাম আমি.. এই পারমিশন আদায় করার জন্য আমি লাঞ্চের পর, গেমস এর পর , প্রেপ এর পর রাহিম ভাই এর রুমে গিয়ে ধর্ণা দিতাম। এরমাঝে আমাদের তারিক একদিন বন আর কলা মিক্স করে খেতে গিয়ে ধরা খেল রাহিম ভাই এর কাছে। পারমিশন পিছিয়ে গেল। অবশেষে আরো ২ সপ্তাহ পর পারমিশন পেলাম উনার কাছে। সে যেন এক বিশাল জয় আমাদের ! এরপর নানা পারমিশন এর জন্য প্রায় ই উনার কাছে আমার যাওয়া লাগতো। এই যাওয়া আসা করতে করতেই টের পেলাম যে আসলে আমার সব ভয় কেটে গেছে। উনার সাথে চমত্কার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। রাহিম ভাই উনাদের ব্যাচ এর ফার্স্ট স্পেল এর জেপি ছিলেন। আমরা তখন নিউ টেন। অল্টারনেট সিনিয়র দের সাথে ততদিনে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। প্রায় ই আড্ডা হতো বিভিন্ন বিষয়ে। এর মাঝে ছিল আইসিসি এথলেটিক্স। রাহিম ভাই সেখানেও মাঠ কাপিয়ে আসলেন। ৪০০ মিটার হার্ডলস এ উনি আইসিসি রেকর্ড টাইমিং করে আসলেন। আইসিসি ফুটবলে রাহিম ভাই এর সাথে প্র্যাকটিস করেছি পুরো সময়। উনি খেলতেন রাইট উইং এ.. আমি প্র্যাকটিসে বেশ কয়েকবার উনার প্লে মেকার হিসেবে খেলে মজা পেয়ে গেলাম। উনাকে থ্রু পাস দিলে উনি প্রচন্ড স্পিডে দৌড়ে গিয়ে বল ধরে ফেলতেন। তারপর বল নিয়ে এখনকার গ্যারেথ বেল স্টাইলের এক দৌড় ! শেষ পর্যন্ত একটা ইনজুরির কারনে রাহিম ভাই আইসিসি ফুটবলে যেতে পারেননি। এ নিয়ে আমাদের টিমের সবার প্রচন্ড আফসোস ছিল।
ক্লাস ১২ এ রাহিম ভাই থাকতেন উপরের বক্স রুমে। ততদিনে আমাদের সম্পর্ক আরো অনেক ক্লোজ হয়ে গেছে। প্রায় লাইটস অফ এর পর উপরে দোতলায় গেলে সিড়ির কাছে অল্টারনেট দের সাথে আড্ডা হতো বিভিন্ন বিষয়ে। একদিন রাত ১ টার দিকে রাহিম ভাই আমাকে, তারিক কে আর জোবায়ের কে ডেকে পাঠালেন। আমরা গেলাম ও জিজ্ঞেস করলাম ভাই কি অবস্থা? তখন উনি বললেন,” টিভি রুম থেকে টিভি আমাদের বক্স রুমে আনতে হবে.. আমার কাছে একটা পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার আছে.. মুভি দেখবো। তোদের হেল্প লাগবে টানাটানিতে” সিনিয়র দের এই এডভেঞ্চারের পার্ট হতে পেরে তীব্র আনন্দে আমরা তিন জন নিচে টিভি রুম এর দিকে দৌড় দিলাম। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে টিভি রুম খুলে আমরা তিনজন আর রাহিম ভাই টিভি নিয়ে দোতলার দিকে রওনা দিলাম। সেই টিভি পরে সেট আপ করা হলো বক্স রুমে। এরপর মুভি পার্টি। অদ্ভুত কিছু সময় !

উইম্বলডনে শিরোপা জেতার পর মারিয়া শারাপোভা নামক এক লাস্যময়ী রুশ টেনিস প্লেয়ারের প্রেমে পরে গেলাম আমি ! পুরাই মাথা নষ্ট টাইপ অবস্থা। আমার একটা স্ক্র্যাপবুক ছিল.. যেটাতে শুধুই শারাপোভার ছবি লাগানো ছিল। পেপারে শারাপোভার কোন ছবি আসলে বেশিক্ষণ ওটা আর থাকতো না.. খুব শীঘ্রই আমার কালেকশনে চলে আসতো। যাই হোক এর মাঝে খবর পেলাম যে রাহিম ভাইও মারিয়া শারাপোভার খুব ভক্ত । প্রতিদিন পেপারে শারাপোভার ছবি আসলে উনি ও অগুলো কালেক্ট করেন। কিন্তু ইদানিং উনার আগেই কে যেন ছবি গুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে। এ নিয়ে উনি কিঞ্চিত ক্ষিপ্ত ও হতাশ। যাই হোক, একদিন লাঞ্চের পর উনাকে গিয়ে বললাম যে আমি ই সেই বান্দা যে শারাপোভার ছবি গাপ করে দিচ্ছে। শুনে উনি হেসেই পারলে চেয়ার থেকে পরে যান.. উনি ধারণা করেছিলেন অন্য কাউকে। আমার নাম উনার মাথাতেই আসে নাই..উনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন,” নিউ এজ এর ছবিটা আমি নিমু, আর ডেইলি ষ্টার এর টা তুই নেইস। এবার খুশি?” ব্যাপক কেলানি একটা হাসি দিয়ে আমি নাচতে নাচতে রুম থেকে চলে আসলাম। সেই ডায়েরিতে আমি পরে প্রায় ২৫০ এর মতন ছবি কালেক্ট করি.. সেই ডায়েরি ছিল প্রেপ টাইমে আমার ডিমোরালাইজ ক্লাসমেট দের বিনোদনের উত্স। একজন এর হাত থেকে আরেকজনের হাতে ঘুরতো। সবাই একনামে চিনতো ঐটাকে ,”নাফিসের শারাপোভা ডায়েরি”। রাহিম ভাই এর সাথে শেষ দেখা হয় ২০০৮ সালের প্রথম টার্ম এন্ড লিভ শুরুর দিন। আমরা এসএসসি ক্যান্ডিডেট তখন। তাই কলেজেই থেকে যাচ্ছি। আর সবাই চলে যাচ্ছে। স্পেশালি অল্টারনেট দের সাথে এটাই শেষ দেখা। ব্রেকফাস্ট এর পর ডায়নিং টেবিলের সামনে এসে অল্টারনেট দের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় আমি পুরো পুরি ভ্যাভ্যা করে কেদে দেই। ৪ টা বছর একসাথে থাকার পর বিদায় জানানো খুব কঠিন ব্যাপার। তার উপর উনাদের সাথে আমাদের ছিল খুব ই ভালো সম্পর্ক।রাহিম ভাই যখন সামনে আসেন তখন আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে ফুপাতে ফুপাতে কাদতে থাকি। উনি বলেন,” আরে ব্যাটা ! তুই পিচ্চি মানুষ নাকি ? আবার দেখা তো হবে, এত কান্নাকাটির মানে টা কি? ” আমি কোন জবাব না দিয়ে কাদতে থাকি। এই শেষ দেখা ! আর দেখা হয়নি , কোনদিন হবেও না ! কলেজ থেকে বের হয়েই আমি চলে আসি সামরিক প্রশিক্ষণে। এরপর আরো ট্রেইনিং এর জন্য দেশছাড়া হলাম। শুধু শুনেছিলাম যে রাহিম ভাই আহসানউল্লাহ তে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছেন। ইউএস এ আসার পর ই আমি ফেসবুকে বসে একটু সোশালাইজ করার সুযোগ পাই.. পুরোনো অনেক ফ্রেন্ড আর সিনিয়র দের এড করি। একদিন রাহিম ভাইকেও খুঁজে পেয়ে এড করি। এরপর একদিন চ্যাটে প্রায় অনেকক্ষণ কথা হয়। এরপর মাঝে মাঝেই ফেসবুকে কথা হতো উনার সাথে। উনার ফুটবল খেলার ছবি গুলো আর লম্বা চুল দেখে ব্যাপক হিংসা লাগতো। একদিন বলেছিলাম ,”ভাই দেশে আসলে আপনাদের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড টুর্নামেন্ট খেলমু একদিন” । উনি অনেক গুলো স্মাইলি পাঠিয়ে বললেন,” আরে আয় ব্যাটা ! আইসা খালি একটা কল দিস.. আমি মাঠ আর খেলার ব্যবস্থা করে দিব”

এই জুলাই এ দেশে যাচ্ছি। চাইলেই আর উনাকে এখন ফোন দেওয়া সম্ভব না। চলে গেছেন না ফেরার এক দেশে। ফুটবল খেলার ইচ্ছেটা ও মরে গেছে আমার। কলেজে শুধু একটা কম্পিটিশনে উনি কখনো অংশগ্রহণ করেননি  । সুইমিং কম্পিটিশন। কে জানতো যে নিয়তি একদিন কোন এক অসীম জলাশয় এর বুকে উনাকে গ্রাস করে নিবে। কয়েকদিন আগে যখন আমি প্রথম এ খবরটা শুনি তখন প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। খালি মনে হচ্ছিল এইটা কিভাবে সম্ভব? হয়তো আছেন আসে পাশে কোথাও লুকিয়ে ,সময় হলে নিশ্চয় বেড়িয়ে আসবেন। এরপর গতকাল কে গেলাম আমার এভিয়েশন ট্রেইনিং এ। ট্রেইনিং শুরুর আগেই শুনলাম যে উনার লাশ পাওয়া গেছে। এরপর থেকে ই আমি পুরোপুরি অনুভূতি শুন্য। মাথায় কোন কথা ঢুকছিল না। হাই প্রেসার চেম্বার রুমে ঢোকানো হয় আমাকে। অক্সিজেন মাস্ক পরে আমি শূন্য দৃষ্টিতে সোজা তাকিয়ে উনার চেহারা কল্পনা করছিলাম। ইন্সট্রাকটর কি একটা বাটনে চাপ দিতে বললেন , আমরা এখন ১০০০০ ফুট উপরের বায়ুচাপে আছি। কিন্তু কোন কথাই আর আমার কান দিয়ে ঢুকছেনা। এক অনেক অবর্ণনীয় বাজে অনুভূতি। এরপর ছিল সুইমিং পুল ফেজ.. একটা ফ্লাইট স্যুট, বুট আর হেলমেট পরে পানিতে ভেসে থাকতে অনেকক্ষণ। ভেসে আছি আর সোজা পানির নিচে তাকিয়ে ভাবছি যে রাহিম ভাই কি ভেসে থাকতে পেরেছিলেন ? কতক্ষণ উনি ভেসে ছিলেন? অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করতে থাকে আমাকে। এ অনুভূতি থাকবে অনেকদিন ধরে.. ফিরে আসবে বারবার নানা ঢং এ , নানা ভাবে ! কাউকে রাইট উইং দিয়ে বল নিয়ে দৌড়াতে দেখলে রাহিম ভাই এর কথা মনে পরবে। এথলেটিক্স ট্র্যাকে কাউকে দৌড়াতে দেখলে রাহিম ভাই এর কথা মনে পরবে। মারিয়া শারাপোভা কে খেলতে দেখলে আমার রাহিম ভাই এর কথা মনে পরবে। কাউকে মৃদু স্বরে হাসতে দেখলে রাহিম ভাই এর কথা মনে পরবে। যেকোন সুপারস্টার কে দেখলে আমার সত্যিকারের সুপারস্টার রাহিম ভাই এর কথা মনে পরবে।

প্লে লাইক রাহিম, রান লাইক রাহিম, লিভ লাইক রাহিম !

৬,১৮৭ বার দেখা হয়েছে

৪৫ টি মন্তব্য : “একজন সুপারস্টার এর গল্প”

  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    আমরা যখন ইন্টারে ছিলাম তখন একটা কবিতা পাঠ্য ছিলো- টু ড্যাফোডিলস। যেটাকে মানে করলে দাঁড়ায় দুনিয়ার সব সুন্দর জিনিস ড্যাফোডিলসের মতই ক্ষণস্থায়ী। সেদিন ঢাকার রাস্তায় রিক্সা নিয়ে যাচ্ছিলাম। ড্যাফোডিলস ভার্সিটির সামনে এসে টের পাই সেখানকার এক ছাত্র বাস্তবিক অর্থেই ড্যাফোডিলস হয়ে গেছে। কষ্টের অনুভূতি ইদানিং ভোঁতা আমাদের কাছে। তাই কাছের লোক কেউ না হলে হয়তো অনুভূতিতে নাড়া দেয় না। ঠিক পরের দিন শুনি সেন্টমার্টিনে কিছু ছেলে মারা গেছে। শুনে অনুভূতি আদ্র্র হয় কিন্তু প্রগাঢ় হয় না। আমরা ইদানিং মানুষের মৃত্যুতে কষ্ট পাওয়াতেও হয় তো পারসিয়াল হয়ে গেছি।

    বলছিলাম ড্যাফোডিলসের কথা। অনুভূতি যত ভোতাই হোক কানের সামনে বাজে কবিতার সেই লাইন " ফেয়ার ড্যাফওডিলস উই ইউপ টু সি ইউ "। খোমাখাতার ব্যবহার সংকুচিত হওয়ায় সে ও আমার নিউজ ফিডে বেশি তথ্যকেই আড়াল করে। আমার স্তীর বড় ভাই (আমার ইমিডিয়েট জুনিয়র মির্জাপুর) আমাকে জানায় যে সেখানে একজন মির্জাপুরএর এক্স ক্যাডেট আছে। স্বগোত্রীয় অনুভূতির কারণেই হয়তো ড্যাফোডিলসের জন্য কান্না আমার জোরালো হয়।

    রাহিমকে আমি চিনি না। তবে দেখেছি তো অবশ্যই। আমার হাউসের ক্যাডেট। আমরা যখন কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে যাব প্রায় সেই সময়ে ওরা এসেছিলো। এত অলপ সময়ে ঐ ব্যাচের কোন কিছুই আমরা জানি না। তবে খোমাখাতায় দেখি, লাল গেঞ্জি পরে ঝড় তোলা ছেলেটার গল্প। হার না মানা এ্যাথলেটের গল্প, নিজের অজান্তেই হয়তো সংযোগ খুঁজে পাই। রাহিমরা থাকে সব ব্যাচে সব কলেজেই।

    ৪০০ হার্ডেল নামটা দেখে আরও কিছু কথা শেয়ার করার দরকার মনে করলাম। সময়টা ২০০০ সাল। আমরা তেন। এ্যাথলেটিকস হচ্ছে। ৪০০ হার্ডেল দৌড়াবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এটা আগে বলে রাখা দরকার এ্যাথলেট হিসাবে আমি হলাম কোটা পূরণ টাইপ লোক, লাল ফিতা ছোঁবার লোক না। টিপসের জন্য গেলাম বড় ভাইদের কাছে। ফজলুল হক হাউসের বিশাল দেহী একজন ট্র্যাকে ভুমিকম্প তুলে হার্ডেল দেয়। তার কাছে শিখতে গেলাম। তার সরল জবাব, শিখার কিছু নাই, ৪০০ দৌড়াতে পারস, তো ১০ টা জায়গায় লাফ দিবি। সেই বিশাল দেহী জাহিদ ভাইয়ের সাথে ছয় বছরে আর কখনো কথা হয় নি। অন্য হাউসের সিনিয়রদের সাথে কথা হওয়ার সুযোগ ও কম থাকে, আর আমার মত লোক হলে তো কথাই নাই। অথচ একদিন জানতে পারি যখন এই দেশ থেকে অনেক দূরের এক শহরের রাস্তায় সময়ের খানিক হেরফেরে চলে গেছেন নিজের দেহের মতই বিশাল মনের মানুষ জাহিদ রেজা ভাই।

    হার্ডেলের কথাই আবার বলব আরেকজনের ক্ষেত্রে। তার নাম রেজা। আমরা যখন টুয়েলভে ওরা তখন নাইনে। কিন্তু অমানুষিক স্ট্যামিনার জন্য ছেলেপেলে ওকে পশু রেজা বলতো। ও দৌঁড়াতে পারত। সেই রেজা ৪০০ হার্ডেলে অংশ নিবে। সেই সময় ৪০০ হার্ডেলেড় ইভেন্টে আমি অল্প বিস্তর যাই বলেই ওদের হাউসের এক ক্লাসমেট আমাকে অনুরোধ করে ওকে সাহায্য করতে। আমি বলবার মত তেমন সাহায্য করি নি। কিন্তু দৌড়ে সেই ছেলে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমবারে গিয়েই দ্বিতীয় হলো। তারপরে কোন এক অবসর মুহূর্তে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যায় হেল্প করবার জন্য। ব্যাপারটা স্বাভাবিকই ছিলো হয়তো। তবে অবাক হই, পরের বছর (আমরা বেরিয়ে যাবার পরে) এথলেটিকসের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়েছিলো আমার। সেই ভিড়ের মাঝেও রেজা আমাকে খুঁজে বের করে আগেরবারের ৪০০ হার্ডেলের কথা মনে করিয়ে আমাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে যায়। আমি অবাক হই ছেলেটাকে দেখে। সেই ঘটনার ছয়মাস পরে রেজার গল্প জানা হয় অন্য ভাবে। এসএসসি ভ্যাকেশনে যাওয়ার পরে সে ফিরে আসেনি আর। পানিতে ডুবে হারিয়ে গেছে বিনয়ী চমৎকার ছেলেটা।

    গল্পে গল্পে অনেকের কথাই বলে ফেললাম। আমরা যখন সেভেনে ছিলাম কমন রুমের সামেন কবীর স্মরনিকা নামে একটা লেখা ছিলো। যেখানে আমাদের কলেজের একখারিয়ে যাওয়া ক্যাডেটএর গল্প ছিলো। সেই রুমের পাশের রুমে ক্লাশ টুয়েলভে আমাদের ব্যাচমেট যে ছিলো সেও হারিয়ে যাওয়ার গল্পে পরিণত হয় ছিনতাই কারীদের গুলিতে।

    কাছের লোক হলে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির প্রতি অনুভূতি প্রগাঢ় হয়। আমাদের কলেজের হারিয়ে যাওয়া জাহিদ রেজা ভাই(৯৪-০০) , কিংবা জুনিয়র রেজা (৯৯-০৫), কিংবা আমার বন্ধু আলম (৯৬-০২) এর সাথে রাহিমের নামটিও যোগ করে নিলাম যদিও সময়ের আমাদের সময়ে ওরা মাত্র এক মাস ই ছিলো।

    খোমাখাতায় রাহিমের প্রোফাইল দেখলাম। সেই সাথে দেখলাম ওর সাথে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদেরও। হারিয়ে যাওয়া প্রাণ যাদের প্রাণের স্পর্শ এই সেদিনও ছিলো। সব কিছু দেখে আদ্র হই। আর মাথার কাছে কেবল বাজে

    "Fair Daffodils, we weep to see
    You haste away so soon;"

    জবাব দিন
  2. রাফী (০৪-০৮)

    ধন্যবাদ দোস্ত লেখাটার জন্য। আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে পুরা ব্যাপারটা: যদিও আজকে এক গ্রুপ মেইলে ওনার মরদেহ দেখলাম। এখন আরো ভাল যায়গায় আছেন রাহিম ভাই, এই প্রার্থনা রইলো।

    জবাব দিন
  3. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    দোস্ত, তোর লেখা পড়ে রাহিম ভাই কে না দেখেও দেখা হয়ে গেল। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন এই প্রার্থনা থাকবে। 🙁 🙁


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন
  4. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    কখনো দেখিনি , চিনি না
    এমন কোন ছেলের জন্য চোখে পানি আসা শুধু হয়ত এক্স ক্যাডেটদের জন্যই সম্ভব
    ফেইসবুক হোমপেইজে ছবিটা দেখলে বিশেষ করে হাসিমাখা মুখটা দেখলে আমি আসলেই মেনে নিতে পারিনা যে এই ছেলেটা বেচে নেই
    আল্লাহ ইনশাল্লাহ তোকে জান্নাতবাসী করবেন ভাই
    যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস
    এতোগুলো ক্যাডেটের চোখের পানি আর দোয়া বিফলে যাবে না


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  5. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    আমি এই লেখাটা পড়বো না। আমার পক্ষে সম্ভব না। জাহিদ রেজা ভাই, আলম ভাই, তাওহীদ, রেজা, রাহিম--ভাল থাকুক সবাই। যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  6. খুব খারাপ লাগল।

    কক্সবাজারে মিনহাজ ইয়াসির নামে একজন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার পরে তার বাবা Yasir Life Guard নামে প্রাইভেট লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠা করে যারা গত ১৭ বছরে ১০০০ এর বেশি মানুষকে ডুবে যাওয়া থেকে বাচিয়েছে। এখানে লিন্ক:

    http://www.dhakatribune.com/safety/2013/aug/22/tourists-cox%E2%80%99s-bazar-sea-beach-need-better-safety-measures

    আমার মনে হয় লাইফগার্ড না হোক, proper ও prominent সাইন দিয়ে সেন্টমার্টিন্সের বিপদজনক বীচ, কারেন্ট, নিয়মাবলী ইত্যাদি সতর্কবানী না লিখে দিলে এ রকম দুর্ঘটনা আবারও ঘটবে। সরকার এরকম কিছু করবে এটা আশা করা বাতুলতা ও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভরা। আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি থেকে সবার মেমোরিতে বা রাহিম এর মেমোরিতে ওর ক্লাসমেট বা সিসিবি এরকম কোনো তথ্যমুলক সাইনবোর্ড সেন্টমার্টিন্সে দিলে অনেক উপকার হবে।

    ব্লগে অনেক সতর্কবানী আমি গত কয়েকদিনে পড়েছি। কিন্তু যারা ওখানে বেড়াতে যাবে, তাদের জন্যে সবচেয়ে কাজের হবে বীচেই সেই তথ্য থাকা - বীচের কোন অংশে রিপ কারেন্ট, খাদ এসব জানা না থাকলে এ ধরনের দূর্ঘটনা ও মন খারাপ করা ঘটনা প্রতি বছরই ঘটবে। এটা কিন্তু খুব সহজেই প্রিভেন্ট করা যায় প্রাইভেট উদ্যোগে।

    জবাব দিন
  7. রাহিম কে কখনো দেখিনি,তবে নাফিসের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে রাহিম আমার-ই কলেজের ছোট ভাই । আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক । তবে আমাদের প্রচারনামূলক কাজ করতে হবে ,সেন্টমার্টিন এ রিপ কারেন্ট সহ আরো অন্যান্য বিষয়গুলো যা যে কারো জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে, সেগুলোর ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে, যেন রাহিমের মতো আর কাউকে এভাবে চলে যেতে হয় ।
    গালিব- সিকক ( ১৯৯২-৯৮)

    জবাব দিন
  8. আহসানুল্লায় স্বল্প সময়ের শিক্ষকতা জীবনের ছাত্র হিসেবে পরিচয় হয়েছিলো রহিমের সাথে। ওদের ব্যাচে একমাত্র ওকেই প্রথম দেখার পর থেকে তুই করে ডাকতাম। দেখা হলেই ভুবন ভোলানো হাসি, আর খোঁজখবর আদান প্রদান হতো। ঘটনাটা শোনার পর থেকে মুষড়ে পড়ে আছি।

    জবাব দিন
  9. জুনাইদ ( ৮৩-৮৯)

    দেখিনি কোন দিন। জানিনা দেখা হোতো কিনা। তোমার মাধ্যমে দেখলাম। বুঝলাম সবকিছুতেই বড় বেশি তাড়াহুড়া তার। সে যে সুপারস্টার, সবাইকে পেছনে ফেলে ছুটে চলা যার রক্তে তাকে থামাবে কে!


    লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়!

    জবাব দিন
  10. মাহমুদ (৯৫-০১)

    নাফিস, খুব সুন্দর লেখা। সুন্দর লেখাও যে মন খারাপ করে দিতে পারে এটা তার একটা উদাহারণ। তোমার লেখাটা পড়ে আমার জাহিদ রেজা ভাই এর কথা মনে পড়ে গেল। তোমার রাহিম ভাইয়ের মত উনিও আমার কাছে একজন সুপারস্টারই ছিলেন। সব সুপারস্টারই কি 'ড্যাফোডিল' নাকি কে জানে?

    রাহিমের মত জাহিদ রেজা ভাইও ছিলেন খেলোয়াড় টাইপের। ইমিডিয়েট সিনিয়র হওয়ায় ফজলুল হক হাউজে ওনাকে পাচঁ বছর কাছ থেকে দেখেছি। কলেজ থেকে বিদায়ের সময় আমরাও অনেক কেদেঁছিলাম। জাহিদ রেজা ভাই অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন। বাবা মায়ের এই একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।

    সেদিন ওনার বাবা (অবসরপ্রাপ্ত বিগেঃ জেনাঃ আবেদ রেজা) এসেছিলেন আমার অফিসে প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরে নিজের ফার্মের তালিকাভুক্তির জন্যে। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ 'বাবা, তোমার নাম কি? তুমি কি আমাকে চেনো? আমি বললাম, ' স্যার, (যেহেতু আমার ডিজি সামনে ছিলেন তাই আঙ্কেল বলতে পারিনি) আমি জাহিদ রেজা ভাইয়ের সাথে একই রুমে অনেক দিন ছিলাম।'' একথা শোনার পরে তিনি বেশ কষ্ট পেলেন বোঝা গেল এবং আমিও বুঝতে পারলাম একমাত্র ছেলের কথা মনে করিয়ে দেয়া মোটেই ঠিক হয়নি। যাইহোক আঙ্কেলের কাজটি দ্রুততার সাথে করে দিলাম। তবে ঐ দিন বাসায় এসে আমিও যেন সবকিছুতেই জাহিদ রেজা ভাইকে খুজেঁ পাচ্ছিলাম।

    যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক আমাদের রাহিম, জাহিদ রেজা ভাইয়েরা...

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।